আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
সাবেক পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে মামলা দায়ের হওয়ার ঘটনায় ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম কাতর হয়ে পড়েছেন। কয়েকদিন আগে তার পত্রিকায় “প্রধান উপদেষ্টার হাতকে শক্তিশালী করুন” শিরোনামে এক নসিহতমূলক নিবন্ধে ‘কিছু ঘটনায় হিতে বিপরীত হচ্ছে,’ মর্মে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে জ্ঞান দান করেছেন। তার বক্তব্য হচ্ছে, ‘যেভাবে বিষয়টি এগাচ্ছে, তাতে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।’ প্রশ্নের জন্ম দেবেই। তিনি তো এ ধরনের ঘটনা নতুন দেখছেন না। আওয়ামী লীগের যেসব অভিযুক্তকে আদালতে তোলার সময় হেনস্তা হতে হচ্ছে, তাতে তিনি কষ্ট পাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের সময় (১৯৯৬-২০০১) আসামীকে আদালত প্রাঙ্গণে গুলি করে হত্য করার ঘটনা ঘটেছে, যিনি স্বয়ং যুবলীগ নেতা ছিলেন। আমার দেশ সম্পাদককে আদালত প্রাঙ্গণে মেরে রক্তাক্ত করা হয়েছে। অতএব, এসব ঘটনা সহসা বন্ধ হয়ে যাবে, এমন আশা করা যায় না।
গত সাড়ে ১৫ বছর যাবত জনগণের অবাধ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে বার বার ঐতিহাসিকভাবে বিজয় অর্জনকারী নির্বাচিত, মহান জাতীয় সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য, পবিত্র সংবিধান সম্মত উপায়ে জাতির জনকের কন্যা, দেশনেত্রী, গণতন্ত্রের মানসকন্যার অধীনে পরিচালিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সরকার কর্তৃক মহান গণতন্ত্র, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতা, বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা, সমাবেশ করার স্বাধীনতার চর্চা দেখেছেন। এই সরকারের আমলে তিনি স্বয়ং ১৭টি রাষ্ট্রদ্রোহমূলক মামলাসহ মোট ৭৯টি মামলায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন। একটি বিপ্লবের মাধ্যমে আগত সরকারের কাছে তিনি এতটা আশা করেন কীভাবে?
তিনি তার নিবন্ধে কিছু ব্যক্তির নামোল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে কেন মামলা হচ্ছে এবং কেন তাদের কেউ কেউ গ্রেফতার হচ্ছেন তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি তার যেসব প্রিয়ভাজনের কথা বলেছেন, তারা হচ্ছেন: মুনতাসির মামুন, শাহরিয়ার কবির, সাবেক বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম; হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেনন। গ্রেফতারকৃত সাবেক মন্ত্রী দীপু মণি আদালতে হেনস্তা হওয়ায় তার মনে হয়েছে যে এমন ঘটনা আদালতে প্রথম ঘটলো! পুলিশ তার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি পুলিশের প্রতিও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
সম্পাদক মহোদয় সম্ভবত আমার দেশ সম্পাদক ও বিএনপি সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমানের কথা ভুলে গেছেন, কুষ্টিয়ার আদালত প্রাঙ্গনে যার ওপর হামলা চালিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলা হয়েছিল। এর আগে তাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে মারধোর করে কেবল জাঙ্গিয়া পরিহিত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছিল। তার নিরাপত্তা দিতে পুলিশের ব্যর্থতায় মাহফুজ আনাম কি বাণী দিয়েছিলেন, তা আমার জানা নেই। কিন্তু একাত্তর টিভির ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের গ্রেফতারের ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছে। তিনি আরও অনেক বিষয়ে জ্ঞান দিয়েছেন।
সরকারের বয়স মাত্র ১৮দিন। এ সরকার রাজনৈতিক সরকার নয়। অতএব এত আশা করা ঠিক নয়। ছাত্র-জনতার বিপ্লবে প্রধানমন্ত্রী পলায়ন করায় উদ্ভুত পরিস্থিতিতে দেশে সামরিক শাসন জারি হবে, এমনটাই ধারণা ছিল সবার। জনগণ যেকোনো উপায়ে আওয়ামী জুলুম ও আওয়ামী জাহেলিয়াতের কবল থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিল। সামরিক বাহিনী এবার প্রকৃত দেশপ্রেম, ধৈর্য্য ও বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে। তারা ক্ষমতা নেয়নি। আওয়ামী লীগ বার বার দেশকে সংকটে ফেলেছে। গত সাড়ে ১৫ বছওে প্রশাসনসহ সর্বত্র আওয়ামী লীগের লোকজনই এখনও বহাল। অতএব ফাঁকফোকড় পেলেই তারা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চেষ্টা করবে।
ইতোমধ্যে অনুরূপ একাধিক আলামত দেখা দিয়েছিল। ছাত্ররা তার নস্যাৎ করেছে।
আওয়ামী শাসনে কার বিরুদ্ধে কত মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ‘হুকুমের আসামী,’ ‘অজ্ঞাত আসামী,’ এসব আদৌ অপরিচিত শব্দ নয়। অপকর্ম যদি কেউ শিখিয়ে থাকে, তাহলে আওয়ামী লীগই বড় শিক্ষক। উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটেছে ৭৭ বছর আগে। এখনও তাদের প্রণীত আইন ঘষামাজা করে প্রয়োগ করা হয়। নিবর্তনমূলক আইনগুলোকে আওয়ামী লীগ তাদের মতো করে সংশোধন করে যেকোনো বিরোধী কণ্ঠকে চেপে ধরতে কাজে লাগিয়েছে। কেউ যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন প্রয়োগে এখনই প্রশ্ন তোলে, তাহলে তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ রয়েই যায়। তারা কি বিভ্রান্তি ছড়িয়ে প্রকারান্তরে আওয়ামী মহত্ব প্রচার করতে সচেষ্ট?
গণহারে মামলা দায়েরের ঘটনায় ডেইলি স্টার সম্পাদক উদ্বিগ্ন। ‘আগে মামলা পরে প্রমাণ’ পন্থার সমালোচনা করেছেন। রাজনৈতিক সরকার, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সাড়ে ১৫ বছরে যা করেছে, তার অনুসরণ কি হুট করে বন্ধ করা সম্ভব? আওয়ামী লীগ বার বার সরকারে ছিল, তাদের কৃত অপরাধও বেশি। বিএনপি ২০২৩ সালে অভিযোগ করেছে এবং ডেইলি স্টার তা রিপোর্ট করেছে যে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তাদের ৪২,২৬,৪৯৪ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সারাদেশে ১,৪১,৬৩৬টি মামলা করা হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ২৭টি করে বছরে ১০ হাজার করে মামলা তায়ের করা হয়েছে। কেবল ঢাকা বিভাগেই বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা সংখ্য ১৫,০৭৯টি।
আমার দেশ সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা সংখ্যা ৭৮টি, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা ৩৬টি, সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ১০০টি, হাবিবুননবী সোহেলের বিরুদ্ধে প্রায় ৪৪০টি, মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ১১টি, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১০টি। অন্যান্য প্রায় সকল নেতার বিরুদ্ধে বহুসংখ্যক মামলা দায়ের করেছিল আইনের শাসনের মহান পূজারি আওয়ামী লীগ।