spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদকবিতাগুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক

গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক

অনুভাব
………

বিষণ্ণ জৈবিক মাটি কুমোরের নিজস্ব পরিখা
তুমি এক লগ্নজাত মুখ, উন্মুক্ত হাতের শূন্য।

দূরের রাস্তার পাশে মাথানত জলাশয়, স্থির।
আমার পরের জন্ম জেগে আছে মাথা উঁচু করে।

উচ্ছ্বসিত বাগানের অপস্বর জিভের উঠোনে
কী চেয়েছে? প্রলম্বিত বাক্? অনুভাব ঈশ্বরের?

কিছু কিছু পতঙ্গের বিজিত ইচ্ছার কাছে হারি
ভেঙে যাই স্তিমিত স্বভাবে, ধীরে, সুরে উচ্চকিত।

কে ভাবেন? তুমি নেই? প্রচলিত ধ্যানের গভীরে
বাগ্মী পুতুল যে তুমি— কারণের আশ্চর্য অপর।

পাগল রথের মতো গড়িয়ে চলেছি, গড়ে উঠছি
লক্ষ লক্ষ পায়ের আড়ালে একা এই বৃহদ্দেশ।

দুহাতে মাতাল খনি দূর্বাঘাস সরিয়ে সরিয়ে
পার হয়ে যাচ্ছি কল্প, জ্ঞানের বৈভব, মোহমায়া।

মায়ের পাখির মতো
………

শহরের শালবনে একা একা ভোর এসে কাঁদে
নানা উচিতের রাত ফাঁদ পেতে ধরেছে বাতাস।

রঙিন ঠোঁটের কোণে সাদা সিগারেট ধোঁয়া, বন
ছেঁড়া প্যান্টালুন বন্ধু আরো ছিঁড়ে জুড়েছে আকাশ।

এই প্রেম, অস্ত্রাগারে চলো নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধের
পরম আকৃতি থেকে ধার নাও ইন্দ্রের পতাকা

আর ফাঁদ পাতা ভুবনের রাঙা ঠোঁটে ছোড়ো তির
আমার ধনুক থেকে তিরের ত্রিফলা নিভু নিভু।

এখনও দোকানে খোলা মাঝ রাত মঞ্চের মতো
অগ্নিশুদ্ধ যুবকের মুগ্ধ চোখ ঝুলিয়ে রেখেছে।

বাসি দুধে চা ছড়িয়ে আগুন জ্বেলেছে ভগবান
মায়ের পাখির মতো নিজেকে ফুটিয়ে রাখা বউ।

হয়তো আর কোনওদিন এমন রাত্রি ফিরে আসবে না
যেভাবে সংযম তালা মেরে চলে গেছে দিগন্তের।

মোহগান
………

যত গান শোনানোর তত শিরদাঁড়া, তত মুখ
অলৌকিক আলপিন গেঁথে আছে হাজার শরীরে।

বেরিয়ে আসার পায়ে লেগে আছে বেবী ফুটপাথ
আলনা জড়ানো গায়ে ঠিক যেন প্রত্যক্ষ আকাশ।

ওই সুর, নভোতল— প্রতিরোধ আলোর, মালার
ব্যক্তিগত প্রচণ্ড আঁধারে চাইছে ভাষা, অন্তস্থল।

আমিও শিউরে উঠি। সুষুম্না কাঁদে। নিষ্প্রভ মন
কতদিন আগে থেকে শুনব সে ঝড়ের জন্মগাথা?

রৌদ্রনগর অন্তর। সে কোনও পাখির ডানা খোঁজে
প্রতিভাসিত সমুদ্রে ওড়ে নক্ষত্রের মোহগান।

ওইখানে খুঁজে দেখো একটি দেহ, তার স্বরলিপি
আগুন তাৎক্ষণিক। নিরানন্দ মহাকাশে ক্ষীণ।

তার চে অমুক স্ট্রিট শব্দে অর্থে গলি বদলে রাখে
সমূহতা হাসে— দিব্য, তার লাল গালে তারা খসা।

লিপি
………

রাস্তার ওপারে যাব অনিঃশেষ অথচ কোমল
যেমন মোহনবৃত্তি— আমাদের সমস্ত ঠিকানা।

কলের পাথর ঘরে ঢুকব না— সেই মোতাবেক
চুক্তি হল সীমাবদ্ধ মরূদ্যান ফেলে পালাবার।

কোথাও তো অস্থিসন্ধি জমা রেখে নিদ্রা যেতে হবে
ঘুমের পুলকে জাগল তারাখসা— চোখের আরাম।

নিজেকেই ধুয়ে ধুয়ে পৃথিবী মোচন করি আমি—
তারপর, মুগ্ধতায় আচমন নানার্থ সকালের।

সাবলীল তাঁবু। পাতো, তুলে ফেলো দিগ্বিদিকে, আলো
সমাপ্তি তো নেই। চোখ জাদুকর। মেলে দিলে ইচ্ছা।

বরফ বা বালি কিংবা নোনাজল পার হয়ে বন
যেখানে মানুষ দেখি নিজের স্রোতেই কথা বলে।

এই তো আমার জন্য এটুকু সময় প্রকাশিত—
তাঁহার চরণ ধন্য দৃশ্যমান প্রতিশ্রুতি লিপি।

ম্যাপ
………

আরেক আরব্য লতা খুঁজে পাই চাঁদের পাহাড়ে
চাঁদের পাহাড় মানে বিভূতিভূষণ ঠিক নয়।

সেখানে হীরের মতো কাঁচা সোনা কচি মুখ মেয়ে
মায়ের দুপুর ভেঙে শুয়ে থাকে কলঙ্ক গুহায়।

আমাদের শিশু দেখে আরেক আশ্রয় সেই চাঁদ
ওয়ার্ডসোয়ার্থ যাকে লুসি ভেবে দিগন্তে পৌঁছাল।

এই মণিহার আমি হৃদয়ে ডোবাতে গিয়ে শেষে
ভেসে গেছি অপার্থিব জ্যোৎস্নায়, পরিহার্য স্রোতে।

তোমার দুয়ার খোলা ধ্বনি দরজা পর্যন্ত আসে
বাঁক নেয় বাজুবন্ধে কোমরে, বিছায়— শ্রী শ্রী পদে।

এও এক অভিযাত্রা— ভিসাহীন আটক শরীরে
নেমে আসে পূর্বপাঠ অনুশীলনীর আগাগোড়া।

ছাই খাই, তারাভ্রংশ, শক্তির গহনে ঝাঁপ দিই—
জমানো কংকাল, ম্যাপ, শরীরী লাবণ্য খুঁজে পাই।

সম্মতি
………

আলোর আরোগ্য থেকে উঠে আসে চলমান শীত
কথা থাকে। আপন উদ্ধারে গাঁথা বিগত হিমঘর।

মৌন সকালের মুখ— ওকে আমি খুশি দেখতে চাই
ফুলচাষী-বউয়ের ব্লাউজ এত ম্লান হলে চলে?

চাল ফোটা হলুদ সরের মতো দিন আর মেঘ—
এই ঘোর থেকে আমি কোন মুখে বের হয়ে যাব?

কোথায় জীবন আছে সাপের খোলস হয়ে পড়ে?
আমি ভেঙে যেতে চাই অন্ধকার গড়ে নেয় যদি।

পাথর পেকেছে তাকে দৃঢ় করে রেখেছে সময়
তার মধ্যে খোকা কৃষ্ণ— বালক স্বভাব খেলাধুলো…

সে সেবা প্রকৃতিগত— শেকড়ে প্লাবন লেগে আছে
সেবাদাসী প্রতিদিন ফোটে, সিক্ত, সিনান বিরত।

জেগে ওঠা পাখিকে সম্ভব একা সম্মতি পাঠানো?
কলস্বর একা সব সমলাতে পারে, জানে রেলগেট।

সূর্যাস্তের পরে পরে
……….

মুহূর্তের হ্রস্ব মুখ বেদনাকে আনন্দিত করে
তোমার নাটকে চেনা পাখির আদর করে খেলা।

বিকল্প রাতের নেশাঘরে শুয়ে থাকে অন্ধ চাঁদ
আমি তার অজ্ঞান বাহক ধরে থাকি আলোপাতা।

মোহান্ধ সন্ধের ঘরে কেউ এল উলঙ্গ পুরনো
বিনয়ে অলস তার গজদাঁত দেখি, অনুবাদে।

পা-দুটি লবণজলে ধোয়া আর প্রলুব্ধ জাগানো
ফেরা যাক জোনাকির দূর পদক্ষেপে আলো মেখে।

অথবা শোকের জল এনে দেবে জ্যোৎস্নার আদর
পিপীলিকা যে ফুলে নামুক তার ভার বেড়ে যাবে।

ঝিঁঝিঁ ডাকে কাঁঠাল পাতায় নীচে বিনিদ্র খরগোশ
ফুলের ফসিল থেকে যতটুকু দেহ চেনা যায়।

আমার স্মরণ্য গুরুভ্রাতা যদি এটুকু বলেন—
আমি সূর্যাস্তের পরে পরে চোখ জিভ খুলে রাখতাম।

ধর্মগ্রাম
……….

নিখুঁত হিসেব কষে সারারাত ঘুমিয়েছি,তাই—
সাধ্যের বাইরে গিয়ে দেখেছি ঈষৎ জেগে আছি।

বিনম্র ভাষার কাছে রপ্ত করেছি নীরবতাকে
যে নীরব, ভাষাময় মহার্ঘ তারার দেশে থাকে।

খুব নীচে, গর্ভবৎ কালো সং ওৎ পেতে আছে
ও আমার তৃতীয় নয়ন ভরা জাদুর বিছানা।

মহাজাগতিক রং বিস্ময়ের অধিক স্বপ্নালু
হাতে ধরা পটল বেগুন নয়— মঞ্চের বক্তৃতা।

নিরাপদ ওজনের ঝুঁকি মাথা পেতে নিতে নিতে
খাল কেটে কুমির এনেছি, মুক্তি কীসে জানা নেই।

এই রাফখাতা, আমাদের পিতৃভূমি আর শিশু—
বার বার ডাকে। উদোম ফূর্তির সেই পিছুটান।

পার হতে হতে মমত্বের সেই ধর্মগ্রাম এলো
একমাত্র আমিই জানি এরপর জীবনে ফিরে যেতে।

¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤

পরিচিতি
…………

অরুণ পাঠক। জন্ম ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ কাঁজিয়াখালি, হাওড়ার মাতুলালয়ে। পিতৃভূমি ভারত, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সোনাকোপা গ্রাম। সেখানেই আবাল্য বসবাস। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঙ্গভাষা ও সাহিত্য-এ স্নাতকোত্তর। শিক্ষক শিক্ষণ ডিগ্রিপ্রাপ্ত। পেশা শিক্ষকতা। এই শতাব্দীর সূচনা (শূন্য) দশকের কবি। কবিতা ও কবিতা বিষয়ক সাহিত্যপত্র ‘সাহিত্যের বেলাভূমি ‘ পত্রিকার সম্পাদক। স্যাক সাহিত্য সম্মাননা, বনানী পুরস্কার, সামসুল হক স্মৃতি পুরস্কার প্রভৃতি একাধিক পুরস্কারে সম্মানিত। কবিতা পড়তে একাধিকবার বাংলাদেশে গিয়েছেন। বাংলাদেশে প্রকাশিত হয়েছে কাব্যগ্রন্থ ‘দ্বিতীয় বার একা’
এ পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ পনেরোটি । কবিতাই তাঁর প্রথম এবং একমাত্র আশ্রয়।

আরও পড়তে পারেন

2 COMMENTS

  1. বিনম্র ভাষায় লেখা বোধ ও বোধিময় লেখাগুলো অনন্য ।

  2. খুব সুন্দর বোধ সম্পন্ন কবিতাগুলো

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ