তাজ ইসলাম
“বাংলা কবিতাকে আবার নতুন করে কিভাবে উপস্থাপন করা যায়, কিভাবে লিখলে সব ধরনের পাঠকই কবিতাকে নিজের করে নিতে পারবে, মূলত কবিতায় কী থাকে—এসব নিয়ে যিনি ভেবেছেন, কখনো নিজেই লিখেছেন, কখনো অন্যকে দিয়ে লিখিয়েছেন—সেই কবি ও সম্পাদক সাজ্জাদ বিপ্লব। একদিকে সৃষ্টিশীল ভাবুক ও দার্শনিক,অন্যদিকে কবি ও গদ্যকার, সম্পাদক ও প্রকাশক। ২৩ এপ্রিল তাঁর জন্মদিন। আমাদের অঢেল শুভকামনা ও ভালোবাসা তাঁর জন্য।” একজন কবিকে তার জন্মদিনে অন্য একজন কবি এভাবেই জানালেন জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
জন্মদিনে স্পর্শ করেছেন ৫৩তম বছরকে। জীবনের ৫২ বছর অতিক্রম করেছেন। অর্ধশতক পাড় হয়ে এসেছেন আগেই । হাফ সেঞ্চুরি করলে ব্যাটসম্যান তা উৎযাপন করেন। জীবনের পঞ্চাশকে তাই উৎযাপনের উপলক্ষ করেছেন তার সতীর্থগণ। বোদ্ধা পাঠক, শুভাকাঙ্ক্ষী ও লেখক বন্ধুগণ জন্মদিনে জানিয়েছেন শুভেচ্ছা। তার লেখাজোঁকা নিয়ে করেছেন মূল্যায়ন। এসবের কিছু নিয়ে রহমান তাওহীদ প্রকাশ করেছেন একটি সংকলন। নাম তার “পেরিয়ে ৫০ ” ।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত কবি তৈমুর খান কবি সাজ্জাদ বিপ্লবকে নিয়ে লিখেছেন গদ্য। কবি তৈমুর খানের লেখার শুরুর অংশ উপরে উদ্ধৃত হয়েছে। তৈমুর খান নিজেও কবি। একজন কবিই পারেন চিহ্নিত করতে আরেকজন কবির কবিতার মেজাজ। সনাক্ত করেন কবিতার কবিকে, এবং বলেন :
“সাজ্জাদ বিপ্লব এক সহজ জীবনবাদী চেতনায় সর্বদা চালিত হয়েছেন। সমস্ত সৃষ্টির মধ্যেই তিনি আত্মসত্তার জাগরণ টের পেয়েছেন। তাই তাঁর কবিতা ও ছড়াগুলিতে এক মরমি জীবনচারণার উচ্ছল আনুগত্য স্পর্শ করা যায়।……
সাজ্জাদ বিপ্লব সেই কবি যাঁর কবিতায় আছে মানবিক কল্যাণের অনুসন্ধান, বিশ্বাসের আত্মজাগরণ এবং ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা। রোমান্টিক অবাস্তবের অনুসরণ কবি করতে চাননি। জীবনের মর্মরিত আলোড়নকে তিনি শব্দে ধারণ করেছেন। বক্তব্যকে জটিল করেননি। ভাষায় ও শব্দে সাবলীল উচ্চারণ ও স্বচ্ছ গতিময় ছন্দের নিবিড় অভিব্যক্তিতে তিনি প্রতিটি ছড়া ও কবিতা রচনা করেছেন। তাঁর ভাবনার মধ্যে দর্শন এসেছে, কিন্তু তা খুব উপযোগী এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই তাঁর সৃষ্টিতে এক ধরনের ভালোলাগা অন্তরস্পর্শী প্রজ্ঞায় প্রলোকিত হয়। অনবদ্য এক সারল্য এগুলিতে বিরাজ করে।’
সাজ্জাদ বিপ্লবকে নিয়ে ” পেরিয়ে ৫০” এ লিখেছেন অনেকেই। কাজী জহিরুল ইসলাম তাদের মাঝে অন্যতম। তিনি লেখেন :
“রবীন্দ্র বলয় থেকে বেরিয়ে এসে ত্রিশের দশকের কবিরা যে নতুন কাব্যভাষা তৈরি করেছিলেন সেই ধারাতেই এগুচ্ছিল বাংলা কবিতা, এই প্রথম নব্বুইয়ের দশকের কবিরা, এই প্রমিত ভাষা মানি না, এখন উত্তরাধুনিক কবিতা লিখতে হবে, ইত্যাদি কথা বলতে শুরু করেন।”
এই শুরু করাদের একজন সাজ্জাদ বিপ্লব। সাজ্জাদ বিপ্লব নব্বইয়েরই আলোচিত এক নাম। তার কবিতা নিয়ে কাজী জহিরুল ইসলাম’র বক্তব্য :
“সাজ্জাদের কবিতার দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য আমি শনাক্ত করেছি, একটি হচ্ছে গতি, কবিতা যত বড়োই হোক, এই গতি পাঠককে ধরে রাখে এবং শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। তিনি অনুপ্রাস প্রয়োগে বেশ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। অন্ত-আদি অনুপ্রাস নির্মাণের এমন দক্ষতা বাংলা ভাষার কবিদের মধ্যে অল্প কয়েকজনই দেখাতে পেরেছেন। এই ধরণের অনুপ্রাস কবিতাকে গতিশীল করে তোলে। অন্য বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ততা। তার কবিতায় আরোপিত কোনো বিষয় বা ভাবনা নেই, এমনকি কবিতাটিকে প্রায়শই অপরিকল্পিত মনে হয়। যেন লিখতে লিখতে যেদিকে যেতে চেয়েছে কবিতা তিনি কোনো ধরণের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করে কবিতাকে ঠিক সেদিকেই যেতে দিয়েছেন। এর ভালো মন্দ দুটো দিকই আছে। আমি মনে করি কোনো কোনো কবির এমনই হওয়া উচিত, এই পরিকল্পনাহীন স্বতঃস্ফূর্ত পরিভ্রমণের মধ্য দিয়ে হয়ত বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিতাটি বেরিয়ে আসতে পারে, যখন আমরা বিশ্বাস করি, কবিতা মূলত চর্চায় তৈরি হয় না, এর জন্ম অলৌকিকতায়, অপার্থিব কোনো ভূবনে, স্বতঃস্ফূর্ততায় তা প্রতীয়মান হয়।
সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিতায় আমি প্রায়শই ধর্মের উপস্থিতি দেখি, আস্তিক্যবাদ বা বিশ্বাসের উপস্থিতি দেখি। ধর্ম বিশ্বাস মানুষকে প্রশান্তি দেয়, কবিকেও দেয় এবং এর প্রতিফলন তার কবিতায় পড়তেও পারে। কিন্তু কবি যেন তার অন্তরের স্বাভাবিক কৌতুহল দূরে ঠেলে দিয়ে ধর্মহীনতাকে প্রতিপক্ষ মনে না করেন এবং কবিতায় ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে না ওঠেন। কবি সর্বৈব স্বাধীন, তিনি যদি ধর্মের ছবি আঁকেন তা আঁকবেন একান্তই নিজস্ব তুলি দিয়ে বোধের ক্যানভাসে, মৌলিক রঙে।
সাজ্জাদ বিপ্লব নব্বুইয়ের দশকের কবি। এই দশকের কবিদের নিয়ে আলোচনা করা খুব জটিল ও বিপদজনক। কারণ এই দশকের কবিরা বহু বিচিত্রগামী, তাদের সমষ্টিগত একটি চরিত্র এখনো স্থির হয়নি। তবে, এই যে বহু বিচিত্রগামী, এটিও একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য।”
সাজ্জাদ বিপ্লব কবি। তিনি দেশে থাকেন না।
কবি আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ জবানে :
“থাকেন আমেরিকায়। জিয়ো-পোয়েটিক্স, কবির বর্তমান, স্থানিকতা তার কবিতায় দুর্নিরীক্ষ্য নয়। তাতে কবিতা স্বাভাবিকতায় পাঠকের অভিজ্ঞতাকে নতুনত্ব দেয়। যতোটুকু পড়েছি মনে হয়েছে, সাজ্জাদের কবিতা মৃদু সুর ও স্বরের কবিতা। একটা প্রশান্তি যেন ঘিরে রাখে ভাব ও ভাষায়। তার ভাষা বৃষ্টির পড়ার শব্দের মত খুব ধীরে আন্দোলিত হয়। তার বলার মধ্যে কোনো জোর নেই, যেন খুব সহজেই তার অন্তরের তলদেশ থেকে উঠে আসছে কবিতার থরো থরো ধ্বনি। সারাদিনের কোলাহল মুখর সময় পার করে এক টুকরো জলাশয়ের দিকে ফিরে আসা– যেখানে পাঠক জলের আয়নায় নিজের শান্ত বিম্বটুকু যেন দেখতে পায়। সাজ্জাদের এটি শক্তি, তার সিগনেচার মার্ক। স্বভাবে রোমান্টিক, কিন্তু ভাব ও চিন্তার স্বচ্ছতা তার কবিতাকে করেছে আকর্ষণীয়।”
সাজ্জাদ বিপ্লবকে আরও অন্তরঙ্গভাবে চিনেন তার সময়ের কবিগণ। নয়ন আহমেদ সাজ্জাদ বিপ্লবের ঘনিষ্ঠ কাব্য সহচর। তিনি বলেন :
“সাজ্জাদ বিপ্লব-এর আবির্ভার নব্বই-এর দশকে। প্রখর মেধাদীপ্ত এ কবি বাংলা সাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছেন ইতোমধ্যেই। সূচনালগ্নে সম্পাদনা করেছেন সাহিত্যের ছোটোকাগজ “স্বল্পদৈর্ঘ্য”। এই কাগজটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একদল সাহসী কবি, তারা সাহিত্যে তৈরি করেছেন নিজস্ব বোধ ও ব্যাপ্তির জগৎ। এ কাগজটিকে নব্বই দশকের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য করা হয়। নব্বই দশকের কবিদের নিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য সংকলনও করেছেন তিনি। এটি বহুল সমাদৃত হয়েছে। “নব্বইযের কবিতা : অন্য আকাশ ”– নামের এই কবিতা সংকলনটি তার সুচারু সম্পাদনার পরিচয় বহন করছে। বর্তমানে তিনি উত্তর আমেরিকায় বসবাস করছেন। তার সাথে আছে তার বাংলাদেশ, আবহমান সংস্কৃতি আর কবিতা। “বাংলারিভিউ ” https://banglareview.blog নামে অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করছেন সেখানে বসেই। বাংলাভাষা ও সাহিত্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে নিরন্তর সাধনা করে যাচ্ছেন তিনি।”
নয়ন আহমেদের জবানে দেওয়া হল কবি সাজ্জাদ বিপ্লবের পরিচয়। তার কবিতা ও কবিতার গতি নিয়ে নয়ন আহমেদের অভিমত :
” সাজ্জাদ বিপ্লব তার পাঠককে নিয়ে যান প্রাত্যহিকতার অভ্যাস ও অভ্যস্ততায়। জীবনকে তিনি সহজ ও স্বাভাবিকরূপে পেতে চান। তার কবিতা এই স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ-বিজ্ঞানে পূর্ণ। কোমল ও মধুর, গীতল ও প্রাণস্পর্শী তার ভাষা–এ যেন এক নিবিড় প্রার্থনা। এখানেই সাজ্জাদ-এর ব্যক্তিভাষা তৈরি হয়েছে। তার কাব্যভাষা ব্যতিক্রমী–আলাদা। তিনি স্বাক্ষর রেখে চলেছেন প্রেমের মধ্য দিয়ে স্বস্তি ও আস্থার পৃথিবী নির্মাণে–একটি মানবিক জগৎ সৃষ্টির উল্লাসে। একটি পূর্ণাঙ্গ কবিতা দিয়ে এই আলোচনা ইতি টানছি–
“রুয়ে দিলাম
আমার ভালোবাসা
তোমার জমিনে
পত্র-পুষ্প-পল্লবে
ভরে যাক
এ রঙিন গ্রহ
দ্রোহ থেকে প্রেমে
আমাদের জীবন-যৌবন
ওঠে যেনো ঘেমে”।
–এই কবিতাটি আমাদের জীবনের পূর্ণতার কথা বলে। সাজ্জাদ বিপ্লব-এই ভাষারই নির্মাতা, জীবনশিল্পী।”
“পেরিয়ে ৫০”-এ লিখেছেন আরও অনেকেই। আবু তাহের সরফরাজ,তাজ ইসলাম, মুহম্মদ মতিউল্লাহ প্রমুখ লেখকদের লেখাতেও চিত্রিত হয়েছে বিচিত্র সাজ্জাদ বিপ্লব। আছে কবি’র নিজের একগুচ্ছ কবিতা। কবির নিজের জবানীতে আছে লেখক জীবনে যাত্রা কথা আর তার লেখক হয়ে ওঠার গল্প।
” পেরিয়ে ৫০ ” নিয়ে কথা বলা মানে বিষয়টি পাঠককে অবহিত করা। পাঠক জানুক একজন কবিকে অন্য কবির চিন্তা ও দৃষ্টিতে। ভালো লাগলে সংগ্রহ করবে “পেরিয়ে ৫০” ও এই কবির অন্যান্য কিতাবাদী। ইতোমধ্যে প্রকাশ হয়েছে তার প্রায় ১০ টি কবিতা কিতাব। ৪ খানা ছড়া পুস্তক আছে। “নব্বইয়ের কবিতা: অন্য আকাশ” তার আলোচিত সম্পাদিত কিতাব। কবি আল মাহমুদের সাক্ষাৎকার গ্রন্থ আছে। প্রবন্ধ- নিবন্ধ,লিটলম্যাগ সব মিলিয়ে ৫২ বছরের জার্নিতে সংগ্রহ সম্মানজনকই বলা যায়।
বাংলা রিভিউ প্রকাশনার একটি বিশেষ আয়োজন ” পেরিয়ে ৫০”।
কবি ও সম্পাদক সাজ্জাদ বিপ্লব এর ৫৩তম জন্মদিন উপলক্ষে এটি একটি বিশেষ সংখ্যা। এর সম্পাদনা আঞ্জাম দিয়েছেন রহমান তাওহীদ। কবির বয়স ৫৩ হলেও সংখ্যাটি সেলিব্রেট করেছে বয়স পঞ্চাশকে। আমরাও আলোচনার সময় ৫৩ কে গৌণ রেখে ৫০ কেই ধর্তব্যে রেখেছি। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা। একজন কবিকে অন্য অনেকের কলমে জানতে পারার সহজ মাধ্যম। সংখ্যাটি আপনার সংগ্রহে থাকলে উপকৃত হবেন। মূল্য ১০০ টাকা।
ভালোবাসা জানাই। আন্তরিকভাবে দীর্ঘ ও সুস্থ জীবন কামনা করি।
শুভকামনা সবসময়
খুব সুন্দর উপস্থাপন
সাজ্জাদ বিপ্লব বাংলাভাষা ও সাহিত্যের জন্য এক অপরিহার্য ব্যক্তিত্ব।
আল্লাহর কাছে তাঁর দীর্ঘজীবন কামনা করি।
কবি, সমালোচনাক তাজ ইসলামকেও জানাই মোবারকবাদ।
তাঁকে সুন্দরকরে তুলে ধরেছেন তিনি।