আহমাদ মাযহার
চঞ্চল আশরাফ সাহিত্য পর্যালোচনায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে পারেন। আনিসুল হকের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘মা’ নিয়ে “সাংবাদিকের ‘উপন্যাস’ ও গণমাধ্যমের ভ্রষ্টাচার” শিরোনামে তেমনি এক পর্যালোচনা লিখেছেন ‘পরস্পর’ ওয়েব পোর্টালে। আনিসুল হকের ‘মা’ উপন্যাস নিয়ে সরদার ফজলুল করিম, আনিসুজ্জামান ও মুহম্মদ জাফর ইকবাল পর্যালোচনা লিখেছেন বিভিন্ন সময়। বইটির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে এগুলো বেশ কাজে এসেছিল। তাই চঞ্চল এই পর্যালোচনাগুলোর সীমাবদ্ধতাকেও তাঁর রচনার অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন। তবে যতই প্রশংসার মোড়কে এই তিন পর্যালোচনা বর্ণাঢ্য হোক না কেন এগুলোর মধ্যে যা বলা হয়েছে তা থেকেও আনিসুল হকের ‘মা’ বইটির প্রকৃত মূল্য নিষ্কাশিত হয়ে এসেছিল–চঞ্চল আশরাফের আলোচনায় তাও উন্মোচিত হয়েছে।
এই রচনায় চঞ্চলের বক্তব্যের মূলভাব ঠিকই যে, তিনটি সমালোচনাতেই আর যা কিছু থাকুক সাহিত্য বোধের পরিচয় নেই। আলোচনাগুলোর কোনোটিরই উদ্দশ্য ছিল না ‘মা’কে উপন্যাসশিল্প হিসেবে বিবেচনা করা। ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ও ‘মা’ বিষয়ে জনপ্রিয়তাবাদী যে কোনো মাধ্যমের ক্ষেত্রে যেমন কাঁচা আবেগ বিক্রি করতে চাওয়া হয় এসব আলোচনাতেও তা-ই করা হয়েছে। জনপ্রিয়তাবাদী যে কোনো কাজের যেভাবে প্রচার করা হয় এই পর্যালোচনাগুলোও ছিল সেরকমই প্রচারণার অংশ!
২.
সরদার ফজলুল করিমের লেখার অন্য গুরুত্ব থাকলেও সাধারণত তিনি সাহিত্য বোধের পরিচয় দিতে পেরেছেন এমন প্রায় কখনোই মনে হয়নি আমার। ‘মা’ সম্পর্কে তাঁর লেখাটিও তার বাইরে নয়। আনিসুজ্জামানের লেখাটিতেও ‘মা’ বইটির শিল্পত্ব প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস নেই। তাঁর রচনাটিও স্নেহ ও প্রচারণামূলক। সেজন্যই আনিসুজ্জামান বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা উপন্যাস হিসেবে এবং মাকে নিয়ে লেখা উপন্যাস হিসেবে আনিসুল হকের মা যে-কোনো সময়ের একটি প্রধান উপন্যাসের মর্যাদা লাভ করবে বলে আমার মনে হয়।’ (চঞ্চলের উদ্ধৃতি) এই উদ্ধৃতিতে স্নেহবশত যা বলা হয়েছে তার ব্যখ্যা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে সচেতন ভাবেই! অর্থাৎ মন্তব্যটিকে মন্তব্য আকারেই রাখা আছে এর সমর্থনে যুক্তি দেয়া হয়নি। মুহাম্মদ জাফর ইকবালও সাহিত্য পর্যালোচনায় সাহিত্যিকতায় তাৎপর্যপূর্ণ কথা কোথাও বলতে পেরেছেন এমনটা আমার জানা নেই! ফলে বলাই যায় যে, এই তিন আলোচনা বইটির বাজার বৃদ্ধিতে জনপ্রিয়তাবাদী সহায়ক হিসেবেই ভূমিকা রেখে চলেছে।
৩.
পূর্বোক্ত পর্যালোচনাগুলো বইটি সম্পর্কে কতটা সত্য বলেছে তা নিয়ে জনান্তিকে যথেষ্ঠ আলোচনা হয়েছে বিভিন্ন সময়। ন্যূনতম সাহিত্য রুচি সম্পন্ন প্রায় কোনো পাঠকই বইটির শিল্পক্ষমতা সম্পর্কে আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপে অন্তত ইতিবাচক কিছু বলেননি। কোনো বই থেকে সাহিত্যিক অর্থে কোনো তাৎপর্য নিষ্কাশন করতে না পারলে সে বই নিয়ে আলোচনা প্রায় অর্থহীন হয়ে পড়ে। আবার কোনো রচনার কেবল নেতিবাচকতা তুলে ধরা যেহেতু সাহিত্য সমালোচকের প্রকৃত কাজ নয় সেজন্য অনেকেই বইটি নিয়ে পর্যালোচনামূলক কিছু লিখতেও চাননি। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করে সাহিত্যের ইতিবাচকতার দিকে যাওয়া চঞ্চল আশরাফের ব্যক্তিগত প্রবণতা! সুতরাং তিনি এ ধরনের আলোচনা লিখবেন তা অস্বাভাবিক নয়।
৪.
চঞ্চল আশরাফের সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে আমি একমত হতে না পারলেও তাঁর যে একটা গভীর সাহিত্য বোধ আছে তা আমি সবসময় মানি। সৃষ্টিশীল চিরায়ত সাহিত্যের বিভিন্ন সংরূপের শিল্পকর্মে রয়েছে তাঁর নিবিড় পাঠ। তেমনি রয়েছে নানা রকম তত্ত্বের মাধ্যমে সেসবের বিচারেরও প্রয়াস। তার ওপর তাঁর মধ্যে রয়েছে নন্দন রজনীতির নিজস্ব অবস্থানও। আমার অবস্থান কখনো কখনো তাঁর চেয়ে ভিন্ন হলেও, এমনকি তাঁর বিবেচনা আমার বিরুদ্ধে গেলেও, তাঁর সাহিত্য বিবেচনাকে আমি আমলযোগ্য মনে করি। সুতরাং এই পর্যালোচনাটিও আমার কাছেও বিবেচনাযোগ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে। চঞ্চলের এই কথার সঙ্গে আমি পুরোপুরি একমত যে, ‘সাহিত্যের সচেতন পাঠক সব বুঝতে পারে। তাদের নীরবতার অর্থ সর্বদা এই নয়—যা ঘটেছে, তারা তা মেনে নিয়েছে।’
[চঞ্চল আশরাফের রচনাটি পড়তে https://poros-por.com ভিজিট করুন]