গোরস্থান
হঠাৎ সকালে ঘুম থেকে উঠে রুদ্ধবাক হয়ে দেখি, সমস্ত পৃথিবী
হয়ে গেছে এক মহাগোরস্থান। একেকটা বাড়ি যেন একেকটা
জীবন্ত কবর; সে-কবরে ফিসফিস করে বলছে সবাই
দুঃসংবাদের কথা। মৃত্যু আর দুর্ভিক্ষের কথা ভেবে কেঁপে কেঁপে
উঠছে তারা ভয়ে। হায়, এই লোকগুলো কবে বেঁচেছিল?
এদের প্রেতাত্মা সেই কবে পৃথিবীর পথেঘাটে হাঁটতে দেখেছি আমি।
দেখে ‘ভূত! ভূত!’ বলে চীৎকার করে উঠতেই, হো হো করে
হেসে উঠেছিল জারজ সভ্যতা।
চারদিকে খা খা অন্ধকার। নিশ্ছিদ্র নিরব অন্ধকারের ভিতর
মৃত লোকগুলো জেগে উঠছে বারবার, তারা বেঁচে আছে কিনা,
তা দেখার জন্য। কেউ কেউ জানলায় মুখ রেখে বাইরে মারছে
উঁকি। বাঘের চোখের মতো জ¦লজ¦ল করছে তাদের চোখ। বুঝি
পড়েছে অতিষ্ঠ হয়ে তারা ইসরাফিলের প্রলয়শিঙার শেষ ফুঁ শোনার
জন্য। কত আর থাকা যায় ঘুমিয়ে কবরে! কত আর
জীবনের যন্ত্রণায় গলাকাটা মোরগের মতো লাফালাফি করা যায়
বিদঘুটে ভয়ের ভিতর!
হাঁটতে হাঁটতে আমি ভাবতে লাগলাম, কোথায় রয়েছি আমি?
যে-পৃথিবী প্রত্যাখ্যান করে পালিয়ে এসেছিলাম একদিন
ভূত চরা রাতে, সেখানেই খাচ্ছি কি ঘুরপাক আজও লাটিমের মতো?
আমি তাদেরকে বললাম, “তোমরা তো আছো এক উদ্ভট ডাকাতদের
গ্রামে! কেমন সীমান্ত খুলে দিয়ে ঢুকিয়ে নিয়েছো ঘরের ভিতর
চোর-দস্যু-গুণ্ডা-বদমাশ। কী করে মানুষ, হায়, থাকে এই
জাহান্নামে?” তারা দা-বল্লম নিয়ে তাড়া করলো আমাকে। আমি
ছুটতে ছুটতে উঠে গিয়ে দাঁড়ালাম হিমালয়ের চূড়ার উপর। দাঁড়িয়ে
পৃথিবীবাসীর উদ্দেশে চীৎকার করে উঠলাম, “ভাইসব! তোমাদের
ঘাড়ের উপর চেপে বসে আছে এক একচক্ষু দৈত্য। সে কখনো
গণতন্ত্র, কখনো সমাজতন্ত্র, কখনো ধর্মের নাম নিয়ে বশ করে
রাখছে তোমাদেরকে।কি-কৌশলে সুঁই ফুটিয়ে ফুটিয়ে তোমাদের
সমস্ত শরীর থেকে শুষে শুষে খাচ্ছে সে রুধির! যে-পৃথিবী
বলিষ্ঠ কর্মঠ উৎপাদনশীল মানুষকে বানিয়েছে প্রজা ও পরগাছার
মতো বসে বসে খাওয়া বুদ্ধিজীবীদের একচক্ষু সেই দৈত্যের দোসর;
যে-পৃথিবী কুকুরের মতো দেহপ্রদর্শনকারী বেহায়াদেরকে বসিয়েছে
সম্মানের সর্বোচ্চ আসনে আর মেরেছে তেনার মতো ছুঁড়ে সব
লজ্জাশীল বিজ্ঞ তাপসকে অবজ্ঞার ডাস্টবিনে; যে-পৃথিবী সব সৎ
ও সত্যবাদীকে নিয়ে নেকড়ের মতো করে খেলা; তোমরা সানন্দে
প্রত্যাখ্যান করো তাকে, প্রত্যাখ্যান করে ছুটে আসো, আমরা সবাই
একসাথে চলে যাই গভীর জঙ্গলে।” আমার আহ্বান শুনে
“পাগল! পাগল!” বলে হাসাহাসি করতে করতে ফিরে গেল তারা
সুন্দর তাদের লোহার খাঁচায়।
আমি ভাবি, যে-জগৎ এত প্রাণঘাতী ভাইরাসে ভরা; যেখানে সত্যের
মূল্য নেই এক পাইও; যেখানে কেবলি প্রতারণা, রোগশোক, মৃত্যু, ক্ষুধা,
জালিমের অট্টহাসি কেউটে সাপের মতো ফোঁসফোঁস করে ফণা তুলে;
যেখানে বাতাসে বিষ, পানিতে পাপের ফেনা, মৃত্তিকায় মহামারি,
মানুষে পশুত্ব আর নারীতে নষ্টামি; হায়, সে-জগৎ নিয়ে
মানুষেরা কেন এত বিচলিত আর এত দিশেহারা? না-মরেও
মানুষ কিভাবে কবরজীবন আজ করছে যাপন! তবু বুকে কোনো
প্রেম নেই, চোখে কোনো জল নেই, যেন মরা কোনো খাল;
অনন্ত জীবনে-পুনরুত্থানে-বিচারদিবসে বিশ্বাস নেই এক তিলও;
শুধু চোখজুড়ে, বুকজুড়ে কামে গিজগিজ করা জীবনের লোভ
ও মৃত্যুর নীল ভয়। ইন্দ্রিয়ের সুখে পশুদের মতো এরা অন্ধ হয়ে
থাকে অষ্টযাম।“হায়, এইসব সুখ, এইসব খ্যাতি আর অর্থ বিত্ত
গাড়ি বাড়ি বিপুল ক্ষমতা ফেলে রেখে ফকিরের মতো খালি হাতে
হিমশীতল মৃত্যুর হাত ধরে কোনখানে যেতে হবে শেষমেশ?
কোথায় ঠিকানা জীবনের তবে— সে-জীবন, যে-জীবন
নেশার তাড়ির মতো মত্ত করে রাখে শুধু দুনিয়ার মোহে?”
তারা ভাবে।
আমি ভাবি, কখনো কি এইসব জীবন্মৃত জীবগুলো ফিরে পাবে
প্রকৃত জীবন, যে-জীবনে সত্য আছে, ত্যাগ আছে, প্রেম আছে,
আত্মা আছে, যে-আত্মায় অশান্ত নদীর মতো ছলাৎ ছলাৎ করে
বিশ্বাসের ঢেউ, যার ধ্বনি শুনে অনন্তের পাড় হতে ঝাঁক বেঁধে
উড়ে আসে লাল ঠোঁট প্রশান্তির পাখি, যারা গানে গানে ভরে তোলে
পৃথিবীর গ্রাম-জনপদ?
৫, ৬ ও ৭ এপ্রিল ২০২০
করোনাকালে গৃহবন্দী অবস্থায় রচিত। এপিক হাউজ, কাজলা, রাজশাহী
ভয়
বাঁধা-বিঘ্নহীন জীবনের লোভে
লালায় কুত্তার মতো এরা! হায়াতের
সূর্য যদি ডোবে,
যদি ধসে পড়ে নিয়তির ঘর—
এই ভয়ে কেঁপে কেঁপে ওঠে
এদের অন্তর
এবং শরীর। কোথায় যে ছোটে
মনুষ্যবিহীন কোন্ গ্রহে এদের কল্পনা-বুদ্ধি-জ্ঞান,
যেখানে স্বর্ণের বানিয়ে নিবাস, বিশুদ্ধ বায়ুর
চিরস্থায়ী খাঁচা, আর ফেলে
নিশ্ছিদ্র নিপুণ নিরাপত্তাজাল, অনন্ত আয়ুর
ঝাড়বাতি দেবে জ্বেলে!
কখনো এমন জনপদ দেখেছে কি এরা, যেখানে মৃত্যুর
বাজেনি দুন্দুভি? কে কবে কোথায় অমর অক্ষয়?
তবু কেন জীবনকে নিয়ে এত অস্থির-উদ্বিগ্ন? কেন এত ভয়
মরণের? ঢের
এসেছে মানুষ পৃথিবীতে; ফের
গেছে তারা চলে; এভাবে চলেছে জগৎ-সংসার;
কেবল থাকবে যার
অনশ্বর কীর্তি, ত্যাগ আর মানবতা—
পৃথিবী বলবে তার কথা।
০৪.০৪.২০২০ এপিক হাউজ, কাজলা
দাগ ও দুর্গন্ধ
কত বার হাত ধুলে মুছে যাবে হাত থেকে শোণিতের দাগ?
কত বার মুখ ধুলে মুছে যাবে মুখ থেকে মাংসের দুর্গন্ধ?
যতই হিসেব কষো, ক্যালকুলেটরে তুমি করো গুণ-ভাগ,
মিলবে না এ গণিত, ফিরবে না জীবনের কাব্যে সেই ছন্দ!
অনেক কেঁদেছে নারী, অনেক কেঁদেছে শিশু, শিশুদের পিতা
মানুষের আর্তনাদে অনেক হয়েছে ভারী বিশ্বের বাতাস
নষ্ট ওই হাত দিয়ে টিপেছো বোতাম কিংবা টেনেছো কী ফিতা,
পড়েছে হুমড়ি খেয়ে নিযুত নিযুত, আহা, শতচ্ছিন্ন লাশ!
হায়েনারও হায়া আছে, চমকায় চোখে তারও ভয়ের বিদ্যুৎ,
পাথরেরও শক্ত প্রাণে তরমুজের মতো বুঝি আছে কোমলতা;
কিন্তু হে মানুষখেকো! স্বাধীনতাখেকো ওহে রক্তচোষা ভূত!
দয়া-মায়া-হায়া-ভয় তোমার জগতে জানি শুধু রূপকথা।
ধুয়ে যাও কোটি বার, তারপরও কোটি বার, কোটি বার ফের—
যত বারই ধোও না হে, যাবে না রক্তের দাগ, দুর্গন্ধ মাংসের।
৫ এপ্রিল ২০২০ এপিক হাউজ, কাজলা