অমিতাভ দাস হিমুন
কবি মামুন মিজান সামাজিক দায়বদ্ধতার অনবদ্য উচ্চারণে তার কবিতায় একদা বলেছিলেন–
মাংসের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ওরা কারা শুঁকছে খবরের কাগজ?
কালো অক্ষরগুলোও যেন তা দেখে বিদ্রোহ করে বেরিয়ে আসতে চায়
ঘুমের মধ্যে নিঃশব্দ মৃত্যুর মতো আকাঙ্ক্ষা বুকে পুষে রেখে
ছায়াগুলো যেন দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ায়
দ্যাখো, চাঁদের মধ্যে আটকে পড়া বুড়ির মুখ খুঁজতে থাকে তারা পদ্মা কিংবা নৈরঞ্জনার কূলে।
ওই বসি-বাসীর চোখ থেকে ঝরে পড়া লবণের মধ্যে
পাঠযোগ্য হয়ে ওঠে তোমার মুখ
তখন হস-রেখা ভুলে আমরা তাকাই আকাশে।
প্রেম-বিরহ-নদী-নারী-নিসর্গও তার কবিতায় যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে সমসাময়িক সমাজের বিরাজিত অসংগতিগুলো। অসম্ভব রোমান্টিক মামুন মিজান প্রয়োজনে তখন তার শব্দমালায় ঝরিয়েছেন বারুদের উত্তাপ। সব মিলিয়ে তাকে চিনতে হলে ডুব দিতে হবে তার সৃষ্টিকর্মের নিজস্ব পৃথিবীতে।
তার সম্প্রতি প্রকাশিত উপন্যাস ‘অপরাজেয়’তে মামুন সম্পর্কে প্রকাশকের মন্তব্যটি কিছুটা হলেও তার সম্পর্কে ধারণা দেবে। সেখানে লেখা হয়েছে–
উত্তর ঘাঘট পাড়ের ছোট্ট একটি জেলা গাইবান্ধা। এই জেলার নিভৃতচারী এক সাহিত্যকর্মী হলেন মামুন মিজান। ‘অপরাজেয়’ তার দ্বিতীয় উপন্যাস। মানুষের আড়ালে থেকে, মঞ্চের আড়ালে থেকে শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে, শব্দের শিকলে ছন্দের সবুজে লিখে চলেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস। তৈরী করছেন সাহিত্যের নিজস্ব ভুবন। তার সাহিত্য মেজাজ একান্ত তার নিজের। মানুষ হিসেবে তিনি প্রতিবাদী। আর তাই উপন্যাসের প্রতিটি ছত্রে ছত্রে তার প্রতিবাদ লিপিবদ্ধ হতে থাকে এক অসম সাহসী অপরাজেয়র মতো। তার সাহিত্য ভাবনায় আছে প্রকৃতি, প্রেম, নারী, রাজনীতি। প্রেমের মধ্যে দুঃখবোধ, বেদনা বোধ যেমন প্রবল তেমনি আছে একটা সবুজ অরণ্যের গোছালো জীবন। লেখক অসম্ভব রকমের প্রকৃতি প্রেমী। সময় পেলেই একা অথবা সঙ্গী নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন প্রকৃতির নিরলস আস্বাদ গ্রহণ করবার জন্য। বেশীর ভাগ সময় কাটে সাহিত্য ভাবনা নিয়ে। সাহিত্যের প্রতিটি শাখার পথ ধরে হেঁটে যেতে চান মাঠের পর মাঠ, গ্রামের পর গ্রামে এবং আধুনিকতার পথ ধরে উত্তরাধুনিকতার মাচানে।
কবি, কথাশিল্পী, গীতিকার মামুন মিজানের জন্ম ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর গাইবান্ধা জেলার নলডাঙ্গায় নানা বাড়িতে। বাবা গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শামসুল হোসেন সরকার, মা মেহেরুন নেছা। চার ভাই এক বোনের মধ্যে মামুনের অবস্থান তৃতীয়। শৈশব কেটেছে গাইবান্ধা শহরের ডেভিড কোম্পানী পাড়ায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় আসামের মাইনকারচরে ক্যাম্পে অবস্থানকালে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হন তিনি। তাই তার জীবনযাপন ছিল অন্য শিশুকিশোরদের চাইতে একটু আলাদা।
উত্তরপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর ৫ম শ্রেণিতে চলে যান পিটিআই পরীক্ষণ বিদ্যালয়ে। বাবা শামসুল হোসেন সরকার তার পরিবারে মুক্তিযুদ্ধ, স্বদেশ প্রেমের চেতনা ছড়িয়ে রেখেছিলেন। শৈশব থেকেই মামুন মিজান সেই আদর্শিক প্রেরণায় বেড়ে ওঠেন। নলডাঙ্গা উমেশ চন্দ্র বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করে দেয়া হয় মামুন মিজান কে। এসএসসিতে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন ১৯৮৭ সালে। ভর্তি হন নলডাঙ্গা ডিগ্রী কলেজে। ৯ম শ্রেণিতে পড়ার সময় নলডাঙ্গার উমেশ চন্দ্র পাঠাগারের একরকম দায়িত্বই নিয়ে ফেলেন মামুন মিজান। স্কুলের পড়ার ফাঁকে সমৃদ্ধ পাঠাগারটি তার সামনে এক নতুন অর্থবহ পৃথিবীর দরজা মেলে ধরে। মামুন পরিচিত হন বাংলা সাহিত্যের সেরা মনীষীদের সৃষ্টির সাথে। সেই সময় থেকেই লেখালেখির জন্য নিজেকে তৈরি করতে শুরু করেন তিনি। ১৯৮৯ সনে এইচএসসি পাশ করার পর মামুন তার আগ্রহের কারণেই ভর্তি হন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। নিমগ্ন হন অবিরাম সাহিত্যপাঠ ও লেখালেখিতে। তার সম্পাদনায় বের হয় ‘কাজ’ নামে একটি লিটল ম্যাগ। বেশকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়ে সাহিত্যপ্রেমীদের মনযোগ আকর্ষণ করে। বাংলা বিভাগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মেধাবী মামুন শিক্ষকদের ভালবাসায় ও অনুরাগে ধন্য হয়ে পরিণত হন অপরিহার্য মানুষে। জনপ্রিয় মামুন মিজান দুদফায় বিভাগের সাহিত্য ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। দেশের শীর্ষ সাহিত্যের কাগজ ও জাতীয় দৈনিকে তার লেখা ছাপা হতে থাকে। ১৯৯৮ সালে বাংলা একাডেমীর তরুণ লেখক প্রকল্পের মাধ্যমে তার কবিতার বই ‘অন্তস্বরের প্রায় গান’ প্রকাশিত হয়। ২০০৫ সালে গাইবান্ধায় বসে তিনি রচনা করেন ভিন্ন ভাষারীতি ও আঙ্গিকের উপন্যাস ‘হাড়বণিক’। ২০১০ সালে প্রকাশিত হয় আর একটি উপন্যাস ‘অপরাজেয়’। প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে রম্য রচনা গ্রন্থ ‘সন্তুমামার বিবাহ কাণ্ড’।
কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে রাজধানীর হাতছানি উপেক্ষা করে তাকে ফিরে আসতে হয় গাইবান্ধায়। একে একে বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন কামারপাড়া কলেজ, সাদুল্যাপুরের জয়েনপুর আলিয়া মাদ্রাসা এবং সবশেষে আবু হোসেন সরকার কারিগরি মহিলা কলেজে। আমৃত্যু সেখানেই কর্মরত ছিলেন মামুন মিজান। মাঝে কিছুদিন খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন গাইবান্ধার আহম্মদ উদ্দিন শাহ্ শিশু নিকেতন স্কুল ও কলেজে।
মামুন মিজান ২০০০ সালে সুন্দরগঞ্জের ধোপাডাঙ্গার মেয়ে ফারহানা জিন্নাত শাপলার সাথে ঘর বাঁধেন। তার ঘর আলো করে জন্ম নেয় দুই কন্যা মিথিলা পৃথিলা। স্নেহ-ভালবাসার বন্ধনে মামুন মিজান থিতু হন গাইবান্ধার ডেভিড কোম্পানী পাড়ায়।
অসাধারণ ভরাট একটি কণ্ঠ ছিল মামুন মিজানের। উচ্চারণ, বাচনভঙ্গিতে পরিশীলিত সেই কণ্ঠের আবৃত্তি আজও আমাদের হৃদয়কে আপ্লুত করে।
বিভিন্ন পত্রিকায়, ফেসবুকে সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতি নিয়ে কলাম ও কবিতা লিখতেন মামুন মিজান। অসাধারণ সেসব লেখায় তার বোধের গভীরতা উপলব্ধি করতেন মুগ্ধ পাঠক। শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, বিশ্ব সাহিত্যের উপর তার দখল ছিল উল্লেখ করার মতো।
গাইবান্ধার তরুণদের সাহিত্যকর্মে উজ্জীবিত করতে গড়ে তোলেন সাহিত্য একাডেমী। সেখানে ‘মঙ্গল সন্ধ্যা’ নামে নিয়মিত সাহিত্য অনুষ্ঠান ও আলোচনার আয়োজন করতেন। বের করতেন সাহিত্য পত্রিকা ‘সবুজ পাতা’। তার ‘অপরাজিত’ উপন্যাসের শেষ প্রচ্ছদে দেয়া জীবন বৃত্তান্তের একটি অংশ উদ্ধৃত করছি– ‘তিনি পছন্দ করতেন বই পড়া, ছবি দেখা, গান শোনা, ইন্টারনেট ব্রাউজিং। ব্যথিত হন কেউ ভুল বুঝলে, আলস্য, পরচর্চা, মিথ্যা, অসততা, অসাধু লোকের প্রতাপকে। নিভৃতচারিতা ভেঙে মাঝে মধ্যে ঢুকে পড়ে লোকসমুদ্রে, সব ধরণের মানুষের সঙ্গে মিশে নিরন-র সন্ধান করেন শ্রেয়তর জীবনসত্য ও তাঁর সাহিত্যের উপাদান। প্রতিকূল বাস্তবতার মধ্যেও মাথানত না করা অদম্য এই মানুষটি সাহিত্যসেবার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে যেতে চান গভীর নিবেদনের মধ্যদিয়ে আমৃত্যু।
মামুন মিজান ২০১৩ সালের ১৯ জুন দুপুরে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। বিকেলে চিকিৎসকদের পরামর্শে তাঁকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু অন্য ভূবনের আহবান তাকে জীবিত ফিরতে দিল না স্বজনদের কাছে, প্রিয় গাইবান্ধা মাটি ও মানুষের কাছে। শাপলা, মিথিলা, পৃথিলার চোখের পানিতে এখনও বেদনার্ত বৃষ্টির মতো ঝরছেন কবি এবং কবিতার প্রাণপুরুষ মামুন মিজান। তার বন্ধু ও সাহিত্যসঙ্গীদের বুকের চিনচিন করে ওঠা ব্যাথা মনে করিয়ে দিচ্ছে অসম্ভব মেধাবী এক মানুষ এই পৃথিবীতে এসেছিলেন। যিনি ভালবাসা দিতে জানতেন, স্বপ্ন জাগানিয়া উদাত্ত কণ্ঠে ডাক দিতেন।