তাজিমুর রহমান
১.
প্রজ্ঞা,পরিমিতি,প্রেম ও প্রতিবাদ–এই চারটি শব্দের মাধুরীকে সামনে রাখলে যে নামটি চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তিনি হলেন শঙ্খ ঘোষ। আমার মতো তুচ্ছ মানুষের পক্ষে তাঁকে নিয়ে কিছু লিখতে যাওয়া এক অর্থে ধৃষ্টতার সামিল।তবু তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে কিছু কথা বলা ছাড়া উপায় নেই বলে এই শব্দবন্ধ।
শ্রদ্ধেয় শঙ্খ ঘোষ অন্যান্য অনেকের মতো আমার কাছেও একজন মনীষা।কেন?এর যথাযথ কারণ ব্যাখ্যা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আসলে,এই নশ্বরভূমে এমন কোনো কোনো মানুষ থাকেন যাঁদের প্রতি ভিতর থেকে অকপট শ্রদ্ধা নিবেদন করা ছাড়া উপায় থাকে না।শঙ্খ ঘোষ আমার কাছে তেমনই একজন। অবশ্য এটা শুধু তাঁর সৃজনশীলতা ও মেধা-পান্ডিত্যের জন্য নয়। কিংবা তাঁর অসাধারণ কৃতিত্ব বা প্রতিবাদী সত্তার জন্যও নয়। বরং বলতে পারি তাঁর সহজতা, সহৃদয় মনোভাব, সহিষ্ণুতা ও দৃঢ়-স্থিতধী মননের জন্য তিনি আমার কাছে অন্যান্য অনেকের থেকে স্বতন্ত্র,অনন্য। হ্যাঁ, তাঁর প্রতিবাদী সত্তাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েও বলছি তিনি আমার কাছে উল্লেখিত গুণগুলোর জন্য অনেক বেশি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। যাঁকে দেখলে অনায়াসে নতজানু হতে হয়,আর দূর থেকে প্রণাম রাখা যায়। প্রাবন্ধিক বীরেন মুখার্জীর কথায়–“৫০-এর কবি হলেও মানসিকতা ও জীবনদর্শনে তিনি তাঁর সময়ের অন্যান্য কবিদের থেকে আলাদা।”
রবীন্দ্র-জীবনানন্দ উত্তরকালে বাংলা কাব্য-সাহিত্য জগতে কবি শঙ্খ ঘোষ এমন একটি নাম যাঁর কথা মনে পড়লে আঁধারে আলোর দিশা খুঁজে নেওয়া কোথাও যেন বড় সহজ হয়ে যায়।বিপন্নতায় জেগে ওঠার শক্তি পাওয়া যায়। আমরা রবীন্দ্রনাথকে পাইনি।পাইনি কাজী নজরুল ইসলাম, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ কিংবা বিষ্ণু দে প্রমুখ কবিদের। অবশ্য পাবার কথা নয় বলে পাইনি। সুতরাং তার পরবর্তীকালে আমাদের সামনে অনেকটা ধ্রুবতারা হয়ে জেগে ছিলেন যে মানুষটি, তিনি কবি-শিক্ষাবিদ শঙ্খ ঘোষ নন।তার থেকে অনেক বেশি বাংলার জাগ্রত বিবেক-স্বরূপ ব্যক্তি শঙ্খ ঘোষ। এই আঁধিময় সময়ে যাঁর নীরব উপস্থিতিও চরম বিপর্যয়ের মুখে একটা বড় আশ্রয়। দিশাহীন জীবনের প্রেরণা।আত্মবিক্রয়ের কালে আপোষহীন এক উদাত্ত কন্ঠ।তাই, হয়তো প্রাবন্ধিক তপোধীর ভট্টাচার্য এভাবে বলতে চেয়েছেন–” রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী প্রজন্মে জীবন সম্পর্কে সংশয় ও অবসাদ যখন আধুনিকতার ক্ষয়িষ্ণু রূপ সর্বত্র প্রকট করে তুলেছিল, সৃষ্টি ও মননের পথ হারিয়ে যাচ্ছিল আঁধিতে। পণ্যায়নপুষ্ট বিকারের সঙ্গে আপোষ রফায় আবিল হয়ে যাচ্ছিল বাংলা সাহিত্য । সেই সন্ধিক্ষণে যিনি নন্দন-যোদ্ধা হিসেবে আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন আজও, তিনি শঙ্খ ঘোষ।” (শঙ্খ ঘোষ: সৃষ্টি ও নির্মাণ)। আসলে,কবি শঙ্খ ঘোষ মানে শুধু অন্ধকারে আলোর দিশারী নয়, বিচ্ছেদের মধ্যে সেতু কিংবা বিপন্নতার মাঝে বেঁধে বেঁধে থাকার দীপ্ত আহ্বান। এসবের পরেও তিনি ছিলেন বাংলার শিল্প-সাহিত্য জগত থেকে শুরু করে সমগ্র সুশীল সমাজের প্রকৃত অভিভাবক।
২.
কবি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে আমার সরাসরি সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়েছিল মাত্র দু’বার।একবার ছাত্রাবস্থায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পুনর্মিলন উৎসবে। আর এক বার তাঁকে উৎসর্গকৃত আমার ‘শিরোনামহীন একা’ কাব্যগ্রন্থটি সরাসরি তাঁর হাতে তুলে দিতে গিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র নিবাসে।এই দুই সাক্ষাতের মধ্যে ব্যবধান ছিল প্রায় দু’দশক। ফলে, ব্যক্তি শঙ্খ ঘোষ সম্পর্কে গভীরভাবে জানার কোন সুযোগ হয়নি। এই অল্প সময়ে জানার কথাও নয়।তবু,কেউ কেউ থাকেন যাঁকে এক বা একশ–যতবার দেখা যাক না কেন অনুভূতির খুব একটা তারতম্য ঘটে না। কবি-অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষের সম্পর্কে আমার অনুভূতি অনেকটা তেমনই।পরম শ্রদ্ধার।তাঁর না থাকা সামগ্রিকভাবে যে শূন্যতা তৈরি করে দিয়েছে তা কোনদিন পূরণ হবে কিনা বলা কঠিন। তাঁর অনুপস্থিতি বাংলার শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের কাছে অপরিসীম ক্ষতি শুধু নয়, সামগ্রিকভাবে বিচার করলে যেন ইন্দ্রপতন। তাই কবি জয় গোস্বামী কবির মৃত্যুর পর বলেছেন– “এক মহা বটবৃক্ষের পতন হল।….তিনি ছিলেন জাতির বিবেক।”
হ্যাঁ, এটা ঠিক যে তাঁর সমকালীন বা পরবর্তীকালে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে বহু গুণী ব্যক্তিত্ব ছিলেন বা আছেন, তাঁদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়েও বলতে দ্বিধা নেই যে,শঙ্খ ঘোষ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তাঁর সামগ্রিকতার সামনে দাঁড়ালে শুধু শ্রদ্ধা জানানো ছাড়া কোন উপায় থাকে না। পাশাপাশি বলা মনে হয় অমূলক হবে না যে, এমন অনমনীয় মনোভাবের মানুষ বিশ শতকে খুব কম দেখা গেছে। সারাজীবন ক্ষমতাতন্ত্রের কাছে কখনো মাথা নোয়াননি। চরম বিপর্যয়ের মধ্যেও তাঁর মেরুদন্ড সবসময় ছিল টান টান,ঋজু। সমস্ত অন্যায়-অবিচার, অপশক্তির বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদী কন্ঠ ছিল উদাত্ত।তাই, কবিতায় প্রতিবাদে গর্জে ওঠার পাশাপাশি আশি বছর বয়সেও পা মিলিয়েছিলেন কবিতা থেকে মিছিলে।ডাক দিয়েছেন মানবতা হত্যাকারী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে।তাই প্রাবন্ধিক বীরেন মুখার্জীর মতে,–” প্রতিবাদী বিশ্বের নতুন স্বরায়ণের কবি শঙ্খ ঘোষ।”
আমার সঙ্গে তাঁর প্রথম আলাপ কবিতার মাধ্যমে। আটের দশকের একেবারে শেষ দিকে আমার এক সহপাঠীর মাধ্যমে হাতে এসেছিল তাঁর লেখা ‘ধূম লেগেছে হৃদকমলে’ বইটি।এই বইটির মধ্য দিয়ে প্রথম তাঁকে চিনি।এরপর অন্যান্য বই পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থ পড়া চলতে থাকে। কিন্তু, মফস্বল এলাকা হওয়ায় সব সময় তাঁর বই পাওয়ার একটা সমস্যা ছিল।যাই হোক এভাবে তাঁকে ধীরে ধীরে চিনতে চেষ্টা করি তাঁর কবিতার মাধ্যমে।এমন অবস্থায় একদিন হাতে পেলাম ‘কবিতার মুহূর্ত’। সত্যি কথা বলতে কি আমার কাছে ওই তরুন বয়সে অমৃত পাবার মতো মনে হয়েছিল। বইটি পড়তে পড়তে একেবারে বুঁদ হয়ে গেছিলাম। সেসময়ে এমন একটি বই পড়ার পর আমার সামনে উন্মোচিত হয়েছিল বিস্তৃত এক দিগন্ত। এটি পড়ে জানতে পারলাম কিভাবে বাস্তব ঘটনার অভিঘাত একজন কবির জীবনে আলোড়ন তোলে। জেনেছিলাম, কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতাযাপনের কথা এবং তাঁর কবিতার উৎস ও ইতিহাসের কথা।সেই সঙ্গে চিনতে চেষ্টা করলাম তাঁর কবিতায় কিভাবে ব্যক্তিগত বিষয় ও ইতিহাস মিলে মিশে সৃজন করে দিয়েছে একটা সময়পথ, তাও। বইটির “সূচনা” অংশে কবির কথায় যেন তেমনই প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। তাঁর কথায়, “কবিতার মধ্য দিয়ে তাই পিছনের দিনগুলিতে একবার ফিরে যেতে থাকি। যেতে যেতে দেখি একটা পথরেখা চিহ্নিত হয়ে আছে, কিছু-বা ব্যক্তিগত কিছু-বা ঐতিহাসিক স্মৃতিতে মিলে মিশে যাওয়া এক সময়পথ।” সেই সময়ের পথরেখা ধরে বইটির হাত ধরে ক্রমে আমার কাছে আকাশের মতো উন্মোচিত হয়েছে বাস্তু, বিকল্প, মহানিমগাছ, ভূ-মধ্যসাগর, রাধাচূড়া, বিকেল বেলা, ভিখিরির আবার পছন্দ,ভিড়, হাতেমতাই, উল্টোরথ, কলকাতা প্রভৃতি কবিতাগুলো।আমরা যারা নব্বইয়ের দশক থেকে লেখালেখি করার চেষ্টা করে চলেছি তাদের অনেকেই হয়তো এই বইটির মধ্য দিয়ে নিয়েছি ইতিহাস চেতনার প্রথম পাঠ।শিখেছি কিভাবে একজন সময় ও সমাজ সচেতন কবিকে সৎ থাকতে হয় অক্ষরের কাছে। তাঁর এই বইটি আমার মতো অনেককেই হয়তো শিখতে সাহায্য করেছে অমোঘ এক সত্য–তা হল একজন সংবেদনশীল কবির হৃদয়সংবেদী মনোভাব কেমন হওয়া উচিত।কবি যশোধরা রায়চৌধুরীর কথায় যেন এই কথাগুলির প্রতিধ্বনি শোনা যায়। তিনি কবির ৮০তম জন্মদিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে বলেছেন, “যমুনাবতী’-র মত অতি জনপ্রিয় কবিতার লেখার পেছনের ঘটনাকাহিনি, কোন সে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সংযোগ করে চিন্তার বারুদে আগুন, আর ঘটিয়ে তোলে কবিতার আতশবাজি…তা জানার সুযোগ পেয়েছি। জেনেছি ‘বাবরের প্রার্থনা’-র মত কবিতার প্রেক্ষাপট। আরো কত, কত কবিতা। ‘আরুণি উদ্দালক’, ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ’, ‘লজ্জা’, ‘ভিখিরি ছেলের অভিমান’, ‘কলকাতা’। প্রতিটা কবিতা নিজেকে উন্মোচিত করেছে আমার কাছে, এই কবিতার মুহূর্তের হাত ধরে ধরেই। আর কী বিশাল এক ইতিহাসপট রচিত হয়েছে মাথার ভেতরে। কতটাই না বড় হয়ে খুলে গেছে কবিতার আকাশ।” তাই আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় ‘কবিতার মুহূর্ত’ বইটি কবিতায় হাত মকসো করতে আসা তরুণ কবিদের পাশাপাশি লেখালেখির জগতের সকলের পড়া উচিত। আমাদের যুবক বয়সে কতজনে যে বইটি নিয়ে কাড়াকাড়ি করে পড়েছি তার ইয়ত্তা নেই।শুধু তাই নয় এর পর কবি শঙ্খ ঘোষ হয়ে উঠেছিলেন প্রায় আমার দৈনন্দিনের সঙ্গী।ফলে,একে একে সংগ্রহ করে পড়তে থাকি তাঁর কবিতার পাশাপাশি গদ্যের বইগুলোও।
৩.
আমরা প্রায় সকলেই কম বেশি জানি যে, বাংলা আধুনিক কবিতার মুল ধারাটি ব্যক্তিবাদীর অবচেতন ভাব-শাসিত। সেখানে সমাজ বা ইতিহাস বোধের প্রাধান্য কম। ফ্রয়েডীয় ভাবনাজাত আধুনিকতার তরঙ্গে ভাসমান পাঠক- সমাজের কাছে তাই অনেক শক্তিশালী কলমও কাব্য জগতে একরৈখিক চিন্তা দ্বারা চিহ্নিত হয়ে কলকে পায়নি।এর জ্বলন্ত উদাহরণ বোধ হয় বিষ্ণু দে। কবিতার শঙ্খ ঘোষের কী একই অবস্থা বলা যায়? আমি ব্যক্তিগতভাবে তা মনে করি না। আমার বিশ্বাস তিনি আদ্যোপান্ত একজন প্রকৃত কবি। অধ্যাপক পবিত্র সরকারের কথায় যেন সেই কথারই প্রতিধ্বনি।তার কথায়,–“শঙ্খ ঘোষ বাংলা সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ কবি;সে কথা নানাভাবে উৎকীর্ণ থাকবে।” আসলে তাঁর কবিসত্তা ছিল দ্বিমুখী। একদিকে তাঁর মন সবসময় সজাগ সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনার ঘাত- প্রতিঘাত বিষয়ে। সমাজের অন্যায়, বৈষম্য, অপশক্তির বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছেন। কখনো শ্লেষ, কখনো ব্যাঙ্গাত্মভাবে। অন্যদিকে, তিনি আবার অবচেতনভাবে হেঁটে গেছেন গভীর অতলান্তের দিকে। সেখানে তাঁর কবিতাগুলো দার্শনিক প্রজ্ঞা ও জীবনরসে জারিত। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক শিশির কুমার দাশের বক্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন’–একটি ব্যক্তিমুখী,এর নির্জনতা সন্ধানী ব্যক্তিসত্তার আত্মকথা, সংকেতময় ভাষায় ও প্রতিমায়, মৃদুকোমল ছদ্মস্পর্শে অনুত্তেজিত কণ্ঠস্বরে এই কাব্যধারা বিশিষ্ট, অন্যধারাটি চারপাশের জগতের অসঙ্গতি, সমাজের বৈষম্য ও অমানবিকতার প্রতিক্রিয়ায় বিচলিত-ক্রুদ্ধ এক ব্যক্তিমনের প্রতিবাদের ধারা, তা মূলত বিদ্রূপেও, ব্যঙ্গে কখনো স্পষ্ট ও তীব্র, কখনো বেদনায় ও যন্ত্রণায় গভীর।”
হ্যাঁ, এটা ঠিক যে তাঁর লেখা নিয়ে বিরুদ্ধ মতামতও থেকে গেছে।থাকাটাই তো স্বাভাবিক। কারোর মতে তিনি অনেক বেশি তাত্ত্বিক কবি,তাই তাঁর কবিতায় বিস্তীর্ণ ক্যানভাসের অভাব। আবার কেউ মনে করেছেন তাঁর কবিতা বক্তব্য কেন্দ্রিক হওয়ায় রহস্য কম। ফলে রসময়তা নেই। এই সব সমালোচনাকে জাস্টিফাই করার পরিসর এ লেখায় নেই বলে তা বিচারের ভার আগামীর হাতে রাখলাম। হয়তো ইতোমধ্যে এ নিয়ে বহু লেখাও হয়েছে। অনুসন্ধিৎসু পাঠক তা খুঁজে পড়ে নেবেন সে বিশ্বাস আমার আছে।আমি এখানে মূলতঃ লেখাটির শুরুতে যে চারটি শব্দবন্ধ রেখেছি তার নিরিখে আমার কয়েকটি ভালো লাগা কবিতা পড়ার চেষ্টা করব।সেই সঙ্গে তাঁকে কেন্দ্র করে আমার অনুভূতি ভাগাভাগি করে নেবো পাঠকের সঙ্গে।
চিরকাল মাথা উঁচু করে চলতে অভ্যস্ত একজন আপোষহীন ধারার মানুষ ছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। কখনো ক্ষমতার কাছে নতজানু হননি।তাই,জরুরী অবস্থার সময় ‘দেশ’ পত্রিকার জন্য পাঠানো কবিতা শাসকের নির্দেশে বাতিল হবার পর পুনরায় কবিতা চাওয়া হলেও আর দেননি।এমনই দৃঢ়চেতা মনের মানুষ ছিলেন বলে কবিতায় তুলে ধরেছেন ‘নিঃশব্দের তর্জনী’।শুধু তাই নয়,শ্রেষ্ঠ কবিতার ভুমিকায় দীপ্ত কন্ঠে অকপট বলতে পেরেছিলেন,’ সত্যি কথা বলা ছাড়া কবির আর কোনো কাজ নেই।’ ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত ‘দিনগুলি রাতগুলি’ কাব্যগ্রন্থ থেকে তাঁর এই জার্নির শুরু। বিরামহীন এই যাত্রায় তিনি অধিকাংশ লেখায় তাঁর সহজাত প্রতিবাদের কথা লিখেছেন ঠিকই, তা বলে তাঁকে শুধু প্রতিবাদী কবি হিসেবে গণ্য করলে অতি সরলীকরণ হয়ে যায়। তা যথার্থও হবে না বলে আমার মনে হয়।কারণ, তাঁর বিভিন্ন কাব্যের পাঠ বিশ্লেষণে গেলে বিষয় -বৈচিত্র্য, ছন্দের নতুন নতুন ব্যবহার ও ফর্মের বৈচিত্র্যময়তায় কবিতাগুলো যে অনন্য তা প্রমাণিত। সে জন্য হয়তো কবি গৌতম বসু বলেছেন,–” শঙ্খ ঘোষ কোন কবিতা লেখেননি,কবিতায় এক তন্ত্র নির্মাতার (সিস্টেম বিল্ডার) ভুমিকা পালন করেছেন।” কবি রণজিৎ দাশের কথায় যা হল,’কাব্যভাষার নতুন ইডিয়ম ও ডিকশন।’
এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর লেখার বিস্তৃতি ও গভীরতা বেড়েছে।সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে বহু মাত্রাযুক্ত সংবেদনশীলতা,যার প্রতিভাস তাঁর বিভিন্ন কাব্য ও গদ্যগ্রন্থগুলিতে ছড়িয়ে রয়েছে। আমরা এখন তাঁর কয়েকটি কবিতা পড়ে নিতে চেষ্টা করব, যেখানে কবি শঙ্খের প্রেম, প্রতিবাদ যেমন ধরা আছে।তেমন প্রজ্ঞা ও পরিমিতি বোধও জায়মান হয়ে রয়েছে।
কথায় বলে প্রেমহীন জীবন যেন ধূসর মরুভূমি। আবার প্রেম ছাড়া প্রতিবাদ–অলীক কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। সুতরাং আমি মনে করি কবি শঙ্খ ঘোষ বড় প্রেমিক বলেই প্রকৃত প্রতিবাদী। অবশ্য তাঁর এই প্রেমানুভূতি যতটা না ব্যক্তিক তার থেকে অনেক বেশি সামাজিক। মানবিক তো বটেই। এখন তাঁর ‘শ্লোক’ কবিতাটি পড়া যাক—“
“সেই মেয়েটি আমাকে বলেছিল:
সঙ্গে এসো, বেরিয়ে এসো,পথে।
আমার পায়ে ছিল দ্বিধার টান
মুহূর্তে সে বুঝেছে অপমান
জেনেছে এই অধীর সংকটে
পাবে না কারও একতিলও–
সেই মেয়েটি অশথমূলে বটে
বিদায় নিয়ে গাইতে গেলে গান।
আমি কেবল দেখেছি চোখ চেয়ে
হারিয়ে গেল স্বপ্নে দিশেহারা
শ্রাবণময় আকাশভাঙা চোখ
বিপ্লবে সে দীর্ঘজীবী হোক
এই ধ্বনিতে জাগিয়েছিল যারা
তাদেরও দিকে তাকাইনি সে মেয়ে
গ্লানির ভারে অবশ করে পাড়া
মিলিয়ে গেল দুটি পায়ের শ্লোক।”
কবিতাটিতে প্রেমের একান্ত অনুভূতিকে ক্রমে পৌঁছে দিতে চাওয়া হয়েছে সামাজিক মঙ্গলভাবনায়। কবি এখানে তাঁর ব্যক্তিগত প্রেমকে বিপ্লবের সঙ্গীতরূপে দীর্ঘজীবী করার আশা ব্যক্ত করেছেন। ফলে, কবিতাটিতে তাঁর যুগ্ম প্রেমিকসত্তার(ব্যক্তি ও সামাজিক) যুগপৎ অবস্থান স্পষ্ট প্রতিভাত।যা কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতার মুল রেসিপিও বটে।এর পাশাপাশি তাঁর ‘আড়ালে’ কবিতাটি পড়লে দেখা যাবে সেখানে তাঁর একান্ত প্রেমানুভূতি দার্শনিক চেতনায় চির উজ্জ্বল।কবিতাটির পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে আবেগতাড়িত রূপে প্রেমের সঙ্গে কাম-কলহের সূক্ষরূপ–
“দুপুরে রুক্ষ গাছের পাতার
কোমলতাগুলি হারালে-
তোমাকে বকব, ভীষণ বকব
আড়ালে।
যখন যা চাই তখুনি তা চাই।
তা যদি না হবে তাহলে বাঁচাই
মিথ্যে, আমার সকল আশায়
নিয়মেরা যদি নিয়ম শাসায়
দগ্ধ হাওয়ার কৃপণ আঙুলে–
তাহলে শুকনো জীবনের মূলে
বিশ্বাস নেই, সে জীবন ছাই!
মেঘের কোমল করুণ দুপুর
সূর্যে আঙুল বাড়ালে-
তোমাকে বকব, ভীষণ বকব
আড়ালে।”
অন্যদিকে, ‘ফুলবাজার’ কবিতাটি পড়লে বুঝতে পারা যায় এটি কবির আবেগঘন জীবনরসের কবিতা। যেখানে ‘পদ্ম’ নামে এক কিশোরীর সঙ্গে কবির প্রেম।যে প্রেমে আবেগের পাশাপাশি যৌনতার স্পষ্ট আভা। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই প্রেমিকার জীবন চোরাস্রোতে হারিয়ে গিয়ে অন্ধকারে ঠাঁই হওয়ায় কবির মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে বটে, কিন্তু প্রেমের মৃত্যু হয় না।–
“পদ্ম, তোর মনে পড়ে খালযমুনার এপার ওপার
রহস্যনীল গাছের বিষাদ কোথায় নিয়ে গিয়েছিল?
স্পষ্ট নৌকো, ছৈ ছিল না, ভাঙা বৈঠা গ্রাম হারানো
বন্য মুঠোয় ডাগর সাহস, ফলপুলন্ত নির্জনতা
আড়ালবাঁকে কিশোরী চাল, ছিটকে সরে মুখের জ্যোতি
আমরা ভেবেছিলাম এরই নাম বুঝি বা জন্মজীবন।
কিন্তু এখন তোর মুখে কী মৃণালবিহীন কাগজ-আভা
সেদিন যখন হেসেছিলি সত্যি মুখে ঢেউ ছিল না!
আমিই আমার নিজের হাতে রঙিন ক’রে দিয়ে ছিলাম
ছলছলানো মুখোশমালা,সে কথা তুই ভালই জানিস—
তবু কি তোর ইচ্ছে করে আলগা খোলা শ্যামবাজারে
সবার হাতে ঘুরতে-ঘরতে বিন্দু বিন্দু জীবনযাপন?
একই সঙ্গে কবি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গিনী,পালক, জন্মদিন, মহানিমগাছ,খাল, তুমি আর নেই সে তুমি,গঙ্গাযমুনা, ভিখারী বানাও, তুমি তো তেমন গৌরী নও প্রভৃতি অসংখ্য কবিতায় তাঁর প্রেমিকসত্তা স্পষ্টরূপে জারিত হয়ে রয়েছে। আমার বিশ্বাস,এই প্রেম-ই কবিকে আলোড়িত করেছিল বলেই তাঁর প্রতিবাদের ভাষা ক্রমে ক্রমে তীক্ষ্ণ হয়েছে। মননে- চিন্তনে তিনি প্রতিবাদী ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর সেই প্রতিবাদ তো সমষ্টির প্রতি প্রেম থেকে জাত।তাই তো, নন্দীগ্রামের ঘটনা হোক বা গুজরাটের গণহত্যা হোক–সবেতেই তিনি প্রতিবাদী। সেই সঙ্গে সামাজিক বৈষম্য, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, অন্যায়-অবিচার ইত্যাদির প্রতি ছিলেন খড়গহস্ত। ফলে,তাঁর কবিতা শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতার অপশাসনের বিরুদ্ধে নয়, সমস্ত ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়িয়ে অতন্দ্র থেকেছে। আর এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রান্তিক, পীড়িত জনগোষ্ঠীর কন্ঠস্বর।তাঁর প্রতিবাদী সত্তা যেন তাঁর-ই প্রতিদ্বন্দ্বী। যে প্রতিবাদ ভুখাপেট নিয়ে খাদ্যের দাবিতে মিছিলে হাঁটা কিশোরীর পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর বিরুদ্ধে যৌবন বয়সে (যমুনাবতী) গর্জে উঠেছিল।পরবর্তীতে তা ক্রমে ডানা মেলেছিল সমকালীন বিভিন্ন ঘটনা ও নিপীড়িত মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ।এই প্রেক্ষিতে তাঁর দু’একটি কবিতা পড়া যেতে পারে। ‘ন্যায় অন্যায় জানিনে’ কবিতায় লিখলেন–
‘তিন রাউন্ড গুলি খেয়ে তেইশ জন মরে যায়, লোকে এত বজ্জাত হয়েছে !
স্কুলের যে ছেলেগুলো চৌকাটেই ধ্বসে গেলো, অবশ্যই তারা ছিল
সমাজবিরোধী।
ও দিকে তাকিয়ে দ্যাখো ধোয়া তুলসিপাতা
উল্টেও পারেনা খেতে ভাজা মাছটি আহা অসহায়
আত্মরক্ষা ছাড়া আর কিছু জানেনা বুলেটরা।
দার্শনিক চোখ শুধু আকাশের তারা বটে দ্যাখে মাঝে মাঝে।
পুলিশ কখনও কোনও অন্যায় করে না তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ।”
কবিতার শেষ প্রান্তে এসে তাঁর প্রতিবাদী সত্তা যেন আছড়ে পড়ল।কী অসাধারণ মুন্সিয়ানায় একবারে নগ্ন করে দিলেন রাজনীতির মুখোশ। বুঝিয়ে দিলেন কিভাবে অক্ষর নামক শাণিত তরবারির আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন করতে হয় যাবতীয় অন্ধকার ও ক্ষমতাতন্ত্রকে।প্রায় একই রকম প্রতিধ্বনি নন্দীগ্রামের গণহত্যার প্রতিবাদে লেখা ‘সবিনয় নিবেদন’ কবিতায়ও। তিনি লিখলেন’—
“আমি তো আমার শপথ রেখেছি
অক্ষরে অক্ষরে
যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন
দিয়েছি নরক করে।
দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল
অন্যে কবে না কথা
বজ্র কঠিন রাজ্যশাসনে
সেটাই স্বাভাবিকতা ।
গুলির জন্য সমস্ত রাত
সমস্ত দিন খোলা
বজ্র কঠিন রাজ্যে এটাই
শান্তি শৃঙ্খলা ।
যে মরে মরুক, অথবা জীবন
কেটে যাক শোক করে—
আমি আজ জয়ী, সবার জীবন
দিয়েছি নরক করে।”
এখানেও সেই শাসকের অপশাসন, ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র শ্লেষ-ব্যঙ্গে উচ্চারিত প্রতিবাদ। গুজরাটের গণহত্যা তাঁকে যেমন নাড়িয়ে দিয়েছিল, তেমনি নন্দীগ্রামের গণহত্যা সহ কামদুনির ঘটনায় তিনি চুপ থাকেননি।প্রতিবাদে নেমে পড়েছিলেন রাস্তায়।এ যেন তাঁর কবিতা থেকে মিছিলে নেমে প্রতিবাদ।গুজরাটের দাঙ্গার পর লিখলেন,– “নারায়ণ নয়, আমি পেয়ে গেছি নারায়ণী সেনা।/যতদূর যেতে বলি যায় এরা, কখনো আসেনা কোন কূটতর্ক নিয়ে,/ভাবলেশহীন ধ্বংস হাতে ছুটে যায়। যদি বলি দিন বলে দেয় দিন/যদি বলি রাত,বলে রাত।” মনুষ্যত্বহীন একশ্রেণীর ধর্মের ধ্বজাধারী কূটশক্তির মুখোশটা টেনে খুলে দিলেন এই কবিতায়। আবার,এন আর সি-র চাতুরী প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি লিখলেন ‘ মাটি’ কবিতাটি।–
“আমারই হাতের স্নেহে ফুটেছিল এই গন্ধরাজ/ যে–কোনো ঘাসের গায়ে আমারই পায়ের স্মৃতি ছিল/আমারই তো পাশে পাশে জেগেছিল অজয়ের জল/আবারও সে নেমে গেছে আমারই চোখের ছোঁয়া নিয়ে/কোণে পড়ে–থাকা ওই দালানে দুপুরে ভাঙা থামে/আমারই নিঃশ্বাস থেকে কবুতর তুলেছিল স্বর/শালবন–পেরনো এ খোলা মাঠে মহফিল শেষে/নিথর আমারই পাশে শুয়েছিল প্রতিপদে চাঁদ।/তোমাদের পায়ে পায়ে আমারও জড়ানো ছিল পা/তোমরা জানোনি তাকে, ফিরেও চাওনি তার দিকে/দুধারে তাকিয়ে দেখো, ভেঙে আছে সবগুলি সাঁকো/কোনখানে যাব আর যদি আজ চলে যেতে বলো।
গোধূলিরঙিন মাচা, ও পাড়ায় উঠেছে আজান/এ–দাওয়ায় বসে ভাবি দুনিয়া আমার মেহমান।/এখনও পরীক্ষা চায় আগুনসমাজ/এ–মাটি আমারও মাটি সেকথা সবার সামনে/ কীভাবে প্রমাণ করব আজ।”
এরকম অসংখ্য কবিতার কথা বলা যায় যেখানে প্রতিবাদের আগুন ঝরিয়েছেন কবি শঙ্খ ঘোষ। অনুসন্ধিৎসু পাঠকের আশা করি সেগুলো পড়ে নিতে অসুবিধা হবে না।
প্রেম-প্রতিবাদের সহজাত প্রকাশ কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতায় যেমন অনন্যসাধারণ,তেমনি দার্শনিক প্রজ্ঞা ও পরিমিতি বোধও তাঁর কবিতায় অনবদ্য। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ‘কবর'(নিবেই যখন গেলাম আমি,নিবতে দিও হে পৃথিবী/আমার হাড়ে পাহাড় করো জমা–/মানুষ হবার জন্য যখন যজ্ঞ হবে, আমার হাড়ে/অস্ত্র গোড়ো,আমায় কোরো ক্ষমা।)কবিতায় মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য যে আত্মদর্শন তিনি প্রকাশ করেছিলেন তা অভাবনীয়। তখন-ই তিনি চিনিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর কলমের জাত।এরপর তো শুধু এগিয়ে চলা।যে চলায় আমরা পেয়ে যাই ‘নিহিত পাতালছায়া’, ‘বাবরের প্রার্থনা’,’মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’,’আদিম লতাগুল্মময়’, ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’,’ধূম লেগেছে হৃদকমলে’, ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’, ‘গোটা দেশজোড়া জউঘর’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের পাশাপাশি ‘নিঃশব্দের তর্জনী’,’এ আমির আবরণ’,’শব্দ আর সত্য’, ‘নির্মাণ আর সৃষ্টি’,’কবির বর্ম’, ‘জার্নাল’ প্রভৃতি গদ্যের বইগুলি। সমৃদ্ধ হই আমরা। সমৃদ্ধ হয় সমাজ থেকে বৃহত্তর পাঠক। প্রজ্ঞা ও পরিমিতির যুগপৎ অবস্থান তাঁর অধিকাংশ কবিতায় প্রতীয়মান। জল, তক্ষক,ঘর,
বৃষ্টি হয়েছিল পথে সেদিন অনন্ত মধ্যরাতে,ভিড়,বর্ম,ঘর প্রভৃতি কবিতার পাশাপাশি ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ ও ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’ কবিতা গ্রন্থের কবিতাগুলোর কথা বিশেষভাবে বলা যেতে পারে।এখন পড়া যাক ‘ জল’ কবিতাটি—
“জল কি তোমার কোনো ব্যথা বোঝে? তবে কেন, তবে কেন
জলে কেন যাবে তুমি নিবিড়ের সজলতা ছেড়ে?
জল কি তোমার বুকে ব্যথা দেয়? তবে কেন তবে কেন
কেন ছেড়ে যেতে চাও দিনের রাতের জলভার?”
কবিতাটিতে একাধিকবার ব্যবহৃত জল শব্দটি। অথচ এর মুল সুরটি সহজে নিজরূপে ধরা দিতে চায় না। ‘নিবিড়ের সজলতা’ ছেড়ে জলে যাওয়া নিষেধ আবার দিন-রাতের জলভার ধরে রাখতে চায়।এখানেই শব্দের সীমায়িত অর্থ অতিক্রম করে ‘জল’-কে একটি রহস্যময়তায় পৌঁছে দিতে চেয়েছেন কবি। আবার পিঠোপিঠি পড়া যাক ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ গ্রন্থের ৪ নম্বর চতুষ্পদীটি:
“চোখের পাতায় এসে হাত রাখে শ্লথ বেলপাতা
পাকা ধান নুয়ে পড়ে আদরে ঘিরেছে শরীরীকে
বালির গভীর তলে ঘন হয়ে বসে আছে জল
এখানে ঘুমোনো এত সনাতন, জেগে ওঠা, তাও।”
কিংবা
“এই চত্বরের পাশে শুকনো খোলস আছে পড়ে,
তৃপ্ত পিচ্ছিলতা নিয়ে চলে গেছে সচ্ছল শরীর।”
এখানেও কবির সেই অসাধারণ প্রজ্ঞা ও পরিমিতি বোধ খেলা করছে।ইন্দ্রিয় আচ্ছন্ন করে রাখা এক বিবশতার ছবি…. সংক্ষিপ্ত অথচ শোভন। মৃদু উচ্চারণ।প্রজ্ঞার আলোকচ্ছটায় মর্মরিত।যেন কোন শিল্পীর আঁকা ছবি। আসলে,শঙ্খ ঘোষ তাঁর সৃজন আবহে চিরটাকাল এমনই।তাই, প্রাবন্ধিক কাজী নাসির মামুন ‘শঙ্খ ঘোষের প্রতিধ্বনি’ শীর্ষক একটি লেখায় বলেছেন,”বুদ্ধদেব বসু বহির্বিশ্বে রবীন্দ্রনাথের ‘ঋষি’ পরিচয় নিয়ে বিব্রত ছিলেন। আর রবীন্দ্রানুরাগী শঙ্খ ঘোষ সেই ঋষিত্বকেই আরাধ্য ভেবে প্রজ্ঞার পরিমিতিতে যাচাই করেছেন কবিতাকে।”
এর পাশাপাশি,চলুন পড়ি কবির ‘ভবিতব্য’ কবিতাটিও—-
“আগুন লেগেছে শূন্যে, আমোদে মেতেছে তটভূমি ।
হাড়পোড়া শব্দগন্ধ জড়িয়েছে গভীর আশ্লেষে
ঘুমন্ত মনেরও বোধ । মনে হয় একদিন তুমি
জলাধার হয়ে তবু দাঁড়াবে আমারই সামনে এসে ।
কতজনে জানতে চায় বেঁচে আছি আজও কি তেমনই —
অথবা কীভাবে আজও তোমাকেই ভেবেছি প্রবাহ !
তোমার সঞ্চয় তবে মিথ্যে থেকে মিথ্যে হয়ে এল ?
আমারও প্রতীক্ষা তবে শেষ থেকে হয়ে এল শেষ ?
আগুন ছড়ায় আরও, কোথাও কিছুই নেই বাকি
পুড়ে যায় চক্ষুতারা, পুড়ে যায় দূরে বনস্থলী —
তবুও কীভাবে আজও তোমাকেই ভবিতব্য ভাবি !
যে-কথা কারোরই কাছে বলা যায় না — কীভাবে তা বলি !”
এর কী কোন ব্যাখ্যা দেওয়া যায়! শুধু অর্থ বা তাৎপর্য খুঁজতে গিয়ে কবিতাগুলো কাটাছেঁড়া না করে প্রিয় পাঠক গভীরভাবে ডুব দিয়ে দেখুন কবিতাটির মধ্যে। আমি নিশ্চিত আপনারা খুঁজে পাবেন অমিয়।কারণ কবি তো বলেছেন, “যে কথা কারোরই কাছে বলা যায় না–কীভাবে তা বলি!”
এইরকম বৈচিত্র্যময় বিষয়গুলো নিয়ে আকাশ-পাতাল প্রদক্ষিণ করতে করতে তীব্র অনুভূতির আবহে ডুব দিয়েছেন কবি। কিন্তু সেখানে আবেগের আতিশয্যে না ভেসে তিনি অনেক বেশি সংযমী। আর এই পরিমিতি বোধই তাঁর সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য বা পরিচয়।যা তাঁর জীবনযাপন,আচার আচরণে,এমনকি কবিতা যাপনে চির ভাস্বর হয়ে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমরা পড়ে নিতে পারি তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতাটি, “এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো/শব্দহীন হও/শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর/লেখো আয়ু লেখো আয়ু/ভেঙে পড়ে ঝাউ, বালির উত্থান, ওড়ে ঝড়/তোমার চোখের নিচে আমার চোখের চরাচর/ওঠে জেগে/স্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে স্তব্ধ/আয়ু/লেখো আয়ু লেখো আয়/চুপ করো, শব্দহীন হও” ( চুপ করো, শব্দহীন হও)। এখানে আয়ু লেখার আড়ালে কবির ইতিহাস চেতনার কথা ফুটে উঠেছে।না,এটা কোন রাজনৈতিক কবিতার কথা বলে না। বরং অনেক বেশি বিবেকের কবিতা হয়ে উঠেছে।পর নিন্দা না করে নিজেদের ভেতরের অতল গহ্বরের নৈঃশব্দ্যকে প্রস্ফুটিত করতে বলছেন তিনি এখানে।আমরা সবাই জানি,এই শব্দহীন থাকাটাই তাঁর পরিমিতি বোধের চুড়ান্ত রূপ।অযথা শব্দের ভারে ভারাক্রান্ত না করে কি করে কম কথায় অমোঘ সত্যকে প্রকাশ করা যায় তার উজ্জ্বল নিদর্শন কবি শঙ্খ ঘোষ।
সর্বপরি, বলা যায় মানুষের মঙ্গলব্রতে, মানবতার জয়গানে, তিনি ছিলেন চিরচঞ্চল। সমস্ত অপশক্তি, ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে অনমনীয় এক সৈনিক, যিনি পরশুরামের মতো কুঠারাঘাত করতে সদা প্রস্তুত থাকেন আঁধিপীড়িত শক্তির বিরুদ্ধে। কিংবা কলমও শাণিয়ে রাখেন সব বৈষম্য, অত্যাচার, পীড়নের বিরুদ্ধে অতন্দ্র প্রহরীর বেশে।তাই তো, তিনি ছিলেন শতাব্দীর জাগ্রত বিবেক।আর, জীবনের বিচিত্র অনুধ্যানে ছুটে বেড়িয়েও কাব্যজগতে তিনি সবসময় বিশেষ থেকে নির্বিশেষ হয়ে উঠেছেন।এই নির্বিশেষ হয়ে উঠার ক্ষেত্রভুমি তৈরি হয়েছিল তাঁর বহির্জগত ও অন্তর্জগতে যুগপৎ অনবিচ্ছিন্ন ভ্রমণে,যা তাঁর প্রজ্ঞা ও পরিমিতিবোধের ছোঁয়া পেয়ে ক্রমে অনন্যসাধারণ হয়ে উঠেছে।সেই সঙ্গে তাঁর মৌলিকত্বকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। আর,আমাদের দিয়েছে চরম বিপর্যয়ের মধ্যে জেগে ওঠার মন্ত্র। তাই কবি-প্রাবন্ধিক চিন্ময় গুহ বলেন, ‘ যখন চারপাশে মৃত্যুর রাক্ষসমুখ খোলা,শঙ্খ ঘোষের কবিতা যেন ধ্বংসের কিনারায় জীবন-পাথরের সামনে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে।’
তথ্যসূত্র:-
ক)শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা,(পরিবর্ধিত সংস্করণ)দে’জ পাবলিসিং, কলকাতা।
খ) কবিতার মুহূর্ত: শঙ্খ ঘোষ (অনুষ্টুপ প্রকাশনী,১৯৮৮)
গ)বাবরের প্রার্থনা (সপ্তদশ সংস্করণ,১৯৮৬), কবি শঙ্খ ঘোষ,দে’জ পাবলিসিং, কলকাতা।
ঘ)তুমি তো তেমন গৌরী নও(দ্বিতীয় সংস্করণ,১৯৭৪), কবি শঙ্খ ঘোষ,দে’জ পাবলিসিং, কলকাতা।
ঙ)‘কবি সম্মেলন’ পত্রিকা, ফেব্রুয়ারি,২০১২।
রবীন্দ্রোত্তর কবিতা বৈচিত্র্য:- সাহিত্য রংবেরং।
ছ)আনন্দবাজার পত্রিকা (অনলাইন সংস্করণ,২১ এপ্রিল,২০২১)।
ছ)বিভিন্ন অন লাইন পত্র-পত্রিকা ও গুগল-এ
শঙ্খ ঘোষ উইকিপিডিয়া।
তাজিমুর রহমান। কবি ও প্রাবন্ধিক। পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।