spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদকবিতাগুচ্ছ কবিতা : রহমান মাজিদ

গুচ্ছ কবিতা : রহমান মাজিদ

………
জাকারোভা-১
……….

চোখের ভিতরে লুকিয়ে রেখেছো বঙ্গোপসাগর,
কী নিতান্ত এক শিশু আমি! ছুটে যাই সেন্টমার্টিন।

তারা ভেবে তোমাকে রাখতে গিয়েছিলাম বুক পকেটে
পকেট আমাকে ডেকে বলে, ওরে অর্বাচিন খবিশ
তুই যে গ্রহের উপগ্রহ, জাকারোভা তার সৌরজগত।

আল্লার কিরে জাকারোভা, আমি জানতাম না,
বিশ্বাস হয়তো আমিও করতাম না, যদি না সেদিন–
অমন করে ঝঙ্কারিত হতো তোমার হাসির ভায়োলিন
তোমার দাঁতের উজ্জ্বলতায় সূর্য উঠেছিল আমার গ্রহে।

আসলে আমি ছিলাম বরফাচ্ছাদিত এন্টার্কটিকা
তুষার আর তমসার সাথে গাদন খেলতে খেলতে
হঠাৎ তোমার নিশ্বাসের উঞ্চতা, এখন রৌদ্র সারাবেলা।

………..
জাকারোভা-২
……….

জাকারোভা! প্রাণের সোনাভান আমার
কোথায় আছো, কেমন আছো?
পত্রযোগে খবর দিও।

তোমার ঠোঁটের কোনায় যে তিলটা ছিল
যা চিকচিক করতো শ্বেতপাথরের মর্মর ধ্বণির মতো
আর পতপত করে উড়তো আমার অস্তিত্বের পতাকা
আজও কী তা দাঁড়িয়ে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘার উচ্চতায়?
নাকি ভিজে গেছে নিশি বর্গীর নিষিক্ত লালায়?
পত্রযোগে খবর দিও।

সুজাতা নামে তোমার একটা বোন ছিল
বড় অদ্ভুত মেয়ে ছিল ও
একবারই দেখেছিলাম ওকে
হসপিটালাইজড একজন রোগীর পাশ থেকে উঠে
মুখোমুখি বসেছিলাম একটা অখ্যাত রেস্টুরেন্টে।

ডাইনিং টেবিলে থরে থরে সাঁজানো ছিল
শিক কাবাব, থাই স্যুপ, চিকেন টিক্কা মাসালা
হঠাৎ দেখলাম ধুমো ওঠা সেই খাবারগুলো
রুপান্তরিত হয়ে গেছে ভাষা ও বর্ণমালায়
অতঃপর বুভুক্ষের মতো আমার প্রিয় নানরুটি
হলকুম দিয়ে পাকস্থলীতে চালান দিচ্ছে মেয়েটি।

সুজাতা এখন কোথায় আছে, কেমন আছে?
খবর দিও পত্রযোগে।

জাকারোভা! আমাকে ভুল বুঝনা প্রাণের বেহুলা
যতটুকু আলো শুষে নিলে একটা রাত অন্ধকারময় হয়
ততটুকু রেটিনা শুষে নেয়া হয়েছে আমার চোখ থেকে
তোমার সবুজ মুখমন্ডল–
যাকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করে আমার ঠোঁট ও নিশ্বাস
ব্যবহৃত এক টুকরো টিস্যু পেপার ভাবা ছাড়া
অন্য কোন অপশনই ছিলনা মৃত সেই চোখগুলোর।

সুজাতা কী এখনো হিপনোটাইজ করে?
নাকি সান্ধ্য প্রার্থনায় মগ্ন হয়েছে স্বর্ণমন্দিরে?
খবর দিও পত্রযোগে।

………
পদ্মা
………

পদ্মা-কে দেখলে আমার বৃষ্টি হতে ইচ্ছে করে
ঘরে ফেরার প্রাক্কালে অস্তগত সূর্য
প্রতিদিন টিটকারি মারে বৃদ্ধটাকে
এতে নদীটার যতটা না রাগ হয়
তারচেয়ে বেশি মরে আত্মাভিমানে
গরুগুলো গোল্লাছুট খেলছে ওর বেডরুমে।

এখানে মানুষই একমাত্র গাংচিল
উড়তে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে বালুর বাজারে
ফারাক্কার মামলায় প্রিজন সেলে জলদা
হায়! যদি উট হতো ভাটির দেশের বালকেরা!

……….
বাজার
……..…

আমাকে আর ক’টা দিন উপোস থাকতে দিন
এই তো শরীর ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসছে করোটি।

এখন ভাতের হাড়িতে সেদ্ধ হচ্ছে উড়াল সেতু
আর আমার দেহে আছে দুইশত ছয়টি স্প্যান।

আমাকে আর ক’টা দিন উপোস থাকতে দিন
আমার হাড় দিয়ে তৈরি হবে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু।

……….
মজুরের চামড়া
……….

মজুরের কপাল থেকে এখন আর ঘাম ঝরে না
যেন থেমে গেছে কুমারী নদীর পেরিওডিক ধারা
দ্যাখো বাজারে বিক্রি হচ্ছে রাশি রাশি হাহাকার
পাতে পাতে ধোঁয়া উড়ায়–সূচকের উর্দ্ধক্রম উন্নয়ন।

একটি শিকাগো পুড়তে কতটুকু আগুনের দরকার?
একগাদা খড়ের উপরে কতটুকু শ্রমিক ঢেলে দিলে
দপ করে জ্বলে উঠতে পারে তোমার মধ্যরাত
নড়বড়ে সাঁকোর মতো কেঁপে ওঠে পুঁঞ্জিভূত পুঁজির পাহাড়।

একটা ঢেউ এগিয়ে আসছে– কাঞ্চনজঙ্ঘার উচ্চতায়
পিছনে ঢেউয়ের ছেলে, নাতি, পুত্রবধুরা–
প্রত্যেকের হাতে দুটি করে বঙ্গোপসাগর
ফসলের জমিতে অহেতুক আগাছা–সাফ করে ফিরবে ওরা।

জন হেনরীও এসেছিল একদিন গনগনে দুপুরে
ম্যাক ডেলিনের লাল চুমুটা ঠোঁটে লাগিয়ে
পশ্চিম ভার্জিনিয়ার বিস্তীর্ণ সুড়ঙ্গে পলাশ ফোটাতে
ফিরে গিয়েছিল রক্তজবার মতো লাল ক্ষত বুকে নিয়ে।

ভাতের বদলে যারা তিন বেলা পেট ভরে লাত্থি খায়
আনকাট কাজের মাঝেই গেলাস গেলাস খিদে খায়
হাড়ে, চামড়ায় ঝনঝন বেজে ওঠে মৃদঙ্গের মে ডে
শ্রমের আকাশে হেনরী ওরা, বেঁচে আছে অক্ষয় কৃষ্ণচূড়া ।

………….
কেটে দাও আমার জিহ্বা
…………..

ও গাছি ভাই!
তোমরা আমার জিহ্বাটা কেটে দাও
সে বড়ো লোভি আর বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

একটা দামি গ্রহ ভেঙে পড়েছে বাজারের মাঝখানে
যে যেমন পারছে খুঁটে খাচ্ছে
দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে ইশ্বর।

ও পণ্য! তোমরা কেটে দাও আমার জিহ্বা
সে ভুলে গেছে– হাতির ওজন মাপতে যাওয়া পিঁপড়ের পরিণাম।

………….
তাঁত বালা
….……….

কবিতার চিলেকোঠায় দাঁড়িয়ে আছে তাঁতকন্যা
গায়ে তার মোহিনী মিলের সাতখানি মসলিন
জোসনায় ঝলকাচ্ছে তবু দেহের হিমোগ্লোবিন
কবি! তুমি শব্দের জরায়ুতে খোঁজ কবিতার ডিম্বানু?

শীতের কুয়াশার মতো তরল অন্ধকারে
সুতার আঁতের মতো প্যাঁচানো অন্ধকারে
উপমার রশ্মি জ্বলছে তার ঢাকাইয়া মলমলে
জানোনা সে তোমার কাব্য প্রাসাদের রত্ন জামরুদ?

গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ওরা খোঁজে কেবল ময়দার মাড়ি
চরকার পাতিতে দ্যাখে সূর্যাস্তের সূর্যদয়
মুঠোর টানে টানে ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে
স্বদেশী আন্দোলনের মুহূর্মুহূ স্লোগান।

অ-ফোটা পদ্মের কুঁড়ির মতো নিরুত্তর তাঁতবালা
শুধু চরকার প্রতি পাঁকের শেষে ফিরে আসে সোমে
কবিতার আদ্যানুপ্রাস ওরা, গল্পের দৃশ্যময় কল্পনা
তাই রুমার গায়েই জড়িয়ে দিলাম কবিতার দুবলিজাল।

………..
তবনের শিল্পীরা
…………

মানুষ এখন আর লুঙ্গি পরেনা
আধুনিক হতে হতে আমরা
দাঁড়িয়ে রয়েছি এক বিবসন রাস্তার ধারে
যেখান থেকে সুস্পষ্ট দেখা যায় চাঁদের সুমন্ত অন্তর্বাস।

সই! কী হবে মরার পাশা খেলে?
তারচেয়ে চলো যাই, কলা বেচি হাটে হাটে
দ্যাখো তবনের শিল্পীরাও ছেড়েছে আদিম পেশা
ক্ষতি কি? উলঙ্গ যদি থাকে রক্তিমাভা কৃষ্ণচূড়া !

…………..
তাঁত রাণী হাওয়া বিবি
…………..

মাঝে মাঝে দৃষ্টি বড়ো বেশি ঝাপসা হয়ে যায়
তখন আমরা যেটা দেখি তা সত্যের অপলাপ
যেমন ধরুন ধুলোয় পড়ে থাকা ছাগলের বিষ্ঠা
রুদ্রাক্ষের ফল ভেবে মালা করি–ধুয়ে পানি খাই
সাটল বক্সের ভিতরে মেড়া মাকুর টিক টাক টকাস
মনে হয় স্যাক্সোফোনে বাজছে যুদ্ধ শেষের আনন্দ সুর।

অথচ তুমি জানোনা, সাতপাখিয়া একটা ল্যাবরেটরি
মেড়া, মাকু, শানা, বও– বৈজ্ঞানিক যন্ত্রসম্ভার
আমার আব্বা এই সাইন্সল্যাবের একজন কর্মকর্তা
আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্টিফিক রিসার্সার।

দ্যাখো একটি দুরন্ত কৈশোর দৌড়াচ্ছে উঠোনময়
বারান্দার মেঝেতে বসে তার মা– সেলাই করছে
যাদের পরনে ছিল গাছের বাকল, পাতার জামা

তোমরা যখন অসভ্য ছিলে, পরনে পাতার পাতলুন
মালা বদল হয়েছিল তখন তাঁতের সাথে চরকার
আব্বা বসে গেলেন দাদীমা হাওয়ার পিটলুমে
তুমি যখন বল, ‘শালার জোলার বুদ্ধি তোলা তোলা’
ফুন ফুন ঘুরে ওঠে গান্ধীর চরকা।

আরও পড়তে পারেন

2 COMMENTS

  1. অসাধারন। এক অন্য ভাবাদেশে যেন হারিয়ে গেলাম। একগুচ্ছ ভালোলাগা শরতের বাতাসের মতো শুভ্রতা ছড়িয়ে গেল কাশফুলের উপর দিয়ে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

এ্যাডঃমনিরুল ইসলাম মনু on গুচ্ছ কবিতা : বেনজীন খান
পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা