মঈনুস সুলতান
জলাশয়ে ফুটে ওঠা শাপলার মতো আমার এলোমেলো ভাবনার সাথে কীভাবে যেন কবিতার প্রসঙ্গ মিলেমিশে আছে, একটি থেকে অন্যটিকে বিচ্ছিন্ন করা খুবই মুশকিল। আর এ নিয়ে ভাবলেই স্মৃতির ছোট্ট হাঁস যেন জলজগুল্মের ভেতর দিয়ে একেবেঁকে ভেসে.. ..ডুবসাঁতারে বয়সের অতল থেকে তুলে আনে শ্যাওলা মাখানো শামুক। মনে পড়ে, খুব ছোটবেলা ছনে ছাওয়া নির্জন এক বাংলাঘরের অন্ধকার কোণে অযত্নে ফেলে রাখা ভাঙ্গা পাল্কিতে জানালার নক্সার দিকে তাকিয়ে পেয়েছিলাম চমৎকার কিছু পংক্তি। কখনো শিরাজি কুতুবখানা বলে একটি পারিবারিক লাইব্রেরীর বইপত্র ঘেঁটে কেটে যেত নির্জনতা। কাঁচভাঙ্গা আলমারির শেল্ফে মাকড়শার জালে জড়ানো রুবাইয়াতে খৈয়াম বা বন্দে আলী মিয়ার ময়নমতির চর এর পৃষ্টা উল্টাতে উল্টাতে গোধূলি অতিক্রম করে ঘরে নামতো সাঁঝের নিবিড় অন্ধকার; আর আমি হ্যারিক্যানের আলোয় কিছু শব্দের সমাহারে মুসবিধা করতাম কবিতার খসড়া।
এরপর তো অনেক বছর পরবাসে। তবে পরিযায়ী পাখির মতো ফিরে এসেছে মনে কখনো কখনো কবিতার প্রসঙ্গ, আর সাথে ফেব্রুয়ারী মাস ও লিটিল ম্যাগাজিনের অবধারিত অনুসঙ্গ। কাজ করছিলাম মোজাম্বিকে। চাকুরী থেকে অব্যাহতি পেয়ে ফিরে এসেছি যুক্তরাষ্ট্রের মফস্বল শহরে। বেশ রাত করে বসে আছি একটি ইথিওপিয়ান রেস্তোরাঁয়। এ শহরের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বছর কয়েক আগে লেকচারার হিসাবে কাজ করেছি। পথঘাটও চেনা। বিল মিটিয়ে ফুটপাতে নামতেই দেখি—একটি মেয়ে, ছাত্রী হবে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় বর্ষের, শরীর বাঁকিয়ে উঁবু হয়ে রঙিন খড়ি দিয়ে ফুটপাতে আল্পনা আঁকছে। তার নিরাভরণ পা ও বাহুর সঞ্চালনে সৃষ্টি হয়েছে মনোজ্ঞ একটি জ্যামিতির। না, শুধু নকশাই আঁকছে না সে, সাথে বড় বড় হরফে লিখছে একটি প্রশ্ন— ‘হোয়াট ইজ পোয়েট্রি?’ সড়কে আঁকাজোকা স্পষ্টত আইনের খেলাফ, কিন্তু এতরাতে তা প্রয়োগ করার মতো কেউ আশেপাশে নেই। আল্পনাতে ভিন্ন রঙের খড়ি বুলিয়ে সে সোজা হয়ে রোড-ক্রসিং এ এসে দাঁড়ায়। ট্যাফিক সিগনালের লাল বাতির দিকে তাকিয়ে, শর্টসের হিপপকেট থেকে বের করে ব্রাউন পেপারে মোড়া ছোট্ট বোতল। আলো সবুজ হতেই পান করতে করতে সে পেরিয়ে যায় জেব্রার ডোরাকাটা দাগ। কিন্তু এ দৃশ্যপট ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলো, স্বদেশে ফেব্রুয়ারী মাসে কবিতায় মোড়া লিটিল ম্যাগাজিন ও আল্পনা আঁকা সড়কের কবোষ্ণ স্মৃতি। আর অনেকদিন কিছু না লিখতে পারার লাল সিগনাল মুছে গিয়ে মন ভরে ওঠেছিলো সৃজনের সিগ্ধ সবুজ আলোয়।
হোটেলে ফেরার পথে বাসস্টপের কাঁচের শেডে এসে দেখি, মেয়েটি বেঞ্চে আধশোয়া। দূরের ল্যাম্পপোস্টের আলো এসে পড়ছে তার বিভাজিকায়; আর অত্যন্ত পরিষ্কার উচ্চারণে কিছু সে আবৃত্তি.. .. না, আবৃত্তি নয়, সে যেন গাইছে.. .. চমৎকার সুর খেলছে তার গলায়। গানের কথাগুলো আমি নোটবুকে টুকে নেই: “বেইবি, আই ডোন্ট নো দ্যাট আই ক্যান সে ইট/ ডোন্ট নো ইফ মাই মাউথ ক্যান ফর্ম দ্যা ওয়ার্ডস্ /আই ওয়ান্ট ইউ টু জাস্ট আন্ডারস্ট্যান্ড ইট/ টু বি সো মাচ এ পার্ট অব মি/ ইট ক্যান বি লেফ্ট আনস্পোকেন..।”
আজ আমি কবিতা থেকে অনেক অনেক দূরে। তার পরও কবিতার প্রসঙ্গ ভাবলেই মনে উঁকি দেয় এ স্মৃতিপট। মনে হয়, ‘পার্ট অব মি’, আমারই অবচেতনের একটি অংশ থেকে গেছে ‘আনস্পোকেন’, এ না বলা বিষয়টিকে অনুভব করি, মনে হয় বিমূর্ত, কখনো স্বতস্ফূর্ত ভাবে বেরিয়ে আসে তা শব্দে.. রূপকল্পে, প্রকাশিত হয় ভাবে, ভালোবাসায় ও গল্পে।