তৈমুর খান
ইমদাদুল হোসেনকে ভুলতে পারি না, আজও মনে হয় ভোরের কুয়াশায় সে আমার আগে আগে হেঁটে চলেছে। তাঁকে অনুসরণ করতে করতে হঠাৎ সম্বিৎ ফেরে। না, ইমদাদুল নয়, আমারই ভ্রম। বীরভূমের প্রান্তিক গ্রাম রাজগ্রাম থেকে রামপুরহাটে ট্রেন থেকে নেমে সে সারারাস্তা হেঁটে আসত আমার গ্রামের বাড়িতে। অবাক হতাম। বলতাম, তোমার কি মাথা খারাপ?
সে উত্তর দিয়ে বলত, আসলে বাসে উঠেও নেমে গেলাম, মানুষেরা বড়ো কাঁদছে। আমি কান্না সহ্য করতে পারি না।
সত্যিই তার কাছে মানুষের দুঃখের কান্না বাজত । অভাবের ঘ্রাণে দিশেহারা হয়ে যেত ইমদাদুল। তার মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এমনই যে তা ভেবেও সে অস্থির ও বিমর্ষ হয়ে পড়ত।
স্কুলজীবনেই ওর সঙ্গে পরিচয়। চিঠিপত্রের আদান-প্রদানও। কিশোর মনের কত স্বপ্ন ও লুকোচুরি, ইশারা ও সম্মোহন উপলব্ধি করতে পারতাম। ওইটুকু বয়সেই তার কবিতার শব্দে পারস্য- ইসফাহানের ভ্রমর-ভ্রমরীর গুঞ্জন শুনতে পেতাম। বয়ঃসন্ধির ইরানী বালিকার নূপুর বেজে উঠত। ওমর খৈয়াম, আমির খসরু, মির্জা গালিব যেন সবাই এসে তার চারিপাশ ঘিরে আছে। তাঁদের লেখা প্রেমের ও বিরহের কবিতাগুলি সে নিজেই অনুবাদ করে শোনাচ্ছে। শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে যেতাম। ভাবতে পারিনি সেই ছেলেটাই একদিন রেললাইনে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুর স্বাদ পেতে চাইবে। আমেরিকান কবি সিলভিয়া প্লাথের (১৯৩২ -—১৯৬৩) মতো তারও মনে কি প্রশ্ন জেগে উঠেছিল? “Is there no way out of the mind?” কিংবা তার মনে হয়েছিল “Dying is an art, like everything else….”
অথবা আমেরিকান আর এক কবি অ্যান সেক্সটনের (১৯২৮ —১৯৭২) মতো তাকেও পেয়ে বসেছিল “Death, I need my little addiction to you….”
এই আত্মহত্যা যে মারাত্মকভাবে নিজেকে ধ্বংস করার পথ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যে সময় তার উন্মুক্ত ও মহাবিস্ময়ের ব্যাপ্তি নিয়ে লোকসম্মুখে আসার কথা, সেইসময়ই সব অন্ধকার হয়ে যাওয়া।
ইমদাদুল হোসেন পৃথিবীতে এসেছিল ৭ জানুয়ারি ১৯৭৪ সালে। প্রস্থান করেছিল ৩০ অক্টোবর ১৯৯৮ সালে। পিতার নাম আব্দুল মকিম শেখ, মাতা সেলিনা বানু। জন্মস্থান বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রাম রাজগ্রাম। বিড়ি বাঁধা শ্রমিক ঘরে জন্ম বলে অভাবের লোনা স্বাদ পেয়েছে ছোট বয়সেই। অত্যন্ত মেধাবী হওয়ার কারণে বৃত্তিও পেয়েছে কয়েকবার। মাধ্যমিকে “স্টার” পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত গড়ালেও অভাবের কারণে পড়াশুনো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।
১৯৯১ সাল থেকেই বেশকিছু পত্র-পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৯৪ সালে ১ জানুয়ারি ‘দেশ’ পত্রিকায় তার ‘ইক্ষুক্ষেতের ভিতর পরীক্ষাহল’ নামে একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। সুধী মহলে কবিতাটি রেখাপাত করে। এসময় ভারত-বাংলাদেশের বহু পত্রিকায় গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা প্রকাশ পায়। এক অভূতপূর্ব চিত্রকল্পধর্মী কবিতা স্বপ্ন ও বাস্তবের মাঝামাঝি অন্য জগতে পাঠককে টেনে নিয়ে যায়। সাহিত্যের নতুন পদধ্বনি বলে মনে হয়।
তবে নব্বই দশকের যা বৈশিষ্ট্য আত্মাভিমানে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া জীবনের স্বরূপ ইমদাদুলেরও কবিতার প্রধান বিষয়। প্রেমশূন্য, মানবিক সম্পর্কশূন্য এক জগতের ঊষর মরুতে কবি দাঁড়িয়ে যেন পাতা ঝরিয়ে দিচ্ছে। আত্মহননের মরমি করাত কবির সত্তাকে সর্বদা চির্ চির্ করে দিচ্ছে। দীর্ণ অস্তিত্বের ভেতর সময় ধারণের অনুলিখন ফুটে উঠছে। মাত্র ২৪ বছর বয়সেই জীবনের অন্তিম মুহূর্ত তাই সমাগত। ‘ইক্ষুক্ষেতের ভিতর পরীক্ষাহলে’ ইমদাদুল লিখেছে :
“ইক্ষুক্ষেতের ভিতর পরীক্ষাহল, ইক্ষু খেতে খেতে পরীক্ষা দিই আমরা !
আমি, অভিজিৎ, সচরাচর না দেখা-যাওয়া মৃণাল
চশমা-পরা শ্যামলদা
মিঠিপুরের ভাস্কর গাঙ্গুলি, নৃপেন, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ—
সেলিমদা ;
মেয়েরা এসেছে যথারীতি
মহুয়া তার বান্ধবী সিঁদুর-মাথায় নির্মলার সঙ্গে গল্পরত
ইক্ষুক্ষেতের ভিতর পরীক্ষাহল, ইক্ষু খেতে খেতে পরীক্ষা দিই আমরা !”
নব্বই দশকের গ্রামবাংলা ছিল “ইক্ষুক্ষেত” যেখানে আমাদের মানবসভ্যতার পরীক্ষাহল। বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী বিভিন্ন নাম ধারণকারী আমাদের পরিচয়টিও কবি তুলে ধরে। কবিতার পরবর্তী অংশে আমরা দেখি এর ওর প্রশ্নপত্রে উত্তর লিখে দেওয়া,উপযুক্ত পরীক্ষকের অভাবে রুই মাছ এঁকে দেওয়া, টেবিল বাজিয়ে ‘হাওয়া হাওয়া’ গান করা — যা শাসনহীন শৃঙ্খলাহীন জীবনের রসদে ডুবে যাওয়ার মতো ঘটনা। এর মধ্যে যে শ্লেষ আছে, জীবনের দিশাহীন, মৌলিক প্রত্যয়হীন কাণ্ডকারখানা আছে তাতে সময়কে জানানোর পক্ষে যথেষ্ট। অথচ ‘সিঁদুর-মাথায় নির্মলা’র পরিচিতিতে সামাজিকতা ও সৌজন্যও আছে, তবু যেন সবই এক-একটা ফার্স মাত্র। তখন কি টি এস এলিয়টের কথাই মনে হয় না? “All our knowledge brings us nearer to our ignorance.”
আর্থিক ও পারিবারিক কারণে কবি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। খুব বেশিদিন আর স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করে উঠতে পারে না। অবশেষে চলন্ত ট্রেনের সামনে নিজেকে ঠেলে দেয়। ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সংখ্যা বাংলাদেশের বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা “দ্বিতীয় চিন্তা” (সম্পাদক : ইফফাত আরা) পত্রিকায় প্রকাশিত তার একটি কবিতার কিছুটা অংশ উল্লেখ করলে বোঝা যাবে তার কবিতার বৈশিষ্ট্য :
“একজন হকার মশলা-মুড়ি তৈরি করছে। সোমবার।
তিনটি আন্দোলনের ইস্তাহার ইস্টিশানের দেয়ালে ঝুলছে
আটজন পুরুষ-রমণী চাদর ঢাকা দিয়ে শুয়ে আছে মেঝেয় —
কবি ও দক্ষিণের কয়েকজন প্যাসেঞ্জার বসে আছেন লম্বা কাঠের চেয়ারে
একটি পশমের শিশু তার মায়ের স্তন পান করছে —
কুয়াশায় আপাদমস্তক ডুবে আছে মীরকাশিমের দেশ..”
মীরকাশিমের দেশের কোনো ট্রেনস্টেশনের চিত্র। কবিতাটির আগের অংশে ভিখিরির হাতে থালা, ইউক্যালিপটাস গাছে কুয়াশার চাদর, হনুমান মন্দির, সি আর পির বাংলো, চাষির মাথায় বেগুনের ঝুড়ি সব দৃশ্যের মধ্যেই বাংলার সকালকে দেখতে পাই। ইতিহাসের সঙ্গে কবি বর্তমানকেও মিলিয়ে দিয়েছে।
প্রাত্যহিক জীবনের চলমান চিত্রকল্পকে ইমদাদুল শব্দের ক্যামেরায় ধারণ করতে পারত। কিন্তু কোনো চিত্রকল্পই সাময়িকতার সীমায় বন্দী হত না, মনে হত বহু যুগ ধরেই এই চিত্রকল্প প্রবহমান। গুহামানব কী করে চাষবাস শিখেছিল, পশুপালন শিখেছিল, ঘর বাঁধা শিখেছিল—সেসব চিত্রকল্পও তার কবিতার বিষয় ছিল। অতীত থেকে বর্তমানে তা যেন আমাদের দৃষ্টির গোচরে প্রতিফলিত হয়ে চলেছে। নিজেদের মনে হত, আমরাও যেন সেই আদিম যুগ থেকেই মানবসভ্যতার এই সময়ক্রমে এসে উপস্থিত হয়েছি। কাঠের লাঙল দিয়ে চাষ করতে করতে রোদ্দুরে হাঁপাচ্ছি আর গাছের ছায়ায় গিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছি। কখনো পালিত পশুগুলোকে ছায়ায় জমায়েত করিয়ে মাথার টুপি খুলে চিতপাট হয়ে মাটিতে ঘুমিয়ে পড়েছি। কোন রাষ্ট্র, কোন সময়, কোন দেশ, আমিই বা কে, আমার ভাষাই বা কী তা মনে থাকত না। প্রবহমান মানবস্রোতে যেন এই জীবনচক্র ভেসে চলেছে। তাই তার কবিতা পড়তে পড়তে হারিয়ে যেতাম কোনো অতীত নৈঃশব্দ্যের গভীরে। হঠাৎ ধ্যান ভঙ্গ হত কারো ডাকে। ছাত্র অবস্থায় ইমদাদুল একদিন বাজার করতে গিয়ে সাইকেল চালিয়ে ফেরার পথে তার বিদ্যালয়ের শিক্ষক মশাইকে কথা না বলে অতিক্রম করে যায়। মনে মনে সে কোনো কবিতার কথাই হয়তো ভাবছিল। তারপর সারাদিন নানা কাজে কেটে গেলেও মধ্যরাতে তার মানসিক বিক্রিয়া শুরু হয়। তার নৈতিক মন তাকে বলতে থাকে: “শিক্ষক মশাইয়ের সামনে দিয়ে সাইকেল চালিয়ে আসা কি তোর অন্যায় নয়? অন্তত শ্রদ্ধা জানিয়ে সৌজন্যবশত নেমে দাঁড়ানো কি তোর উচিত ছিল না?” বারবার মাথার মধ্যে তার এই প্রশ্ন ঘুরতে থাকে। একসময় সে জর্জরিত হয়ে যায়। নিজেকে আর সামাল দিতে পারে না। তখন রাত প্রায় দ্বিপ্রহর। শুনশান রাস্তাঘাট। অন্ধকারে একাকী পায়ে হেঁটে আসার জন্য বেরিয়ে পড়ে তার স্যারের বাড়ির উদ্দেশ্যে। তারপর দরজায় চলতে থাকে দীর্ঘ সময় ধরে কড়া নাড়া। এত রাতে কে? স্যারের বাড়ির লোক প্রায় আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। অনেক চেষ্টা চরিত্তির করে খোঁজখবর নিয়ে দরজা খোলেন। টর্চের আলো ফেলে দেখেন, কিশোর ইমদাদুল রোদনরত অবস্থায় দরজায় দণ্ডায়মান। কথা বলার সুযোগ না দিয়েই স্যারের দুটি পায়ে হাত দিয়ে বলে ওঠেন, “স্যার আমাকে ক্ষমা করে দিন, আমি আপনার ছাত্র হয়েও বেয়াদবি করেছি; সাইকেলে আপনাকে অতিক্রম করে গেছি অথচ কথা বলিনি!”
স্যার ব্রজেন্দ্রনাথ ঘোষ অবাক হয়ে গেছেন তার এই আচরণে। দীর্ঘ কর্মজীবনে এরকম ছাত্র পাননি। সেদিন সস্নেহে ইমদাদুলকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। আশীর্বাদ করেছিলেন। তারপর যতবার সাহিত্য অনুষ্ঠানে গেছি, ইমদাদুলের কবিতা শুনেছি, সমালোচনা শুনেছি, দেখেছি তার কবিতায় এক-একটি শূন্যতা, কষ্ট ও বেদনা। তোমার কিসের কষ্ট? তোমার কিসের বেদনা? বারবার জিজ্ঞেস করেছি। ইমদাদুল একটা কথাই জানিয়েছে বারবার, “এই মানবজন্মটিই বেদনার, এই মানবজন্মটিই কষ্টের। হয়তো আমি আর বহন করতে পারব না!” সত্যিই সে বহন করতে পারেনি। শ্যামপাহাড়ি বেসিক ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হয়েও সে তা সম্পূর্ণ করতে পারেনি। বাড়িতেও স্থির ভাবে কোনো কিছুতে মনোযোগ দিতে পারেনি। তাই নির্জন প্রান্তরে, গাছতলায় একাকী নিঃসঙ্গ যাপনের মধ্য দিয়ে নিজের সঙ্গে নিজেরই সংলাপে মগ্ন থেকেছে। বাংলাদেশের বহু পত্রপত্রিকায় সেই সময় তার গুচ্ছগুচ্ছ কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। অথচ সংগ্রহ করার কোনো তাগিদ ছিল না। আমরাও সেসব পত্রিকার নাগাল পেতাম না। ‘দৌড়’ পত্রিকায় বেশকিছু কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। হয়েছিল কবিতা বিষয়ক মতামতও। ১৯৯৪ এর শারদ সংখ্যা ও বইমেলা সংখ্যা ‘দৌড়’-এ তার দুটি কবিতা পেলাম। এই দুটি কবিতাতেও তার স্বপ্নচারী চিত্ররূপময় মানবসভ্যতার ব্যঞ্জনাশ্রয়ী পরিচয় আছে। কবিতা দুটির কিছুটা অংশ এখানে উপস্থিত করলাম:
১
“চড়ুই পাখিরা আমার চেয়ে অধিক যোগ্যতা সম্পন্ন, একথা ভাবতে ভাবতে
কখন ডুবে গেছি ঘুমের ইক্ষুক্ষেতে
ভূত-মেয়ের শাড়ির স্পর্শে ঘুম ভেঙে জেগে দেখি
ইতিমধ্যে মোমবাতি নিভে গেছে
ঘরময় সেলভা-বনের আঁধার ছড়ানো
ভূত-মেয়ের ফিসফিস কন্ঠস্বর শোনা যায়: ‘আমরা দুজন পাতালের রাজারানি।”
(রুম ও ভূত-মেয়ে)
২
“সকালের রৌদ্ররঙিন আবহাওয়ায় নৌকা যেমন
সুখে থাকে নদীর ঘাটে
সকালের রৌদ্ররঙিন আবহাওয়ায় বিজয় দিবসের পতাকা যেমন
সুখে থাকে তেতলা বাড়ির ছাদে
সকালের রৌদ্ররঙিন আবহাওয়ায় ব্লাউজ যেমন
সুখে থাকে গ্রামের হ্যাঙারে
আশা করি ভালো আছেন সবাই
কবরের ভিতর, কবরবাসীরা!”
(গোরস্থানে)
দুটি কবিতাংশেই আঙ্গিক, চিত্রকল্প, ভাবনা, শব্দচয়ন একজন তরুণ কবির হাতে কিভাবে ধরা দিয়েছে তা দেখার বিষয়। ক্ষণিকতার মধ্যেই আবহমানের প্রশ্রয় আছে। তেমনি আছে ইতিহাসচেতনা এবং জীবনচেতনা। রূপকথা থেকে লোকজ বিশ্বাস, কাহিনি ও উপকাহিনির নানান প্রসঙ্গ তার সমস্ত কবিতাগুলিতেই সন্নিবিষ্ট হয়ে উঠত। কবিতার লাইনগুলি হত দীর্ঘ। মৃত্যু ও জীবনের উপলব্ধিতে কোনো ভেদ থাকত না। প্রকৃতি এবং মনুষ্যজীবনের গভীর অন্বয় উপলব্ধি হত। কখনো সংলাপের মধ্য দিয়ে নিজের অভিমান ওই একাকিত্বকে প্রকাশ করত। কোনো বিদেশী কবিতা পাঠ করার পর তার মনের মধ্যে যে ভাব জন্মাত, উপলব্ধির বাতাবরণ তৈরি হত— সেসবকেও কবিতা করে তুলত ইমদাদুল।তার কয়েকটি কবিতা যা একেবারে প্রথম দিকের লেখা তা এখানে তুলে দিলাম:
১
অপমানিতের কবিতা
এত অপমান মেখেছি দুহাতে
ঘাড় বেয়ে শরীরের বাঁধন ফুটো করে রক্ত ঝরে
তবু কান্না আসে না
এত অপমান মেখেছি দু হাতে
নিজস্ব নদীর কাছে মাথা হেঁট হয়ে গেছে বলে
কোনোদিন মানুষের উঠোনে যাব না, কোনোদিন!
কোনোদিন কোনো দ্বিপ্রহর বেলায়, হে রোদ্দুর মাখানো দিন
পোস্ট অফিসের পাশে পানের দোকানে দশ পয়সার বিষণ্ণ এডি কুড়োতে হবে না
শেষ বিকেলের আপে বুড়ি ভাগলপুরী কঙ্কাল
তার চালের বস্তার ওকালতি নিয়ে কী করে যে শব্দ বনে যায়
দৃষ্টি ফিরাব না
স্টেশন চত্বরে সারাটা দিন মুচিরা ঝিমায় কেন
প্রশ্ন ছুঁড়ব না
এত অপমান মেখেছি দুহাতে
পাহাড়-প্রমাণ শপথ সুন্দরকে দেখে অন্ধকার কাঁদে
কেঁপে ওঠে
এত অপমান মেখেছি দুহাতে
২
তির এবং গান
বাতাসে তির ছুঁড়ে বললাম
কেউ কুড়িয়ে নিও
আকাশে গানের পংক্তি উড়িয়ে বললাম
আকাশ, আমি আমার সর্বস্ব সমর্পণ করছি তোমাকে
তির এবং গান এই পৃথিবীরই মাটিতে ঝরে
এবং আমরা জানি
মাটি ও মানুষের হৃদয় ছাড়া
পৃথিবীতে মসৃণতম দুটি জিনিস কেউ কুড়িয়ে পাবে না
তির এবং গান এই পৃথিবীরই মাটিতে ঝরে পড়েছে
অনেক অনেক দিন পরে
ওক গাছের জঙ্গলের ভিতর
আমি আমার সোনালি তির কুড়িয়ে পেলাম
যা ছিল অক্ষত
এবং গান
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত
আমার বন্ধুর মনের আঙিনায়
ফুল হয়ে ফুটে আছে দেখলাম।
(হেনরি লংফেলো অবলম্বনে)
৩
ধ্বংসস্তূপে আমি আর মহুয়াদি
কী দারুণ সকাল, মহুয়াদি, সারামাঠ জুড়ে
এক আশ্চর্য বিষণ্ণতা
ধানক্ষেতে চাষির পদক্ষেপের চেয়েও ভীষণ কোনো পায়ের ঝংকার
ইতিমধ্যে বেজে গেছে, তা না হলে এত ধান কোথায় যাবে!
গাছেরা বুঝি শুশ্রূষার জন্য শহরতলিতে গেছে
কী দারুণ সকাল মহুয়াদি, সারামাঠ জুড়ে এক আশ্চর্য বিষণ্ণতা
কী নীরব সকাল, মহুয়াদি,
জিঞ্জির পরানো কুকুর নিয়ে শহরের বালক আসে না নদীর তীর
নদী তীরে শিমুলের গাছে পাখি নেই
পাখিরা বুঝি যুদ্ধক্ষেত্রে গেছে
নদী তীরে শিমুলের গাছে ফুলের অভাব
কী নীরব সকাল, মহুয়াদি,
জিঞ্জির পরানো কুকুর নিয়ে শহরের বালক আসে না নদীতীর
নদীতীরে শিমুলের গাছে পাখি নেই
পাখিরা বুঝি যুদ্ধক্ষেত্রে গেছে
নদীতীরে শিমুলের গাছে ফুলের অভাব
কী নীরব সকাল, মহুয়াদি,
জিঞ্জির পরানো কুকুর নিয়ে শহরের বালক আসে না নদীতীর
কী ভীষণ সকাল, মহুয়াদি,
কবিরা চা-পানের জন্য জঙ্গলমহল যান না,
জঙ্গলমহলে জেসাস ক্রাইস্টের মতো নদী কাঁদে
শহরে ও গ্রামে রাজার সেনারা কুচকাওয়াজ করে
তাই বনের পাখির চিবুকে বারুদের গন্ধ এখন
কী ভীষণ সকাল, মহুয়াদি,
কবিরা চা-পানের জন্য আর জঙ্গলে যান না!
৪
যেতে পারি, পারি না
এক.
হে এবং, যেতে পারি যদি তুমি ডাকো।
‘ক’ পারে ‘খ’ পারে, ‘গ’ পারে ‘ঘ’ পারে
‘ঙ’ পারে নাকো।
যেই বল, ‘তুমি পারো, আমি পারি নাকো।’
রেগে মেগে কঁকরোশ বললে।
চোখে আমার জল তবু জ্বললে।
বললে, ‘এ কী ঠেলা—দুর দুর জোড়া লাগে
আর কি সে সাঁকো?’
দুই.
বললাম, ‘যাব না যতই তুমি ডাকো।
‘ক’ পারে ‘খ’ পারে ‘গ’ পারে ‘ঘ’ পারে
‘ঙ’ পারে নাকো।
অনুরোধে গলে যাওয়া, হে এবং কেউ পারে
আমি পারি নাকো।’
যেই বলা, ‘কেউ পারে আমি পারি নাকো।’
কেঁদে কেটে কঁকরোশ বললে।
চোখে জল একগলা, সেই তুমি গললে।
বললে, ‘এ কী গো রাগ করে চলে এলে
তাই বলে
মিছে তুমি
আমার শূন্যতা ঢেকে রাখো।’
উপরের তিনটি কবিতাতেই ব্যক্তিজীবনের বিমর্ষ রক্তাক্ত অভিমানের ছবিটি যেমন ধরা পড়েছে,তেমনি উপসাগরীয় যুদ্ধের বারুদের গন্ধও কবিতার শব্দ ধারণ করেছে। রোমান্টিক হাতছানির পাশাপাশি জীবনের পরম নিঃস্ব রূপকেও কিশোর বয়সেই অনুধাবন করতে পেরেছে। কতগুলি বর্ণের সংকেতেই নিজের অবস্থানটি প্রকাশ করেছে। নিজের শূন্যতা, দৈন্য, আত্মনিগ্রহ এবং বিপর্যয়কে নাটকীয় পর্যবেক্ষণে তুলে ধরেছে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের দুর্ভাগ্য তার প্রতিভার পূর্ণবিকাশ আর হল না। গ্রাম বাংলার কোন অন্তরালে তার প্রতিভার দীপ্তি ঢাকা পড়ে যাবে।
ইমদাদুল একটাও কাব্য প্রকাশ করে যেতে পারেনি। কোনো কোনো লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদক তাঁদের সম্পাদিত পত্রিকায় কবিকে খুঁজে পেতে পারেন। কোনো প্রকাশক বা গবেষক তার লেখাগুলি সংগ্রহ করে একটি সংকলন প্রকাশ করতে পারেন। এই কাজটি করতে পারলে ইমদাদুল বৃহত্তর পাঠকের কাছে হয়তো পৌঁছাতে পারবে।