১
এই কুয়াশায়
ভোরবেলায় কুয়াশা এল
তোমার মতন কুয়াশারা
দ্বিধাদ্বন্দ্বে রাস্তা হারাচ্ছি আমি
রাস্তায় সীমাহীন ষাঁড়
যদিও নরম শিং, ধরা যায় না
মাথা নাড়ে ভয়
শীতের বারান্দায় ঘুমভাঙা সকাল
অস্পষ্ট চিঠি নিয়ে অপেক্ষায় আছে
আমারই ঠিকানা লেখা তাতে
যদিও ঠিকানা নেই আমার
হৃদয় উদ্বাস্তু বহুদিন
একটি শরীর শুধু, শরীরে অবরুদ্ধ কাম
সব ব্যর্থ কৌশলী
কুয়াশার পাঠশালায় স্বপ্নের বালিকারা ওড়ে
তাদের ডানার কোনো ধারণা নেই
শুধু ইঙ্গিতে ভরা জাগরণ
কোথাও নিলাম হচ্ছে সেসব সুদূরিকা
তাদের ঘ্রাণে আড়ষ্ট হই
মাটির জাতক বলে
আমিও বিষণ্ণ আর ক্লান্ত ভঙ্গুর…
২
আমাদের আত্মহত্যার ভেতর
কলঙ্কিত জ্যোৎস্নায় আমরা বেড়ে উঠলাম
আমাদের জ্যোৎস্নাশরীরে বাজনা বাজল
আমরা মৈথুনের দেশে খুঁজছিলাম নিগূঢ় সংগম
কত ঝরনার পাশে রাতজাগা পড়ে ছিল
পরিস্থিতি তৈরি করছিল সময়ের পাঠশালা
আমরা দীক্ষা নিচ্ছিলাম
সারারাত যাওয়া-আসা করছিল ইহকাল পরকাল
কয়েকটি চোখের ইশারা উড়ছিল বাতাসে
প্রৌঢ় আলোকে ছুটোছুটি করছিল বাল্যকাল
আমাদের আত্মহত্যার ভেতর আমরা বেঁচে উঠছিলাম
৩
নরকের কবিতা
শুধু টাকা দেখাচ্ছো?
আর টাকার সঙ্গে কী দেখাচ্ছো?
আমরা মৃত্যুর পাশে ঘুমিয়েছিলাম
আমরা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলাম
আমাদের সমস্ত ইচ্ছার লিঙ্গগুলি
ক্ষতবিক্ষত করছিল স্বপ্নগুলিকে।
আমরা টাকা দেখতে চাইনি
আমরা জীবন দেখতে চেয়েছিলাম
আমরা জীবন দেখতে পাইনি
আমাদের বেঁচে থাকার মুহূর্তগুলি
ঘুমিয়ে পড়ছিল মৃত্যুরশয্যায়।
এত কোলাহল ভাল্লাগে না
এই নরকে আমাদের বিশ্রামের ব্যবস্থা হোক
বক্তৃতা শুনতে শুনতে আমাদের কান পচে গেছে
চেয়ে থাকতে থাকতে আমাদের চোখও অন্ধ হয়ে গেছে
এখন আর আমাদের হৃদয়ের স্পন্দন টের পাই না
হৃদয়ও পাথর হয়ে গেছে।
৪
করাত
সবাই করাত বানাচ্ছে এখন
এক একটি ভয়ংকর করাত!
সব সম্পর্ক কাটা যাবে—
সব ইতিহাস কাটা যাবে—
সব বিশ্বাস কাটা যাবে…
ধর্মের করাত, অধর্মের করাত
ভ্রান্তির করাত, সম্প্রদায়ের করাত
যেদিকেই যাই, যেদিকেই যাই
আমার কাটা যায় সব, আমাদের সব কাটা যায়
তেমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে সারারাত রাস্তা খুঁজি
কোন রাস্তায় থাকে নিরাপদ?
সহনশীলদের বাড়ি কোন রাস্তায়?
কোন রাস্তায় তবে মানবিক সমাচার?
উত্তরহীন এই হাহাকার সময় শুধু ভিক্ষা চায়
কী আছে দাও! কী আছে দাও!
শুধু দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে
ফুসফুস ভরা শুধুই হাহাকার….
ছেঁড়া ইতিহাস, ভাঙা বিশ্বাস, কাটা সম্পর্ক নিয়ে
শুধু একটি কাব্য রেখে যাই এই করাতের দেশে
শুধু একটি কাব্য মানবিক সূর্যের কাছে
অক্ষর ও শব্দ চেয়ে চেয়ে রোজ কাঁদে!
৫
কামড়
কিছুটা এগিয়ে গিয়ে
আবার আসছি পিছিয়ে
হৃদয় বিছিয়েও
আবার নিচ্ছি গুটিয়ে।
চারিপাশে গর্ত
গর্তে জিভ দেখায় সর্প
ছুঁলেই ছোবল দেবে
বিষের বিসর্গ।
নাচতে নাচতে যায়
এই সময়ের মোহ
মোহরাই পেয়ে যায়
সন্তানের স্নেহ।
মাঝে মাঝে তবু বাঘ হয়ে
নিজেকেই ভয় দেখাই নিজে
ছাতাটি শুকনো রাখি
নিজে ভিজে ভিজে।
কমে আসছে দিনের আলো
এখনও জ্বলেনি কোনো চুলো
পরকীয়া এখন আর রান্নাও করে না
হোটেলেই সব সেরে নিলো।
কামড় খেতে খেতে কামড়ের দাগ
শরীর ফুলেছে
শরীরে বিচ্ছিরি গন্ধ
গন্ধ শুঁকে শুঁকে মাছিরা জুটেছে।
৬
আত্মপরিচয়
ঘুরপাক খেতে খেতে
ঘুরপাক খেতে খেতে
একটা আধা শহরে বাড়ি
অবেলার কাক,হাটুরে ফেরিওয়ালা
আর বিক্রি হওয়া মেয়ে
একে একে ফিরে এলে দেখা হয়
যে যার মতন জল মাপে
দু একটা রাজনৈতিক শিকারি
মোড়ে মোড়ে কথা কাটাকাটি করে
মেয়ে পাচার হওয়া সংবাদে
মেতে ওঠে চায়ের দোকান
চোখের সামনে যেটুকু সামান্য আলো
তাও অন্ধকার হয়ে যায়
ছেঁড়া আত্মাটুকু রিফু করতে বসি
ঐশ্বরিক বিশ্বাসের সুতো নষ্ট হয়ে গেলে
কোথায় পাব আর?
বিজ্ঞাপনে দেখি সব তিল তাল হয়ে ঝরে
কোথাও নেই সুসমাচার!
তবুও শহর
গ্রাম থেকে বাবা নদী আনে
মা সেই নদীতে ধরা পড়া মাছ
আমি ও আমার বউ মৎস্যগন্ধা
লুকিয়ে রাখি সমূহ গোপন সংবাদ!
৭
আমার কবিতা
রাস্তায় দৈত্যর সঙ্গে দেখা হলো
দৈত্য বলল, এবার তোমার পালা!
—তাহলে আমার ছেলেপুলের কী হবে?
—সে ভাবনার দায় আমার নয়;
আমি এই রাষ্ট্র চালাই
যাকে যখন দরকার হয়
আমার খাবার টেবিলে তলব করি!
আর কয়েকদিন মাত্র বাকি আছে আমার
দৈত্যের খাবার টেবিলে যাবার আগে
তাই এতো কবিতা লিখি আমি;
কবিতাই শুধু আমার প্রতিবাদ!
তোমাদের সাথে কারও দৈত্যের দেখা হয়নি
তোমরা তাই বিশ্বাস করো না দৈত্যের কথা
তোমরা পূর্ণিমা রাতে আজও ছাদের ওপর বসে
একের পর এক রোমান্টিক কবিতা লিখে যাও;
দুপুরে বিরিয়ানি দিয়ে লাঞ্চ সারো
আর নাইট বাল্ব এর নিচে
স্লিভলেস ব্লাউজের হুঁক খুলে ঘুমোতে যাও!
আমার শুকনো থুতু আর বেড়ে যাওয়া হার্টবিট
আর নির্ঘুম রাত্রি আর অসহিষ্ণু মুহূর্তগুলি
এলোমেলো হয়ে কবিতার কাছে ছিটকে পড়ে
নিঃশব্দেই কত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়…..
৮
একটি ভালো দিন
আজ বিকেলে সুন্দর চা খেলাম
হাঁটুর ব্যথা বলে হাঁটতে বেরোইনি দুদিন
গতকাল এক আয়নাওয়ালা আয়না দেখিয়ে গেছে
আমি ও আমার আত্মীয়-স্বজন সবাই দেখেছি মুখ
শুধু মুখের ভাষা গোপন করে রাতের পাহাড়ের দিকে চলে গেছি চুপচাপ
আমাদের ভেতরের ঘরের বন্ধ দরজায়
কেউ কেউ বসেছিল
ওরা এত কুৎসিত কেউ আয়না দেখেনি কোনোদিন
কোনো কোনো পরামর্শ এসেও ফিরে গেছে
আমরা শুধু দূর থেকেই ওদের নাম দিয়েছি তালিবান
এত ভালো দিন ছিল আজ
শুধু রোদের নাম ছিল খচ্চর!
৯
দেখা হল রাস্তায়
৩৬ বছর পর দেখা হল রাস্তায়
যে যার গন্তব্য খুঁজে খুঁজে
হেঁটে গেছে দীর্ঘ পথ
পথে পথে কত ইতিহাস
ধ্বংসাবশেষ হয়ে আছে
আমাদের ইতিহাস নেই
শুধু স্বপ্ন গড়িয়ে গেছে
ব্যথাতুর চোখে অশ্রু মুছে
আমরা তার পিছুপিছু গেছি
আমাদের কষ্টগুলি বোঝাতে পারিনি
আজ আর কিছু বলবে না?
কিছুই বলার নেই শুধুই শূন্যতা
সময় উড়িয়ে দিয়েছে কাগজের মতো
অথবা নষ্ট হওয়া মহাজীবনের পালক
ঘুরপাক খাই শুধু অনন্ত রাস্তায়…
১০
আমি আজ অনন্তের পথে
আজ রোদ ওঠেনি
একাকী হেঁটে যাচ্ছি অনন্তের পথে
গতকাল যারা বলেছিল:দেখা হবে,রাস্তায় দেখা হবে!
তারা কেউ রাস্তায় আসেনি
আমি শুধু নিজেকেই ভালোবাসতে বাসতে
নিজের সঙ্গেই কথা বলতে বলতে
এগিয়ে চলেছি
রাস্তায় অনেক পাখি আর গাছপালা আর নুড়িপাথর
সবাই দেখছে আমাকে
রক্তাক্ত সভ্যতার কোলাহল কানে আসছে
আর চিৎকার করে মরে যাচ্ছে অন্তিম ইচ্ছাগুলি
এক ঝলক বাতাস অথবা পোয়াতি মেঘের ছায়া
আমাকে আশ্বাস দিচ্ছে আজ
সূর্য ফিরলে আমার দৈব ভিক্ষার সম্মোহন তীব্র হবে
আমি শুধু শূন্যতা চেয়ে নেব অনন্তের সকালের কাছে।
১১
ধাক্কা
আর কিছু নয় : পিছনে কিংবা সামনে
একটু হুমড়ি খেয়ে পড়ছি
মাথাটা ঘুরে গেছে
মনটা বিষণ্নতা পেয়েছে
কিন্তু তারপর আমি আবার উঠে দাঁড়িয়েছি
আমার কলমটি বন্দুকের মতো ধরেছি
শব্দগুলি এক একটি গুলি হয়ে ছুটে গেছে
শুধু লীলা আর কিছু নয়?
কত লীলা তোমাদের!
পাটকাঠির সাঁকো বানিয়েছ
তারপর আমাকে বলেছ পার হতে!
মুখে মুখে হাসির ঝরোকা তোমাদের
হাসতে হাসতেই তীব্র বিষ ঢালতে চেয়েছ
স্নেহের দাঁতগুলি বারবার বদলে গেছে
আলোড়ন দেখে দেখে কত শতাব্দী পার হল
নিমন্ত্রণ সভায় এসেও ফিরে যাচ্ছি
তোমরা শুধু ধাক্কা মারো,ধাক্কা মেরে মেরে এভাবেই জয়ী হতে চাও!
১২
আত্মসমর্পণ
মৃত্যু যে কতবার এসে দেখে যাচ্ছে!
আলোতে আসছে, আঁধারেও আসছে
যখন তখন এসে বসে থাকছে মাথার কাছে
কিছুই বলার নেই
শরৎকালের রোদ্দুর মেশানো ঠান্ডায়
খালি গায়ে বসে আছি পথের ধারে
তুমুল আকাশে মেঘেরা খাটিয়া নিয়ে যাচ্ছে একে একে
আমিও যাব ওদের খাটিয়ায়
আমার উপলব্ধি জুড়ে শিশিরমাখা ধানফুল ঝরে পড়ে আছে
অথবা দূর্বাঘাসের ঘ্রাণ আর শালুকফুলের হাসি
কাত্যায়নী কে হয় আমার?
ঘনঘন গর্জন শুনি তাঁর ব্যাঘ্রের মুখে
আর বাজনা বেজে ওঠে
মৃত্যু নিকটে আসে, জানালা-কপাট বন্ধ করে দেয়
তারপর চোখে চোখ রেখে চুপচাপ বসে থাকে
আমি পাখি দেখি না, চাঁদ দেখি না, জলের দিকেও তাকাতে পারি
বিষাদকে ডেকে এনে তার কাছে আত্মসমর্পণ করি
আমিও নির্লজ্জ হয়ে উঠি…
১৩
কবিতার দোকান
কবিতার দোকানে দোকানে কত আলো জ্বলে গেছে
ফিরতে ফিরতে অন্ধকার হয়ে গেল পথ
শুধু শব্দের মোহিনীতে দু’দণ্ড দাঁড়িয়েছি
শুধু হৃদয় সেঁকেছি একান্ত অনুভবে
আজ শূন্য ছাড়া কিছু নেই আর
শুধু শূন্যই সংগ্রহ করেছি কবিতার বাজারে
শুধু শূন্যের মেঘেই বৃষ্টি চেয়েছি শ্রাবণআকাশে
অথবা হেসেছি কোনো বিকল্প জ্যোৎস্নারাতে
দুঃখ ও আনন্দগুলি থাক তবে
ঘাস হোক, সবুজ লতানো ঘাস
ঘাসে ঘাসে কবিতার ফুল ফুটুক
আমাদের ইচ্ছেগুলি ভ্রমর হয়ে ফিরবে আবার
শব্দশস্য খুঁটে খেতে খেতে নতুন পাখির ঝাঁক
খুঁজে পাবে শূন্যতা, কবিতার ইতিহাস
ফুঁ দিলেও বাজবে না কোনো বাঁশি,যদিও বিশ্বাসী
সবাই নাস্তিক হতে চেয়ে খুঁজে পায় ঈশ্বর…
১৪
গোরক্ষক
মানুষরক্ষক তুমি নও
মানবরক্ষক তুমি হবে না কখনো
মানবসভ্যতায় এসে গোরক্ষক হয়ে গেলে তবে!
রক্তচক্ষু উন্মাদের মতো ছুটে যাও—
রেহাই পাবে না কেহ—
মারো! মারো! তীব্র অস্ত্র হানো,দারুণ উৎসাহ
চূর্ণ হোক মুসলমান—
মারো! মারো! যখন যাকে সন্দেহ…
কী সুন্দর ধর্ম তোমার! কী সুন্দর রাষ্ট্র!
কী সুন্দর তোমার স্লোগান! কাঁপায় থরো থরো
মারো! মারো!
গরু মাতা! গরু মাতা! গরু পূজা শুরু করো!
ওই তো ছুটছে গুলি—
ওইতো নামছে তরোয়াল—
রাষ্ট্র তোমার সঙ্গে আছে; হয়তো পুরস্কার—
মারো! মারো!গরুমাতা প্রসব করছে সন্তান
রাষ্ট্র নির্মাণ করবে ওরা, ধর্ম নির্মাণ করবে ওরা
তারপর শূন্য হবে সব মুসলমান!
কবি তৈমুর খান মানেই কবিতায় নতুন চমক। সাধারণ বিষয় উপস্থাপন গুনে অসাধারণ হয়ে উঠেছে প্রতিটি কবিতা।
প্রতিটি কবিতা জীবনের গান গায়।
প্রিয় কবির জন্য হার্দিক শুভেচ্ছা।