তাজ ইসলাম
গত ৪ অক্টোবর গিয়েছিলাম ময়মনসিংহ। ময়মনসিংহে সিটি কর্পোরেশন সেমিনার হলে ছিল ‘ অবরুদ্ধ সময়ের কবিতা গ্রন্থের প্রকাশনা পরবর্তী স্মৃতি তর্পণ শীর্ষক অনুষ্ঠান। পলিয়ার ওয়াহিদ এ বিষয়ে ফেসবুকে জানান দেন। পলিয়ার ওয়াহিদ ঢাকা থেকে যাবে। আমিও যুক্ত হলাম। অবরুদ্ধ সময়ের কবিতা নামে তারা একটি বই প্রকাশ করেছে। তখন হাসিনা সরকার ক্ষমতায়। আওয়ামী বাকশালীয় ফর্মুলায় চলছিল দেশ। ভিন্নমত পুরোপুরি দমন।ফ্যাসিস্ট সরকারের অধীনে দেশ।কেউ কথা বলতে পারে না গলা চেপে ধরে। সেই সময় কবিরা কথা বলেছেন,কবিতা লিখেছেন।বই প্রকাশ করেছেন।বই প্রকাশ করতে গিয়ে যে ভয়াবহতার স্বীকার হয়েছেন তারই স্মৃতিতর্পণ আয়োজন। ৫ আগস্ট সরকার পতন হয়েছে।হাসিনা পালিয়ে গেছে। এবারের আয়োজন একটু মুক্ত পরিবেশে। আন্দোলনের সময় সক্রিয় ছিলাম আমিও।লেখালেখি, মাঠে সবখানেই সক্রিয় ছিলাম। আন্দোলনে পরিচিত মুখগুলোকে আপন মনে হয়। এক সপ্তাহ আগেই নিশ্চিত করলাম আমি যাব।সঙ্গী করলাম আমার অনুজ কবি রহমান মাজিদকে। পলিয়ার ওয়াহিদ প্রস্তাব দিলেন ইচ্ছা করলে রাতেও যাওয়া যাবে। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ খুব বেশি দূরে না।রাত যাপনে আগ্রহ তৈরী হয়নি। তথাপি পলিয়ার ঘোষণা দিলেন রাতে কেউ যাচ্ছেন না।
আমার অবস্থান ঢাকার শেষপ্রান্তে মোহাম্মদপুর, আমিনবাজারের মাঝামাঝি প্রত্যন্ত গ্রামে।আমাকে পৌছতে হবে ভোর সাড়ে ছ টায় মহাখালি।সকাল বেলা মোহাম্মদপুর বা আমিনবাজার পৌছানোটাই বিড়ম্বনার। গাড়ি পাওয়া যায়নি। আমি মূলত ঘুমকাতুরে মানুষ।বিছানায় গা লাগালেই চোখ বন্ধ। বৃহস্পতিবার রাতে রহমান মাজিদ একটি ভিডিও লিংক পাঠিয়ে বললেন শুনতে। এটি শুনতে গিয়ে আমার ঘুমের বারোটা বেজে যায়।ঘুমাতে ঘুমাতে রাত দুই আড়াইটা বাজে। মোবাইলে এলার্ম দিয়ে রাখি রাত চারটার।ঘুম ভাঙে পৌনে পাঁচটায়।তড়িঘড়ি উঠে রওয়ানা দিই।মোহাম্মদপুর পৌছতে হয় কষ্ট করে।ওখান থেকে হুন্ডা নিয়ে মহাখালী পৌছি। গণভবনের সামনে যেতেই পলিয়ার খোঁজ নেন কোথায় আছি। আসছি বললে আস্বস্ত হন।সবার আগেই আমি পৌছি।তখনও ৬ টা বাজেনি। আমি মহাখালী নেমে হালকা নাস্তা সেরে নিই। তারপর আমরা একত্র হই। সকালের যাত্রায় আমরা আটজনের গ্রুপ হই।জানতে পারি ঢাকা থেকে এক গ্রুপ রাতে ময়মনসিংহ পৌছে গেছেন।
মহাখালী পৌছে ময়মনসিংহের অন্যতম বাস সার্ভিস এনা পরিবহনের খবর নিই।এনা পরিবহন বন্ধ।এনার মালিক স্বৈরাচারের সহযোগী ছিল। এনা তাই রাস্তায় নাই। মালিক পলাতক,পরিবহন আত্মগোপনে। আমরা ইউনাইটেড পরিবহনে চড়ি। কোন টিকিট নেই।যে যেখানে বসতে পারে।আমরা পিছনের বাসে উঠলাম।সামনের বাস সিট বুকিং। পরের বাসে সুবিধা মতো সিটে গিয়ে বসলাম। আমি আর রহমান মাজিদ একসাথে বসছি।নকিব মুকশি,পলিয়ার ওয়াহিদ,মুস্তাকিম বিল্লাসহ সবাই তুমুল কথা চালাচালি করছে।আমরাও সমান তালে কথা চালিয়ে যাচ্ছি। সারারাত গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল।বাসে উঠার পর তুমুল বৃষ্টি। রহমান মাজিদ কিছু খেতে চাইল। বাস থামায়নি। সামনে থামবে এই আশায় রইলাম।আমার তেমন ক্ষুদা লাগেনি। চলতে চলতে ময়মনসিংহ পৌছে গেলাম।তখন মুষলধারে বৃষ্টি। আমাদের আট সদস্যের টিমে দু জনের হাতে ছাতা আছে। একটা অটো পেয়ে আমরা চারজন উঠে গেলাম। আমি,রইস মনরম,মোস্তাকিম বিল্লাহ,সাগর চারজন যাচ্ছি। অটোর ছাউনি ছেড়া। আমি অর্ধেক ভিজে গেছি। রইস মনরমও ভিজে গেছেন। তিনি শার্ট পাল্টালেন।আমার ভিজেছে প্যান্ট।আমি জামা বাড়তি নিয়েছি,প্যান্ট নিইনি।ভেজা প্যান্টই পরে রইলাম। চলতি পথেই অটো ড্রাইভারের সাথে কথা বললেন সাগর। ময়মসিংহ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পলাতক। মেয়র পলাতক তার নেমপ্লেটে নাম তখনও জ্বলজ্বল করছে। সিঁড়ি বেয়ে যখন দোতলায় উঠলাম মেয়রের নেমপ্লেটে আমার চোখ পড়ল। মনে হল স্বৈরাচারের কোন দোসর জড়োসড়ো হয়ে দেখছে আমাদের। ততক্ষণে আমরা সবাই ক্ষুদার্থ। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা সকাল ১০ টায়। বৃষ্টিজনিত কারণে কোন উপস্থিতি নেই।আমরাই তখন কেবল হাজির।কেউ নাস্তা করিনি।বাহিরে তুমুল বৃষ্টি। আয়োজকদের কেউ নাই। আয়োজকদের সাথে কথা হল।সময় পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বৃষ্টি একটু কমলে সবাই নিচে নেমে হোটেলে গেলাম। পরাটা ভাজি নাস্তা করে আবার সেমিনার হলে এলাম। লোকজন জড়ো হয়েছে। সেমিনার হলটি খুব সুন্দর।আধুনিক পরিবেশে সাজানো।বক্তাদের সামনে ডিজিটাল স্ক্রিন। সবার সামনেই স্পিকার। অনুষ্ঠান শুরু হল।কথা বলার কোন নির্ধারিত সময় নেই।বক্তা নিজের মতো করে কথা বলছেন। আনলিমিটেড সময়। ইচ্ছে মতো থামছেন।অবরুদ্ধ সময়ের স্মৃতিতর্পণ করতে গিয়ে আন্দোলনের স্মৃতি চলে আসছে।নিপীড়ন, নির্যাতনের ভয়াবহতা নিয়ে কথা বলছেন। সারাদিন মূলত স্বৈরাচার হাসিনার ভয়াবহ অত্যাচারের চিত্রই তুলে ধরলেন সেদিনের আলোচকগণ। দুপুরে খাবারের আয়োজন ছিল।বিরতির পর আবার শুরু হল।সন্ধ্যা ৬ টায় অনুষ্ঠান শেষ হলে আমরা আর অপেক্ষা করলাম না। দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম।অন্যরা রয়ে গেল।আমি আর রহমান মাজিদ চলে এলাম বাসস্ট্যান্ডে।বৃষ্টি তখনও থামেনি।মহাখালী এসে বাস থামলো রাত সাড়ে এগারটায়। সেদিন রাতে মাজিদের বাসায় রইলাম। তারপর পুরো সপ্তাহ জ্বরে ভুগতে হলে।মঙ্গল বুধবারে জ্বরের প্রকোপে আমি আবোল তাবোল বকতে লাগলাম।আমার বউ ভয় পেয়ে গেল। আমিও ভাবলাম মনে হয় মরেই যাব।অবশ্য পরে মরিনি।জ্বর চলে গেছে। কে কি বলছিল এসব নোট করিনি। জাতীয় পত্র পত্রিকায় নিউজ হয়েছে। এসবেরই একটি এখানে যুক্ত করে দিই।সংক্ষেপে তাহলে জানা যাবে কে কি বলছিলেন। তবে একটি কথা বলে রাখা ভালো।এমন সব অনুষ্ঠানে স্বৈরাচারের সুবিধাভোগীরা যেন না থাকতে পারে সে দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখা উচিত।
ময়মনসিংহে অবরুদ্ধ সময়ের কবিতা ও ফ্যাসিবাদবিরোধী স্মৃতি তর্পণ
নিজস্ব প্রতিবেদক (দৈনিক কালের কণ্ঠ) ময়মনসিংহ
ময়মনসিংহে অবরুদ্ধ সময়ের কবিতা ও ফ্যাসিবাদবিরোধী স্মৃতি তর্পণ
ময়মনসিংহে দিনব্যাপী অবরুদ্ধ সময়ের স্মৃতি তর্পণ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী কবিতা সংকলন ‘অবরুদ্ধ সময়ের কবিতা’র পাঠ-পর্যালোচনা এবং স্মৃতি তর্পণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুক্রবার (৪ অক্টোবর) ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন মিলনায়তনে এ স্মৃতি তর্পণ অনুষ্ঠিত হয়।
কবি ও গীতিকার শহীদুল্লাহ ফরায়জী বলেন, আমাদের এই গণঅভ্যুত্থানে যত শিশু ও নারী, শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে পৃথিবীর কোনো বিপ্লবে এত মানুষ মরেনি। অথচ অনেক আওয়ামী লীগ মনে করেনা গণহত্যা স্বীকার করে না।
হাসিনা গুলি করে হত্যা করে ক্ষমা তো দূরের কথা শোকই প্রকাশ করেনি।
কবি ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সায়ন্থ সাখাওয়াৎ বলেন, ফ্যাসিবাদের পতনের মাধ্যমে দেশে সাময়িক সময়ের জন্য যে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ তৈরি হয়েছে তা যেন ফ্যাসিস্টের কোনো স্থাপনের মাধ্যমে আবার রোহিত না হয় সে ব্যাপারে ছাত্র-জনতা রাজনীতিবিদসহ কবি লেখক সাংবাদিক ও পেশাজীবীদেরও সতর্ক থাকতে হবে।
পতিত ফ্যাসিবাদ ও গণহত্যাকারী যারা পালিয়ে যায় তাদের আর রাজনীতি করার অধিকার থাকে না। দেশের মানুষ তাদের গ্রহণ করে না।
কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভুল পদক্ষেপ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে সহযোগিতা করতে পারে।
এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও রাজনৈতিক শক্তি যাতে ভুল করতে না পারে সেজন্য প্রেসার গ্রুপ হিসেবে ছাত্র-জনতার সঙ্গে কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদেরও সবসময় সোচ্চার থাকতে হবে।
অবরুদ্ধ সময়ের কবিতার সম্পাদক এহসান হাবীবসহ অন্য বক্তারা অবিলম্বে শিল্প সাহিত্য অঙ্গণের ফ্যাসিবাদের দোসরদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
এহসান হাবীব বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে ফ্যাসিবাদের দোসরদের পুনর্বাসন করা হয়েছে।
তিনি অবিলম্বে শিল্পকলা একাডেমির নব নিযুক্ত পরিচালক ও মহাপরিচালকের নিয়োগ বাতিলের দাবি করেন
এ ছাড়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সরকার আজিজ, কামরুজ্জামান কামু, মালেকুল হক, আবু বকর সিদ্দিক রোমেল, মোস্তফা তারেক, পলিয়ার ওয়াহিদ, রোমেনা আফরোজ, মুহিবুর রহিম, শাদমান শাহিদ, মুহাম্মদ মোস্তাকিম বিল্লাহ, সুফি সুফিয়ান, জব্বার আল নাঈম, সানাউল্লাহ সাগর, বায়েজিদ বোস্তামী, শাহেরীন আরাফাত, রাশেদ শাহরিয়ার, শফিক সাঁই, আহমেদ ইসহাক, মিলু হাসান, ওয়াহিদ রোকন, নকিব মুকশি, সালেহীন শিপ্রা, রইস মুকুল, তাজ ইসলাম, রহমান মাজিদ, তারিক ফিজার, লাবীব ওয়াহিদ, রাসেল মিয়া, আকিব শিকদার, দিপু রহমান, সাজ্জাদ হোসেন, তানজিদ আহমেদ, রুবেল মিয়া, সজিব আকন্দ, ফেরদৌসুল মনীরা লাবনী, আরাফাত রিকলে, এসএম রায়হান, তৌহিদুজ্জামানসহ অনেকে।