spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদবই নিয়েঘরে ফেরা কবির নামাজ

লিখেছেন : তাজ ইসলাম

ঘরে ফেরা কবির নামাজ


তাজ ইসলাম

কবিতার উপযুক্ত ব্যাখ্যা হাজির করতে পারে স্বয়ং কবি। কিন্তু নিজের কবিতার তাফসির করা কবির কাজ না। কবির কাজ কবিতা হাজির করা। বিশ্লেষণ করবে মনোযোগী পাঠক, শিল্প বিশ্লেষক। সমালোচক চেষ্টা করবে কবিতার অলি-গলির কোথায় কী আছে তা চেনাতে,জানাতে। তার কলমের খোঁচায় উন্মোচন করবে কবিতার শব্দের ভেতরের অর্থ।
কবি যখন তার কবিতা শুরু করেন:

” কবিতার ভেতরে গিয়ে আজান দিতে চাই”(কবিতার ভেতরে)।

তখন উৎসুক পাঠক কান খাড়া রাখে। আগ্রহী হয়ে জানতে চায় তারপর! তারপর!
অর্থ্যাৎ কবি যে কবিতার ভেতর আজান দিতে চাইলেন তারপর আজান দিলেন কিনা! আজান দেয়ার পর কী হল? আজান দিতে চাওয়ায় চারপাশে কী প্রভাব পড়ল? বা অন্যদের প্রতিক্রিয়া কী? আজানের ইতিহাস অনেক কিছুই জানান দেয়। আজান দিতে চাওয়ায় আছে প্রতিরোধের ইতিহাস। আজান দেওয়ার পরের ইতিহাসও জানা পৃথিবীবাসীর। আজান শুরু হয়েছিল বৈরী পরিবেশে। প্রতিবাদ, প্রতিরোধকে সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করে। কবি যখন কবিতায় আজান দিতে চান তখন তাকে পাঠক চিহ্নিত করে কবিতার মুয়াজ্জিন হিসেবে।পাঠক চোখ রাখেন পরের পঙক্তিতে। কবি লেখেন :

” কিন্ত কোন মসজিদ পাই না বলে ফিরে আসি।”

কবিতার ভেতরে মসজিদ পাওয়া যায়নি। তার আগে মসজিদ পায়নি গৌরগোবিন্দের রাজ্যে বোরহান উদ্দীন।
মসজিদ হারিয়ে ফেলেছে ফিলিস্তিনিরা। সাহিত্যের রাজ্যেও মসজিদ বিরোধী কিংবা মসজিদ বিপক্ষদের প্রতাপ। এ প্রতাপে মসজিদ পক্ষের কেউ কেউ কোণঠাসা। কেউ আবার হীনমন্য। আজ থেকে শত বছর আগে মসজিদ পক্ষের লোকেরা শিল্প সাহিত্যের ময়দানে বাধ্য হয়ে আড়ালে রাখত পিতৃপ্রদত্ত নাম। গোপন রাখতে বাধ্য ছিল নিজের ইসলামী কিংবা মুসলিম নাম বা পরিচয়।
এখনও বহু মুসলমান বাংলাদেশি, আমি বাঙালি বলছি না স্পষ্ট করে–বাংলাদেশি বলছি। শিল্প করতে এসে মুসলমানের সন্তান নিজেকে তথাকথিত প্রগতির পরিচয়ে পরিচিত করতে নামকে অন্যভাবে জাহির করে। কে কি নাম রাখল এটা একান্তই তার নিজের বিষয়। তবে কার্যকলাপে প্রকাশ হয়ে পড়ে উদ্দেশ্য। এইসব আত্মপরিচয় বিস্মৃত, হীনমন্য একদল মানুষের ভিড়ে কবিতার ময়দানে কবি মসজিদ যখন খুঁজে পান না, তখন পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেন একজন সচেতন পাঠক। এই উপলব্ধি হাজির হয় কবির স্বীকারোক্তি :

” বারান্দায় গিয়ে আজান দিই ‘ আল্লাহু আকবর’ আল্লাহু আকবর।’

অসহায়ত্ব স্পষ্ট হয়, অক্ষমতা প্রকাশ পায়। তবু মননের নমনীয়তা নেই, নতজানু ভাব নেই। নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে দৃঢ় থাকেন কবি। জায়গা করে নেয়ার সংগ্রামে অনঢ় থাকেন কবি। এবং বারান্দাকেই তার স্থান হিসেবে গ্রহণ করেন। আর বলিষ্ঠতার সাথে ছড়িয়ে দেন নিজের আওয়াজ। আওয়াজে তিনি ধারণ করেন দেশজ আবহ। দেশজ আবহেই আল্লাহু আকবার কবিতায় হয়ে যায় আল্লাহু আকবর। শব্দটি বিশুদ্ধ আরবীতে আকবার হওয়ার কথা। তাহলে কী কবির প্রয়োগটি ভুল? ভাষার ব্যাকরণে ভুলই। কিন্ত আমরা দেশজ আবহে আকবর উচ্চারণই ঠিক মনে করি। বাংলাভাষী অধিকাংশজন আরবীর উচ্চারণে জবরকে অ করাটা অস্বাভাবিক কিছু না। বরং এটিই প্রচলিত। সেভাবে ভাবলে কবিতায় বলা যায় যথাযথ।

আর খুবই শঙ্কা আর আতংকের বিষয় হিসেবে ধার্য্য করা হয় যখন উল্লেখ করা হয় :

” দূরে দাঁড়িয়ে থাকে– বিদেশি পাইনগাছ”।

জাতি, ধর্ম, বিশ্বাসের দৃষ্টিকোণ থেকে সদা সতর্ক থাকতে হবে এইসব আগ্রাসী বিদেশি পাইনগাছদের বিষয়ে। তারা ভয়ংকর হয়ে হাজির হতে পারে যেকোন মুহূর্তে।

বাংলাদেশের প্রধান দুই কবি আল মাহমুদ আর শামসুর রাহমান। তারা দুজনে ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন। তাদের একটা ছবি সোশাল মিডিয়ায় প্রায়শঃই চোখে পড়ে। সেই ছবিতে কবি আল মাহমুদ দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করছেন, অপরপক্ষে কবি শামসুর রাহমান আপেল বা অন্য কিছু খাচ্ছেন। কথাটা মনে পড়ল। এই চিত্র সমগ্র বাংলাদেশের কবি সমাজের চিত্র। একপাশে নামাজি কবির দল। অপরপাশে নামাজ বিরোধী কবির দল। কেন মনে পড়ল? মনে পড়ল কবি আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ’ র কবিতা কালাম পাঠ করায়। কবি লিখলেন “… সেখানে নামাজ পড়া শুরু করে/ সাদা কাপড়ের মুসুল্লি সকল। আর দূরে কোথাও ভুভুজেলা বাজায়….. । ” কারা বাজায় তা কবিতায় উল্লেখ আছে, দেখে নিতে হবে।

এই কথা, এই নামাজ, নামাজের কবিতা লেখার আগে তার সমাদর কেমন ছিল, লেখার পর পরিণতি কেমন হল তা আমরা উপলব্ধি করতে পারি। সংক্ষেপে তখন ” চুমিতো শাহবাগ, সাকুরা রেস্তোরাঁ ” মাংস আর মদ দেখাইতো বলাকা সিনেমা”।

লেখার পর কবির স্বীকারোক্তি ” আমাকে কাটিলো বিষধর সাপে”।

কবি কী মনে করে কবিতা লিখেছেন, কোন চিন্তা ধারণ করেছেন পাঠক তা ভাবে না। তবে পাঠক হৃদয়ে নানা ভাবনার উদয় হয় একটি কবিতা পাঠের পর। কবি কী বুঝাতে চান, এই কবিতার মর্ম কী? সারমর্ম কী? চিন্তা, দর্শন, বক্তব্য কী?
কবিতা পাঠের পর এমনতর রঙিন ভাবনার ডানা মেলতে পারে পাঠকের মনের আকাশে। তার আকাশে তখন উড়াল দেয় পাখি। সুরে সুরে বলে যায়:

” পাখি একটা রেখেছি গান করে, শ্রাবণ কি এলো?/ শোনে ঝুম বৃষ্টির সেতার।/ সারাদিন ধরে ভেজা- রোদে জামা শুকানোর সংবাদ।/( মায়া)।”

আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ কবি। কবি কল্পনায় ভেসে বেড়ান। ঐতিহ্যকে তাই তিনি কল্পনা করেন হাওয়ার চেয়েও বড় হিসেবে। কবির পক্ষ থেকে নির্দেশ আসে হাওয়ার প্রতি ” ও হাওয়া আরো ক্ষিপ্র গতির বাহন হও,/ তুমি বায়জিদ বোস্তামীর/ আলখেল্লার মতো বড় হও। ( হাওয়া)। সাধারণের চোখে হাওয়া আলখেল্লা থেকে বড়ত্বের অধিকারী ।

কবি জানেন বায়জিদ বোস্তামী ওলি। ওলিদের সাথে কারামত সম্পৃক্ত। কারামতের আলখেল্লার কাছে হাওয়া তেমন কিছুই না। তাই কবি যখন বলেন : যাও বোস্তামীর আলখেল্লার মতো লম্বা হও।” আর আমার মায়ের কবরে যাও/তাকে ফাতিহা পৌঁছাও। ( হাওয়া)।

আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ কবি। কবি শব্দের যাদুকর। তার অঙ্গুলি নির্দেশে শব্দ নেচে ওঠে, ভাষা হেলেদুলে, ঢেউ তোলেন ভাষার তরঙ্গে। কবি তখন হয়ে যান ভাষার খলিফা। খলিফা মানেই প্রতিনিধি। তার প্রতিনিধিত্বে তৈরী হয় নতুন শব্দ, নতুন বাক্য। নতুনত্ব, নিজস্বতা। নিজস্বতা যে যত বেশি নিয়ে আসতে পারেন, তিনি পরিচিত হন তত বেশি দক্ষ হিসেবে ।

কবি ওবায়দুল্লাহ হাজির করেন আমাদের সামনে তার নিজস্বতার প্রমাণ। পাঠক পাঠ করে :

“ঘুমের কয়েদ, হাওয়ার মরশুম,পিঠ বেয়ে নেমে পড়ে সব পাহাড়ের ভার, তারার লণ্ঠন, কালো রাত্রির লোবান, আলোকিত মোরাকাবা, অন্ধ চোখের লেগুন(পৃষ্টা ৫৫)। এগিয়ে যায় কবিতার স্রোত। স্রোতে পাঠক অবগাহন করে।

“এইসব ভালোবাসা শেষ হলে জংশন পেরিয়ে/ আমরা হেঁটে যাই যুদ্ধ -ময়দানে।/দেখি রক্তাক্ত একটা বোন- ফুল পড়ে আছে/শিশুর শয্যায়। আমাদের স্বপ্নের ভেতর ঢুকে পড়ে/ শত্রুদের গ্রাম। আর দূরে সাদা একটা স্মৃতিফুল জেগে ওঠে কবরের পাশে।/তার নাম রেখে দিই– জননী।(নাম রেখে দিই– জননী)।”

এভাবেই কবি লেখেন নিজের কথা, করেন স্মৃতিচারণ, লেখেন দুঃখগাঁথা। কবি লিখতে লিখতেই বলে যান নিজের পরিচয়। পরিচিতি দিতে গিয়ে উল্লেখ করেন ” আমি বাঙালি মুসলমান কবি/আমার সামনে আছে শাহ মোহাম্মদ সগীর,/ সৈয়দ সুলতান,আলাওল,জসীমউদ্দিন, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল।”( আমি বাঙালি মুসলমান কবি পর্ব ২)। এই পরিচয় পরিপূর্ণ করেন তার বলিষ্ঠ উচ্চারণের মাধ্যমে। সে উচ্চারণে দ্ব্যার্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা দেন ” আমি বদর থেকে উহুদ, উহুদ থেকে খন্দক,/ খায়বার থেকে মক্কা বিজয় করে/ বাংলা কবিতায় উড়াই আল্লার নিশান।”

নিশান উড়িয়ে তিনি প্রশংসা করেন এক আল্লার। এক আল্লার প্রশংসা করতে বলেন, মহান আল্লার “সকাশে পেতেছি আমার মখমল জায়নামাজ।/ আমার নামাজ এক আল্লার প্রতি/ আমি বাংলা কবিতায় ঢেলে দিয়েছি/ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র লাল তাসবিহ দানা।”

কবি তার কবিতার বইয়ের নাম রেখেছেন ” কবির নামাজ”। নামের স্বার্থকতা স্পষ্ট হয়েছে শব্দে, বাক্যে, পঙক্তিতে পৃষ্ঠায়। এই বইয়ে তার চিন্তা, বিশ্বাস, বক্তব্য, ইতিহাস, পরিচিতি, ঐতিহ্যের স্পষ্ট বয়ানে নিজেকে অনন্য করে তুলেছেন। গন্তব্যও উল্লেখ করেছেন অকপটে।

মুসলমানের সন্তানেরা শিল্প চর্চা করতে এসে অনেকেই ভোগেন হীনমন্যতায়। আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ এক্ষেত্রে স্পষ্ট কবিপুরুষ। সাহসী কলম সৈনিক। কবিতা অঙ্গনে হীনমন্যদের অতিক্রম করে, শত্রুপক্ষকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কবি বীরবিক্রমে বলেন: “আমি কবি, আমি বাঙালি কবি। আমি বাঙালি মুসলমান কবি। ঈদ আমার আনন্দ। উহুদ,বদর,খায়বর আমার অহংকার। একাত্তর আমার অধিকার। নামাজ আমার মুক্তির পথ। আল্লাহ আমার গন্তব্য। কবিতায় তাই তথাকথিত নাস্তিক, ধর্মবিদ্বেষী, তার ভাষায় সেকুলারদের চক্ষু ঠাটানো পক্ষের সামনে হাজির হয়েছেন ইসলাম ও ইসলামী ভাবধারার কাব্যময় বক্তব্য নিয়ে। “ কবির নামাজ ” বই তার মুক্ত তলোয়ার। এ তলোয়ারে কেটেছেন প্রতিপক্ষের হিংসা আর অস্বীকারকে। বাংলা কবিতায় তার এই প্রয়াস একটি সাহসের নাম। একটি পথ প্রদর্শনের নাম।
এক সময় তিনিও ছিলেন সেকুলার পন্থায় সেকুলারদের সঙ্গী সাথী। তারপর বলেন,” যখন ফিরে আসলাম ঘরে”। ফিরে এসেই লিখলেন ” কবির নামাজ”! না তার আগেও তিনি লিখেছেন,
সিজদা ও অন্যান্য ইসরা” লিখেছেন, ” সমস্ত বিসমিল্লাহ“। এই ধারারই সাম্প্রতিক সংযোজন “কবির নামাজ”। বইটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হওয়া দরকার।আলোচনা হতে পারে প্রতিটি কবিতার। আমরা অন্য সময় আরও বিস্তৃত আলোচনায় যাব। হয়তো এই আলোচনাটিকেই করব আরও প্রশস্থ। আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ’ র আলোচ্য বইটি অমর একুশে বইমেলা ২০২৪ এ প্রকাশ করেছে ঘাসফুল। মূল্য নির্ধারিত ১৯৫ টাকা। কবি করছেন প্রবাস যাপন। পাওয়া যাবে ঘাসফুলে। পেতে পারেন রকমারি থেকেও। আমরা বইটির প্রচার প্রসারের পক্ষেই আছি।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ