সাজ্জাদ শাহরিয়ার
কর্ম সূত্রে বরিশাল গমন। প্রাচ্যের ভেনিস খ্যাত বরিশাল! উত্তেজনা ছিলো, সেই সাথে ছিলো উৎকন্ঠা। ভেনিস নগরীতে যাচ্ছি, তাই উত্তেজনা। অপরদিকে জীবনে বলতে গেলে প্রথম বার। বলতে গেলে এ জন্য যে, খুব ছোটোকালে অর্থাৎ ছেলেবেলার বয়সে বাবার সাথে একবার গিয়েছিলাম পিরোজপুর। তখন হয়তো বরিশালের একটা মহকুমা ছিলো পিরোজপুর। এবার যাচ্ছি একা। সাত নদী একশ তেরো খাল পেরিয়ে বরিশাল, ভাবা যায়? আত্মীয় স্বজন নেই, পরিচিত মুখ নেই, স্ত্রী-পুত্রদের নিতে পারছি না অনিবার্য কারণে। কীভাবে সেখানে সময় কাটাবো? বলতে গেলে– পোস্টিং এর কথা শুনে কিছুটা মুষড়ে পড়েছিলাম। তদুপরি নদী-খালের দেশ, কীভাবে যাবো, কিভাবে সময় কাটাবো? –তাই নিয়ে উৎকণ্ঠার শেষ নেই।
গোঁড়াতে উৎকন্ঠার কারণও ঘটলো। ঘটনা এমন–পুরান ঢাকার সেই চিরপরিচিত ও জনপ্রিয় যানজট ঠেলে যখন সদরঘাটের পন্টুনে পৌঁছলাম তখন রাত সাড়ে আট। বরিশাল অভিমুখী সকল লঞ্চ রাত আটটার মধ্যে ছেড়ে যায়। আমাদের লঞ্চ যাচ্ছি যাবো করতে করতে পন্টুন ছেড়ে দিয়েছে। এগিয়েছে অন্ততপক্ষে একশ মিটার। ব্যাক গিয়ারে গিয়ে বরিশাল অভিমুখে সিধে হচ্ছে। কী করা! আজ রাতেই যেতে হবে, কাল অফিসে যোগদানের তারিখ। এক নৌকার মাঝি বললো, নৌকায় উঠে পড়ুন, লঞ্চ পাইয়ে দেবো। পন্টুনে যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে নৌকা কমপক্ষে ছয় ফুট নিচে। তায় আবার ক্রমাগত দুলেই চলেছে। আমার সাথে দশ-বারো কেজি ওজনের ব্যাগ। সুবিধা হবে মনে করে স্ত্রী যত্ন করে গুছিয়ে দিয়েছেন। ওজনের কথা কী তখন মাথায় আসে? যা-হোক মাঝির প্রস্তাবে ব্যাগ ছুঁড়ে দিলাম। ও দক্ষ হাতেই তা ধরে ফেললো। এবার আমার পালা। লাফিয়েই নামতে হলো। নৌকার দোলা আর আমার অধোগতি দুয়ে মিলে পড়িমরি অবস্থা। মাঝি ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য না করলে বুড়িগঙ্গার কৃষ্ণ সাগরে চুবানি খাওয়া ছাড়া উপায় ছিলো না। অবশেষে মাঝি দ্রুততার সাথে পৌঁছে দিলেন পারাবাত নামের বিশাল এক জলপরীর কার্নিশে। সেখান থেকে জলপরীর দু-একটা পালক ধরে ধরে কোনোভাবে নিজেকে গুঁজে দিলাম পরীর ভেতরে। একে তো ডিপার্টমেন্টের শাস্তি কালাপানি, তায় আবার শুরুতেই বিপত্তি! যা-হোক, লঞ্চ জার্নি নতুন হলেও ভালোই লাগলো। সময়মতো তথা অতি ভোরে সূর্য ওঠার আগেই পৌঁছলাম বহুত শ্রুত সেই বিখ্যাত কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে বরিশাল লঞ্চ ঘাট; সেখান থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে আমার অফিস সংলগ্ন অফিসার্স মেসে।
প্রথম দু-এক দিন কাজ বুঝতেই কেটে গেলো। এরপর সময়টাকে কীভাবে নিজের সাথে খাপ খাইয়ে নেবো সেই ভাবনায় ডুবে গেলাম। কোনো সন্দেহ নেই, বরিশালে আমার কর্মপরিধির প্রায় পুরো এলাকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি। এই এলাকা বরিশাল বিভাগের ছটি জেলা ছাড়াও ঢাকা বিভাগের দুটি জেলা–মাদারিপুর ও শরিয়তপুর নিয়ে বিস্তৃত। এই দুটি জেলা ছাড়া বরিশাল বিভাগের বাকি ছটি জেলায় যাতায়াতে প্রতি পদেপদে ফেরি। গাড়িটাকে ফেরিতে পাড় করে গন্তব্যে যেতে হয়। বিষয়টি উপভোগ করেছি বেশ। তবে ভালো পরিবেশ, ভালো খাবার বসবাসের জন্য উপাদেয় হলেও মানুষের জন্য তা যথেষ্ট নয়। মানুষের জন্য চাই মানুষের সঙ্গ, তাও আবার ভালো মানুষের সঙ্গ। এই অভাব পূরণ করে দিলেন কয়েকজন বিদগ্ধ ব্যক্তি। এঁদের সাথে পুরো পাঁচটি বছর কীভাবে কাটিয়ে দিলাম তা বরিশাল ছেড়ে আসার প্রায় পনেরো বছর পরেও বিস্ময়কর মানি। এঁদের সাথে নিয়মিত আড্ডা হতো বরিশাল মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র বিবির পুকুর পাড়ে। দু-একদিন পরপরই আমরা মিলিত হতাম সেখানে। খোলা আকাশের নিচে। বিবির পুকুর-এর তিন পাশে ফুটপাত রয়েছে, সেখানে অনেকগুলো স্থায়ী বেঞ্চ বসানো। সেখানকার একটি বা দুটি বেঞ্চ দখল করে বিকাল বেলায় জমতো আমাদের আড্ডা।
এই আড্ডায় একদিন পরিচিত হলাম– বাংলার অধ্যাপক মৌন সাধক নয়ন আহমেদ এর সাথে। অতি স্বল্পভাষী তরুণ কবি নয়ন আহমেদ। আমাদের আড্ডায় যারা নিয়মিত হাজির হতেন তারা সবাই কবি-সাহিত্যিক-গবেষক। একমাত্র আমিই ছিলাম ব্যতিক্রম। আড্ডার অন্যান্যরা যখন নানারকম হৈচৈ করছেন, নানা বিষয়ে ব্যক্ত করছেন মতামত, তখন তিনি নীরব। তিনি শ্রোতা হিসেবে অসাধারণ। আজকাল সবাই বক্তা এবং পণ্ডিত। কিন্তু নয়ন আহমেদ ব্যতিক্রম। আমরা যখন হাজারটা কথার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছি, নয়ন আহমেদ তখন একটি মাত্র বাক্যে তাঁর মতামত জানান দিচ্ছেন। সন্দেহ নেই, সেই একটি মাত্র বাক্য হাজার কথার চেয়ে দামি। আগেই বলেছি– আমাদের ৪/৫ জনের ক্ষুদ্র আড্ডার সবাই কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক। কিন্তু বয়সে প্রায় একই রকম হলেও নয়ন আহমেদ তাদের গুরু। আমার মনে আছে, একবার পরামর্শের মতো করে মন্তব্য করেছিলেন– কবিতাকে আরও উপাদেয়, আরও সর্বজনীন করার জন্য কবির দরকার তার পুরনো কবিতাকে খসড়া হিসেবে বিবেচনা করে নতুনভাবে দাঁড় করানো। সত্যি বলতে কী, আমার মতো যারা কবিতা রচনায় চিরকালের নবিশ তাদের জন্য এটা ছিলো আপ্তবাক্য। তাঁর মতামত বিবেচনায় নিয়ে দু-একটা পুরনো কবিতা নিয়ে যখন নতুনভাবে বসলাম, নিজেই লজ্জায় পড়েছিলাম। কী লিখেছি আমি, এটা কোনো কবিতা হলো? ইত্যাদি-ইত্যাদি।
নয়ন আহমেদ– বাংলার অধ্যাপক। স্বাভাবিক ভাবে আমরা ধরেই নিই, একজন বাংলার অধ্যাপক তো কবি সাহিত্যিক হবেনই। এতে অবাক হওয়ার কী আছে? কিন্তু বাস্তবে কি তাই? নয়ন আহমেদ বাংলার কাব্য জগতে এক বিরল প্রতিভা। তিনি আধুনিক কবিতা লেখেন। শুধু আধুনিক নয়, মাঝে-মাঝে তো মনে হয়, তিনি উত্তর-আধুনিক কবিতা রচনা করে যাচ্ছেন। বাংলা কাব্যলক্ষ্মী তাঁর এতোটাই অনুগত যে– তিনি যখন ইচ্ছে, যেমন ইচ্ছে রচনা করে যাচ্ছেন সময়ের সেরা কবিতা। বিষয়বস্তু যতো সাধারণ বা সামান্যই হোক না কেন, সেটাকে অসামান্য ও অসাধারণ করে উপস্থাপনে তাঁর যে মুন্সিয়ানা দেখেছি তা সমসাময়িকতার বিচারে বিরল। বাংলার কাব্যজগতে বিরাজিত হাজারো কিংবা লাখো বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ধারার মধ্যে তিনি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের ছাপ রেখেছেন। আমার তো মনে হয় কবির নামবিহীন শত কবিতার মধ্যে আমার মতো নবিশ কবিতাপ্রেমীও সহজেই তাঁর কবিতা শনাক্ত করতে সক্ষম হবে।
মনে হয়, কবিতাকে তিনি আয়ত্ত করেছেন নিজের ঘর-বাড়ি, প্রাত্যহিক আঙিনার মতো। হিংসা কবিতায় তিনি লিখেছেন—-
শুয়ে আছে হিংসা মানুষের কোমর জড়িয়ে, গলা ধরে।
… … …
সভ্যতার রাতকাণা রোগ হবে।
আর যতো গোলাপ-বাগান
হবে তছনছ মুহূর্তেই। হিংসা বড় কারুকাজ জানে!
(হিংসা, কিছু মেরুদণ্ডী উচ্ছ্বাস)
মানব-চরিত্র চিত্রনে সময়ের কী অপরূপ বিশ্লেষণ! একটি কবিতাকে তিনি পিঁপড়াদের জীবন-যুদ্ধের পাঠ পড়াচ্ছেন। শেখাচ্ছেন জীবনের পাঠ, পিঁপড়াদের মতো ঐক্যবদ্ধ থাকার দৃঢ়তা, শেখাচ্ছেন শৃঙ্খলা। কবিতাকে তো নয়, মূলত কবিদেরকে শেখানো হচ্ছে এসব উচ্চমার্গীয় ধারণা।
কবি নয়ন আহমেদ-এর ভাষায়–
অনেক কবিতা গেছে রাজপথে বর্ণাঢ্য মিছিলে;
কিছু গেছে মন্ত্রিপাড়ায়,
কেউ গেছে চাকরিতে–
কেউ করে বাণিজ্যে বসতি।
এই কবিতাটি কিন্তু কোথাও যাবে না।
কেবল একটি পিঁপড়ের কাছে বসে থাকবে–
পিঁপড়ের জীবন নিয়ে মুগ্ধ অনন্ত দিন।
(এই কবিতাটি, প্রাগুক্ত)
রোদ, ভোর, গোধূলি, রাত, অন্ধকার, পাখি, প্রজাপতি, উপলব্ধি, মানবিকতা, ভালোবাসা– বলতে গেলে এইরকম আটপৌরে শব্দ এবং অনুভূতির বাঙময় ব্যবহারে তিনি রচনা করেছেন কি সব অসাধারণ রূপকল্প! নয়ন আহমেদ ইতিবাচক মানসিকতার বাঙাল, তাই আজকালকার সমস্ত ব্যবহারবিধি আয়ত্তে রেখে পথ চললেও তিনি দেখতে চান ‘কিছু মেরুদণ্ডী উচ্ছ্বাস’। এ কাব্যগ্রন্থের সবগুলো কবিতায় তিনি যেমন চেয়েছেন– একবিন্দু মেঘের বারান্দা-ঘেরা জল ও জীবন, চেয়েছেন আমলকি-ভোর, পথে পড়ে থাকা ভালোবাসার খড়কুটো। আর ‘লেখা’ কবিতাটি অনন্যতার দাবি রাখে। এ শুধু কবিতা নয়, এ যেন যুদ্ধংদেহী মনোভাবাপন্ন দুপক্ষের মধ্যে একপক্ষের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধজয়। ‘উপঢৌকন’ কবিতায় কবির ভাষা– ‘লবণের মতো হও’ কী এক অসাধারণ জীবন ব্যবসার কথা!
‘তাঁর নাম আহমাদ’ কাব্যগ্রন্থে নয়ন আহমেদ তাঁর বিশ্বাসের ভিত আরও চিরস্থায়ী, আরও মজবুত করেছেন। ‘জাতীয় ভাষা’ কবিতাখানি নয়ন আহমেদ নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। এতোই ভালো লেগেছে যে, সাথে সাথে বারকয়েক পড়ে ফেললাম। তিনি বলেছেন—-
মুহম্মদ সাম্যের প্রতীক।
সাম্য আজ সাহাবি হবে।
তিনি বিবাদ-মীমাংসাকারী।
মীমাংসা এখনই সাহাবি হবে।
অবলীলায় অনায়াসে অপরূপ এক দ্যোতনা তৈরি করলেন নয়ন আহমেদ তাঁর কাব্য প্রতিভা এবং চিন্তার মেরুকরণের মাধ্যমে! ‘জাতীয় ভাষা’ ছাড়াও এই কাব্যগ্রন্থের ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি’, ‘মা-পাখি, সাহাবি আর নবিজির গল্পো’, ‘একটি সাহাবি গাছ ও রোদের গল্পো’, ‘শিষ্যদের প্রতি নবি মুহম্মদ’ কবিতাগুলোতে নিজস্ব প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন কবি নয়ন আহমেদ। তেমনি ভাবে ‘একটি শোকের স্তবক’-এ যে বিলাপ ধ্বনি ছড়িয়েছেন সে বিলাপ আজ বিলাপ হিসেবে নয়, বরং আবেদন হয়ে বিশ্বজুড়ে লাখো-কোটি ধ্বনি প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করে মানবের নিত্যপাঠের বিষয়বস্তু করে কেবলই জানান দিচ্ছে– মুহম্মদ আছেন, মুহম্মদ আছেন। মুহম্মদ প্রতিনিয়ত লক্ষ-কোটি সালামের প্রত্যুত্তর দিয়ে রয়েছেন জাগ্রত। ‘তাঁর নাম আহমাদ’ কাব্যগ্রন্থের অনেকগুলো কবিতা বিশ্বসাহিত্যে স্থান পাওয়ার যোগ্য।
নয়ন আহমেদ বাংলা বর্ণমালা, বাংলা শব্দ-প্রতিশব্দ, অলংকার, যতি চিহ্ন, এতটাই আয়ত্ত করেছেন, কি ব্যবহারে, কি কাব্যের অলংকরণে; মনে হয় এ যেনো প্রাত্যহিক খানাপিনা, সালাত আদায় আর জামাকাপড় পরার মতো সহজ ও সাবলীল। বরিশালের উর্বর ভূমির সন্তান নয়ন আহমেদ আজ নিজেই তুল্য হয়েছেন নিজের কাছে। তাঁর কাব্যপ্রতিভা, নিজস্ব রচনাশৈলী– তাঁর কবিতার আবেদনের মতোই লঞ্চ , জাহাজ, স্টিমারে খাল-নদী-সাগর পেরিয়ে দশ দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ুক এ কামনা করি। একইসাথে দোয়া করি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে এ যুগের হাসান ইবনে সাবিত, কবি কা’ব হিসেবে কবুল করুন।