spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধজীবনের সত্য উপলব্ধির শিল্পকৌশল মোশাররফ হোসেন খানের কবিতা

লিখেছেন : আবু তাহের সরফরাজ

জীবনের সত্য উপলব্ধির শিল্পকৌশল মোশাররফ হোসেন খানের কবিতা

আবু তাহের সরফরাজ

জীবন ও জগৎকে দ্যাখার অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি সঞ্চিত হয়েই মানুষের ভেতর তৈরি হয় প্রাতিস্বিক অন্তর্বোধ। এই বোধই নানা শিল্প-মাধ্যমে প্রকাশ করেন শিল্পিরা। চিত্রকলার পর কবিতাই সবচেয়ে প্রাচীন শিল্প। চিত্র প্রকাশের মাধ্যম যেমন রঙ, তেমনই কবিতা প্রকাশের মাধ্যম ভাষা। ভাষার বাহন শব্দ। চিত্রকলায় রঙের ব্যবহার যেমন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে, একইভাবে কবিতাতেও বিষয়কে শৈল্পিক সৌন্দর্যে রাঙিয়ে তোলে শব্দ। বলা চলে, শব্দই কবিতার শিল্পিত কারুকাজ। আশির দশকের কবিরা বিগত দশকের কবিতার প্রভাব থেকে বেরিয়ে কবিতায় নতুনত্ব আনতে প্রয়াসী হন। বিষয়-প্রকরণ সময়ের সাথে বদলে যায়। নতুন সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু ভাষাশৈলী কবিকে নির্মাণ করে নিতে হয়। প্রখর মেধাবী না-হলে কবিতায় ভাষার নতুন শৈলী নির্মাণ করে নেয়া সম্ভব হয় না। বলতে কী, আশির দশকের কয়েকজন কবি কবিতায় স্বকীয় ভাষাশৈলী তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন।
প্রকৃতিরাজ্যে মানুষই সম্ভবত একমাত্র প্রাণী যার অন্তর্জগৎ বিচিত্র উপলব্ধিতে প্রতিমুহূর্তে তরঙ্গায়িত। সাধারণ মানুষ সেসব তরঙ্গকে বুকের গহনে লালন করলেও প্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু কবিরা পারেন। কবিতা তাই ব্যক্তি-মানসের রূপরসগন্ধ সমন্বিত শিল্প-প্রতিক্রিয়া। সুতরাং, কবিতা কেবল কবির অন্তর্বোধের শাব্দিক অনুরণন নয়, একই সঙ্গে তার জীবন-উপলব্ধির সারাৎসার। তবে জীবনকে বহু বর্ণিল অনুষঙ্গে প্রকাশ ঘটালেই কবির দায় শেষ হয়ে যায় না। হয়তো শিল্পের প্রতি কবির দায় তাতে পূরণ হয়, কিন্তু মানুষ হিসেবে কিছু অপূর্ণতা থেকেই যায়। পৃথিবীতে মানুষের জীবন নিশ্চয়ই ছেলেখেলা নয়। জীবনের গূঢ় কোনো মানে নিশ্চয়ই রয়েছে। সেই মানে খুঁজে নিতেই কবির ভেতর একজন দার্শনিককে থাকতে হয়। তা না-থাকলে জীবনকে নানা আঙ্গিকে হয়তো কবিতায় প্রকাশ করা যায়, কিন্তু জীবনের অর্থবহ কোনো সত্যে কবি পৌঁছুতে পারে না। আশির দশকে অনেক মেধাবী কবির আবির্ভাব আমরা দেখতে পাই। তাদের অনেকেই কবিতায় স্বকীয় শিল্পশৈলী নির্মাণ করে নিতে পেরেছেন। সেসব কবিতায় শিল্পের আস্বাদ পাওয়া গেলেও জীবনের অন্তর্গত স্বাদ খুব একটা পাওয়া যায় না। মোশাররফ হোসেন খানের কবিতায় পাঠক সেই স্বাদ পেয়ে যান। মানে, জীবন-উপলব্ধির বিচিত্র ঘূর্ণির ভেতর স্থির সত্যের একটি একক যে জীবনে থাকা দরকার, সেই বিশ্বাস তৈরি হয় তার কবিতা পড়লে গেলে। শরৎ সকালে কবিতায় তিনি লিখছেন:

আমি আমার গন্তব্য স্থির করে ফেলেছি
যেখানে যাচ্ছি সে পথ যদিও বন্ধুর
সেখানে যেতে হলে পার হতে হবে আগুনের দরিয়া
টপকাতে হবে বরফের পর্বত
আঁধারের গুহা পেরিয়ে, সর্পিল ফণা উপেক্ষা করে
সেখানেই পৌঁছুতে হবে।
আমার গন্তব্য যেহেতু স্থির, সুতরাং এখন কোনো
বাধা কিংবা শঙ্কাই আমাকে আর তাড়িত করে না।

জীবনের গন্তব্য স্থির করে নেয়াটাই মানুষ হিসেবে প্রধান কাজ। গরু-ছাগল কিংবা হাঁস-মুরগি কবি হয় না। মানুষই কবি হয়। সুতরাং, একজন কবির সবার আগে মানুষ হয়ে উঠতে হবে। এরপর কবি। কিন্তু আজকাল বাংলাদেশে কবিরা যেন কেবল কবিই, মানুষ নয়। মনুষত্ব, নৈতিকতা, মূলবোধ কবিদের ভেতর তেমন একটা দ্যাখা যায় না। কবিতা নিয়েই তাদের উল্লম্ফন। রেষারেষি। দলবাজি। প্রচারণা। মানুষ হিসেবে জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছুতে তাদের ভেতর কোনো আগ্রহ নেই। এই আগ্রহ তৈরি হয় জীবনকে বোঝার জ্ঞান থেকে। কোরআন ও হাদিস জীবন সম্পর্কে সুসংবদ্ধ জ্ঞান। এই জ্ঞান মোশাররফ পেয়েছেন বলেই গন্তব্য-পথের সকল বাধা পেরিয়ে যাওয়ার দৃঢ়তা তার ভেতর শেকড় গেড়েছে। বলতে কী, ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধান। এক মানুষ থেকে আরেক মানুষের জীবন যাপনের উপায়-পদ্ধতি আলাদা হলেও মনুষত্ব বোধের নিরিখে প্রত্যেকেই মানুষ। সেই মানুষের জীবনপ্রক্রিয়া কী রকম হবে, তার বিধান রয়েছে কোরআন ও হাদিসে। মোশাররফ হোসেন খান সেই বিধানকে মান্য করেই জীবনের বিচিত্র ঘূর্ণির ভেতর স্থির সত্যে পৌঁছুতে পারেন। সেই যাত্রায় জীবনকে কিভাবে উপলব্ধি করেন, তার সরল ও সহজ প্রকাশ ঘটান কবিতার মধ্য দিয়ে। ইসলামি ভাবাদর্শকে ভিত্তি করে তার কাব্যযাত্রা। দীর্ঘদিন ধরেই ইসলামি ভাবধারার কোনো কবি বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে না। ইসলামি সাহিত্য নামের একটি বিষয় যে যুগ-যুগ ধরে বাংলা সাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছে, সেই ইতিহাস আজকের প্রজন্ম ভুলেই গেছে প্রায়। বাংলা কবিতার পাঠক এখন প্রভাবিত। ধর্মনিরপেক্ষ ট্যাবলেট খুব কৌশলে তাদেরকে গিলিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে ইসলামের নামে যা কিছু, সবই তাদের কাছে একপেশে। তথাকথিত প্রগতিশীল (ইসলামি বিধানে যে প্রগতি রয়েছে তারচেয়ে সার্থক প্রগতি আর কোত্থাও নেই) কবিদের কবিতা পড়েই পাঠক শিল্পরুচির সীমানা নির্ধারণ করে নিয়েছে। অথচ দীর্ঘকাল ধরেই বাংলা কবিতায় ইসলামি ভাব ও আদর্শের জয়গান ছিল তুঙ্গে। ১৪-১৫ শতকের কবি শাহ মুহাম্মদ সগীরের কবিতায় আমরা দেখতে পাই ইসলামি ভাবদর্শনের জয়গান। এরপর কায়কোবাদ, কাজী নজরুল ইসলাম, আবদুল কাদির, গোলাম মোস্তফা, ফররুখ আহমদ ও আল মাহমুদসহ বাংলা কবিতার অসংখ্য দিকপালের নাম করা যেতে পারে যাদের কবিতার বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে রয়েছে ইসলামি জীবনবোধ। স্বাধীনতা-উত্তর কালে খুবই কম সংখ্যক কবি পাওয়া যাবে যাদের কবিতায় ইসলামি দর্শনকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করা হয়েছে।
তথাকথিত প্রগতিশীলদের ধারণা, শিল্প-সাহিত্যের সাথে ইসলামি চেতনার কোনো সম্পর্ক নেই। আসলে তাদের পড়াশোনার গণ্ডি দুই ইঞ্চি । ইসলামকে ধারণ করে সারা বিশ্বে যে বিপুল পরিমাণ সাহিত্য লেখা হচ্ছে এবং হয়েছে, তা কি স্রেফ আবেগের বশবর্তী হয়েই? নাকি ইসলামি জীবনবোধের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে? এসব বিষয় ভেবে দেখার মতো মাথাও এখন হয়তো এই জাতির আর নেই। এ জাতির মগজ ধোলাই হয়ে গেছে অনেক আগেই। কারা করেছে, কেন করেছে, সেটা বোঝার আগ্রহ কারো থাকলে তিনি পড়াশোনা করুন। চোখ-কান খোলা রাখুন। বুঝতে পারবেন। ইসলামি ভাবধারার কবিতা আজকাল তেমন লেখা হয় না। এখনকার কবিরা কবিতায় ইসলামকে ডেটল জলে ধুয়ে দিতে পারলে বেশ উচ্ছ্বসিত হন। এই উচ্ছ্বাস অবশ্যি আজকের সমাজের সকলেরই। সাহিত্যে ঈশ্বর শব্দটি থাকলে কোনোই সমস্যা নেই। সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় যখন আল্লাহ শব্দ লেখা হয়। হিন্দু কিংবা রীতিনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের দেশের সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে কারোরই কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু ইসলামি সংস্কৃতি নিয়ে এলে নানাদিক থেকে শুরু হয় বাক্যবাণ ও নোংরা সমালোচনা। এই সমাজ-বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ইসলামের মহত্ত্ব ও ভাবাদর্শ কবিতার বিষয়বস্তু হিসেবে তুলে আনা অবশ্যই হিম্মতের পরিচয়। সেই হিম্মতের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন মোশাররফ হোসেন খান। কেবল ইসলামকেই যে তিনি কবিতার উপজীব্য করেছেন, তা কিন্তু নয়। ইসলাম-বিদ্বেষী কবিরা কবিতায় যেসব বিষয় নিয়ে আসেন, মোশাররফের কবিতায় সেসব বিষয়ও আমরা দেখতে পাই। এক্ষেত্রেও অনেক কবির কবিতা থেকে মোশাররফের কবিতা আমরা আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারি। কারণ, তার ভাষাশৈলী ও বিষয়-বৈচিত্র্য সহজ-সরল। শব্দ কিংবা বাক্যের বিন্যাস সাবলীল। খুঁজে খুঁজে শব্দ এনে তিনি কবিতায় বসিয়ে দেন না। তার বলার কথার সাথে সঙ্গতি রেখে শব্দেরা নিজেই দায়িত্ব নিয়ে কবিতায় বসে যায়। ফলে অনেক কবির মতো তার কবিতা দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে না। কবিতার বিষয় পষ্ট। তার কবিতার শব্দেরা আমাদের প্রতিদিনের জীবন-যাপনের সাথে মিলেমিশে থাকে। আমাদের শ্রমের ঘামে, স্নেহ-ভালোবাসায়, রাগে-ক্ষোভে সেইসব শব্দ একাত্ম।

পৃথিবীর ও প্রান্তের কান্নাও যখন
আমার হৃদয়ে তোলে তীব্র হাহাকার
তখন কীভাবে থাকা যায় নির্বিকার?
আমার কাঁধেও আছে পৃথিবীর দায়।
কেবল ‘মানুষ’ ছাড়া মানুষের কান্না
আর কে শুনতে পায়?
এই তো ঘুরছে দেখো সূর্য চতুর্দিক
আমি তো মানুষ বটে, বিশ্ব নাগরিক।
(বিশ্ব নাগরিক)

দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে মানবতার প্রতিভূ হয়ে নিজের কণ্ঠকে উচ্চকিত করেছেন মোশাররফ। তিনি বলতে চান, রাষ্ট্রের সীমানা একটি আপেক্ষিক ধারণা। বৃহৎ অর্থে, আমাদের আবাসভূমি পৃথিবী। গোটা পৃথিবীতে একটাই সূর্য আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। সুতরাং, সকল মানুষই আসলে বিশ্ব-নাগরিক। পৃথিবীর যে প্রান্তেই মানবতা লঙ্ঘিত হোক না কেন, বিশ্ব-নাগরিক হিসেবে আমরা কেউ-ই নির্বিকার থাকতে পারি না। মানুষ ছাড়া মানুষের কান্না আর কোনো প্রাণী বুঝতে পারে না। কবিতায় মানুষ শব্দটি ঊর্ধ্ব কমা দিয়ে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। মানে, দেখতে মানুষ হলেও সবাইকেই কবিত মানুষ হিসেবে আখ্যা দিতে চান না। উহ্য রেখেই তিনি বলতে চান, যার ভেতর মানবিক বোধ নেই সে কোনোভাবেই মানুষ হতে পারে না। বিশ্ব-নাগরিক হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করার প্রেরণা তিনি পেয়েছেন ইসলামি নৈতিকতা থেকে। ইসলাম আমাদেরকে এই শিক্ষা দ্যায় যে, সকল মানুষ সমান। পৃথিবীর বুকে সকল মানুষ সমান অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকবে, এটাই কোরআন ও হাদিসের শিক্ষা। কোরআনে আল্লাহ বলছেন, “মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একই আত্মা থেকে।” এই উপলব্ধি যার ভেতর আছে কবি তাকেই মানুষ বলতে চান। আর তাই কবিতায় মানুষ শব্দটাকে তিনি ঊর্ধ্ব কমা দিয়ে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছেন। পৃথিবীর দায় নিজের কাঁধে তুলে নেয়ার নৈতিক শিক্ষা তাকে যুগিয়েছে শান্তির ধর্ম ইসলাম। ইসলামবিদ্বেষী তথাকথিত প্রগতিবাদী কবিদের কবিতায় মানবতার এই সাম্য কি আমাদের চোখে পড়ে? ‘আমি তুমি তুমি আমি/চলো যাই বনভূমি’ টাইপের ম্যাড়মেড়ে অনুভূতি ছাড়া তাদের কবিতায় মহৎ কোনো আদর্শ আমরা খুঁজে পাই না। জীবন-উপলব্ধির বিচিত্র ছবি হয়তো তাদের কবিতায় থাকে, কিন্তু মানুষকে ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার প্রেরণা খুব একটা থাকে না। জীবনের অভিজ্ঞতা মোশাররফের কাছে কী রকম? তিনি লিখছেন, ‘ক্ষুধার কষ্টে যার চোখ কখনো সিক্ত হয়নি/প্রকৃত অর্থে তার জীবনই রয়ে গেছে অপূর্ণ/ক্ষুধার অভিজ্ঞতার চেয়ে আর কোনো অর্থপূর্ণ অভিজ্ঞতা নেই।’ তিনটে মোটে বাক্যে জীবনকে তিনি হ্যাচকা টানে নামিয়ে এনেছেন আমাদের চোখের সামনে। জীবনের পূর্ণতার সংজ্ঞা তিনি সহজেই নির্ধারণ করে দিলেন। সহজে, কিন্তু গভীর তাৎপর্যে। এই সংজ্ঞায়নে যে দার্শনিক প্রজ্ঞা রয়েছে, সন্দেহ নেই। জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি তখনই সম্ভব যখন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চূড়ান্ত লড়াইয়ে মানুষকে নামতে হয়। দার্শনিক-উপলব্ধির সত্যকে বাদ দিলেও উদ্ধৃত কবিতাংশে ক্ষুধার্থ মানুষের প্রতি মোশাররফের যে সহমর্মিতা প্রকাশ পেয়েছে, তা তাকে মানবতাবাদী কবি হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত করে তোলে। যে কবি নিজেকে বিশ্ব-নাগরিক ভাবতে পারেন তার অন্তঃকরণ যে সমাজের অধিকার-বঞ্চিত মানুষদের জন্য কেঁদে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক।
কবিতার ভেতর দিয়ে একজন কবি অনেক কথা বলেন। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বলেন। এসব কথা শিল্পের ছাঁকনিতে কবিকে ছেঁকে নিতে হয়। না-হলে সেসব কথামালা কবিতা হয়ে ওঠে না। বলতে কী, আমাদের দেশের নামি অনেক কবি ছাঁকনির কৃৎকৌশল ঠিকঠাক জানেন না। ফলে, তাদের কবিতার ভেতর কী বলা হচ্ছে, তা পাঠকের মাথার ওপর দিয়ে যায়। কিন্তু মোশাররফ হোসেন খানের কবিতার বিষয়বস্তু পাঠক-ঘনিষ্ঠ। আমাদের প্রাত্যহিকতার সাথে তার কবিতার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কেননা, তার বেশির ভাগ কবিতার প্রধান উপজীব্য মানুষ। মানুষই তার চেতনার ধ্যান-জ্ঞান। মানুষের অন্তর্বোধের বিচিত্র উপলব্ধিকে তিনি আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। যতটা তার উপলব্ধ হয়েছে ততটা দিয়েই তিনি সহজ শব্দের বুননে নির্মাণ করেন কবিতা। এ কারণেই তার কবিতা পাঠকের নিজের কথা হয়ে ওঠে। তার কবিতা পড়তে গিয়ে পাঠকের মনে হয়, এই কথাই তো সে কতবার বলতে চেয়েছে। কবিতার সাথে পাঠকের এই যোগাযোগ ঘটানো কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। সুতরাং আমরা বলতেই পারি, যে কোনো বিষয় যতটা সাধারণ হলে অসাধারণ হয়ে ওঠে, মোশাররফের কবিতা তেমনই সাধারণ (অসাধারণ) শিল্প। শিল্পে সৎ-প্রচেষ্টা না-থাকলে শিল্পীর নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। একইসঙ্গে শিল্পের আবেদনও অন্তঃসারশূন্য। মোশাররফের নৈতিকতা যেহেতু মানুষকে কেন্দ্র করেই, সেহেতু মানুষের সাধারণ খুঁটিনাটি সকল কিছুকেই তিনি তার কবিতায় অসাধারণ ব্যঞ্জনায় রূপদান করেন। মানুষের প্রতি গভীরতম মমত্ববোধ থাকলেই এমনটা সম্ভব। পাশাপাশি আমরা দেখি যে, মানুষের প্রতি তার খেদও রয়েছে। অবশ্য প্রকৃতপ্রস্তাবে সেসব মানুষ নৈকিতা-বর্জিত অমানুষ। ‘এই রাত— দীর্ঘরাত’ কবিতায় তিনি লিখছেন:

এই মানুষ কামনার মানুষ
বড় বেশি চতুর বড় বেশি হিসেবী
অথচ, কেমন বেহিসেবীর মতো
তাদেরকে ভালোবেসে
দুঃখের নামতাই বৃদ্ধি করেছি কেবল জীবনের ধারাপাতে।

এরপরও মানুষকে ভালো না বেসে উপায় নেই। মানুষ নিয়েই আমাদেরকে চলতে হয়। ফিরতে হয়। মানুষকে সাথে নিয়েই রুখে দাঁড়াতে হয় অমানুষের বিরুদ্ধে। তাই তো সংবেদনশীল পাঠকদের সাথে নিয়ে মোশাররফ হোসেন খান কবিতায় লিখে চলেন মানুষের অধিকারের কথা। অসত্যের কালো থাবা থেকে পৃথিবীবাসীকে সত্যের আলোয় নিয়ে আসতে তার কবিতা মহৎ কবিদের মতো আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে। ‘বাগদাদ ২০০৩’ কবিতায় তিনি লিখেছেন:

জর্জ ডব্লিউ বুশ, ব্লেয়ার কিংবা শ্যারন—
না, তারা কোনো মানবীর গর্ভে জন্ম নেয়নি।
পৃথিবীর কোনো নারীই এমন জঘন্য সন্তান
প্রসব করতে পারে না কখনো।
তাদের জন্ম কোনো শূকরীর গর্ভে কিংবা
কোনো শয়তানই তাদের গর্ভধারিণী।

ফিলিস্তিন, ইরান কিংবা ইরাকের ওপর ইজরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন দীর্ঘদিনের। এখনো চলছে ইজরায়েলি তাণ্ডব। বলতে কী, গোটা বিশ্বের সহিংসতার নিকৃষ্টতম উদাহরণ ইজরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর তৈরি করে যাচ্ছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবও ইজরায়েল অগ্রাহ্য করছে। পৃথিবীকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে ত্বরান্বিত করছে ইজরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। যাদের এমন যুদ্ধংদেহী মনেবৃত্তি তারা তো সত্যিই কোনো মানবীর গর্ভজাত হতে পারে না। মোশাররফের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, তারা শুয়োরের গর্ভে নয়তো শয়তানের গর্ভে জন্ম নিয়েছে। বিশ্ব-নাগরিক হিসেবে তার এই উচ্চারণ নিঃসন্দেহে আমাদের বিবেককে চাবুক মেরে যায়। ঘোরের ভেতর থেকে মোশাররফ কবিতায় প্রলাপ লিখে যান না। তিনি যা লেখেন কবিতার শিল্প-সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ রেখেই মানুষের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের কথা বলে। জীবনের কল্যাণের বাণী ছড়িয়ে দ্যায়। জীবন যেন তার কাছে মহাবিশ্বের মতো বিস্তৃত একটি ক্যানভাস। সেখানে তিনি জীবনের সারসত্যকে বিচিত্র উপলব্ধির রঙে এঁকে চলেছেন। তিনি জানেন, আজকে বিশ্বজুড়ে যে হত্যাযজ্ঞ চলছে, যে উন্মাদনা চলছে, তার মূল কারণ জীবনের প্রকৃত সত্যকে উপলব্ধি না করা। হযরত মুহাম্মদ (স.) বর্বর আরব জাতিকে সাথে নিয়ে গড়ে তুলেছেন সম্প্রীতির কল্যাণময় একটি রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রের সংবিধান ছিল পবিত্র কোরআন। কিন্তু এখন আমরা রাষ্ট্রীয় জীবনে কল্যাণ চাইলেও কল্যাণ যে কোথায় রয়েছে সে বিষয়ে উদাসীন। ফলে কল্যাণ আমাদের থেকে অনেক দূরে। অকল্যাণ এখন আমাদেরকে গ্রাস করে আছে। এই প্রেক্ষাপটে মুসলিম জাতির কী কর্তব্য? সেই নির্দেশিকা পাওয়া যায় মোশাররফের ‘জিহাদ’ কবিতায়:
হে রাসূল দেখো
বারুদ থেকে উৎক্ষিপ্ত
তোমার উম্মাতের সর্বশেষ শিশুটিও এখন
শত্রুর সম্মুখে জ্বলন্ত লাভা, অনড় পর্বত
তোমার প্রতিটি যুবকই এখন
কাফেরের জন্য অভ্রান্ত কামান।
এবং দেখো
আমাদের মায়েরা কোমল শিশুর পরিবর্তে
প্রসব করছে এখন একেকটা লক্ষ্যভেদী এটম
পৃথিবীর প্রতিটি বিশ্বাসী মানুষের এখন
একটিই মাত্র নাম— জিহাদ।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ