spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধজাকির আবু জাফরের কবিতা : জীবন ও জগতের শব্দস্মারক

লিখেছেন : আবু তাহের সরফরাজ

জাকির আবু জাফরের কবিতা : জীবন ও জগতের শব্দস্মারক

আবু তাহের সরফরাজ

মানুষ প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতির রূপরসগন্ধে প্রতিমুহূর্তে মানুষের জৈবিক রসায়ন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। প্রকৃতির নানা উপাদানের সাথে মানুষের রয়েছে হৃদ্য সম্পর্ক। আমাদের জীবনযাপনে প্রকৃতির অনুষঙ্গ কী প্রগাঢ়, তা উপলব্ধি করা যায় জাকির আবু জাফরের কবিতা পড়তে গেলে। যাপিত জীবনের টুকরো টুকরো নানা ছবি শব্দের তুলিতে এঁকে তার সাথে প্রকৃতির যোগসূত্র তৈরি করেন তিনি। এহেন কৃতকৌশল অবশ্যি নতুন কিছু নয়। বাংলা কবিতায় চর্যাপদের কবিদের মাধ্যমে এই ধারা চলে আসছে। তবে জাকিরের কবিতায় প্রকৃতি ও যাপিতজীবনের যে সাদৃশ্য আমাদের চোখে পড়ে তা সমকালের প্রেক্ষিতে উপস্থাপনা। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতি ও মানবজীবনের যে যোগসূত্র আমরা পাই সেই যোগসূত্র এখন খুঁজতে গেলে আমরা আর পাবো না। কারণ, মহাকালের রথের চাকায় সময় পেরিয়ে গেছে। জীবনযাপনে ব্যবহারিক নানা উপাদানও বদলে গেছে। নব্বইয়ের দশকের ধীমান কবি জাকির আবু জাফর। নিজ কালখণ্ডকে ধারণ করেই তিনি প্রকৃতির অনুষঙ্গে যাপিত জীবনের ছবি এঁকেছেন। যাপিত জীবনকে দিয়েছেন আলাদা ব্যঞ্জনা ও রূপবৈচিত্র্য। ‘ধ্যানের সচিত্র শরীর’ কবিতায় জাকির লিখছেন:

সে কোথায়! যে আমাকে বলেছিল— নদীকে বুকের পাশে রেখো
তোমার তৃষ্ণার অভাব হবে না কোনোদিন
কি ভেবে সমস্ত নদীটাই আমি পুরে নিয়েছি বুকের ভেতর
অথচ আমার তৃষ্ণার প্রচণ্ডতায় পরাজিত হলো গ্রীষ্মের দগ্ধতম দুপুর

নদী এখানে প্রকৃতির একটি উপাদান। কেউ একজন কবিকে বলেছিল, নদীকে বুকের পাশে রাখলে তার তৃষ্ণার জলের অভাব কোনোদিন হবে না। কারণ, নদী তো অথই জলের প্রবাহ। যখন ইচ্ছে আঁজলা ভরে জল পান করা যাবে। কী ভেবে কবি পুরো নদীটাকেই বুকের ভেতর রেখে দিয়েছেন। কিন্তু তার তৃষ্ণা এতটুকুও তৃপ্ত হয়নি। বরং তার তৃষ্ণার কাছে হার মেনে গেছে তাপদগ্ধ গ্রীষ্মের দুপুর। নদীকে বুকের পাশে রাখার পরামর্শ যে দিয়েছিল, কবি এখন তাকে আর খুঁজে পাচ্ছেন না। পেলে তার কাছ থেকে হয়তো এর কারণ জেনে নিতে পারতেন। এখন আমাদের মনে প্রশ্ন জেগে ওঠে, কী এমন তৃষ্ণার বহর যে গোটা একটা নদীতেও কবির তৃষ্ণা নিবারণ হচ্ছে না? বলা দরকার, নদী ও তৃষ্ণা দুটোই প্রতীকী। তৃষ্ণা বলতে আমরা ধরে নিতে পারি, আকাঙ্ক্ষা। অথবা মানবীয় পূর্ণতার গন্তব্য। নদী হচ্ছে সেই গন্তব্যের পৌঁছনোর উপকরণ। মনে পড়ছে বিখ্যাত সেই গানটার কথা :

‘লালন মরলো জল পিপাসায় থাকতে নদী মেঘনা/হাতের কাছে ভরা কলস, তবু তৃষ্ণা মেটে না।’

কেন মেটে না? কেন মানুষের বুকের ভেতর তৃষ্ণার গন্তব্যে পৌঁছতে এত হাহাকার? সেসব জবাব একেক মানুষের কাছে একেক রকম। চট করে সহজেই এর জবাব দেয়া সম্ভব নয়। তবে মানুষ চেষ্টা করে। নিজের মতো করে কল্পনাকুসুম রচনা করে মনে-মনে। আর তাই একই কবিতায় জাকির লিখছেন:

আমার ধ্যানের সচিত্র শরীর নির্মাণ করার জলরঙ জোগাড় করেছি
সূর্যের হৃদয় থেকে
চাঁদ দিয়েছিল রূপালি বোধের তেলরঙ।

ধ্যান শব্দটি পড়ার পর আমরা বুঝতে চেষ্টা করি, ধ্যান ও তৃষ্ণার সাথে সম্পর্ক কি? তৃষ্ণার অনুভূতি একেক মানুষের কাছে একেক রকম। এই অনুভূতি দ্বারা তাড়িত মানুষ স্বভাবগত আবেগে একেক রকম আচরণ করে। কেউ অস্থির হয়ে ওঠে, কেউ আবার ধ্যানের ভেতর থিতু হয়ে কল্পনায় আয়োজন করে তৃষ্ণা পূরণের সম্ভাবনার নানা ছবি। তৃষ্ণা-কাতরতায় জাকির ধ্যানী হয়ে ওঠেন। তার ধ্যানের রূপকে চিত্ররূপ দিতে তিনি সূর্যের হৃদয় থেকে জলরঙ জোগাড় করেন। আমরা জানি, সূর্যের উত্তাপে জল বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। অথচ সেই সূর্যের কাছ থেকেই কবি তার তৃষ্ণা নিবারণের বাসনাকে নির্মাণ করতে জলরঙ সংগ্রহ করছেন। তাও আবার সূর্যের হৃদয় থেকে! সূর্যের হৃদয় সত্যি সত্যি আছে কিনা, তা আমাদের জানা নেই। তবে বুঝতে মোটেও কষ্ট হয় না, জাকিরের কল্পিত ‘সূর্যের হৃদয়’ তার তৃষ্ণাকাতর হৃদয় থেকেই উৎসারিত। রঙ তো পাওয়া গেল, কিন্তু বোধ তিনি কার কাছ থেকে পেলেন? চাঁদের রূপালি বোধের কাছ থেকে পেলেন। অবশ্যি সেই বোধ তেলরঙ হয়ে তার ধানের মূর্তিকে অবয়ব দিয়েছে। প্রকৃতির উপানাদের সাথে এই যে মানবজীবনের যোগসূত্র জাকির আমাদের সামনে তুলে ধরলেন, এটাই কবিত্ব। এখানে কোথাও শিল্পসৌন্দর্য এতটুকু চিড় ধরেনি। বরং, জাকিরের শব্দচয়নে কবিতার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যে পাঠক মুগ্ধ হয়ে ওঠে। জাকিরের কল্পনার সৌন্দর্য কতটা প্রখর তার পরিচয় পাওয়া যায় একই কবিতায় এই পঙক্তিতে, ‘পাখির পাখায় প্রেমপত্র লিখে কলমটি ছিল রোদের পকেটে।’ তবে সত্যি যে, পাখা না লিখে ডানা শব্দটি লিখলে বাক্যটি পড়তে পাঠকের বেশি আরাম লাগতো। ডানা শব্দের ধ্বনিগত যে ব্যঞ্জনা সেটা পাখা শব্দে নেই।
জীবনকে খুব ভেতর থেকে দেখার আশ্চর্য এক শৈল্পিক দৃষ্টি রয়েছে জাকির আবু জাফরের। প্রতি মুহূর্তে নানা ঘটনার অভিঘাতে মানুষের জীবনের বাঁক বদল ঘটছে। বহুবর্ণিল জীবনে এক একজ মানুষের অনুভূতির জগৎও ভিন্ন ভিন্ন। জীবনকে খুঁড়ে বোধের অন্তর্গত রঙছবি ও উপলব্ধির স্ফুরণ কবিতায় শব্দের রূপ দিতে সূক্ষ্মদৃষ্টি লাগে। সাধারণ মানুষ দেখছে, ইটের একটি টুকরো পড়ে আছে। বিজ্ঞানী দেখছেন, একটি পদার্থ অভিকর্ষ বলের আকর্ষণে বাঁধা পড়ে আছে মাটির ওপর। দুই শ্রেণির মানুষের দেখার মধ্যে পার্থক্য কি চোখে পড়ল? আমি মনে করি, কবি ও বিজ্ঞানীর ভেতর কোনোই পার্থক্য নেই। তাদের উভয়েরই দেখার চোখ একই রকম। কাজী মোতাহার হোসেনের একটি প্রবন্ধ আছে ‘কবি ও বৈজ্ঞানিক’ শিরোনামে। এই বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে প্রবন্ধটি পড়ে নেয়া যেতে পারে। বলতে দ্বিধা নেই, বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ ধামাধরা কবিদের এই কবিত্ব নেই। আর তাই, শব্দের বকবকানি ছাড়া তাদের কবিতায় কোনো পর্যটন নেই। কিন্তু জাকির আবু জাফরের বেশির ভাগ কবিতায় দৃশ্যের ভেতর দৃশ্যের নির্মাণ আমাদের চোখে পড়ে। জীবনকে ভেঙেচুরে দেখার আস্বাদ আমরা পাই তার কবিতা পাঠে। বিষয়টি বুঝে নিতে আমরা এবার জাকিরের ‘ডানাওয়ালা গ্রমের শিশু’ কবিতাটি পড়ে ফেলবো।

ডিমের খোসা ভেঙে হাঁসের বাচ্চাটি এইমাত্র লাফিয়ে পড়েছে
পৃথিবীর উঠোনে। এক অদ্ভুদ ভঙ্গিমায় বাতাস ফেঁড়ে
ঝাঁপিয়ে ঢেউ তুলে দিল পুকুরে। আকস্মিক মনে হলো
কোনো হলুদ নক্ষত্রের ছানা কিংবা ডানাওয়ালা গ্রহের কোনো শিশু
হলুদ পশম ছড়িয়ে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছে জলের ঐশ্বর্যে
ছোট ছোট ঢেউ স্পন্দন জাগিয় উচ্ছ্বাসে ভিড়ে যায় তীরে
বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তার কম্পন, হলুদ কোমল মৃদুময় আরাম
এক মনোহরী শিহরণ, এক অনন্য সাহসের উপমা এখন আমার চোখে
আমি দেখছি, কাঁপছি, আনন্দে— সৌন্দর্যে
এবং দেখছি জন্মেই শিক্ষিত এক সাঁতারু

দারুণ দক্ষতায় সাঁতার কাটছে হাঁস-শিশুটি
কে তাকে এমন ভেসে চলার রীতি শিখিয়েছে, এতটা নির্ভরতাই বা
কেন এই ক্ষুদে সাঁতারুর ডানায়—
আমার ভেতর কল্পনার উড়োযান আদিগন্ত তোলপাড় করে ফিরছে
এ কেমন কোমন কম্পন পৃথিবীকে ভাসিয়ে চলেছে সামান্য একটি পুকুর জলে

বিস্ময় কাকে গ্রাস করবে না! কার চোখ কপালে না উঠে পারে!
সামান্য আগেও শিশুটি ছিল একটি খোসার গোলকে বন্দি,
পৃথিবীর কোথাও ছিল না যার স্পন্দন এখন সে কিনা পৃথিবীকে
কাঁপিয়ে দিচ্ছে এক অদ্ভুদ সাঁতার দক্ষতায়—
কী করে ডিমভাঙা বাচ্চাটি সমস্ত পুকুরের দৃশ্যকে পরাজিত করে
পানির কোলে বসে আকাশ দেখে। মাঝে মাঝে অস্পূর্ণ ডানার
দাপটে পানি বাষ্প হয়ে উড়ে যায় বাতাসের পৃথিবীতে।

এ এক নতুন অতিথি পৃথিবীর। মৃত খোলস থেকে বেরিয়ে
ঢেউ ভাঙছে পুকুরের শরীর জুড়ে
তার ঠোঁটে বেজে উঠছে আগামীর আনন্দ গান।

ডিমের খোলস ভেঙে বেরিয়ে হাঁসের একটি ছানা পুকুরের পানিতে নেমে পড়ল। এরপর সাঁতার কাটতে আরম্ভ করলো। এই হচ্ছে কবিতাটির বিষয়বস্তু। খুবই সাধারণ একটি ঘটনা। এরকম অসংখ্য সাধারণ ও তুচ্ছ ঘটনা প্রতিমুহূর্তে আমাদের চারপাশে ঘটে যাচ্ছে। সেসব ঘটনার তাৎপর্য বিশেষভাবে কখনোই আমরা ভেবে দেখি না। কিন্তু জাকির আবু জাফর ভাবেন। কারণ, তিনি কবি। আপেল গাছের নিচে আপনমনে বসে আছেন আইজ্যাক নিউটন। হঠাৎ একটা আপেল টুপ করে পড়ল তার সামনে। আপেলটার দিকে চোখ পড়তেই মুহূর্তে তার মাথার ভেতর একটা চিন্তা ঢুকে গেল, আপেলটা নিচের দিকে পড়ল কেন? ওপরেও তো উঠে যেতে পারতো! ওপর থেকে কোনো জিনিসকে ফেললে সবসময় কেন সেটা মাটির দিকে নেমে আসে? নিশ্চয়ই পৃথিবী সকল পদার্থকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। এই চিন্তায় বিভোর হয়ে গেলেন তরুণ নিউটন। অবশেষে তিনি আবিষ্কার করলেন, পৃথিবী আসলেই সকল পদার্থকে নিজের দিকে প্রতিমুহূর্তে আকর্ষণ করছে। এই আকর্ষণ মহাবিশ্বের যেকোনো দুটি পদার্থের মধ্যে হয়ে থাকে। আরসব মানুষের মতো নিউটন ভাবেননি, আপেল তো নিচের দিকেই পড়ে। এটা আর নতুন কী! যদি ভাবতেন তাহলে তিনি মহাকর্ষ বল আবিষ্কার করতে পারতেন। দেখা যাচ্ছে, বিস্ময়কর এই আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে কৌতূহল। এখানেই সাধারণ মানুষ আর অসাধারণ মানুষের পার্থক্য। সাধারণ মানুষ দ্যাখে, প্রতিদিন সূর্য ওঠে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যার ভেতর কৌতূহল আছে সে প্রতিদিন সূর্য ওঠার কারণ জানতে চায়। কেননা সে জানে, কারণ ছাড়া জগতে কোনো ঘটনাই ঘটে না। এই কৌতূহল আছে বলেই জাকির আবু জাফর কবি। কৌতূহল দ্বারা প্ররোচিত হয়ে তিনি ডিম ফুটে বের হওয়া হাঁসের ছানাকে নিয়ে লিখে ফেললেন গোটা একটা কবিতা। যে কবিতা পড়তে পড়তে আমরা বুঝতে পারি, যে ঘটনা এতদিন আমরা সাধারণ বলেই দেখে এসেছি সেই ঘটনার পেছনে কী সূক্ষ্ম কারুকাজ রয়েছে! নানা উপমা-উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্প ব্যবহার করে কবিতার মধ্য দিয়ে জাকির আমাদেরকে পর্যটন করান জীবন ও জগতের রহস্যে। সদ্যফোটা হাঁসের ছানাটি যখন পুকুরের জলে সাঁতরে বেড়াচ্ছে তখন হঠাৎই জাকিরের মনে হলো, কোনো নক্ষত্রের ছানা কিংবা ডানাঅলা গ্রহের কোনো শিশু যেন জলে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছে। এই কল্পচিত্র কখনোই কী জলে সাঁতরে যাওয়া হাঁসের কোনো ছানার দিকে চেয়ে আমাদের মাথায় এসেছে? কী অসাধারণ, ভাবা যায়? ছিল হাঁসের ছানা, হলে গেল নক্ষত্রের ছানা! দেখার কী আশ্চর্য চোখ জাকিরের! তিনি কবি বলেই এভাবে দৃশ্যান্তর ঘটাতে পেরেছেন দেখার বিষয়বস্তুকে। হাঁসের ছানার সাঁতরে যাওয়ার দৃশ্যের যে বর্ণনা তিনি দিচ্ছেন তা শিল্পসৌন্দর্যে অনন্য। জন্মসূত্রেই শিক্ষিত সাঁতারুকে দেখতে দেখতে কবি যখন বলেন তিনি সৌন্দর্যের আনন্দে কাঁপছেন, তখন পাঠক হিসেবে আমরাও বুকের ভেতর কাঁপুনি অনুভব করি। জাকির প্রশ্ন তোলেন, এভাবে চলার কৌশল কে তাকে শেখালো? ক্ষুদে সাঁতারুর ডানায় এতটা নির্ভরতাই বা কেন? এই প্রশ্ন তীরের ফলার মতো বিদ্ধ করে পাঠকের বিশ্বাসের জগৎকে। সৃষ্টিকর্তার কুশলী সৃষ্টিনৈপুণ্যে পাঠক মুগ্ধ না হয়ে পারে না। বিস্ময় এসে আমাদেরকে গ্রাস করে ফ্যালে। জাকিরের প্রশ্ন, এই দৃশ্য দেখে কারই বা চোখ কপালে উঠবে না? ‘পৃথিবীর কোথাও ছিল না যার স্পন্দন এখন সে কিনা পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে এক অদ্ভুদ সাঁতার দক্ষতায়!’ ভেবে দেখা জরুরি, জাকিরের সাথে সাথে আমরা ক’জনের চোখ কপালে ওঠে। খুব বেশি নিশ্চয়ই নয়। আমাদের চারপাশের বেশির ভাগ মানুষ প্রকৃতির রহস্য সম্পর্কে উদাসীন। তাদের ভাবখানা এমন যে, প্রকৃতিরাজ্যে যা ঘটে যাচ্ছে তার আলাদা কোনো মানে নেই। সেসব ঘটছে, তাই ঘটছে। কিন্তু যাদের বোধশক্তি আছে তারা জানে, সৃষ্টিকর্তার নির্ধারিত কার্যকারণ সূত্র মেনেই প্রতিটি ঘটনা ঘটছে। জগতের কোনো ঘটনাই এমনি এমনি ঘটে না। শেষ বাক্যে জাকির লিখছেন, ‘তার ঠোঁটে বেজে উঠছে আগামীর আনন্দ গান।’ সদ্যজাত হাঁসের ছানার ছোট্ট ঠোঁটে যে চিঁউচিঁউ আওয়াজ তাকেই কবি বলছেন, আগামীর আনন্দ গান। কিসের আনন্দ? প্রাণস্ফুরণের আনন্দ। জগতের প্রাণের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়ার আনন্দ।
জাকিরের প্রায় কবিতাতেই জীবন ও জগতের এমন যোগসূত্র আমাদের চোখে পড়ে। যে চোখ দিয়ে জাকির এই যোগসূত্র মিলিয়ে দেখেন তা যেন দার্শনিকের চোখ। সত্যিই তাই। জীবন ও জগৎকে বুঝে নেয়ার দায় থাকে দার্শনিকের। জাকির আবু জাফর তার কবিতার ভেতর দিয়ে জীবন ও জগৎকে বুঝে নিতে চান বলেই আমার মনে হয়েছে। ‘হৃদয়ের মতো রাজ্য নেই’ কবিতায় জাকির লিখছেন:

আত্মহননের আকাঙ্ক্ষা প্রশ্রয় দেয়ার আগে
একবার হৃদয়পুরীর জলের শরীরে ফেরো
দেখবে ভালোবাসার মতন কোনো পদ্ম নেই পৃথিবীর হৃদয়কাননে।

জীবনকে যখন মানুষ ছুঁয়ে দেখতে পারে না, যাপিত বাস্তবতা যখন যন্ত্রণার পেরেক হয়ে মানুষকে প্রতিমুহূর্তে বিদ্ধ করতে থাকে, সেই মুহূর্তে মানুষ জীবনের প্রতি সকল আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তার ভেতর সেসময় জেগে ওঠে আত্মহননের প্রবল আকাঙ্ক্ষা। জাকির জীবনবাদী। তিনি জানেন, জীবনের একপিঠে যন্ত্রণা আছে ঠিকই কিন্তু আরেক পিঠে রয়েছে আনন্দ। ভালোবাসার আনন্দ। ভালোবাসার চেহারা নানা রকমের। নানা রঙের। এই ভালোবাসার উৎস হচ্ছে মানুষের হৃদয়। বলা চলে, হৃদয় হচ্ছে ভালোবাসার আনন্দ সরোবর। এই সরোবরে ভালোবাসা পদ্ম হয়ে ফুটে থাকে। এই পদ্মের মতো সৌন্দর্যমণ্ডিত আর কোনো পদ্ম পৃথিবীর হৃদয়বাগানে নেই। আর তাই, জাকির আত্মহননে উদ্যত মানুষকে পরামর্শ দিচ্ছেন, হৃদয়পুরীর আনন্দ সরোবরে একটিবার ফিরে যাও। তবেই দেখতে পাবে, জীবন কত সুন্দর। জীবনের আনন্দ ভালোবাসার পদ্ম হয়ে কি আশ্চর্যভাবে ফুটে আছে তোমার হৃদয়পুরীর সরোবরে। মানুষের অন্তঃকরণকে জাকির হৃদয়পুর বলছেন। মানে, একটি অঞ্চল হিসেবে বোঝাতে চাইছেন। যেমন, আমি যে গ্রামে বাস করি তার নাম কমরপুর। আশপাশের দুটি গ্রামের নাম শোভাপুর ও পরাণপুর। জাকির বোঝাতে চাইছেন, একইভাবে হৃদয়পুরও একটি গ্রাম। যে গ্রাম সকল মানুষের ভেতরই রয়েছে। কিন্তু আমরা কখনো সেই গ্রামে গিয়ে সৌন্দর্য অবলোকন করি না। যদি করতাম তাহলে দেখতে পেতাম, কী বিচিত্র আনন্দের আয়োজন সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। নব্বইয়ের দশকের আরেক কবি সরকার আমিন একটি কবিতায় লিখেছেন, ‘আত্মহত্যার পরিবর্তে ১ কাপ চা খাও’। আমিন ও জাকির একই কথা ভিন্ন ব্যঞ্জনা ও আঙ্গিকে বলেছেন। আমিনের পরামর্শ, আত্মহত্যার বদলে এককাপ চা খেতে খেতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দাও। অথবা এককাপ চা খেতে খেতে প্রকৃতি দ্যাখো। মনের ওপর থেকে ভার নেমে যাবে। জাকির যেহেতু কবিতার ভেতর দিয়ে জীবন ও জগৎকে বুঝে নিতে চেষ্টা করেন তাই তার পরামর্শ, আত্মহত্যার পরিবর্তে পরাণের গহীন ভেতরে ডুব দাও। এই পরামর্শটা আমার ভালো লেগেছে। কারণ, মানুষের অন্তর্জগৎ মহাবিশ্বের মতো বিস্তৃত। সেখানে কত কত রঙ, কত কত বিচিত্র অনুভূতির ঢেউ প্রতিমুহূর্তে জেগে উঠছে আবার ভেঙেও যাচ্ছে। সীমাহীন সেই জগতের আনন্দযজ্ঞে জাকির আমাদের নিমন্ত্রণ জানাচ্ছেন জীবনবাদী দার্শনিকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। একই কবিতায় তিনি লিখছেন:

কিছুই তো থাকে না মাটির মৌচাকে ধুলির সংসারে
শ্যামল অরণ্য সহসা কিভাবে ধূসর বিবস্ত্র হয়, দ্যাখোনি?
বৃদ্ধের দৃষ্টির বিবর্ণ বসন্ত কোনোদিন পারেনি
ফোটাতে প্রেমের গোলাপ
আত্মহননের আগে জেনে নাও বন্ধু
প্রেম থেকে বড় কোনো বিরহও নেই।

জাকির আমাদেরকে বলছেন চূড়ান্ত সেই কথা যা অমোঘ। মাটির সংসারে কিছুই টিকে থাকে না। সৃষ্টি আর ধ্বংস, ধ্বংস আর সৃষ্টিই হচ্ছে জগতের নিয়ম। আজ যেখানে সবুজ শ্যামল বনানি, হয়তো কাল দাবদাহে পুড়ে সেই বনানি পুড়ে ধূসর হয়ে যায়। বৃদ্ধের চোখে বসন্ত বিবর্ণ। সেই চোখে কখনোই প্রেমের গোলাপ ফোটে না। সুতরাং, আমাদের চোখকে বৃদ্ধ হতে দেয়া চলবে না। তরুণ প্রাণের চোখেই আমাদেরকে দেখতে হবে পৃথিবী, গায়ে মেখে নিতে হবে প্রকৃতির রূপরসগন্ধ। আবার এই সত্যিও জাকির আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, আত্মহত্যার আগে জেনে নাও যে, প্রেম থেকে বড় কোনো বিরহও জগৎ-সংসারে নেই। মানে, জীবনের একপিঠে আনন্দ আরেকপিঠে যন্ত্রণা। এই দুইয়ের মাঝমাঝি ভারসাম্য রেখে বেঁচে থাকার নামই জীবন। এইভাবে জীবনবাদী দর্শনের পাঠ আমরা পাই জাকির আবু জাফরের প্রায় সকল কবিতাতেই।
তিনি বিশ্বাস করেন, জীবন গতিশীল। থেমে যাওয়ার নাম জীবন নয়। জীবনকে নানা রূপে নানা রসে প্লাবিত করেই মানুষকে এগিয়ে যেতে হয় গন্তব্যে। আর তাই, আশ্বাস বাণীর মতো জাকির আমাদেরকে শোনান সকল প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে সামনে এগিয়ে চলার শব্দপুঞ্জ। ‘দুঃস্বপ্নের উপত্যকা ছেড়ে’ কবিতায় তিনি লিখছেন:

আমাদের মুখাশ্রিত নতুন শব্দের ঔজ্জ্বল্য
মুছে দেবে অন্ধত্বের কালঘুম
আমরা জেগে উঠবো এক আস্বাদিত সমৃদ্ধির গৌরবে
আবার মানুষ হওয়ার মন্ত্রে মুগ্ধ হবো নিবিষ্টে।

এই যে দৃঢ়প্রত্যয়, এ যেন পরম নির্ভরতার একটি মানবিক আশ্রয়। জীবন তুচ্ছ নয়, জীবন হননের নয়, জীবন উপভোগের। এই সত্য গূঢ়মন্ত্রের মতো আমাদের কানে শোনাতে থাকে জাকির আবু জাফর। তার বলা মন্ত্র সকল মানুষই বুঝতে পারে, না বোঝার কোনো কারণ নেই। কেননা, যেসব শব্দ বিন্যাস্ত করে তিনি কবিতার শরীর নির্মাণ করেন সেসব শব্দ আমাদের প্রতিদিনের যাপিত জীবনে আমরা ব্যবহার করে থাকি। আটপৌরে শব্দের সমারোহে জাকিরের প্রতিটি কবিতাই যেন জীবন ও জগতের শব্দস্মারক।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
সাজ্জাদ সাঈফ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on ১০ টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ