spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধকবি হিসেবে ব্রাত্য রাইসু দুষ্টু আছে

লিখেছেন : আবু তাহের সরফরাজ

কবি হিসেবে ব্রাত্য রাইসু দুষ্টু আছে

আবু তাহের সরফরাজ

নব্বইয়ের দশকের কবি হিসেবে রাইসু যতটা আলোচিত ও পরিচিত, আর কোনো কবি ততটা নয়। আলোচিত না বলে বরং সমালোচিত বলাই উচিত। রাইসুর কবিতা অনেকে স্বচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করেন, আবার অনেকে খুবই সতর্কতার সাথে বর্জন করেন। এহেন গ্রহণ-বর্জনের নানাবিধ হেতু রয়েছে। কবিতা বলতেই আমরা এতদিন দেখেছি প্রমিত ভাষার ব্যবহার। খুব সুললিত শব্দের কাব্যিক ব্যঞ্জনা। কবিতার শরীরে খুৃব মনোলোভা শব্দের বিন্যাসে বাংলা কবিতার পাঠক অভ্যস্ত। পাঠক ধরেই নিয়েছিল, মার্জিত ও সুললিত ভাষা ছাড়া কবিতা যেন কবিতা হয়ে ওঠে না। বিষয়টি স্বতঃসিদ্ধ প্রথার মতো দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ব্রাত্য রাইসু সেই প্রথাকে ভাঙলেন। ভেঙেচুরে একশা করে ফেললেন বাংলা কবিতার প্রমিত ভাষা রীতিকে। তিনি দেখালেন, প্রতিদিনের জীবনযাপনে আমরা যে ভাষায় কথা বলি সেই ভাষাতেও কবিতা লেখা যায়। কবিতার জন্য ভদ্রসমাজের প্রমিত ভাষা খুব জরুরি নয়। অবশ্যি মুখের ভাষায় কবিতা লেখার চেষ্টা তার আগেও অনেক কবিই করেছেন। কেউ কেউ সফলও হয়েছেন। কিন্তু রাইসু তাদের থেকে আলাদা। কবিতাকে ‘কবিতা’ হওয়া থেকে মুক্তি দিয়ে তিনি নামিয়ে এনেছেন ধুলোমাটির সংসারে। কবিতাকে করে তুলেছেন এক্কেবারে সাধারণ, খুলে ফেলেছেন কবিতার গায়ের জামা-কাপড়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এত খোলাখুলির পর তার কবিতা হয়তো উদোম হয়ে পড়েছে। আলঙ্কারিক সৌন্দর্য হারিয়েছে। তা কিন্তু মোটেও হয়নি। প্রমিত ভাষা ভাঙা আগের কবিদের থেকে এখানেই রাইসুকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায়। তার কবিতা ভদ্রলোকদের ড্রইংরুমের সুনসান নীরবতা থেকে নেমে এসে মিশে যায় বৃহত্তর জনস্রোতে। জনমানুষের ঘামের গন্ধে, যৌনতার অবদমনে, সাধারণ মানুষের ভাবনা-চিন্তায় মিশে যায় রাইসুর কবিতা। ‘রাস্তায়’ কবিতায় তিনি লিখছেন:

সকলে যেদিকে দৌড়ে চলেছে
সেদিকে তুমি কি যাবা না না নাকি?
ভোরবেলা ছিল অন্য রকমই
যত দিন হলো
আগেকার সব ঘটা ঘটনারা
একে একে সব ঘটতে চলেছে?

বাক্যগুলো প্রচলিত কবিতার কোনো চিহ্ন বহন করে না। কেমন যেন খাপছাড়া। কিন্তু খাপছাড়া বাক্যগুলোই রাইসু এমন এক ভঙ্গিতে বলছেন যে, তার বলার ভঙ্গিটাই কবিতা। এই অর্থে রাইসুর প্রতিটি কবিতাই রাইসুয়ীয় কবিতা। মানে, বাংলা কবিতায় রাইসু নিজস্ব একটি ঢঙ তৈরি করে ফেলেছেন। যে ঢঙে আর কোনো কবি কবিতা লেখেন না। অথবা হয়তো লিখতে পারেন না। ‘তুমি কি যাবা না না নাকি?’ এই প্রশ্ন-বাক্যটি আসলে গণমানুষের ভাষা। খুবই সাধারণ মানুষের মুখের কথা। কিন্তু রাইসু যখন লেখেন তখন তা কবিতার ভাষা হয়ে ওঠে। দেখা যাচ্ছে, কবিতা লিখতে গিয়ে রাইসু নিজের মতো করে ভাষা তৈরি করে নিয়েছেন। তার এই ভাষায় কিছু ক্যারিকেচার আছে। যেমন ওই বাক্যটি ‘তুমি কি যাবা না না নাকি?’— এখানে ‘না’ একবার লিখলেই চলতো। কিন্তু রাইসু লিখছেন দু’বার। এরকম ক্যারিকেচার তার প্রায় সব কবিতাতেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এটা পড়তে মজা লাগে। এই মজা ভদ্রলোকরা পাবে না, পাবে গণমানুষ। রাইসু গণমানুষের রুচিতেই তার বলার কথা লিখে ফেলেন কবিতায়, আর ভদ্রলোকদের নিয়ে মশকরা করতে থাকেন। ব্রাত্য রাইসু আসলে ইয়ার্কির কবিতা লেখেন। অন্তত তার বেশিরভাগ কবিতার ভেতরই এই ইয়ার্কির প্রচ্ছন্ন রূপটি ফুটে ওঠে। কেন ইয়ার্কি, কিসের ইয়ার্কি— সেই আলাপে যাওয়ার আগে ইয়ার্কি বিষয়ে আমাদের একটু ধারণা পেতে হবে। ইয়ার্কি মানে বন্ধুদের মাঝে ঠাট্টা, তামাশা কিংবা ফাজলামি। ইয়ার্কির এই তিনটি প্রতিশব্দ রাইসুর কবিতার ইয়ার্কির সঙ্গে ঠিকঠাক যায় না। কারণ, তার কবিতায় ইয়ার্কি আরও ব্যাপকভাবে কিংবা বলা যায় সূক্ষ্মভাবে কোনো ইঙ্গিত বহন করে। রাইসু কবিতার মধ্যদিয়ে ইয়ার্কি করেন সমাজের তথাকথিত সুশীলদের সঙ্গে। সুশীলদের অন্তঃসারশূন্য ফাঁপা ভাবমূর্তি নিয়ে রাইসু ইয়ার্কি করেন তার কবিতায়। সুশীল কারা? সমাজে যারা ভদ্রজনোচিত ভাবমূর্তি নিয়ে চলাফেরা করেন, অথচ ভেতরে ভেতরে প্রত্যেকেই এক একজন মিচকে শয়তান, রাইসু তাদের সেইসব শয়তানি প্রকাশ করে দেন তার কবিতায়। সমাজ-কাঠামো নির্মাণ করে কারা? এইসব সুশীলরাই। এটা সমাজসম্মত, এটা সমাজসম্মত নয়— সমাজজীবনে এরকম বিধি-নিষেধের বেড়া তুলে দিয়ে সুশীলরা নিজেরাই সেই বেড়া টপকে নানাবিধ সুবিধে ভোগ করে। অথচ বাইরে এরা নিপাট ভদ্রলোক। যেন, ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না! এদের প্রত্যেকের পকেটে লুকনো থাকে নানা আকৃতির ও নানা বর্ণের অদৃশ্য এক একটি মুখোশ। সময় ও সুযোগ বুঝে ব্যক্তিস্বার্থ-উদ্ধারে এরা সুবিধেমতো কোনো একটি মুখোশ পকেট থেকে বের করে টুপ করে মুখে পরে নেয়। ওই মুখোশকেই তাদের মুখ ভেবে তাদের সাথে মেলামেশা করে সাধারণ মানুষ। আর, ভুল করে। একটা সময়ে ভুলের খেসারতও অবশ্যি দিতে হয়। রাইসু তার কবিতার ভেতর দিয়ে হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেলেন সুশীলদের সেইসব মুখোশ। আর তখন বেরিয়ে পড়ে সুশীলদের প্রকৃত স্বরূপ। এই খোলার কাজটি করতে গিয়ে রাইসু ইয়ার্কির আশ্রয় নেন। খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে নয়, বরং হাসতে হাসতে রাইসু সুশীলদের মুখোশে টান মারেন। এখানেই রাইসুর কবিতা পড়ার মজা। যে যা নয় সে যদি তা সেজে থাকার ভান করে, তবে তা সমাজের জন্য মোটেও কল্যাণকর নয়। এই সত্য আমরা যাপিতজীবনে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারি। ঘরের পুষি বিড়ালটি যদি বাঘের মতো হুংকার দিয়ে বলে ওঠে, আমি বাঘ, তাহলে সত্যি সত্যিই সে বাঘ হয়ে যায় না। আর তাকে বাঘ হিসেবে মেনে নেয়াও যে বুদ্ধিমানের পরিচয় নয়, এই বার্তাই রাইসু আমাদেরকে জানিয়ে দেন। তবে এখানে রাইসুর কৃতিত্ব হচ্ছে, ইয়ার্কির ঢঙটি।
আমাদের সহজ পৃথিবী কবিতায় রাইসু লিখছেন, ‘বাসা পাহারা দেওয়ার জন্যে কুকুরেরা গলায় বেল্ট পরে বাসার সামনে চরকির মতো ঘুরতে থাকে। তখন তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অবলা বুদ্ধিজীবীদের মতো দেখায়।’ মাত্র দুটি বাক্যে দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মুখোশ হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেললেন রাইসু। এর আগে কবিতার প্রথম বাক্য হিসেবে তিনি লেখেন, ‘পৃথিবী মানুষের থাকবার জায়গা। এরপর মানুষের বসবাসের উপযোগী এই পৃথিবীর বর্ণনা দেন তিনি। মানুষের সঙ্গে আর কী কী প্রাণী পৃথিবীতে বসবাস করে, সেসবের সংক্ষিপ্ত একটা ধারণা তিনি পাঠককে দেন। যদিও পড়তে পড়তে পাঠকের মনে হবে, এসব কথা তো সবাই জানে, নতুন করে আবার জানানোর কী দরকার! কিন্তু দরকার যে আছে তা বোঝা যায় একেবারে শেষ বাক্য পড়ে। আসলে জানা কথাই রাইসু পাঠককে জানাতে থাকেন তার ইয়ার্কি ছুড়ে দেয়ার জায়গাটি প্রস্তুত করতে। জানা কথা রাইসুর কাছ থেকে জানতে জানতে পাঠক যখন একটু বিরক্তবোধ করতে থাকে, ঠিক তখনই রাইসু সুশীলদের যে কোনো একটি মুখোশ ধরে হ্যাঁচকা টান দেন, আর হাসতে থাকেন। ঠিক ওই মুহূর্তে পাঠকও একটু ভ্যাব্যাচ্যাকা খেয়ে পরমুহূর্তে হেসে ফেলেন কাকের দেহে লাগানো ময়ূরের পেখম খসে পড়তে দেখে। ঈশপের এই গল্পটি তো আমরা সবাই জানি। এরপরও আরেকবার পড়ে নিই।
এক বনে বাস করতো একটি দাঁড়কাক। একদিন উড়ে যাওয়ার সময় তার দৃষ্টি পড়লো একদল ময়ূরের দিকে। ময়ূরের পেখম দেখে সে মুগ্ধ। তারও খুব ইচ্ছে হলো ময়ূরের দলে যোগ দিতে। কিন্তু সে তো দাঁড়কাক! মনে-মনে বুদ্ধি এঁটে সে ময়ূরের পেখম কুড়িয়ে নিয়ে নিজের দেহে লাগালো এবং ময়ূরের দলে ভিড়তে চাইলো। কিন্তু ময়ূরের দল তাকে দেখে চিনে ফেলল। তারা তাকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিল। মনের দুঃখে সে ফিরে গেল দাঁড়কাকের দলে। কিন্তু তার দেহে ময়ূরের পেখম দেখে দাঁড়কাকেরাও তাকে তাড়িয়ে দিল। এরপর বেচারা দাঁড়কাক একা-একাই থাকতে লাগলো।
আমাদের সমাজের সুশীলরা প্রত্যেকেই আসলে এক একজন দাঁড়কাক। আমাদের সহজ এই পৃথিবীতে তারা যে জটিলতার সৃষ্টি করে, তাতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের সমস্যা হয়। কেননা, মানুষের বসবাসের পৃথিবী যেমন সহজ, তেমনই সহজ মানুষের জীবনধারা। এখানে যা কিছু জটিলতা, তার সবই ওই সুশীলদের সৃষ্টি করা। সহজ এই সত্যিই রাইসু বলতে চান তার কবিতার ভেতর দিয়ে। আর তা বলেন সুশীলদের মুখোশ খুলে ফেলে। এতে সুশীলদের জন্য বিব্রতকর আবহ তৈরি হলেও মুখোশ যিনি খুললেন আর যারা সেই দৃশ্য দেখলেন, উভয়েই হেসে ওঠেন। রাইসুর ইয়ার্কি তাই মহৎ, কোনোভাবেই নিন্দার্থে নয়। সুবিধেবাদী এই সমাজে মুখোশধারীর সংখ্যাই আসলে বেশি। মুখ ও মুখোশের প্রকৃত স্বরূপ এই সমাজে খুব বেশি একটা উন্মোচন হয় না।
রাইসু বড়লোকদের সঙ্গে মিশতে চান। এই মিশতে চাওয়ার আগ্রহের পেছনে লুকিয়ে আছে তার পরিকল্পিত ইয়ার্কি। কারণ, রাইসু জানেন বড়লোকদের জীবনযাপন পদ্ধতি আসলে ফাঁপা। বাইরে থেকে যতই চটকদার দেখাক না কেন, ভেতরে ভেতরে কতটা অসহায় ওরা। বড়লোকদের সব আছে। কত কিছু আছে। টাকা আছে। ভালো-ভালো খাবার-দাবার আছে। এরপরও তাদের মৃত্যুও আছে। মানে, সারা জীবনই যে বড়লোকরা তাদের বড়লোকি আয়েশ ভোগ করতে পারবে, তা নয়। রাইসু লিখছেন:

তবে বড়লোকদেরও শুনছি আব্বা আম্মা মারা যায়
ওরা তাতে অল্প অল্প কাঁদে।
বেশি দুঃখ পায় তাই কান্দে অল্প হাসে বেশি মদ খায়
আব্বা মারা গেলে।

ইয়ার্কি কোথায়, কীভাবে রাইসু ঢুকিয়ে দিয়েছেন বাক্যগুলোর ভেতর, তা নিশ্চয়ই ভেঙে বুঝিয়ে বলে দিতে হবে না। আর, যে ভাষায় তিনি কথাগুলো বলছেন সেই ভাষার কারুকাজ এতটাই নিখুঁত যে, এই ভাষা ছাড়া ওই কথাগুলো অন্যভাবে বললে কথাগুলোর ভেতর লুকিয়ে থাকা ইয়ার্কি আরোপিত হয়ে যেত। ইয়ার্কির স্বতঃস্ফূর্ততা থাকতো না। কবি হিসেবে রাইসু দুষ্টু আছে। সবসময় তার চেষ্টা থাকে, তার কবিতা যেন ‘কবিতা’ না হয়ে ওঠে। শেষমেষ তার সেই চেষ্টা সফলও হয়। তার কবিতা তথাকথিত কবিতা হয়ে না উঠে এমন এক রকম স্ট্রাকচার দাঁড় করায় যা বাংলা কবিতায় তার আগে আর দেখা যায়নি। কবিতায় শব্দ ব্যবহারেও তিনি সামাজিক বিধি-নিষেধের প্রাচীর ভেঙে ফেলেছেন। ফলে সামাজিক মানুষ রাইসুর কবিতা সহজভাবে পড়তে পারে না। চোদাচুদি শব্দটি অবলীলায় রাইসু তার কবিতার ভেতর ঢুকিয়ে দেন। যৌনতা নিয়ে সুশীলদের মতো রাখঢাক তার নেই। এ ধরনের কবিতা পড়তে বাঙালি পাঠক এখনো তৈরি হয়ে ওঠেনি। ‘বহুগামী কবিদের টাইডাল ওয়েভ’ কবিতা থেকে একটুখানি পড়ে দেখা যাক:

বুঝছ— তুমি একটি বারই ব্রেক আপ করবা
বয়ফ্রেন্ড ছেড়ে আইসা পড়বা…
শাহবাগেই কত পরীরা ঘুরছে,
ওরা ছোট কবিদের বন্ধু,
তোমারে ছাড়াও ওদের সঙ্গে করব—
বেংলা কবিতার মায়রে চুদব
পেয়ারার গাছে দাঁড়কাক আছে
চোদাচুদিময় বাংলা।

রাইসু কোনো একজন সুন্দরীকে প্রলুব্ধ করছেন। এরপর বলছেন, শাহবাগে কবিদের আড্ডায় অনেক সুন্দরী যৌনতার উত্তাপ ছড়ায়। রাইসু সেসব কবিদের ছোট কবি হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। এখানে উহ্য থাকে যে, সুন্দরীরা সাধারণত মেধাবী পুরুষদের শয্যাসঙ্গিনী হয় না। কারণ, যে যত সুন্দরী তার মেধার ঊর্বরতা তত কম। ফলে তাদের মেলামেশা ছোট কবিদের সাথে। রাইসুর আকাঙ্খা যে, প্রথমোক্ত সুন্দরীর সাথে তিনি ‘করবেন’, এরপর ছোট কবিদের সাথে ঢঙ করতে থাকা সুন্দরীদেরকে ‘করবেন’। এর ব্যাখ্যা হিসেবে তিনি বলছেন, চোদাচুদিময় বাংলা। রাইসুর বলাবলিতে কোনোই রাখঢাকা নেই। আকাঙ্ক্ষার কথা খোলাখুলি তিনি বলে দিচ্ছেন। এটা ভালো। এখানে কপটতা নেই। সুন্দরী নারী দেখলে কোন পুরুষ আছে যে, ‘করতে’ চায় না? অথচ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে সে কী লজ্জা তাদের! যেন এসব কথা বললে পৃথিবী তার কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে ছিটকে পড়বে। ঠারেঠোরে সুন্দরীদের লোভনীয় স্থানগুলো দেখে নিয়ে কল্পনায় ‘করতে’ তাদের সমস্যা নেই, সব সমস্যা আকাঙ্ক্ষার কথা খোলাখুলি বলে ফেলতে। এই কপটতা রাইসুর পছন্দ নয়। তবে এও সত্যি যে, যৌনতার একটি সীমারেখা আছে। মানুষের প্রবৃত্তির জগতে কু ও সু নামের দুটি বিপরীত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ফলে আকাঙ্ক্ষাকে সংযত করা ওই সুপ্রবৃত্তির দাবি। এসব অবশ্যি তাত্ত্বিক কথা। সহজ কথা হচ্ছে, যে পুরুষ আড়চোখে সুন্দরীর সৌন্দর্য দ্যাখে আর মনে মনে ‘করতে’ থাকে সেই পুরুষ কপট। মেরুদণ্ডহীন। রাইসু আকাঙ্ক্ষাকে অবদমন করেন না। তিনি সরাসরি সুন্দরীকে বলে দেন তার বিশেষ খায়েশের কথা। আর তাই, রাইসুকে ঘিরে কবি-পাড়ায় বেশ সমালোচনা আছে। এমনকি, সহজে তার সঙ্গে অনেক কবিই মিশতেও চান না। এতকিছুর পরও রাইসু কিন্তু রাইসুই। রাইসুর বিকল্পও রাইসু নিজেই। একথা লিখছি কারণ, রাইসুর কবিতায় তথাকথিত অশ্লীলতা থাকলেও কোথাও শিল্পসুষমা এতটুকু বিঘ্নিত হয়নি। তবে এও সত্যি যে, প্রচলিত শিল্পবলয় রাইসুর কবিতা ভেঙে ফেলেছে। তার বদলে বরং শিল্পের নতুন মেরুকরণ তৈরি করেছে তার কবিতা। বাংলা কবিতায় রাইসুর এহেন আধিপত্যে নব্বই-উত্তর কোনো কোনো কবি তাকে অনুসরণ করতে চেষ্টায় রত হয়েছে। তবে আশানুরূপ ফল তারা কেউ-ই পায়নি। কারণ, এসব কবি কেবল দেখেছে রাইসুর কবিতার অশ্লীলতা ও ইয়ার্কি। তার ভেতর লুকিয়ে থাকা শিল্পের সূক্ষ্ম সুষমা তাদের চোখ এড়িয়ে গেছে। ফলে, রাইসুর উত্তরসূরী হতে গিয়ে তারা প্রকৃত অর্থে তাদের কবিতার স্বকীয় রূপটিই হারিয়ে ফেলেছে।
রাইসু বড়লোকদের সঙ্গে মিশতে চাইলেও ব্যক্তিজীবনে তার সেই প্রচেষ্টা আমার চোখে পড়ে না। যেখানে কত কত কবির দল রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার তোষামোদি করে উঁচু উঁচু পদে আসীন হয়ে বসে আছেন, সেখানে রাইসু নিজেরই মুদ্রাদোষে একা থেকে গেছেন। ক্ষমতাধরদের তোষামোদি তো দূরের কথা, সাধারণ কোনো সাহিত্য সভাতেও তাকে দেখতে পাওয়া যায় না। এখানেই ব্রাত্য রাইসুর স্বকীয়তা, নিজস্ব শিল্পের বলয়।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ