তাজ ইসলাম
মানুষের নেই কোন নিরাপত্তা। নেই কোন গোপনীয়তা। সব যেন আড়িপাতা যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে। ব্যক্তি জীবন,পারিবারিক জীবনের সব গোপনীয়তা ফাঁস হওয়ার ভয়ে তটস্থ নাগরিক সমাজ।
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বেডরুমে গিয়ে ঘুমের শ্রান্তির রাতও হয়ে পড়ে অসহ্য। কবির অনুভবে অনুরণন করে অন্য এক উপলব্ধি। তখন তার স্বগতোক্তি
“আমার অসহ্য রাতে কারা দুয়ার খুলে ঢোকে?
ঘুম নেই,অনন্ত বিস্ময় চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে
নিভৃত বেঁচে থাকাগুলি”
যদিও তার আগে ঘটে গেছে অনেক কিছু।
যদিও কাল্পনিক মরু ভেসে গেছে জলোচ্ছ্বাসে/
যদিও তেজী ঘোড়ার পিঠে ছুটেছে কুমারী স্বপ্নগুলি/
যদিও বিশ্বাস এসে আমার কপাল ছুঁয়ে গেছে/
( তখনও)
খোলা দরজায় তবুও বিচ্ছিন্ন আর্তনাদ
সব বিবরণ দিয়ে গেছে/
যদিও বাতাস উড়িয়েছে মৃত ফুলের পরাগ/ প্রজাপতির স্মৃতির ভ্রমে কেঁদেছে নিশিরাত/ করুণার জল দাও তবে/…
এই একটু করুণার জলের স্পর্শে কবি ফিরে পাবেন আশা। আশায় বাঁধবেন বুক। বুকের সাহসে লিখে যাবেন সমস্ত বৃত্তান্ত। বৃত্তান্ত হয়তো লেখা হবে নিজস্ব নোটবুকে। অথবা বিবৃত হবে কোন সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকার বিষয়েও তার প্রস্তাব:
“আজ সব সাক্ষাৎকার হোক নীরবে নীরবে “
এই যে বয়ান এগুলো মূলত কবির বয়ান।
কবি জন্ম গ্রহণ করেন একটি দেশে। তারপর যখন তিনি কবি হয়ে ওঠেন তখন অতিক্রম করতে চান দেশের সীমানা। ছড়িয়ে পড়তে চান বিশ্বের বুকে। সভ্য নগর তাকে সীমানার ব্যারিকেটে আটকে রাখে। কোথাও কাঁটাতারে, কোথাও সুউচ্চ প্রাচীরে।
কবি তখনও অতিক্রম করেন দেশের সীমানা প্রাচীর। কবির কথা পৌঁছে যায় নিজ দেশের কঠিন প্রাচীর ভেদ করে বিশ্ব নাগরিকের মন ও মননে। নিয়ম তখনও আটকে রাখে নিজের সীমানায়। এক সময় দেশ ছিল। দেশের সীমানা ও সীমান্তও ছিল। তবে ছিল না কোন সীমানা প্রাচীর। আধুনিকতা ও সভ্যতা মানুষকে উপহার দিয়েছে নিয়মের কড়াকড়ি। নাগরিক এখন সীমানা প্রাচীরের জেলখানায় বন্দি। রাষ্ট্র ও নিয়মের কাছে অসহায়। কবি তাই অসহায়ের মতো বলেন;
” কোন সীমানায় রাখবে? রাখো/ সীমানায় সীমানায় হাঁটি…”
হাঁটতে হাঁটতে কবি দেখেন,
” মাটি ভাগ করে নিয়ে/ মৃত্যু ভাগ করে নিয়ে/ বেঁচে আছে দেশ,/ দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে সব মহিমার লাশ । /( সীমানা)।
বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় জীবন সহজ হয়েছে। জীবনের প্রয়োজনে যুক্ত হয়েছে আবিস্কৃত ও উদ্ভাবিত যন্ত্র। মানুষ হয়েছে আধুনিক। জীবনে যেমন যুক্ত হয়েছে অনেককিছু। হারিয়ে গেছে বহুকিছু। প্রযুক্তি কেড়ে নিয়েছে লোকজ অনেক যন্ত্র। কলের লাঙল দখল করেছে হালের গরুর জায়গা। যন্ত্রের কাছে পরাজিত লোক বাংলার ঐতিহ্য।
কবির কাজ বর্তমানে বাস করে অতীতকে সামনে নিয়ে আসা। অতীতকে ঐতিহ্যিক উপাদানে উপস্থাপন করা সচেতনতার কাজ। নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত করে দেওয়া, আগামী প্রজন্মের জন্য স্মৃতি জাগানিয়া হিসেবে হাজির হবে এসব সৃষ্টিশীলতা। তৈমুর খানের কলমে সৃষ্টি হয় (ঢেঁকি) কাব্য।
কবি আধুনিক কবিতার শরীরে গেঁথে দেন ঢেঁকি। লিখেন,
” পাড়াপ্রতিবেশীদের কলহ বিবাদে/ ঢেঁকিটি এখনও অবিরাম ওঠে নামে।( ঢেঁকি)”।
তৈমুর খান সমাজ সচেতন। বিস্তার করেন শব্দ দিয়ে নিজস্ব চিন্তার জাল। কল্পনা করা কবির কাজ। কল্পনায় ডুব দেওয়ার আগে অবলোকন করেন সমাজের চারপাশ। পরকীয়া এ সমাজের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাধী। পরকীয়া তাই হয়ে ওঠে কবিতার বিষয়। কবি শিল্প সচেতন। পরকীয়ার ইঙ্গিত তিনি দিয়েছেন কিন্তু পরিহার করেছেন রগরগে বর্ণনা। ইঙ্গিতময়তা কবিতার সৌন্দর্যকে করেছে বৃদ্ধি। তার কবিতা কথন,
” আজ মেঘ ফিরে যাও/ পৃথিবীতে কলঙ্কিত সব পরকীয়া।( পরকীয়া)।
কবিরা সাধারণত হন কল্পনা প্রবণ। কল্পনার আকাশে উড়াল দেন অনায়াসে। কল্পনার মুক্ত আকাশে উড়ে কবি দেখেন,
“রোজ আমি বাঘ হয়ে দেখি:/ আস্ত অথর্ব এক বাঘ;/
রোজ আমি ময়ূর হয়ে দেখি;/
নাচ আসে না আমার।/
অস্ত যাবার আগে সোনালি মুহূর্ত জাল বোনে/ জালে আটকে থাকি কল্পনার দুরন্ত এক মাছি।( কাল্পনিক)”।
কল্পনা যারা করতে পারে তারা ভাবতে পারে জীবন ও জগত নিয়ে। বাস্তবতা তার চোখের ভেতরে জাগিয়ে তুলে আরেক চোখ। সে চোখের দ্রষ্টব্যে পাঠ করা যায় জীবনের নানান স্তর। তখন বুঝতে সহজ হয়। সময় লাগে না। দশ মিনিটে জগতের সব হিসাবের খাতা দেখা হয়ে যায়। সে খাতার অদৃশ্য পৃষ্ঠায় লেখা বিদগ্ধ কোন জীবনীকারের অভিজ্ঞতা,
“এ সংসারে জলও বিকোয়, ঘামের দাম নেই/
শরীর ক্ষয়, মন বিষণ্ন দশ মিনিটেই।/( দশ মিনিট)”।
অভিজ্ঞ শিল্পী লিখেন তার দেখা মানুষের চরিত্র। মানুষ বহুরূপী। কেউ ভালো,কেউ মন্দ। মানুষ মন্দ হলে পাশবিক হয়, হয় অমানুষ। মানুষ আর হিংস্র জন্তু জানোয়ারে তখন থাকে না ফারাক। এবং এইসব জানোয়ার কার চরিত্রে কতটুকু অথবা কে কতটা জন্তু তা প্রকাশ করে তার আচরণ। এ জন্যই কবি লেখেন,
“এখন আমরা কে কোন জন্তু / তা আমাদের শিকার কৌশল দেখলেই বোঝা যাবে/ (জব্দ)”।
মানুষ অমানুষ হয়ে গেলে শান্তনারা নিহত হয়। ঘাতক সমাজ, ঘাতকের সাথে সহবাস। সৎ মানুষ দারুণ অসহায়।
সুখ ও শান্তনাদের অবশিষ্টরা বিয়ে করে অন্যপাড়ায় সংসার করে। কবি আফসোসের স্বরে বলতে থাকেন,
“শান্তনাদের বিয়ে হয়ে গেছে বলে এ শহর ফাঁকা/অশান্তির কারবারিরা ব্যবসা পেতেছে/ মৃত আকাঙ্খাদের শুধু মনে মনে ডাকা/ প্রাচীন তরবারি ব্যবহৃত হতে হতে আজ পলাতক/ কেবল ইন্দ্রিয়গত তার কার্যক্রমের সীমানা/ মনুষ্যত্বের এই সহবাসে সেও দেখি আশ্চর্য্য ঘাতক।/ (আশ্চর্য ঘাতক)।
এতোক্ষণ যে কবির কথা বললাম তিনি তৈমুর খান। তৈমুর খান বাংলা ভাষার কবি। তৈমুর খান বাঙালি কবি। জন্ম তার ভারতের বীরভূমে। কবিতা তার মনের কথা বলার মাধ্যম। কবিতায় প্রচার করেন নিজস্ব চিন্তা। বয়ান করেন আপন দর্শন।
প্রেমকেও নিয়ে আসেন কবিতার শব্দে, বাক্যে, ছন্দে। এই প্রেম মানবীর সাথে না, প্রেমিকার সাথে না। আত্মার বন্ধনে বাঁধা তার প্রেম। নিজেকে নিজেই বলেন,
“কাজল পরাও চোখে / আয়নায় নিজেকে দেখি/ নিজের ভেতর থেকে নিজে বেরিয়ে এসে / আরও একবার বলি: ভালোবাসি!/
উত্তম অথবা মধ্যম পুরুষে/ আমাদের ব্যাকরণ যতই রচিত হোক ভিন্ন সর্বনামে। ( ব্যাকরণ)”।
” রোজ ঘর তুলি,দেওয়ালে দেওয়ালে/ আর নিকোনো উঠোনে বসাই শ্রীমুখ/লক্ষীর হাসিতে যেন উপচে ওঠে সুখ ( রোজ ঘর তুলি)।
পরিবেশ,পরিস্থিতি, সমাজ, ভূখণ্ড সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে। কবি নিজের দেশ,জাতি, ধর্ম নিয়ে লেখেন। তবু অসচেতনভাবেই হোক, অথবা সংস্কৃতির আগ্রাসনেই হোক কখনো কখনো গ্রাস করে তাকে। প্রচলিত শব্দে যাকে বলা হয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। তৈমুর খান ভারতের বীরভূম জেলার রামপুরহাটের মানুষ। লক্ষী, সরস্বতী সেদেশের বহু মানুষের বিশ্বাসের কেন্দ্র। সেদেশের সাহিত্যে তাদের স্থান দেব ও দেবীর আসরে। তৈমুর খান সে বিশ্বাসের অনুবর্তী নন। তিনি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে গ্রাস হয়েছেন বলা না গেলেও সচরাচর প্রভাবিত হয়েছেন বলা যায়। কাজেই অনায়াসে লিখেন,
“লক্ষীর হাসিতে যেন উপচে ওঠে সুখ”। বিশ্বাস তাকে টলাতে না পারলেও পরিবেশ প্রচার ও ব্যবহারের বাহুল্য তাকে টানতে পেরেছে। লক্ষী, দূর্গা তাদের সাহিত্যে সহজলভ্য।
তৈমুর খান প্রেমের কবি। কাম, প্রেম, দ্রোহ নিয়েই জীবন। প্রেম সেসবের উর্ধ্ব আসনে বসা। তৈমুর খানও প্রেম পিয়াসী। প্রেম সন্ধানে তার জীবন চলে আসছে সায়াহ্নে। কবির ভাষায়,
প্রেমের রাস্তা খুঁজতে খুঁজতে/ সন্ধে হয়ে এল/….
কেউ ভিক্ষা দেবে নাকো অন্ধ ভিখিরিকে/ শুধু নির্বাসনের হুইসেল বাজবে/ ট্রেন চলে যাবে ছেড়ে/ দূরে বহুদূরে( নির্বাসন)।
“ট্রেন চলে যাবে ছেড়ে” চলে যাওয়ার পর ছেড়ে শব্দ কী খুব বেশি প্রয়োজন ছিল! কবিতার শরীরে এমন একটা দুটা শব্দকে বাহুল্য বলেই মনে হয়। শব্দের মেদ অবশ্য তৈমুর খানের কবিতায় নেই। তৈমুর খানের আলোচ্য বইটির নাম ” ভালোবাসা খুঁজতে খুঁজতে”।
প্রায় ৪১ টি ছোট-ছোট কবিতা নিয়ে তিন ফর্মার এই বইটি প্রকাশ হয়েছে ২০২১সালে। মলাট বা প্রচ্ছদ করেছেন দিব্যেন্দু হালদার।
বইটি প্রকাশ করেছে শব্দ লেখা।
বিনিময় মূল্য মাত্র ২০ টাকা। তৈমুর খান ও তার বই ছড়িয়ে পড়ুক পৃথিবীর পাঠকের দ্বারে দ্বারে। আমরা এ আশাই করি।