[প্রচলিত ধারায় ছোটগল্পের মধ্যে পরিণতি আরোপের ব্যাপারটা অত্যন্ত প্রকট। আবার অণুগল্পের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই। বস্তুতপক্ষে, ছোটগল্প ও অণুগল্পের মধ্যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কোনো পার্থক্য নেই। দু’নামে গল্পের শ্রেণীবিভাগ করা হলেও তারা মূলত একই। যদি ছোটগল্পকে একটা গাছের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তাহলে অণুগল্পকে তুলনা করা যেতে পারে সেই গাছের বনসাইয়ের সঙ্গে। যেটুকু তফাৎ তা শুধুমাত্র আয়তনে ও শব্দ সংখ্যায়। এবং আরও একটা কথা হচ্ছে, অণুগল্পের জন্য নির্দিষ্ট কোনো শব্দ সংখ্যার সীমাবদ্ধতার উল্লেখও থাকে না। ১টি শব্দসংখ্যা থেকে শুরু করে ১০০, ২০০, ৩০০, ৪০০, ৫০০… যা খুশি হতে পারে। আর ছোটগল্প ও অণুগল্প সব ক্ষেত্রেই একটা নির্দিষ্ট পরিণতিতে পৌঁছে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু ঝুরোগল্পে এই নির্দিষ্ট পরিণতিতে পৌঁছনোর ব্যাপারটাই থাকে না। গল্প হঠাৎই শুরু হয় এবং হঠাৎই শেষ হয়ে যায়। অসম্পূর্ণতা ঝুরোগল্পের স্বাভাবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কোনো নিটোল গল্প লেখার দায় ও তাগিদ থাকে না। অথচ গল্পটি পাঠকের মনে ক্রমশ চারিয়ে যায়। মাত্র ৪০০ শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে ঝুরোগল্প।]
প্রত্যক্ষদর্শী
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যের ঠিক মুখে, যখন একটু একটু করে আলো ফুরিয়ে যাচ্ছিল আর অন্ধকার নিঃশব্দে তার ডানা মেলছিল, সেই সন্ধিকালে চারটে লোক একটা লোককে চ্যাংদোলা করে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে এলো নির্জন নদীর ধারে একটা গাছতলায়। ঘটনাচক্রে রামদাস অধিকারী, স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষক, মেদ ঝরানোর অভিপ্রায়ে অন্যদিনের মতোই সান্ধ্যভ্রমণে সেখানে ছিল। তার মনে হলো, এই পাঁচজন লোকই তার অচেনা। আগে কখনও দেখেনি। তবে তারা যে কোনো অসামাজিক কাজের জন্যই এখানে এসেছে, তা বুঝতে পারল। কিছুটা দূরে নিজেকে অন্য একটা গাছের আড়ালে রেখে রামদাস লক্ষ্য করল, চ্যাংদোলা করে নিয়ে আসা লোকটার দু’হাত ও দু’পা দড়িবাঁধা। মুখও বাঁধা গামছার শক্তপোক্ত বাঁধনে। প্রথম চারটে লোক পঞ্চম লোকটিকে উপুড় করে গাছের তলায় শুইয়ে রাখল। তারপর তারা কিছুটা হাত-পা ছড়িয়ে তারই পাশে বসল। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করল। রামদাস তা শোনার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কিছুই শুনতে পেল না। ইতিমধ্যে একটি লোক অদূরে রাখা সেই গাড়ি থেকে কয়েকটি মদের বোতল নিয়ে এলো। রামদাস বুঝতেই পারছিল, এরপর কী ঘটতে চলেছে। একটি হত্যাকান্ডের প্রস্তুতি নিচ্ছে সেই চারটে লোক। পঞ্চম লোকটিকে হত্যার প্রাকমুহূর্তে নিজেরা হত্যাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
রামদাস কোনোদিন কাউকে হত্যা করেনি, তাই তার জানার কথা নয়, হত্যার আগে হত্যাকারী কী মানসিকতায় অবস্থান করে বা অনুপ্রবেশ করে! এমনিতে রামদাস নিতান্তই নিরীহ মানুষ। প্রাণীহত্যায় অনীহা আছে, তাই সে নিরামিষাষী। বিয়ের মাসখানেক পরেই স্ত্রী গর্ভবতী হলে, স্ত্রী এত তাড়াতাড়ি মাতৃত্বের দায়িত্ব নিতে রাজি ছিল না, তাই অ্যাবরশন করতে চেয়েছিল। কিন্তু ভ্রুণহত্যায় আপত্তি রামদাসের। স্ত্রীর মুখদর্শন করেনি গোটা একমাস। অবশ্য শেষপর্যন্ত সন্তানপ্রসব হয়নি, বরং স্ত্রীর মিসক্যারেজ হয়েছিল।
রামদাস বুঝে উঠতে পারছিল না, এখন তার কী করণীয়! পঞ্চম লোকটিকে যে মেরে ফেলা হবে, এব্যাপারে সে নিশ্চিত। শুধু সময়ের অপেক্ষা। রামদাসের কি উচিৎ এইরকম একটা অসামাজিক কাজে বাধা দেওয়া? সেকী প্রতিবাদ জানাবে অবশ্যম্ভাবী একটা হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে? রামদাস অবশ্য জানে না, যে লোকটাকে আর একটু পরেই মেরে ফেলা হবে, তার কী অপরাধ!
এই পরিস্থিতিতে রামদাসের দু’চোখ বন্ধ করে রাখা উচিৎ ও স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু কী এক অস্বাভাবিক উত্তেজনায় ও অস্থিরতায় সে দু’চোখের পাতা কিছুতেই জড়ো করতে পারছিল না। পলকহীন চোখে তাকিয়েছিল। আর তারপরই সেই নৃশংস ক্ষণে সে দেখল, চারটে লোকের হাতের উদ্যত ভয়ংকর চপার পঞ্চম লোকটির শরীরে বারবার ঢুকছে আর বেরোচ্ছে। আর সেই ক্ষত বিক্ষত শরীরটা ছটপট করতে করতে নিথর হয়ে পড়ছে।
না, রামদাস আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না। নিজের অজান্তেই তার গলা থেকে বেরিয়ে এলো আর্ত চীৎকার। মুহূর্তে শবদেহ ছেড়ে হতচকিত চারটে লোক উঠে দাঁড়াল চীৎকারের উৎস খুঁজতে। লোকগুলোর হাতে তখনও উদ্যত চপার। চেতনা হারানোর আগে রামদাস অবশ্য বুঝতে পারল না, লোকগুলো কোনদিকে এগোচ্ছে! তার দিকে, নাকি গাড়ির দিকে!
২.
লক্ষ্মীছাড়া
ইদানীং বড় শীত শীত করে সীতেশের। শীত শুধু বাইরে থেকে নয়, ভেতর থেকেও যেন উজিয়ে আসে। বয়সটা যে খুব বেড়ে গেছে, তা নয়! এই তো সবে বাহান্নতে পা দিল। যদিও বয়সের এই অঙ্কটা প্রবীণের আওতায় এসে যায়, কিন্তু বৃদ্ধ তো সে আদৌ নয়! এই বয়সে পৌঁছেও অনেকে ফুটবল খেলে, মেয়েদের পেছনে লাইন মারে, বিয়েও করে। সীতেশ অবশ্য এই তিনটি কাজ না করলেও নিয়মিত অফিস করে, দোকান-বাজার করে, জলের কলে গন্ডগোল হলে কলের মিস্ত্রি ডেকে আনে। তবে কোনো কাজের সঙ্গেই সে ভালোলাগা বা ভালোবাসার সম্পর্ক খুঁজে পায় না। তার নিজের কোনো সংসার নেই, দাদা-বৌদির সংসারে থাকে। আগে মাসের প্রথমে যখন খামে-ভরে মাইনের টাকা হাতে হাতে পেত, তখন সেই খাম বৌদির হাতে তুলে দিত। এখন মাইনের টাকা ব্যাংকে আসে, শীতেশের সঙ্গে বৌদির জয়েন্ট ব্যাংক একাউন্ট, বৌদি সংসারের প্রয়োজন মতো নিজেই টাকা তুলে নেয়।
বৌদি মাঝে মাঝে বলে, মেঘে মেঘে তো বেলা বয়ে গেল সীতেশ, কী লাভ হলো এভাবে লক্ষ্মীছাড়া একটা জীবন বেছে নিয়ে!
সীতেশ ভাবলেশহীন মুখে বলে, লক্ষ্মীকে তো আমি ছাড়িনি বৌদি, বরং লক্ষ্মীই আমাকে ছেড়ে গেছে।
বৌদি তেরিয়া হয়ে বলে, কেন পৃথিবীতে লক্ষ্মীর অভাব ঘটেছে নাকি? এক লক্ষ্মী গেছে তো গেছে, আরও কত লক্ষ্মী আছে!
সীতেশ আর কথা বাড়ায় না। চুপ করে থাকে। বৌদিকে বোঝানো খুব মুশকিল। বুঝতে চায় না। হয়তো বুঝতেও পারবে না! দাদা খুবই সাদামাটা মানুষ। ছোটভাইকে সে পুত্রস্নেহেই দেখে। কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী সে নয়। লক্ষ্মীর সঙ্গে কবে কীভাবে সীতেশের যোগাযোগ হয়েছিল আর কীভাবেই বা ছাড়াছাড়ি হলো, এব্যাপারেও দাদার বিশদ কিছু জানা নেই, জানার আগ্রহও নেই। বৌদি তবু কয়েকবার নিজেই আগ্রহী হয়ে দাদাকে বোঝাতে চেয়েছে এবং সীতেশের একটা নিজস্ব সংসার গড়ে দেবার জন্য দরবার করেছে। কিন্তু দাদা ভাইয়ের নিস্পৃহতা লক্ষ্য করে নীরব থেকেছে।
বৌদি কখনও বা সীতেশকে খোঁচা দিয়ে বলেছে, আচ্ছা সীতেশ, আমাকে বোঝাও তো, লক্ষ্মীর শরীরে যা যা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আছে, তা তো সব মেয়ের শরীরেই আছে! সব মেয়ের শরীরেই কামনা আছে, মনে ভালোবাসা আছে। এর বেশি লক্ষ্মী তোমাকে আর কী দিতে পারে! সে তো তোমাকে কিছু দেয়ওনি! তাহলে কেন তুমি সেই লক্ষ্মীর জন্য এভাবে নিজের জীবনটা ছন্নছাড়ার মতো কাটাচ্ছ?
মাঝেমাঝে সীতেশ ভাবে, বৌদি এত আপনজন, এত ভালোবাসে, কারও কাছে যদি মন খুলতে হয়, তবে এই বৌদির কাছেই একমাত্র। কিন্তু ভেতর থেকে কেমন একটা দ্বিধা তাকে যেন আষ্ঠেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। সীতেশ নির্বাক বসে থাকে। শীত শীত করে। ইদানীং শীতের প্রকোপ খুব বেড়ে গেছে। কতদিন হয়ে গেল, লক্ষ্মীর সঙ্গে দেখা হয়নি তার। দেখা হয়নি নিজের মেয়ের সঙ্গেও। মেয়েটাও তো কত বড় হয়ে গেল! বেশি ভাবলে বুকটা যেন চৌচির হয়ে যায়। এতদিনে কি মেয়েটাকেও লক্ষ্মী লাইনে নামিয়ে দিয়েছে?