মুহম্মদ মতিউল্লাহ্
১৯ জুলাই ২০১২ বৃষ্টি আর মেঘ ভরা সেই দুপুরবেলা। এক দৈনিকের সাংবাদিক বন্ধু ফোনে জানালেন দুঃসংবাদটা। আমাকে ফোন করে তিনিও নিশ্চিত হতে চাইছেন, খবরটা সত্যি তো! কবিরুল ইসলাম আর আমাদের মধ্যে নেই। এ সংবাদ খুব যে অপ্রত্যাশিত ছিল আমার কাছে, তা তো নয়। তবু মন প্রস্তুত ছিল না। পঁচিশ-তিরিশ বছর ধরে সেই কিশোর বয়স থেকে কবিরুল ইসলামের কবিতার জগৎ আমি চিনি। খানিকটা হলেও চিনি ব্যক্তি মানুষটিকে। কখনো অতি বাক সংযমী, কখনো প্রগলভতায় ভরা আবেগী একটি মানুষ। দু-তিন দশক জুড়ে তাঁর স্নেহ সাহচর্য আমি পেয়ে এসেছি। মধ্য দুপুরে কাজকর্মের মাঝেই শুধু নয়, গভীর রাত্রে কিংবা শেষ ভোরেও হঠাৎ হঠাৎ তাঁর চকিত ফোন আমাকে উদ্বেলিত করেছে। আশংকিত করেছে কখনো হয়তোবা। বছর বছর বহুবার বলেছেন এই ভাদ্রে এবার আমার ৭২ বছর হবে। কখনো ৭৫ বছর।সে বছরও বলেছিলেন, ‘এই ভাদ্রে আমার ঊনআশি। কবে মারা যাব ঠিক নেই। এস একবার’।
২০১২, ২৪ অগাস্ট কবিরুল ইসলামের আশি বছর পূর্ণ হত। না, এমনতর ভরাট কণ্ঠস্বর সে বারে আর আসেনি। কবিরুল ইসলাম আমাদের কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেলেন। দু-দিন আগে প্রথমে বাথরুমে পড়ে যান। তারপরে আবার বই পাড়তে গিয়ে তিনি ঘরের মধ্যে। বুকের পেসমেকারটি হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোমায় আচ্ছন্ন হয়ে যান কবিরুল ইসলাম।
মানুষের জীবনযাপন এবং তার পরিণতি নিয়ে অনেক মৌন দার্শনিকতা তাঁর কবিতায় আছে। সেই আমাদের কিশোর বয়সে পড়েছিলাম মৃত্যু বিষয়ক তাঁর কবিতা। কিন্তু সেই বালক বয়সে সে কবিতা আমাদের আলোড়িত করেনি। কেননা সে কবিতার লেখককে তখন দেখি জীবনের উল্লাসে উন্মুখ, জীবনরসঋদ্ধ স্মার্ট এক নাগরিক মানুষ। তিনি লিখেছেন :
‘আমি এই ঘরের দুয়ার জানালা সব খুলে দিয়ে একদিন চলে যাবো
আমি এই ঘরের আড়াল ভেঙে সমারূঢ়
একদিন চলে যাবো
চৌদিকে দেয়াল —আমি চোখ কান বুজে
একদিন চলে যাবো
অখণ্ড আলয়ে
যেখানে আকাশে আলো হাওয়া বহে নিরন্তর
আমি একদিন এই ঘর ভেঙেচুরে ঠিক চলেযাবো।’
১৯৮২-৮৪ সাল, সদ্য আমি মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছি। কবিরুল ইসলামের একটি কবিতার বই আমার হাতে এল। নাম ‘বিকল্প বাতাস’। প্রকাশক করুণা প্রকাশনী। সেই গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত কাব্যশরীর, ভাষার পরিমিতিবোধ —সব যে তখন বুঝেছিলাম তা নয়। কিন্তু আমার পরবর্তী পড়াশোনার জীবনে, কবিতাচর্চার জীবনে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকে সেই কবিতার বই। এর পরেপরেই পড়ি ‘দেশ’ সাহিত্য সংখ্যায় (১৯৮০) কবিরুল ইসলামের আত্মকথনগদ্য ‘কুশল সংলাপ’। সেই গদ্যের শেষে তার ছোট্ট কবিতাটি আজও আমি মুখস্থ বলতে পারছি —
‘ভালোবাসা নিয়ে ঢের যুদ্ধ হয়ে গেছে
এই যুদ্ধ প্রাণের গানের —
ভালোবাসা নিয়ে আরও ঢের যুদ্ধ হবে
এই যুদ্ধ মানাভিমানের।
এই যুদ্ধে জয় নেই, পরাজয়ও নেই
চলো যাই উৎসে উজানের
ভালোবাসা নিয়ে আরও ঢের যুদ্ধ হবে
এই যুদ্ধ আবহমানের।’
তাঁর কবিতার সংযমী বাক্যবিন্যাস, অব্যর্থ শব্দ প্রয়োগ, তাঁর রোমান্টিক অভিমানী কবিহৃদয় তাঁর কবিতাকে আমাদের কাছে অনন্যসাধারণ করেছে। কবিতায় কখনো তিনি উচ্চকণ্ঠ নন। সাময়িক করতালি সমৃদ্ধ জনচিত্ততোষী উপাদানে তাঁর কবিতা কখনো দীর্ণ নয়। একই সঙ্গে কবিতার ঘরানা এবং তাঁর সাংস্কৃতিক জীবনযাপন আমাদের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল। আপাদমস্তক নগরমনস্ক শৌখিন স্মার্ট মানুষ ছিলেন তিনি। ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবেও ছিল যথেষ্ট খ্যাতি।
তাঁর আত্মপ্রকাশ পঞ্চাশের দশকে, তবু তিনি ষাটের কবি হিসেবেই চিহ্নিত। এর কারণ হয়তো তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কুশল সংলাপ’-এর প্রকাশ ষাটের শেষে ১৯৬৭ সালে। তা প্রকাশ পেয়েছিল ‘পূর্বাশা’ সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে। সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও ‘পূর্বাশা’-র যথেষ্ট প্রশ্রয় ও আনুকূল্য অর্জন করেছিলেন তিনি। এ গল্প বহুবার তাঁর মুখ থেকে শুনেছি। সঞ্জয় ভট্টাচার্য এক চিঠিতে তাঁকে লিখেছিলেন, ‘কবি হিসেবে যদি তুমি বিশিষ্টতা অর্জন করতে পারো সে গৌরব নবপৰ্য্যায় পূর্বাশার – আমি এই মনে করি।’
শুধু সঞ্জয় ভট্টাচার্য নয়, তিরিশের বিশিষ্ট কবিদের অনেকেরই নিবিড় সাহচর্য তিনি অর্জন করেছিলেন। একটি মূল্যবোধের চর্চার জায়গায় থেকে তিরিশের কবিদের উপদেশ নির্দেশ তিনি মান্য করতেন। তাঁকে পাঠানো বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে-র পত্রাবলি তাঁর কাছে ছিল অমূল্য সম্পদ। বুদ্ধদেব বসু তাঁর কবিতা পছন্দ করে নিজেই ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপতে দিয়েছিলেন। তিরিশের কবিদের এই উষ্ণ সান্নিধ্যের গল্প কবিরুল ইসলাম বহুবার আমাকে শুনিয়েছেন। তাঁকে লেখা বুদ্ধদেব বসুর চিঠিপত্রগুলি আমার সম্পাদিত ‘বুদ্ধদেব বসুর পত্রগুচ্ছ’ গ্রন্থে সংকলিত হয়। এ ব্যাপারে তাঁর অকুণ্ঠ সহযোগিতা আমি পেয়েছিলাম। সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘পূর্বাশা’-র পুরো সেট কবিরুল ইসলামের সংগ্রহে ছিল। তা থেকে অতিরিক্ত অনেক সংখ্যা তিনি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। আজ এ গদ্য লিখতে বসে আমার বইয়ের শেলফ, টেবিলের চারপাশে ভিড় করে আছে কবিরুল ইসলামের স্মৃতি। তাঁর চিঠিপত্র। তাঁর উপহার দেওয়া বইপত্র। মনে পড়ছে কবিরুল ইসলাম লিখেছিলেন —
‘যেহেতু যা কিছু বর্তমান
সমস্তই একদিন স্মৃতি হয়ে যায়,
তুমি আমি অনিবার্য নীল ঢেউ-এ ঢেউ-এ
স্মৃতির বাসরে চলে যাবো।
এবং স্মৃতিতে আমি বেঁচে থাকবো সম্রাটের মতো।’
কবিরুল ইসলামকে ৮০-র দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমি প্রথম দেখি। সেই বয়স থেকেই আমি তাঁর সেই স্বর্ণযুগের চিঠিপত্র পেয়ে এসেছি। আজ মনে হচ্ছে তাঁর লেখালেখির চূড়াস্পর্শী সময়ে তিনি তরুণ স্নেহাস্পদদের কাছে ছিলেন যথেষ্ট সংযমী, স্বল্পভাষী। ব্যক্তিগত চিঠিপত্রের ভাষাতেও ছিল সেই স্বল্পভাষিতা। কিন্তু তাঁর জীবনের শেষ দশ বছরে কবিরুল ইসলাম, আমার মনে হয়েছে, খানিকটা হতাশ। আমার শৈশবের চেনা মানুষটা কেমন বদলে গেছেন। দেখা হলেই প্রচুর কথা বলেন। অপ্রয়োজনেও কথা বলেন। কোথাও একটা অভিমান কিংবা ক্ষোভ এমনকি তরুণ কবিদের কাছেও। অনতিক্রম্য বার্ধক্যে অসুস্থতায় তাঁর লেখালেখির কোথাও শিথিলতা পড়েনি। সিউড়ি-কলকাতা যাতায়াত তাঁর কমেনি। কিন্তু কোথায় যেন একটা ছন্দপতন। সিউড়ির বাড়ি, বসার ঘর এককালে অতিরিক্ত আভিজাত্যে সাজানো গোছানো থাকত একসময়; শেষের দিকে যেন সব এলোমেলো। বইপত্রের বিপুল সংগ্রহ, ছবির সংগ্রহ — সবকিছু এক লহমায় কেমন ছেলেমানুষিকতায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন। রাত দু-টোর সময় হঠাৎ ফোন বেজে উঠলে আমি আর অবাক হতাম না। ‘কবিরুল ইসলাম বলছি – তুমি ঘুমোচ্ছো কেন? দু-টো আড়াইটায় কোনো কবি কখনো ঘুমোয় নাকি? তোমার সঙ্গে খুব দরকার। সকালবেলায় উঠেই তুমি সিউড়ি চলে এসো।’ বাইরে গাঢ় অন্ধকার দূরে ল্যাম্পপোস্টের স্বল্প আলো, আর বাড়ির ভেতরে জিরো বালবের অনুজ্জ্বলতা। আমি স্বপ্নাবিষ্টের মতো কবিরুল ইসলামের কথা শুনে চলি। হয়তো আমার প্রতি প্রচুর বকুনি। অথবা কোনো তরুণ কবির নামে কিংবা কোনো স্নেহভাজন কথারাখেনি। তার প্রতি হয়তো কোনো উষ্মা। পরক্ষণেই সব ভুলে গিয়ে সব কথা ফুরিয়ে গেলে, নির্দেশ দিলেন ‘এবার ঘুমিয়ে পড়। কাল সকালেই না এলেও চলবে।’ বুঝলাম কবিরুল ইসলামের ডিপ্রেশন হয়তো বেড়েছে। একবার তাঁকে নিয়ে ‘কবিসম্মেলন’-এ আমি একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখি। সে লেখা নিয়ে তাঁর আগ্রহের সীমা ছিল না। ‘কবিসম্মেলনের’ সে সংখ্যা সংগ্রহ করে আমিই পাঠিয়ে দিই তাঁকে। সে লেখা পড়ে তাঁর সরস মন্তব্য ‘তুমি তো আমাকে নোবেল পুরস্কারের চেয়েও বেশি কিছু দিয়ে দিয়েছ। কিন্তু লোকে বলবে নাতো সংখ্যালঘু কবিরুল ইসলামকে নিয়ে সংখ্যালঘু মতিউল্লাহ্ প্রবন্ধ লিখেছে?’ তাঁর অভিমানের পরোক্ষ প্রকাশ এভাবেই ঘটেছে নানা ভঙ্গিতে। টেলিফোনে নানা কথার মাঝে তিনি এ-নির্দেশ দেবেনই, ‘মাঝে মাঝে একটা পোস্টকার্ড লিখো, আর ফোন করো। কবিরুল ইসলাম তোমাদেরই সঙ্গে আছে।’
একটি পুরনো কাগজে তাঁর একটি কবিতার ভাষা প্রয়োগ নিয়ে তাঁর সঙ্গে একদিন কথা হচ্ছিল। তাঁর কবিতা কিংবা মৌখিক সংলাপ মানেই তো সরল বাংলা, কখনো বা তৎসম শব্দের নিপুণ ব্যবহার। কিন্তু আরবি ফারসি শব্দের প্রয়োগ কবিরুল ইসলামের কবিতায় মনে তো পড়ে না আমাদের। আমি টেলিফোনে শোনালাম কয়েকটি ছত্র :
‘আমি তো আনত আছি, অবনত আছি
সিজদায় যাবার মুখে নামাজী যেমন
আরও যে কদিন বাঁচি, বাঁচার সমগ্রে
আমি তো বিনত আছি, পদানত আছি।’
আমি শোনালাম কবিতাটি। আমার লক্ষ্য এর শব্দ প্রয়োগ নিয়ে। জানালেন তিনি তুমি গুরুত্ব দিয়ে যেটা ধরতে চেয়েছ ঠিকই বলছ। এ কবিতাটি একজন আস্তিকের ঘরে ফেরা — এ ভাবেই কবিতাটি দেখবে। জীবনরসিক কবির এও আরএক পরিচয়। ছেলেবেলায় তাঁর সুদর্শন রোমান্টিক চেহারায় আমরা মুগ্ধ ছিলাম। শেষ পর্যন্ত বয়স তাঁকে পর্যুদস্ত করে। জরা তাঁকে স্পর্শ করে। একাকিত্ব তাঁকে অবসন্ন করে। পৌঢ়ত্বের অবসন্নতা অনেক সময় তাঁকে অস্থির করেছে। আমরা অপরাধী, আমরা তাঁর পাশে থাকতে পারিনি। একদা কবিরুল ইসলাম লিখেছিলেন—
‘ফুরোলে পঁয়ত্রিশ
বয়স বাঘের মতো তেড়ে আসে
শুধু দূর্বাঘাসে আর
অসুখ সারে না।
মোড়ে মোড়ে ওড়ে শিস
ঠোঁটে ঠোঁটে হয়ে যায় রীলে
একটি মাত্র তিলে আর সাম্রাজ্য কাড়ে না।’
একটা করে ভাদ্র মাস এলেই গত এক দশক ধরে তিনি টেলিফোনে ডেকেছেন আর শুনিয়েছেন ‘কবে চলে যাবো জানি না।’ ২০১১-র গ্রীষ্মে তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজের উলটো দিকে তাঁর সেই বাড়ি। একা একা তিনি বাস করেন তিনতলা জোড়া সেই বাড়িতে। অসুস্থ স্ত্রীও তখন চিকিৎসার জন্য বাইরে। ফলত তিনি একা। (একবার চিঠিতে লিখেছিলেন ‘আমি আর আমার স্ত্রী দু-জনে একা একা থাকি’)। একজন রিকশা চালক রাত্রিবেলায় তাঁর বাড়িতে থাকেন । এটুকুই! সেদিন দেখা হতেই বললেন, চল, তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি, এখনো খাইনি আমি।’
চল মানে? বুঝতে আমার একটু সময় লাগল। অর্থাৎ বাইরে দোকানে খেতে যেতে হবে।’ অতঃপর ঘরে এসে বসলাম। এ ঘরে আমি বহুবার বসেছি। সবটুকুই আমার চেনা। কিন্তু কোথায় একটু অচেনাও ঠেকছে আজ। ছন্দপতন। দেয়ালে টাঙানো থাকতো সুধীন্দ্রনাথ দত্তের একটি বাঁধানো ফটোগ্রাফ। সেটি বিছানায় পড়ে আছে। বিছানা জুড়ে বই। বই আর বালিশ পাশাপাশি উঁচু হয়ে আছে; চেনা যায় না। বিছানার চাদরটা মনে হল, অনেকদিন ধোওয়া হয়নি। কবিরুল ইসলামের গায়ে যে পাঞ্জাবিটা চড়িয়েছেন, তিনি খুব সচেতন তার কলারে ময়লা লেগে আছে। এরই মধ্যে গত দু-এক বছরে প্রকাশিত তার অনেকগুলি বই ধীরে ধীরে লিখে আমাকে উপহার দিলেন। কথা বলতে বলতে তাঁর আয়ত চোখ, ধনুকের মতো বাঁকা ভ্রূ কুঁচকে এল। কিন্তু কোনো দুশ্চিন্তা তাঁকে ক্লিষ্ট করতে পারছে এমন নয়। বললেন, ‘চারদিন হল বাড়িতে জলের লাইন কাজ করছে না। আমি তো চারদিন স্নান করিনি। আমার অবশ্য অসুবিধা হয় না।’ আমি বললাম সে কি কথা। কোথায় জল পাওয়া যায়? আমি জল নিয়ে আসি, আপনি স্নান করুন।’ কবিরুল ইসলাম খুশি হয়ে আনন্দে নেচে উঠলেন যেন। দোতলার বারান্দা থেকে দেখতে পেলাম সামনেই রাস্তার ধারে একটা টিউবওয়েল। কিন্তু তাঁর সংকোচ আমি জল আনতে পারবো কিনা। উনি জানতেন ডায়াবেটিক সমস্যায় আমি শারীরিক দুর্বল থাকি। ‘নিশ্চয় পারব’ বলে আমি নিচে নেমে রাস্তার কল থেকে এক বালতি জল তুলে আনলাম। নিষ্পাপ একটি শিশুর মতো হাত নেড়ে নেড়ে তিনি আমাকে বোঝাতে লাগলেন এক বালতি জলে কিভাবে স্নান করতে হয়। বললেন, ‘স্নান করা আমি শিখে গেছি; এখন আর অসুবিধে হয় না। দুপুর একটা নাগাদ আমি তাঁর কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। দরজা পর্যন্ত তিনি বেরিয়ে এলেন। কথা বলতে বলতে লক্ষ করলাম তাঁর গলা ধরে এল অবরুদ্ধ কান্নায়, “তুমি তো পুত্রবৎ। মনে রেখো, এসো মাঝে মাঝে, এভাবেই। টেলিফোন করো, মাসে একটি করে পোস্টকার্ড লিখো।’ তাঁর ভরাট গম্ভীর গলার অবরুদ্ধ সেই কণ্ঠস্বর আমি আজও শুনতে পাচ্ছি। আমার ছেলেবেলা থেকে চেনা সেই ধোপদুরস্ত নাগরিক কবিরুল ইসলাম আমার সামনে তাঁর ব্যক্তিগত দুর্বলতা ঢাকতে পারছেননা। বাইরে সিউড়ি শহরের রুদ্র গ্রীষ্মকাল। একটি মাত্র নিঃসঙ্গ পাতা ভরা গাছ। রাস্তার ওপারে তার বিপর্যস্ত ছায়া পড়েছে। আমি রাস্তায় নেমে এলাম। আমার মনে পড়ল কবিরুল ইসলাম ষাটের দশকে, তাঁর যৌবনে লিখেছিলেন :
‘আমার নিজের বলে কিছু নেই
কখনও ছিল কি?
যেমন নিজের বাড়ি, শৌখিন আসবাবপত্র
বইয়ের আলমারি
প্রিয়জন বন্ধু কিংবা নারী
আমার নিজের বলে কিছু নেই
বলো, কার থাকে?’