মুহম্মদ মতিউল্লাহ্
১৩৬১ সালে ‘ময়ূখ’ প্রকাশিত হয় জগদিন্দ্র মন্ডল ও সমর চক্রবর্তীর সম্পাদনায়। দ্বিমাসিক কাগজ হিসেবে ‘ময়ূখ’ চলেছিল প্রায় ছয় বছর। ঠিক এই একই সময়ে প্রকাশিত হয় ‘কৃত্তিবাস’ এবং তার বছর দুই আগে ‘শতভিষা’। প্রকৃতপক্ষে ‘ময়ূখ’ পত্রিকাটি ঘিরে পাঠকের আগ্রহ তার ‘জীবনানন্দস্মৃতি সংখ্যা’র জন্যই মূলত। এ ছাড়া পঞ্চাশের কবিতাপত্র হিসেবে ‘ময়ূখ’ এর পরিচয় বোধ হয় তার উদ্যোক্তাদের বাইরে সাধারণ পাঠকের সত্যিই তেমন জানা নেই।
এই পর্যায়ে প্রকাশের আগে ‘ময়ূখ’ প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ১৩৫৯ (১৯৫২) সালে, এবং তার উদ্যোক্তা ছিলেন সুবোধকুমার গুপ্ত, সুনীল গুপ্ত, তারাপদ চট্টোপাধ্যায়। সেটি ছিল ‘ময়ূখে’র খুব স্বল্পকালীন একটি পর্যায়। ‘ক্ষীণ কলেবরের’, এবং ‘দাম ১০পয়সা’। তার প্রথম কার্যালয় ২৩/১ চক্রবেড়িয়া রোড কলকাতা ২৫। প্রথম সম্পাদক সুবোধকুমার গুপ্ত। ২০, বিহারী ডাক্তার রোড কলকাতা- ২৫।
‘ময়ূখ’এর দ্বিতীয় পর্যায়টিই পাঠকের পরিচিত পর্যায় এবং এই সময়েই উল্লেখযোগ্য জীবনানন্দ স্মৃতি সংখ্যার প্রকাশ। দ্বিতীয় পর্যায়ে, জগদিন্দ্র মন্ডল এবং সমর চক্রবর্তীর সঙ্গে পত্রিকায় যোগ দিয়েছিলেন প্রতাপ গোস্বামী, স্নেহাকর ভট্টাচার্য। এরা সকলেই একসময় ময়মনসিংহের একটি স্কুলের সহপাঠী ছিলেন, এবং দেশভাগের প্রাক্কালে চলে আসেন কলকাতায়। কেউ কলেজের ছাত্র কেউ চাকরিপ্রার্থী। ‘ডাক্তারির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র’ ভূমেন্দ্র গুহর সঙ্গে এই সময়ে ‘ময়ূখে’র পরিচয়। এবং তার ‘ময়ূখে’র দলে যোগদান। বলা যায় এরা প্রায় ‘সকলেই উদ্বাস্তু’। জীবন সংগ্রামের লড়াইয়ে নানা পেশা ও জীবিকার সন্ধানে এদের কেউ কেউ তখন উন্মুখ, এবং অবশ্যই আর্থিকভাবে সবাই সচ্ছল ছিল না। দিব্যেন্দু পালিতের ভাষায় ‘এদের কেউ মেডিকেল পড়ুয়া কেউ সরকারি অফিসের কেরানি কেউ স্কুলশিক্ষক, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চের কাজে যুক্ত’।
নয়ের দশকে ‘ময়ূখ’কে আর একবার জাগাতে চেয়েছিলেন জগদিন্দ্র মন্ডল। সেটি ছিল ‘ময়ূখে’র তৃতীয় পর্যায়। জগদিন্দ্র মন্ডল লিখেছেন, ‘সেদিনের ‘ময়ূখ’ প্রকাশে সেই তরুণদের কী কোন সজ্ঞান-নীতিবোধ কাজ করেছিল? সজ্ঞানে না হলেও শুদ্ধতর ও মহত্তর সমাজ জীবনের ছবি তাদের চোখে ছিল।… এই নব যুবকদের অর্থ ছিল না, সামান্য উপার্জিত অর্থ বাঁচিয়ে, কখনো ভিক্ষা করে এরা ‘ময়ূখ’ প্রকাশে ব্রতী হয়েছিল।… কিন্তু তারপর যখন এই যুবকরাই অন্নসংস্থানের অমোঘ নির্দেশে জীবিকার সন্ধানে পেশাগত বিষয়ান্তরে নিবিষ্ট হল, কবিতার মুখরেখা, ক্রমে দূরে অপসৃত হতে থাকল… ‘ময়ূখ’ বন্ধ হয়ে গেল।’
‘ময়ূখ’ ছিল পঞ্চাশের দশকের আত্মপ্রকাশ উন্মুখ তরুণ কবিদের আত্মপ্রকাশের মাধ্যম। এবং ‘ময়ূখে’র পাতায় পশ্চিমবঙ্গের কবিদের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের কবিরাও একই সঙ্গে আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছিল। দুই বাংলার নবীন কবিপ্রতিভার সহাবস্থান ঘটেছিল ‘ময়ূখে’র পাতায়। ‘শতভিষা’, এবং ‘কৃত্তিবাসে’র সঙ্গে যুক্ত নয় এমন
কবিপ্রতিভাকে আবিষ্কার করতে চেয়েছিল ‘ময়ূখ’। এই তরুণদের একমাত্র আত্মপ্রকাশ স্থল হয়ে উঠেছিল এই কাগজ। ‘ময়ূখে’র পাতা থেকে উঠে আসা উল্লেখযোগ্য কবিদের নাম আল মাহমুদ, রাজলক্ষ্মী দেবী, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ভূমেন্দ্র গুহ।
সে সময়ের প্রতিষ্ঠিত কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ ছিলেন ‘ময়ূখে’র একমাত্র হিতাকাঙ্ক্ষী। ‘ময়ূখে’র তরুণ সম্পাদকেরা আর সব প্রতিষ্ঠিত কবিদের কাছে লেখা চাইতে গিয়ে বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন–তারা যে এত কষ্ট করে পত্রিকা করছেন তার কোন মূল্যও প্রতিষ্ঠিত কবিদের কাছ থেকে পাননি, এই খেদ জানিয়েছিলেন জগদিন্দ্র মন্ডল। প্রতিষ্ঠিতদের থেকে বরং ‘ ময়ূখ’ প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বারবার। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন জীবনানন্দ দাশ। ‘ময়ূখে’র প্রথম দুটি সংখ্যার প্রকাশ মান দেখে খুশি হয়েছিলেন জীবনানন্দ এবং নিজে থেকেই তিনি কবিতা দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় ‘ওর নির্বাচনে সবচেয়ে ভালো কবিতাগুলি আমাদের দেন’ লিখেছেন জগদিন্দ্র মন্ডল। ‘ওঁর আদর আশ্রয়ে, ওঁর অকৃপণ প্রশ্রয়ে আমরা বিপুল উৎসাহে ‘ময়ূখে’র প্রকাশনায় আরও নিবিষ্ট হলাম।’ জগদিন্দ্র মন্ডল আরও লিখেছেন,
‘ আমরা ওই বয়সে জীবনানন্দে আকৃষ্ট হয়েছিলাম ওঁর কবিতার গুণ বুঝে নয়। আকৃষ্ট হয়েছিলাম ওঁর কবিব্যক্তিত্বের সহজ সরল উদার মানসিকতায়’। খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা থেকে অনেক দূরে দারিদ্র্য লাঞ্ছিত জীবনানন্দ তখন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের কাছে প্রায় উপেক্ষিত। ‘ ময়ূখে’র এই তরুণেরা জীবনানন্দের প্রতি একটি মায়ার সূত্রে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং জীবনানন্দও তাদেরকে গ্রহণ করেছিলেন। ‘আমরা জীবনানন্দের জন্য যেমন, তেমনি জীবনানন্দ ছিলেন, আমাদের মনে হতো, যেন ‘ময়ূখে’ র জন্য।’ কিন্তু ছন্দপতন ঘটল তার অকস্মাৎ প্রয়াণে।
সঞ্জয় ভট্টাচার্যের নির্দেশে ‘ময়ূখে’র তরুণেরা জীবনানন্দের পাশে থেকে প্রাণপণে তার সেবা শুশ্রূষার কাজে যুক্ত থেকেছিলেন।
জীবনানন্দ দাশের পারলৌকিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রবীন সাহিত্যিকদের মধ্যে একটি মনোমালিন্য তৈরি হয়, বিশেষত বুদ্ধদেব বসু ও সজনীকান্ত দাসের মধ্যে। সেই পারলৌকিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অজিত দত্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সজনীকান্ত দাস। উপস্থিত ছিলেন তরুণ অরুণকুমার সরকার, নরেশ গুহ, বিশ্ব বন্দ্যোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তাদের সঙ্গে ছিলেন ‘ময়ূখে’র তরুণতম বন্ধুরাও।
সেই অনুষ্ঠানের পর বিমর্ষ সঞ্জয় ভট্টাচার্য এই তরুণদের নির্দেশ দেন জীবনানন্দকে নিয়ে একটা কিছু করতে। ‘ময়ূখে’র তরুণদের উদ্দেশে সঞ্জয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘শেষের দিনগুলিতে এমন জড়িয়ে পড়েছিলে…জীবনানন্দ তোমাদের কাগজে লিখেছেনও, তোমরাও আদিখ্যেতা কম করনি…উনি তো তোমাদের সময়েই বেশি বাঁচতে চেয়েছেন।’…
সঞ্জয় ভট্টাচার্যের পরামর্শে ‘ময়ূখে’র তরুণেরা সিদ্ধান্তে আসেন তাদের আত্মজন প্রয়াত জীবনানন্দ দাশের স্মৃতিতে একটা কিছু করতে হবে। ঠিক হল ‘ময়ূখের’ জীবনানন্দ স্মৃতিসংখ্যা’ প্রকাশ পরিকল্পনা। জগদিন্দ্র মন্ডল লিখেছেন, ‘জীবনানন্দের প্রয়াণের পর স্নেহাকর ভূমেনকেই দায়িত্ব দিল জীবনানন্দের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে।’ এবং নিষ্ঠার সঙ্গে ভূমেন্দ্র গুহ সে কাজটি করে গেছেন। ‘জীবনানন্দের বোন সুচরিতা দাশ ভূমেন ও আমাদের আন্তরিক সহযোগিতা পেয়ে ভরসা পেলেন।’
ভূমেন্দ্র গুহ , তারপর লেখা ও লেখক নির্বাচনের একটি পরিকল্পনা সাজাতে শুরু করলেন। জীবনানন্দ দাশের লেখাগুলি খুঁজে বের করা। কাজটি যেমন কৌতূহলসঞ্চারী তেমনিই ঝুঁকি সাপেক্ষ। সুতরাং এ ব্যাপারে তাকে সহায়তা দেবেন অশোকানন্দ দাশ এবং সুচরিতা দাশ। জীবনানন্দের পরিবারের সদস্য এদের দুজনকে স্মৃতিকথামূলক গদ্য লিখতে বলা হবে। এবং যেহেতু লাবণ্য দাশের এসব বিষয়ে আগ্রহ কম সুতরাং তাকে কিছু লিখতে বলা হবে না। ঠিক হল স্নেহাকর ভট্টাচার্য জীবনানন্দ সম্পর্কে ‘ময়ূখে’র মনোভঙ্গিটি কেমন ছিল এ নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখবেন।’তাতে জীবনানন্দ বিরূপ বামপন্থীদের অনুযোগ অভিযোগের একটা মুখের মত জবাব দেবার চেষ্টা থাকবে।’ লিখতে অনুরোধ জানানো হবে সঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে। জীবনানন্দের ভক্ত ছাত্রদের মধ্যে আবুল কালাম শামসুদ্দীন এবং অরবিন্দ গুহ-র
সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে তাদের লেখা পেতে। কেননা ‘জীবনানন্দকে তাঁর যে ছাত্ররা দেখেছেন চিনেছেন তার ভক্ত হয়েছেন’ এমন ছাত্র এরা দুজন। লিখতে আমন্ত্রণ জানানো হবে
নীহাররঞ্জন রায়, বাণী রায়, অমলেন্দু বসুদের।
এঁরা ‘জীবনানন্দের সঙ্গে কখনও না কখনও কোনো না কোনোভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন অথচ দলেও নেই বিদলেও নেই।’
আরো সম্পাদকীয় সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো, যাঁদের নিজেদের কাগজ আছে তাদের কাছে লেখা চাওয়া হবে না, তাঁরা তাঁদের কথা নিজেদের কাগজেই বলতে পারবেন।’ এছাড়া ওপার বাংলার যাদের সঙ্গে জীবনানন্দের এমনকি চিঠিপত্রেও যোগাযোগ ছিল তাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হবে এ সংখ্যায় লেখার জন্য।
পত্রিকার শেষাংশে জীবনানন্দের প্রকাশিত এবং অগ্রন্থিত রচনার যে পঞ্জি ছাপা হয়েছিল, সে পরিকল্পনাটি অবশ্য শুরুতেই নেওয়া হয়নি। সুচরিতা দাশের সহায়তায় জীবনানন্দের পান্ডুলিপির বাক্সগুলি নাড়াচাড়া করার পর সবশেষে এই পরিকল্পনাটি নিয়েছিলেন ভূমেন্দ্র গুহ। জীবনানন্দ সংখ্যার পরিকল্পনা নিতে অনেকটা সময় কেটে গেছে। ‘ময়ূখে’র প্রকাশ ততদিনে খুব স্বাভাবিক নেই আর। তাই ঠিক হলো জীবনানন্দ সংখ্যা বেরোবার আগে একটি সাধারণ সংখ্যা প্রকাশ করতে হবে তাতে জীবনানন্দন স্মৃতি সংখ্যা যে বেরুচ্ছে সেই ঘোষণা জানানো হবে। প্রস্তাবিত সেই সংখ্যাটিতে থাকবে জীবনানন্দের একটি প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত প্রবন্ধ, থাকবে অপ্রকাশিত কবিতা। এই সংখ্যাটি প্রকাশিত হল ‘হেমন্ত সংখ্যা’ হিসেবে। জীবনানন্দের বহু পরিচিত যে ছবিটি আমরা এখন দেখতে পাই ‘ময়ূখে’র ওই সংখ্য’য় সেটি প্রথম ছাপা হয়, ‘যেটি হয়তো তিনি স্টুডিওতে গিয়ে, স্বভাব-বিরুদ্ধভাবে নিজেই তুলিয়েছিলেন’ কোনো গুণমুগ্ধের একান্ত অনুরোধে।
হেমন্ত সংখ্যা যথাসময়ে বেরিয়ে গেল। জীবনানন্দ স্মৃতিসংখ্যার প্রস্তুতি তখন তুঙ্গে। নিজেরা যারা যা লিখবেন সে বিষয় নির্ধারণ করে সময় বেঁধে দেওয়া হল। ভূমেন্দ্র গুহ মেতে উঠলেন জীবনানন্দের পান্ডুলিপি সংগ্রহের কাজে। তাঁর কথায়, ‘ আমি আর দিদি (সুচরিতা দাশ) জীবনানন্দের ট্রাঙ্কগুলি নিয়ে পড়লুম,তাঁর খাতাপত্র ফাইল লেফাপা কাটিং নিয়ে।’..
কিছুদিনের মধ্যেই অশোকানন্দ দাশ তাঁর গদ্য লেখাটি লিখে ফেললেন, ‘ জীবনানন্দ বিষয়ে তাঁর জীবনের প্রথম প্রবন্ধ।’ সুচরিতা দাশ ‘তাঁর লেখাটি কে কতবার কাটাকুটি করলেন, কপি করলেন কতবার’ এবং শেষ পর্যন্ত সমস্ত আমন্ত্রিত লেখা জমা পড়ে যাওয়ার অনেক পরে তার লেখাটি দিলেন।
বাণী রায়কে লেখার কথা জানাতে, কিছুদিনের মধ্যেই তার লেখাটি তৈরি করে ডাকে পাঠিয়ে দিলেন। নীহাররঞ্জন রায় আগ্রহের সঙ্গে বারবার জানান লেখা দেবেন। কিন্তু নতুন লেখা, তাঁর আর হয়ে ওঠে না। অনেকবার তাঁর বাড়িতে যান ভূমেন্দ্র গুহরা। অবশেষে তিনি জানালেন, ‘ তোমরা আমার ‘নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’এর সভাপতির অভিভাষণ থেকে উপযুক্ত অংশটুকু ছেপে দাও; জীবনানন্দ সম্পর্কে অনেকটাই ওখানে বলা হয়েছে।’ শেষপর্যন্ত নীহাররঞ্জন রায়ের সেই লেখাটিই নেওয়া হল।
আবুল কালাম শামসুদ্দীনকে ঢাকার ঠিকানায় চিঠি লিখে লেখা চাওয়া হলে পত্রপাঠ তিনি লেখা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। অরবিন্দ গুহর লেখা অবশ্য আসেনি। ভূমেন্দ্র গুহের ভাষায়, ‘ তিনি হয়তো অন্য কোন বহুল প্রচারিত সাময়িকপত্রকে সে লেখা দিয়েছিলেন।’ সঞ্জয় ভট্টাচার্যের পরামর্শে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের কাছে লেখা চাওয়া হয়। যদিও তাদের ভয় অচিন্ত্যকুমার ‘মুডি মানুষ খুব’। এবং তিনি লেখা দিলে পারিশ্রমিক নিয়ে থাকেন। ময়ূখের সে আর্থিক ক্ষমতা নেই। সব শুনে অবশ্য অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তাদের বলেছিলেন ‘কোন লিটল ম্যাগাজিন তো আমার কাছে লেখা চায়না, পারিশ্রমিকটা সব সময় ডিসাইডিং ফ্যাক্টর নাও হতে পারে।’… একদিন তিনি চিঠিতে তার লেখাটি তৈরি, এবং নিয়ে যেতে, জানালেন। চিঠি পেয়ে শেষ পর্যন্ত তার বাড়ি থেকে লেখাটি সংগ্রহ করে আনা হলো। পাওয়া গেল না অমলেন্দু বসুর প্রবন্ধ। তিনি জানালেন এখন তিনি লিখতে পারছেন না। পরে জীবনানন্দের উপর বড়সড়ো কিছু লিখবেন এবং তখন ‘ ময়ূখকে স্মরণ করবেন’। ‘ময়ূখে’র সম্পাদকদের অবশ্য ধারণা তৈরি হয় তাদের পত্রিকার শীর্ণ কলেবর দেখে সম্ভবত অমলেন্দুবাবু তাদের পত্রিকার উপর আস্থা রাখতে পারেননি। তারপর সঞ্জয় ভট্টাচার্যের লেখা তারা পেয়ে গেলেন। সবশেষে তৈরি হলো জীবনানন্দ দাশের প্রকাশিত অপ্রকাশিত লেখার একটি সূচিপঞ্জি। পরিশ্রম সাপেক্ষ এ কাজটি করে ফেললেন ভূমেন্দ্র গুহ। এই পঞ্জি প্রণয়নের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন ভূমেন্দ্র গুহ,
‘… জীবনানন্দ নিজেই তার অনেক মু্দ্রিত লেখার কাটিং রেখেছেন। তার শীর্ষে কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, কোন সংখ্যায় কোন বর্ষে ইত্যাদি… কয়েকটা মাস যে কীভাবে খরচ হয়ে গেল পিছন ফিরে তাকিয়ে তা আর বোঝা গেল না।’
সংখ্যাটি শুরু হয়েছিল ঋগ্বেদের শ্লোক ও তার বঙ্গানুবাদ দিয়ে। সঞ্জয় ভট্টাচার্য চয়ন করে দিয়েছিলেন সেই শ্লোক। ‘গোটা গোটা মুক্তোর মত হাতের লেখায়’ সঞ্জয় ভট্টাচার্য তিনটি শ্লোক ভূমেন্দ্র গুহ-র হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ মুখবন্ধে এই শ্লোক তিনটি উল্লেখ করে জীবনানন্দ তর্পণ শুরু করো। তাতে শুরু থেকেই একটা বিনয়াবনত গাম্ভীর্যের আবহাওয়া বাঁধা হয়ে যাবে তোমাদের স্মৃতিতর্পণে।’
এ সংখ্যার প্রচ্ছদ পরিকল্পনা নিয়ে ময়ূখের অনেক ভাবনা কাজ করেছিল। জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পান্ডুলিপি’র যে প্রচ্ছাদের ছবি সেটিই পত্রিকার এ সংখ্যার প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হয়। প্রচ্ছদ করেছিলেন অনিল ভট্টাচার্য। ঠিক হয় ‘ভারি ইম্পোর্টেড আর্ট পেপারে মলাট ছাপা হবে।’ এছাড়া জীবনানন্দকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির প্রতিলিপি এসংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রপ্রকাশনার ধরনে ব্যবহৃত হয় হলুদ রঙের কাগজের প্রিন্ট। জীবনানন্দ দাশের কবিতার পান্ডুলিপির ব্লক করে হাতের লেখার প্রতিলিপি মুদ্রণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। তিনটি পান্ডুলিপি নেওয়া হল তার কবি জীবনের তিন পর্যায়ের, যাতে পান্ডুলিপি থেকেও তার কবিতার এবং হস্তলিপির বিবর্তন ধারা পাঠক বুঝে নিতে পারে। ছাপা হয়েছিল আরো একটি জীবনানন্দের ছবি সুচরিতা দাস সেই ছবিটি সরবরাহ করেন বলা ভালো তার ইচ্ছেতেই এই ছবির ব্যবহার। মৃত্যুর পর সে বছর ৬ ফাল্গুন সুচরিতা দাশের স্কুলে জীবনানন্দের জন্মবার্ষিকী পালিত হয়। তারই একটি ছবি তুলেছিলেন তমলুকের সচ্চিদানন্দ রায়, যিনি সুচরিতা দাশকে ‘দিদি’ সম্বোধন করতেন। এই ছবির নির্বাচনটি ময়ূখের বন্ধুদের খুব যে পছন্দ হয়েছিল এমন নয়। তবু সুচরিতা দাশের ইচ্ছেকে মর্যাদা দিতে সেটিই ছাপার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ভূমেন্দ্র গুহ লিখেছেন, ‘আমাদের খুব যে পছন্দ ছিল তা নয়, তবু দিদির টাটকা বিয়োগব্যথাকে কেউ আহত করতে চায়নি বলে তার ইচ্ছেয়ষষ সেই ছবিটিও মুদ্রিত হবে, মেনে নেওয়া হল; ঠিক হল, আর্ট পেপারের ছোট কাগজে ছবিটি ছেপে ছাইরাঙা মোটা কার্টিজ কাগজের পাতায় ছবিটি সেঁটে দেওয়া হবে।’
‘ময়ূখ’ ছাপা হতো কালিঘাট প্রেস থেকে। ছাপা যে খুব খারাপ হত এমন নয়। কিন্তু জীবনানন্দ সংখ্যার ছাপা কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না। আরও ভালো হওয়া চাই। ফলে কালিঘাট প্রেস থেকে সমস্ত লেখা তুলে নিয়ে যাওয়া হল সূর্য সেন স্ট্রিটের ‘সানসাইন প্রেস’- এ। কিন্তু প্রেস বদল করতে গেলে তো পুরনো সব ধার শোধ করে দিতে হবে। নতুন প্রেসকে অ্যাডভান্স দিতে হবে। তখনি তখনি কাগজ কেনার নগদ টাকা চাই। খরচ আসবে কোথা থেকে? ‘ময়ূখে’র সম্পাদকেরা কেউ ধনীর ছেলে নন একেবারেই। ‘ময়ূখ’ ছাপার খরচও যোগাড় করতে হতো নানা উপায়ে, নানা পন্থা অবলম্বন করে।
শেষ পর্যন্ত টাকা অবশ্য কিছুটা যোগাড় হল। ভূমেন্দ্র গুহ তার মেডিকেলের পড়াশোনার বইগুলি বিক্রি করে দিলেন। জগদিন্দ্র মন্ডলও তার পাঠ্যপুস্তক বিক্রি করে দিলেন। এমন কি ভূমেন্দ্র গুহ, বন্ধুদের পরামর্শে কর্ণপাত না করে, রক্ত বিক্রি করতেও চলে গেলেন। অন্যান্য সদস্যদের যৎসামান্য উপার্জন থেকেও আরও কিছু টাকা পাওয়া গেল। আবার প্রেস বদল করা হল। ‘সানসাইন প্রেস’ থেকে এবার যাওয়া হল ‘উৎপল প্রেসে’। এই ‘উৎপল প্রেসে’ই নাকি সত্যজিৎ রায়ের ‘অপরাজিত’ ছবির শুটিং হয়েছিল। সেই প্রেসে এসে তাদের জীবনানন্দ সংখ্যা ছাপার কাজ একটু একটু করে শেষপর্যন্ত সম্পূর্ণ হয়ে গেল। এবং তারপর পাঠানো হল দপ্তরিখানায়, বাঁধাই এর কাজে। দপ্তরিখানার নাম ‘আর্যলক্ষ্মী বুক বাইন্ডিং ওয়ার্কস’। দপ্তরিখানা থেকে বাঁধাই পত্রিকা উদ্ধারের ক্ষেত্রে আবার নেমে এল আর্থিক সংকট। সকলেই এবার ঢিমে তেতালে চলে। অবশেষে একদিন ‘ময়ূখে’র এক সুহৃদ সেই সচ্চিদানন্দ রায় যিনি সুচরিতা দাশকে দিদি বলতেন, তিনি এগিয়ে এলেন এই বিশেষ সংখ্যার প্রকাশের শেষ ব্যবস্থার ভার নিতে । তারই আর্থিক সহায়তায় শেষ পর্যন্ত জীবনানন্দ স্মৃতি সংখ্যা প্রকাশিত হল। ‘ময়ূখে’র অন্যতম সহযোগী প্রতাপ গোস্বামী সেদিনের স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘আমাদের সর্বস্বান্ত করে দিয়ে ময়ূখ তাহলে বেরলো শেষ পর্যন্ত। আজ আর সমস্ত রাত ঘুম হবে না। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতেই দেখতে পাব যে জানালার পাশে চাঁদ ডুবে যাচ্ছে। এত যন্ত্রণা এত দুঃখেও যে অশেষ সুখ ছিল সেই সুখের ঘরের তালার চাবি শেষে হারিয়ে ফেলেছিলাম অবশ্য।’…
এরপরও অনিয়মিত ‘ময়ূখ’ চলেছিল আরও কিছুদিন, ১৯৬৮ পর্যন্ত।
……………
তথ্য ঋণ : ভূমেন্দ্র গুহ,দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, জগদিন্দ্র মন্ডল-এর যাবতীয় স্মৃতিকথা গদ্য।