আবু তাহের সরফরাজ
কবিতার সৌন্দর্য বলতে আমরা আসলে কী বুঝি? প্রথমত, কবিতার শরীরে শব্দের কারুকাজ দেখে। যে কবিতায় শব্দের কারুকাজ যত নিখুঁত, সেই কবিতার শরীর থেকে শিল্পের সৌন্দর্য পাঠকের চোখে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। শব্দের যথেষ্ট বুনন নয়, বরং শব্দ ব্যবহারের পরিমিতিবোধেই কবিতায় শব্দের কারুকাজ নান্দনিক হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, কবির বোধের জগতের নানা রকম কলস্বর কী উপায়ে ঢেউ তুলছে কবিতায়, সে বিষয়টি। বোধের কলস্বর শব্দের বাহনে চড়িয়ে কবিতায় তুলে আনা খুবই মুশকিলের কাজ। বোধের স্ফুরণ তো সহজে ধরা দেয় না। এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বেশ আক্ষেপ ছিল। তিনি লিখেছেন, ‘কিছু তার দেখি আভা/কিছু পাই অনুমানে/কিছু তার বুঝি না বা।’ আর তাই তো কবি কান পেতে থাকেন বোধের গহন দরজায়। এভাবে কান পেতে যা কিছু তিনি শুনতে পান সেসব দিয়েই নির্মাণ করেন কবিতা। সেই কবিতা পাঠে পাঠকের বোধেও যদি ঢেউ ওঠে তাহলে আমরা বলব, সেই কবিতা শিল্পোৎকর্ষে অনন্য। শিল্পসুষমায় সেসব কবিতার বিশিষ্ট একটি রূপ ধরা পড়বে পাঠকের চোখে। নয়ন আহমেদের কবিতা পড়তে পড়তে পাঠক সহজেই কবিতার অন্তর্নিহিত গহনে ডুব দিতে পারে। কারণ, তার কবিতায় শব্দের ওপর জোরপ্রয়োগ নেই। মানে প্রকাশের দায় থেকে কবিতার অবয়বে শব্দ যেন নিজের থেকেই জায়গা করে নিয়েছে। সেসব কবিতা পাঠে পরিষ্কার হয়ে ওঠে, কবিতা তিনি লেখেননি। কবিতাই তাকে মাধ্যম করে নিজেকে প্রকাশ করেছে। ‘যৌথ’ কবিতায় নয়ন আহমেদ লিখছেন:
নরম রোদের তক্তপোষের
মগ্নতা—
ঝুলিয়ে দিলাম চোখ দুখানির
স্বল্পতা।
চোখের ভেতর নদীর ভাষা
ডুবানো;
প্রেমের কাব্য লাল কালিতে
চুবানো।
ওপরের পঙক্তিগুচ্ছ ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত ছন্দের মিশেলে তৈরি হয়েছে। প্রথম চার লাইন ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্ত। কিন্তু দ্বিতীয় চার লাইনের ‘নদীর ভাষা’ ও ‘লাল কালিতে’ ছয় মাত্রা অনুপস্থিত। ফলে, এখানে স্বরবৃত্তের ঝোঁক প্রকট হয়ে উঠছে। কিন্তু একটু টেনে পড়লে ছয় মাত্রা পূরণ করে দেয়া যাচ্ছে। আমার ধারণা, কবি ইচ্ছে করেই এই খেলাটি খেলেছেন। আর এই খেলায় সাফল্যের সঙ্গে তিনি উতরেও গেছেন। এই কবিতায় ব্যবহৃত শব্দগুলো কবি লেখেননি, কবিকে দিয়ে শব্দগুলো নিজেই লিখিত হয়েছে। এই সত্য যে কোনো সচেতন পাঠককে স্বীকার করতেই হবে। শব্দগুলো প্রাণস্পন্দনে সজীব। নীরস নয়, কাঠখোট্টা নয়। শব্দগুচ্ছ দিয়ে নির্মিত বাক্যগুলো কী মানে প্রকাশ করতে চাইছে, কবিতা পড়ার সাথে সাথেই তা পাঠকের মাথায় ভেতর ছবির পর ছবি হয়ে আঁকা হয়ে যাচ্ছে। পাঠকের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে না। ‘হিংসা’ কবিতায় নয়ন আহমেদ লিখছেন:
শুয়ে আছে হিংসা মানুষের কোমর জড়িয়ে, গলা ধরে।
পরস্পর হাত ধরে, আলিঙ্গনে
করে যৌথসভা; ভাববিনিময়।
মত্ত তারা এইসব প্রেমালাপে। প্রেম মানে—
আগুন আগুন খেলা; পুড়ে হবে ছাই
মানব-বসতি, সভ্যতার রাতকানা রোগ হবে।
আর যত গোলাপ-বাগান
হবে তছনছ মুহূর্তেই। হিংসা বড় কারুকাজ জানে!
মানুষের প্রবৃত্তির মারাত্মক একটি কুপ্রবৃত্তি হচ্ছে হিংসা। হিংসার বৈশিষ্ট্য এমন যে, তা মানুষকে মানুষ থেকে অমানুষে নামিয়ে আনে। হিংসার প্রাবল্যে মানুষ হারিয়ে বসে তার মানবিক বোধ। ধ্বংসাত্মক এই হিংসার নানামাত্রিক প্রকাশকে উপজীব্য করে এমন চমৎকার কবিতা এর আগে আমার চোখে পড়েনি। খুবই সহজ ভাষায় পরিচিত নানা উপমা-উৎপ্রেক্ষায় কবি হিংসার স্বরূপ পাঠকের চোখে উপস্থাপন করেছেন। ভাষা মানে শব্দগুলো আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহারিক হলেও এক একটি শব্দ যে অর্থময়তা ছড়িয়ে দিচ্ছে, তা হৃদয়ঙ্গম করতে পাঠককে বোধের ভেতর ডুব দিতে হয়। মানুষের কোমর জড়িয়ে, গলা ধরে হিংসা শুয়ে আছে। কী চমৎকার উপমা! বাক্যটি পড়ার সাথে সাথেই মানুষের গলা ধরে শুয়ে থাকা হিংসার ছবিটি পাঠক মনের চোখে দেখতে পান। আর উপলব্ধি করেন, হিংসা তারও গলা ধরে, কোমর জড়িয়ে শুয়ে আছে। এই উপলব্ধি পাঠককে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। সহজ এই সত্যি পাঠককে নতুনভাবে নিজের সত্তাকে আবিষ্কার করতে উৎসাহী করে তোলে। যখন পাঠক জানতে পারেন, হিংসার সাথে প্রতিমুহূর্তে তার প্রেমালাপ হচ্ছে। হিংসার সাথে প্রেমালাপ কেন হবে? হিংসা কি মানুষের প্রিয়তমা? একটু গভীরভাবে ভাবলেই উদ্ঘাটিত হবে যে, হিংসার সাথে মানুষ যেভাবে জড়িয়ে আছে তাতে মনে হতেই পারে, হিংসা যেন মানুষের বড়ই আপনজন। আর তাই, মানুষ প্রতিমুহূর্তে হিংসার সাথে প্রেম করে যাচ্ছে। এই প্রেমের স্বরূপ কী? কবি বলছেন আগুন-আগুন খেলা। এই আগুনে মানুষের বসতি পুড়ে খাক হবে। লাখ লাখ বছরের দীর্ঘ প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা মানুষের সভ্যতার রাতকানা রোগ হবে। রাতকানা রোগ এখানে প্রতীকী। আমরা জানি, আগুনের উপস্থিতিতে রাতের অন্ধকার দূরীভূত হয়। কিন্তু হিংসার আগুনে পুড়ে সভ্যতা রাতকানা রোগে আক্রান্ত হবে। ফলে, আগুনের ধ্বংস-তাণ্ডবের কিছুই সভ্যতার চোখে পড়বে না। সভ্যতা এখানে নির্বিকার। এই হিংসার আগুনে মানুষের সৌন্দর্যবোধও নষ্ট হয়ে যাবে। যেমন তছনছ হবে গোলাপ-বাগান। এতসব কিছু ঘটবে কারণ, হিংসা বিচিত্র কারুকাজ জানে। কখন কিভাবে কী করতে হবে, সেই কৌশল হিংসার নখদর্পনে। ফলে, হিংসার প্রতিটি তাণ্ডবই কারুকার্যখোচিত। এই কারুকাজে মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। মানুষ বুঝতেও পারছে না, মনোলোভা কারুকাজের আড়ালে হিংসা দেখতে আসলে দৈত্যের মতো কুৎসিত ও ভয়ঙ্কর। নিপাট সাদামাটা বর্ণনায় কী গভীর উপলব্ধি! পাঠকের মুগ্ধতা বাড়ে এর পরের পঙক্তিগুলো পাঠে। এইভাবে পাঠককে গতির মধ্যে রাখা যে কোনো উৎকৃষ্ট কবিতার প্রধান গুণ। অথচ এই কবিতায় ছন্দের কোনো কারবার নেই। তাহলে পাঠককে গতিশীল করে তুলছে কি? এর জবাব, বিষয়। একইসঙ্গে বিষয়কে নানা উপমায় সজ্জিতকরণ। এসব কারণেই সাধারণ ভাষায় নির্মিত এই কবিতাটি হয়ে উঠেছে অসাধারণ। বিশেষ করে কবিতাটির শেষ বাক্য ‘হিংসাদের নেই কোনো সবুজ ইউনিফর্ম-পরা মহাকাল; চিরদিন।’
এ ধরনের কবিতা অনেক লিখেছেন নয়ন আহমেদ। প্রতিটি কবিতাই পাঠককে শিল্পের আস্বাদ তো দেয়ই, পাশাপাশি নিজের সত্তাকে নতুনভাবে উন্মোচনে উৎসাহী করে তোলে। এসব কবিতা যেন এক একটি আয়না। যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পাঠক নিজেকেই দেখতে পায়। এখানে বলে রাখা ভালো, যে কোনো শিল্পই আসলে জীবন ও জগৎকে দেখার আয়না। শিল্পের যে আয়না যত স্বচ্ছ সেই আয়নায় তত পরিষ্কারভাবে জীবন ও জগৎকে দেখতে পায় পাঠক কিংবা দর্শক। মানুষের জীবন তো আসলে একঘেয়ে। ছকে বাঁধা। কিন্তু মানুষের বোধের জগৎ সীমাহীন। সেই জগৎ কোনো বাঁধাধরা সীমারেখা মানে না। অনেকটা নজরুলের ওই পঙত্তির মতো, ‘থাকব না কো বদ্ধ ঘরে/দেখব এবার জগৎটাকে।’ কিন্তু চাইলেও মানুষ নিজের সীমা ভেঙে জগৎ দেখতে বেরিয়ে পড়তে পারে না। আর তাই, শিল্পের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখার এই কাজটি সেরে নেয়। নয়ন আহমেদের বেশিরভাগ কবিতার আয়না স্বচ্ছ। সেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পাঠক সহজেই জীবন ও জগতের বৈচিত্র্য দেখতে পারে। ‘শুরু’ কবিতাটি পুরোটাই পড়ে নেয়া যাক:
শুরু করতে পারো পাতা থেকে, সব পদ্যে লেখা।
আপাদমস্তক আবৃত; বোরকাওয়লি তার কিছুটা কি জানে?
বাকিটা গোপন? ছন্দে লেখা কিছু শব্দঘ্রাণ!
এই হেমন্তের কোঠরে কোঠরে আছে জন্মবাস্তবতা। সূর্যরেণু।
হয়তো তুমিও চাও পাতাযুক্ত নিষিক্ত আগুন। জলপাই জলপাই অগ্রহায়ণ।
গৃহকোণ আছে; ধানে ধানে ঝাড়ো পার্থিবতা।
পাবে পদাবলি; হয়তোবা সামান্যই। হয়তোবা চালঝাড়া খুদ।
তবু নয় নতজানু।
স্থির হয়ে আছে সংলগ্ন বাহুতে;
শাশ্বত। প্রীতির লিখন।
শুরু করতে পারো পাতা থেকে শেকড় অব্দি।
সব পদ্যে লেখা। নিষ্ঠাবান গৃহী আগুন।
আছে একবিন্দু মেঘের বারান্দা-ঘেরা জল ও জীবন।
পাতা শব্দটি পড়ার সাথে সাথেই পাঠকের চোখে সবুজ রঙ শান্তি বুলিয়ে দেয়। শান্তিই তো মানুষের জীবনের পরম আরাধ্য। তাই হয়তো কবি পাতা থেকেই শুরু করতে বলছেন। আরও বলছেন, সবকিছুই নাকি পদ্যে লেখা। একটু ভেবে দেখলে আমাদের জীবনে পদ্যের লিখিত রূপটি পরিষ্কার হয়ে ফুটে ওঠে। জীবন যতই একঘেয়ে হোক, জীবনের স্পন্দন কিন্তু ছন্দময়। স্থবির নয়। বাইরের জীবনটাই তো কেবল মানুষের একমাত্র জীবন নয়। এরই সাথে প্রত্যেক মানুষের ভেতরও রয়েছে আরেকটি জীবন। আসলে যে জীবন মানুষ যাপন করে, তা সে যাপন করতে চায় না। সে চায় তার আকাঙ্ক্ষার জগতের জীবনকে যাপন করতে। এই দ্বন্দ্ব্বে পড়েই মেসমার মানুষ, সংসার ও হৃদয়ঘটিত জীবন। বলা চলে, মানুষ আজ ক্লান্ত আর বিষণ্ণ। মানুষ আজ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ একা। এই যদি হয় মানুষের যাত্রাপথ, তাহলে মানুষ বেঁচে থাকে কেন? যাপিতজীবনে মানুষ আসলে বেঁচে থাকে না। মানুষ বেঁচে থাকে তার আকাঙ্ক্ষার জগতে। এই আকাঙ্ক্ষার জগৎ মানুষের সৌন্দর্যবোধ দিয়ে তৈরি। এই বোধ পদ্যের মতো ছন্দমুখর। এই ছন্দের দোলায়িত তরঙ্গেই মানুষের অন্তর্জগৎ আপাতমস্তক আবৃত। তার খুবই অল্প কিছু হয়তো কবি কবিতায় তুলে আনতে পারেন। তবে পুরোপুরি নয়। তাই হয়তো নয়ন আহমেদ বলছেন, ‘ছন্দে লেখা কিছু শব্দঘ্রাণ’। মানে, বোধের অন্তর্লীন কিছু ঘ্রাণ শব্দের ভেতর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া শব্দের আড়ালে বাকি জীবনটা গোপনেই থাকে। ‘জাতীয়তা’ কবিতায় নয়ন আহমেদ লিখছেন:
মাটির ওপর রোদ লেগে ঝলমল করছে
আর মাটিতেই জন্ম নিচ্ছে তাবৎ উদ্ভিদ
ছড়িয়ে পড়ছে লোকালয়,বসতি, প্রেম।
মানুষের সংসার লিখে যাচ্ছে সভ্যতার নাম।
পরিষ্কার একটি ছবি আমরা দেখতে পাই ওপরের পঙক্তিগুচ্ছ পাঠে। মাটির ওপর রোদ পড়ে ঝলমল করছে। আর রোদ ঝলমল এই মাটিতে জন্ম নিচ্ছে উদ্ভিদ, এবং বেড়ে উঠছে। বলা দরকার, উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার জন্য রোদ অপরিহার্য। নয়ন আহমেদ বিজ্ঞানের এই গূঢ় সত্য এখানে উহ্য রেখেছেন। কিন্তু প্রথম বাক্যেই বৈজ্ঞানিক সত্য পরিস্ফূট হয়ে ওঠে। কেননা, দ্বিতীয় বাক্যেই তিনি জানাচ্ছেন, মাটিতেই জন্ম নিচ্ছে উদ্ভিদ। তৃতীয় বাক্যে কবি সভ্যতার বিকাশ সম্বন্ধে কথা বলছেন। বলছেন যে, ‘ছড়িয়ে পড়ছে লোকালয়, বসতি, প্রেম।’ উদ্ভিদের সঙ্গে মানুষের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মূলত উদ্ভিদের ওপরই নির্ভর করে মানুষের লোকালয়। লোকালয় মানেই সংসার, প্রেম, সমাজ ও সভ্যতার বিকাশ। কবি বলছেন, ‘মানুষের সংসার লিখে যাচ্ছে সভ্যতার নাম।’ মানুষের হাতেই তো সভ্যতার নির্মাণ। চারটি মোটে বাক্য, অথচ কত কিছুই না কবি বলে ফেললেন। তার এই বলাটা আমার কাছে গণিতের মতো মনে হয়েছে। এক ও এক যোগ করলে যেমন দুই হয়, তেমনই মাটি, রোদ, উদ্ভিদ, লোকালয়, প্রেম ও সভ্যতা শব্দগুলো পরপর সাজিয়ে কবি বলছেন, এদের যোগফল সভ্যতা। বোধের কী চমৎকার পারম্পর্য। ‘জাতীয়তা’ কবিতার শেষ তিনটি বাক্য এবার পড়া যাক:
সব মানুষের জন্য এই ভূখণ্ড
সবার জন্য এই পৃথিবী।
তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের জাতীয়তা— প্রেম।
ওপরের প্রথম ও দ্বিতীয় বাক্যে কবি সর্বজনীন সত্য ঘোষণা করছেন। বলছেন, মাটি, রোদ, উদ্ভিদ, লোকালয়, প্রেম ও সভ্যতা দিয়ে আজকের যে পৃথিবী গড়ে উঠেছে সেই পৃথিবী সব মানুষের। যদি তাা-ই হয় তাহলে নিশ্চয়ই মানুষের জাতীয়তা প্রেম। মানুষের এই জাতীয়তা জানার পর পাঠক ভাবতে বসে, প্রেমের শ্বাশত রূপ যদি সর্বজনীন হয় তাহলে আজকের পৃথিবীতে এত রক্তপাত কেন? এত হিংসা কেন? এর জবাব কবি নিজেও জানেন না। আর তাই তো ‘হাততালি’ কবিতায় তিনি লিখছেন:
একটি হাত উড়ে গেল বাচ্চাটির;
যেমন পাখি ওড়ে।
এই ধাবমান দ্রুততায় কাঁদল ঘাসফড়িং;
টুকরো টুকরো পাথরকণা, মধ্যপ্রাচ্যের একছড়া খেজুর—
আর চিৎকার করে কাঁদলো তার অন্য হাত, মাথা ও চোখ।
তার পা ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো।
বোমা বিস্ফোরণে একটি শিশুর উড়ে যাওয়া হাতের সাথে উড়ে যাওয়া পাখির তুলনা এককথায় অসাধারণ। অনন্য। কবির কবিসত্তার সৃষ্টিকুশলতা প্রকাশ করে। একইসঙ্গে পাঠকের চোখকে করে তোলে অশ্রুসিক্ত। যে দ্রুততায় শিশুর হাত পাখির মতো উড়ে গেল তা দেখে কেঁদে উঠল প্রকৃতির নিরীহ একটি জীব ঘাসফড়িং, মধ্যপ্রাচ্যের খেজুর। মধ্যপ্রাচ্য বলায় আমরা বুঝতে পারি, ওই শিশুটি আসলে ইজরায়েলি বর্বরতার শিকার গাজা উপত্যকার একটি শিশু। একটি হাত হারিয়ে শিশুটি তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। প্রতিদিন এইভাবে কত যে শিশু মৃত্যুর যন্ত্রণা ভোগ করছে ইজরায়েলি হামলায়, তার হিসাব প্রতিদিনই আমরা নিউজ পোর্টালে পড়ছি। কিন্তু পড়া পর্যন্তই। ইজরায়েলকে নিয়ন্ত্রণ করতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ আমাদের চোখে পড়ে না। জাতিসংঘও ইজরায়েলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ইহুদি এই জাতিটির হিংসাত্মক উন্মাদনা এখন লাগামহীন। এক পৃথিবীর অধিবাসী হয়ে যে মানুষের জাতীয়তা হওয়া উচিত ছিল প্রেম, সেই মানুষের জাতীয়তা এখন হিংসা। আর হিংসার ফলাফল রক্তপাত।
এইভাবে কবিতার ভেতর দিয়ে জীবনকে উল্টেপাল্টে দেখতে থাকেন কবি। যে উপমা কিংবা শব্দ তিনি লিখে চলেন তা সহজ ও স্বাভাবিক গতিতেই ধ্বনির বহুমুখি ব্য না ছড়াতে থাকে। বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায়, উপমা ও উৎপ্রেক্ষায় নয়ন আহমেদ কবিতার বিশিষ্ট এক রূপ নির্মাণ করেন। ফলে তার কবিতার ভেতর দিয়ে পাঠক জীবন ও জগৎকে নানা অ্যাঙ্গেল থেকে দেখার সুযোগ পায়। প্রতিদিনের যাপিত জীবনের বাইরে গিয়ে শিল্পের আয়নায় দেখা জীবন ও জগৎ বিশ্বস্ত কারুকাজে ছড়িয়ে থাকে নয়ন আহমেদের কবিতার পরতে পরতে। পাঠক উপলব্ধি করে, শিল্পের অনন্য এক আস্বাদ।
খুব ভালো লেগেছে লেখাটা। এই লেখাগুলো নিয়ে একটা বই হতে পারে।
প্রিয় কবি নয়ন আহমেদকে যথার্থভাবে ফুটিয়ে তোলা একটি ঋদ্ধ আলোচনা, চমৎকার
কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলা রিভিউ-এর কর্ণধার কবি সাজ্জাদ বিপ্লবকে ও আলোচক বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক– সরফরাজ খানকে।
তিনি যথেষ্ট সুন্দর লেখেন।
যুক্তিগ্রাহ্য আলোচনা করেন তিনি।
শ্যামল কান্তি দাস সম্পর্কে আবু রাইহানের লেখা পড়লাম॥ভালো রেখা॥লেখক কে ধন্যবাদ।