| মাহমুদ নোমান |
কবিতা একেকজনের কাছে একেকভাবে ধরা দেয় অথচ কবি নিজেই যদি অন্যের কবিতা ভেবে নেয় তখন ঐ কবিকে নিয়ে কিছু বলার থাকলো না। এটাকে নিশ্চিত পরকীয়াও ভাবার ফুরসত নেই। পৃথিবীতে অমর সৃষ্টির বহুলাংশেই আপনাদের কথিত পরকীয়া থেকে সৃজিত ; হালের বনলতা সেন’ উৎকৃষ্ট উদাহরণ। অথচ আমার কাছে পরকীয়া বলতে কিছু নেই, (পর)কীয়া বলতে যা একটু বুঝি… সেদিন একটা কবিতা পোস্টে দিতেই গুগল এটাকে ট্রান্সলেট করে সাথেসাথেই আর এসব আমি শিখিনি বলে এক কবি আমাকে ইংরেজিটা দেখায় অথচ ভড়কেই গিয়েছি। ভেবেছি কবিতা’টি কারো কপি!!! কী অস্থিরতা মুহূর্তে, নিজের কবিতা অন্যজনে লিখেছে ভাবতে গা ঘিনঘিন এমনকি মেজাজ চরমে। এই যে এখানে নিজের কবিতাকে অন্যের ভাবতে কী চরম ঘেন্না অথচ বেশিরভাগ কবি অন্যের মতো লিখতে না পারার হাপিত্যেশ করেন!!! এদেরকে নিয়ে ভাবার সময়টাও আমার নেই,কিন্তু পরে ট্রান্সলেটের ব্যাপারটা খোলাসা হলো কবিজনের সাথে ফোনের আলাপে… কবিতাটি আমার কবিতার ট্রান্সলেট, তবে আমার নামটা(mahmod caunon বোধহয় 😉 আর( বলে সর্পিণী — (পর)কীয়া মোহে/ ভালোবাসো আজো সুযোগ পেলে) এই দুটো লাইনের (পর)কীয়া’তে পর এর অনুবাদে ( after) এটাতে কবিটির ঘাপলা লেগেছে বুঝতে পারলাম। কিন্তু কী আশ্চর্য যে,আমার এটাকে অতি উত্তম লেগেছে। কেননা আমার মনের অনুবাদ হুবহু করলো। আমিতো পরকীয়া বলিনি,বলেছি (পর)কীয়া। এখানে পিছনে লাইনে দাঁড়িয়ে আড়ালে ঢুকার একটা ব্যাপার আছে। এটাতে প্রেম নেই, নিজস্বতা নেই। আমি কখনো প্রথম প্রেম,দ্বিতীয় প্রেম ভাবতে রাজি নই। যখন যেটা আসে সেটাই প্রেম। প্রেম হয়ে এলেই প্রেম। তাঁকে পুজা করি,শ্রদ্ধা করি। আমার বিশ্বাস প্রেম বা কবিতা যখন যাঁর কাছে যায় পবিত্র হয়েই যায়। কোনো ধরণের ভাবনা/ দ্বিধাও নেই — কবিতা বা প্রেমিকা কখনও অপবিত্র হতেই পারে না….
এসবকিছু বলতে আমাকে সু্যোগ করে দিয়েছে কবি মজিদ মাহমুদের ‘মাহফুজামঙ্গল’… আমি আশ্চর্য হলাম খুব,কবিকে কেউ দাঁত খেচিয়ে দৌড়ালো না কেন…? মাহফুজাকে কখনো মা,কখনো প্রেমিকা,কখনো শয্যাসঙ্গী,এমনকি নানান সম্পর্কের অনুসঙ্গে দেবীও মান্য করেছে। এসব শুনতেই আপনাদের হাত-পা কাঁপছে…? অথচ এটাই চিরন্তন সত্য। এই জগতের এমনকি লেখকসমাজের ৮০% এসব বুঝবার কথাও নয়… তবুও মজিদ মাহমুদের ‘মাহফুজামঙ্গল’ প্রকাশের ৩০ বছর পূর্তি উৎসব হতে যাচ্ছে। এটা অতি আশ্চর্যের ব্যাপার হলেও দৃঢ়বিশ্বাস এই যে, মজিদ মাহমুদ হয়তো এখনের নয়,ইতিহাসের… তিনি নিজেও জানেন না কখন জন্মেছেন এই ধরাধামে, এটা নির্দ্বিধায় বলতে পারি….
কবিরা হচ্ছে চিরকালের। কবিতার ভাষায় মজিদ মাহমুদ সারল্যের মাঝে বেশ আন্তরিক শুধু নয় বেশ হৃদয়গুহায় হানে অদৃশ্য তীর; গদ্যছন্দে নির্দ্বিধায় বলা শুরু করেছে ইতিহাস ঐতিহ্যের আনুষাঙ্গিকতা,মিথের ব্যাপারে বেশ পরীক্ষিত। ভাষাটাকে ম্যাড়ম্যাড়ে করে তুলেননি বরঞ্চ পাঠক ‘মাহফুজামঙ্গল’ পড়া শুরু করলে এটাকে রেখে অন্য কোনো কাজে যাবে সে ভাবনাও আসবে না। ‘মাহফুজামঙ্গল’ এর ভাষা, শব্দ, বিষয়-আশয় দিন যত যাবে ততই চর্চিত হয়ে ওঠবে। মিষ্টতা বাড়বে বৈকি কমবে না। নতুনতর স্বর হয়ে পুনঃপুনঃ আবিস্কৃত হতে থাকবে। ‘মাহফুজামঙ্গল’এর শুরুতে ‘কুরসিনামা’য় কবি বলা শুরু করলেন,বলতে পারেন সূচনা করলেন কী কী বলবেন পরক্ষণেই —
” ঈশ্বরকে ডাক দিলে মাহফুজা সামনে এসে দাঁড়ায়/ আমি প্রার্থনার জন্য যতবার হাত তুলি সন্ধ্যা বা সকালে/ সেই নারী এসে আমার হৃদয় -মন তোলপাড় করে যায়/ তখন আমার রুকু/ আমার সেজদা / জায়নামাজ চেনে না/ সাষ্টাঙ্গে আভূমি লুণ্ঠিত হই/ এই মাটিতে উদ্গম আমার শরীর/ এভাবে প্রতিটি শরীর বিরহজনিত প্রার্থনায়/ তার স্রষ্টার কাছে অবনত হয়/ তার নারীর কাছে অবনত হয় “
আদতে শুরু আর শেষ বলতে একটাই, পাঠকরা হয়তো মাহফুজামঙ্গলের কয়েকটা পর্বের অনুসারে নানান ব্যঞ্জনায় কবিতা পড়বেন; ‘কুরসিনামা’র পরে ‘মাহফুজামঙ্গল’, তারপর ‘উত্তরখন্ড’এ কবিতায় মজিদ মাহমুদ পরিবেশ পরিস্থিতির দিকের খোঁজ দিয়েছেন। বলতে গেলে জীবনের তাগিদে নানান বিষয়ে কথা বলেছেন, কিন্তু শেষে এসে ‘যুদ্ধমঙ্গল’এর ‘সন্ধি’ কবিতায় বললেন —
” তুমি একাকী দাঁড়িয়ে আছ বিধ্বস্ত সমর প্রান্তরে/ আমিও আজ হৃতসর্বস্ব ভিক্ষুকের বেশে/ অথচ তুমি ছিলে মহারানি ভিক্টোরিয়া/ আর আমি মহীসুরের টিপু সুলতান /
তবু কেউ আজ পরাস্ত নই— সন্ধি তো যুদ্ধের নিয়মে/”
সন্ধির কথা শেষে এসে বললেও প্রথমে এবাদতে বলে দিয়েছেন যত প্রার্থনায় সে একই জায়গায়। ঈমান বা আক্বিদা একটা জায়গায়। যাঁর সামান্যতে ঈমান আসে না,তাঁকে সারা জাহান বুঝালেও হবে না। মসজিদ মন্দিরে বা কোনো উপসনালয়ে বিধাতা ঘুমিয়ে থাকেন না,মানুষের ভেতরে সর্বদা বিরাজমান। কবিতা চর্চা মূলত আধ্যাত্মিকতার চাষবাস। সাধারণের এমনকি নিজের মধ্যে কী জারি হচ্ছে অনেকসময় সবটাই বোধগম্য নয়। কবিতা কেবল একটা বাইতেনে জ্ঞান। এসব কথা মাহফুজামঙ্গল স্বীকার করেছে,মজিদ মাহমুদের স্বীকারের ধার ধারি না। সৃষ্টির সাথে কথা আমার,স্রষ্টা লুকিয়ে থাকুক সৃষ্টিশীলতায়। তাই ‘এবাদত’ কবিতার সে কথাটি স্মরণযোগ্য—
” মাহফুজা তোমার শরীর আমার তছবির দানা/আমি নেড়েচেড়ে দেখি আর এবাদত হয়ে যায়/”