spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধমানবিক কবি ফররুখ আহমদ

লিখেছেন : পথিক মোস্তফা

মানবিক কবি ফররুখ আহমদ


পথিক মোস্তফা

যারা মোটামুটি পড়াশুনায় ছিলেন বা আছেন, তাদের যদি প্রশ্ন করা হয়– আচ্ছা ফররুখ আহমদকে চেনেন? হয়তো জবাব আসবে, কেন চিনবো না! তিনি তো একজন কবি।
–তিনি কেমন কবি?
পাল্টা প্রশ্ন করলে, যে উত্তর আসার সম্ভাবনা বেশি তা হলো– ইসলামি রেনেসাঁর কবি, ইসলামি জাতীয়তাবাদের কবি, মুসলিম পুনর্জাগরণের কবি ইত্যাদি।

যখন এই বিশেষণে তাকে সম্বোধন করা হলো, অমনিই তিনি একপেশে কাব্যস্রষ্টায় পরিণত হলেন। হয়তো আপনার পাশের কিশোর কিংবা যুবকটিও যার এখনো ফররুখ সাহিত্যের কোনোটার সাথেই পরিচয় ঘটেনি সে ধরেই নিবে তিনি শুধু মুসলিমদের কবি। কিন্তু কবি কি আসলেই শুধু একটি নির্দিষ্ট জাতি, ধর্ম বা বর্ণের হন, নাকি মানুষের হন, মানবতার হন।

এসব প্রশ্নের মধ্য দিয়ে কবি ফররুখ আহমদকে নিয়ে নানা মত-বিমত তৈরি হতে পারে। আমি কবি ফররুখকে একপেশে কবি বলতে রাজি নই। তিনি একজন আধুনিক মনষ্ক মানবিক কবি। তার কবিতায় যে পরিভাষা গড়ে উঠেছে তা হয়তো বেশির ভাগই ইসলামের ঐতিহ্য ও কৃষ্টির প্রকাশক। তাই বলে তার কবিতা কেবলই মুসলিম জাগরণের নয়; মানবিক বোধের বহিঃপ্রকাশও বটে।

কবি ফররুখ আহমদ’র শুধু নয়, কবি-সাহিত্যিক কিংবা যে কোনো ব্যক্তির জীবন নিয়ে কথা বলতে গেলেও মাত্র দু-একটি ঘটনার উদাহরণ আলোচনা করলেই তার সম্পর্কে আদ্যন্ত জানা-বোঝা সম্ভব নয়; আর কবি-সাহিত্যিকের জীবন তো নয়ই। তবে, আমি মনে করি, ফররুখ মানস আলোচনার জন্য তার সমসাময়িক বা অব্যবহিত পূর্বে এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় বিষয়াবলি ইতিহাসের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বিচার করতে হবে। তার কবিতা ও অন্যান্য লেখায় তিনি তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। তিনি যেহেতু মুসলিম ছিলেন, তাই তার সৃষ্টি-সাহিত্যে মুসলিমদের বিষয় বেশি আলোচিত হয়েছে। তার সাহিত্য বিচারে ইসলামি রেনেসাঁর কবি শুধু তকমা লাগালে একজন মানবিক কবি ফররুখ আহমদকে খাটো করা হয় বলেই আমি মনে করি। কবির কাব্য-সাহিত্যে যে জাগরণী বক্তব্য ফুটে উঠেছে তা কেবল ধর্মীয় গণ্ডির আগলে বন্দি নয়, বরং তা মানবিক, তা সর্বজনীন।

কবি ফররুখ আহমদ’র সাড়া জাগানিয়া কাব্যগ্রন্থের মধ্যে অন্যতম- ‘সাতসাগরের মাঝি’। এই কাব্যগ্রন্থের নাম অনুসারে অনুমেয় যে, একটি দিশেহারা জাতিকে পথপ্রদর্শনের আহ্বান এই কাব্যে প্রকাশিত হয়েছে। একজন নাবিক, একজন মাঝি কিংবা একজন পাঞ্জেরি যেমন পথহারা জাহাজকে দরিয়া কিনারে নিয়ে এসে যাত্রীসাধারণকে মুক্তির দিশা দিতে পারেন, তেমনি একজন দক্ষ, সৎ নেতাও পারেন একটি পথহারা জাতিকে সঠিক পথের দিশা দিতে। কবি ফররুখ আহমদ’র সময়কাল শুধু নয়, বিশ্বময় মুসলিম জাতি আজ দিশাহারা, এক সময়ের বিশ্ব মানবতার ত্রাতা আবু বকর, ওমর, ওসমান, আলীর ফৌজেরা আজ নিজেরাই পথভোলা। হারুন আল রাশিদ, সালাউদ্দিন আইয়্যুবির দৃঢ়চেতা মহানুভবতা আজ ভূলুণ্ঠিত। এমন অবস্থায়, সেই স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে এনে সকল বি ত ভাগ্যাহত মজলুম মানবতার মুক্তিকামনা কোনো নিছক ধর্মীয় অনুভূতির বিষয় নয়; এটি বিশ্ব মানবতার মুক্তির বারতাও বটে। শুধুই ধর্মীয় আবহে তৈরি মানসিকতার দুই শ্রেণির মানুষ (ক) যারা কেবলই ধর্ম বলতে নিজপালিত ধর্মের নামটুকুই অবগত, (খ) অপরপক্ষে নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করার অপচেষ্টাকারীরা ধর্মের নাম শুনলেই কেবল অসারতা খুঁজে ফেরেন। এই দুই শ্রেণির অধিকাংশই কোনো ধর্ম সম্পর্কে কিংবা এর অনুসারীদের সার ও অসারতা নিয়ে ঐতিহ্যের অনুসন্ধান করার ধারে কাছেও ঘেঁষে না। প্রথম শ্রেণির মানুষ কেবলই চোখ বুজে নিজের ধর্মের বড়ত্ব প্রকাশের লড়াইয়ে ব্যস্ত, আর দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ অহেতুকই ধর্মের বিরোধিতা করতে ব্যস্ত। তবে এখানে বলে রাখা ভালো যে, একমাত্র ইসলাম ধর্মই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষের কাম্য আচার-আচরণের নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছে, তাই বিশ্বময় এই ধর্ম নিয়েই মানুষের প্রতিক্রিয়া বেশি দেখা যায়। কারণ, ইসলামই একটি প্রচলিত অগোছালো জীবন-যাপনের মর্মমূলে আঘাত হেনে নতুন একটি সুশৃঙ্খল জীবন-ধারণ পদ্ধতির প্রচলন ঘটিয়েছে। তাইতো মানুষের বিপরীত সংঘাতের জায়গা তৈরি হয়েছে কেবল ইসলাম ধর্মকে নিয়ে।

এই যে প্রচলিত বিশ্বাস ও ধ্যান-জ্ঞান আমাদের সংঘাতমুখী করে ফেলেছে সেক্ষেত্রে সব থেকে বড়ো কারণ হলো, নিজস্ব বোধ-বিবেককে জাগ্রত না করে, পূর্বতন কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ না করে কেবলই বিরোধিতার মানসে বিরোধিতা তৈরি করা। সেখানে নিজ নিজ পালিত ধর্মানুভূতির বহিঃপ্রকাশ কবি-সাহিত্যিকের সৃষ্টিতে প্রকাশিত হওয়া কোনোক্রমেই সাহিত্যানুভূতিকে খাটো করা নয়। যেমনটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার সাহিত্যে নিজ বিশ্বাসের ধর্মকে বড়ো করার জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মকে সূক্ষ্মভাবে আবার কোথাও স্থূলভাবে খোঁচাও মেরেছেন। তিনি তার ধর্মের মাহাত্ম্য বয়ান করে নিজ ধর্মের মানুষকে প্রেরণা যুগিয়েও যদি হিন্দু রেনেসাঁর তকমার বদলে সাহিত্যসম্রাট হতে পারেন, ঈশ্বরচন্দ্র কেবলই হিন্দুধর্মের ভালোমন্দ বর্ণনা করেও সাহিত্যের মানদণ্ডে বিদ্যাসাগর উপাধি পান, কিংবা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তার সমগ্রসাহিত্যে মুসলিম সমাজকে নজরের বাইরে রেখেও আমাদের সকলের কবিগুরু, বিশ্বকবি হয়ে ওঠেন, তাতো কেবল তাদের সাহিত্যমেধার জোরেই। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বললে, কবি ফররুখ আহমদ, গোলাম মোস্তফা বা ক্ষেত্রবিশেষে কবি নজরুল ইসলামরা তাদের বিশ্বাসের ধর্মানুভূতি সাহিত্যে তুলে আনলে তার যদি সাহিত্যমান থাকে তাকে কেনই একপেশে ধর্মীয় সাহিত্যের তুলাদণ্ডে পরিমাপ করি। আমি মনে করছি, এটাও একটি বিচার্য বিষয় বটে। উপরে উল্লিখিত কোনো কবি-সাহিত্যিকই সাহিত্যের মানবিচারে শুধুই কোনো ধারার বা ঘরানার কবি বা সাহিত্যিক নন, তারা সকলেই সর্বমহলের। উপরন্তু, অধিকতর যুক্তি বিচারে কবি ফররুখ আহমদ আরো বেশি মানবিক বোধের। কারণ, তিনি তার স্বীয় ধর্মের পরিভাষা ব্যবহার করে সমগ্র মানবকেই দিয়েছেন সোনালি অতীতের সন্ধান, শুনিয়েছেন মুক্তির আহ্বান। তার কাব্য-সাহিত্যে কোথাও কারো প্রতি কোনো বিরাগ-বিদ্বেষ প্রকাশিত হয়নি। সেক্ষেত্রে মহানুভব কবির তালিকায় ফররুখের নাম অগ্রগণ্যই হবে বলে আমি মনে করি।

কবি ফররুখ আহমদ তার ‘সাতসাগরের মাঝি’ কাব্যগ্রন্থের ‘পাঞ্জেরি’ কবিতায় বলেন–
রাত পোহাবার কতো দেরি পাঞ্জেরি?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
সেতারা, হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড়টানি ভুলে
অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।
এই আহ্বান কোন অর্থে সর্বজনিনতা বর্জিত? বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে এই কবিতার যে আক্ষেপ, এই কবিতায় কবির যে মর্মান্তুদ বেদনার অনুভূতি প্রকাশ, তা কোন বিচারে শুধুই একপেশে কবিতার চরণ? সঠিক সাহিত্য বিচারে এ যেমন সন্দেহাতিতভাবে সাহিত্য মানোত্তীর্ণ কবিতা, তেমনি কবির এই ডাকও সকল অন্ধকারাচ্ছন্ন জনপদের সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য। আজ ফিলিস্তিনের ওপর যে বর্বরোচিত ইহুদি হামলা হচ্ছে তা কেবল মুসলিমদের ওপর হামলা বলে বিশ্ববিবেক সাধারণ মানুষ ও কবি-সাহিত্যিক যেমন বসে থাকে না, মানুষের হৃদয় সেখানে যেমন গুমরে গুমরে কেঁদে ওঠে, কবি ফররুখের ডাকও তেমনি মানবিক বোধকে জাগ্রত করে। এই কবিতার শেষাংশে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে–
ওকি দরিয়ার গর্জন,–ওকি বেদনা মজলুমের!
ওকি ক্ষুধাতুর পাঁজরায় বাজে মৃত্যুর জয়ভেরী!
পাঞ্জেরি!
জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রুকুটি হেরি;
জাগো অগণন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি;
দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরি, কত দেরি\
এই অংশে কোনো সমালোচক-বোদ্ধার প্রয়োজন হয় না, সাধারণ পাঠকমাত্রই বুঝতে পারেন, কবির মানবিক আকুতি।

এই কবিতায় কবি একজন পাঞ্জেরির প্রত্যাশা করেছেন, যিনি মহাসমুদ্রের দিকহারা জাহাজকে সঠিক পথ দেখিয়ে কাঙ্ক্ষিত বন্দরে পৌঁছে দেবে। রূপক অর্থে– নানা অনিয়ম-দুর্নীতি, অত্যাচার-নিপীড়ন আর ক্ষুধা-দারিদ্র্যের কবল থেকে একটি জাতির ত্রাতা হচ্ছে এই পাঞ্জেরি। তাই এটি কেবল স্থূল দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করে ফররুখ আহমদকে একটি জাতিগোষ্ঠির কবি হিসেবে আখ্যা দেয়া কোনো ভাবেই উচিত হবে না।

আলোচনা করা যেতে পারে– কবির ‘ডাহুক’ কবিতাটিও। ‘ডাহুক’ কবিতায় কবির চেতনার পাখি ডাহুক। যা আমাদের গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের সাথে জড়িত। গ্রামীণ পরিবেশ-প্রতিবেশে বড়ো হওয়া মানুষমাত্রই ডাহুকের ডাক শুনেছেন। আমাদের বাড়ির পাশের অনিবিড় জঙ্গলে কিংবা স্বল্প পানির ঘাসে সরুপায়ে ঘুরে বেড়ানো পাখি ডাহুক। দিনের আলো নিভে গিয়ে রাতের গভীরতা এই পাখির বিরহের বারতা নিয়ে আসে। প্রিয়তমের সান্নিধ্য বি ত এই পাখি রাতভর বিরামহীন ডেকে চলে। নিস্তব্ধ ঘুমের পাড়ায় এই ডাক সকল প্রাণে সাড়া ফেলে না, যারা ডাহুক-ডাহুকির মতো প্রেমকাতুরে তাদের প্রাণে এই পাখির ডাকে বিশেষ স্পন্দন জাগায়। কবি বলেন–
রাত্রিভ’র ডাহুকের ডাক …

এখানে ঘুমের পাড়া, স্তব্ধদীঘি অতল সুপ্তির!
দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে আছি।

ছলনার পাশা খেলা আজ প’ড়ে থাক,
ঘুমাক বিশ্রান্ত শাখে দিনের মৌমাছি,
কান পেতে শোনো আজ ডাহুকের ডাক।
কী এক অপরূপ রাত্রির দৃশ্য চিত্রায়ণ করেছেন কবি তার কলমের তুলিতে! সকল বিচার বিশ্লেষণ পাশে ফেলে রেখে শুধু ডাহুক কবিতার রাত্রির সুন্দরতার বিবরণ দেখলেই কবিতাটি হয়ে ওঠে নয়নাভিরাম, ভরে যায় হৃদয়ের চিত্রিত ক্যাম্পাস। কবি ফররুখ আহমদ’র কবিতায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের যে সৌকর্যময় বিবরণ তার এক বিরল দৃষ্টান্ত এই ‘ডাহুক’ কবিতাটি। পাঠকমাত্রই এই কবিতা পাঠে ফিরে যাবেন– তার শৈশব-কৈশোরের বেতস বনে, পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দেয়া চাঁদের স্নিগ্ধতা আর তারার বন্দরে–
তারার বন্দর ছেড়ে চাঁদ চলে রাত্রির সাগরে
ক্রমাগত ভেসে ভেসে পালক মেঘের অন্তরালে,
অশ্রান্ত ডুবুরি যেন ক্রমাগত ডুব দিয়ে তোলে
স্বপ্নের প্রবাল।
অবিশ্রান্ত ঝ’রে ঝ’রে পড়ে
শিশির পাখার ঘুম,
গুলে বকৌলির নীল আকাশ মহল
হ’য়ে আসে নিসাড় নিঝুম,
নিভে যায় কামনা চেরাগ;
অবিশ্রান্ত ওঠে শুধু ডাহুকের ডাক।
ডাহুকের ডাকের কী স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের বিবরণ দিয়েছেন কবি, কবিতা পাঠে মনে হয় যেন ডাহুকের ডাকের সেই রাতের আবহে অবগাহন করছি–
রাত্রির পেয়ালা পুরে উপচিয়া প’ড়ে যায় ডাহুকের সুর।
শুধু সুর ভাসে
বেতস বনের ফাঁকে চাঁদ ক্ষ’য়ে আসে
রাত্রির বিষাদ ভরা স্বপ্নাচ্ছন্ন সাঁতোয়া আকাশে।
কবির সৌন্দর্যের সুরা ভরা পেয়ালা পান করতে করতে পাঠককে হারিয়ে যেতে হয় ভাবের অতলে। তাইতো এই কবিতায় সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন নাই, দরকার একটি সুন্দরের আবেগমথিত পাঠক হৃদয়। যেমনটা কবি বলেন–
ডাহুকের ডাক …
সকল বেদনা যেন, সব অভিযোগ যেন
হ’য়ে আসে নীরব নির্বাক।
সর্বোপরি এই কবিতায় ডাহুকের ডাকের মধ্যে কবি খুঁজে পান মুক্তির আহ্বান। সকল প্রকার শৃঙ্খলের গেঁড়ো খুলে বেরিয়ে পড়ার ডাক আসে ডাহুকের সুরে। এ যে শুধুই বিরহকাতর হৃদয়ের আর্তি নয়, এ হলো মুক্তির মন্ত্র। এই মুক্তি মানবতার, এই মুক্তি নিপীড়িত জনতার–
রাত্রির অরণ্যতটে হে অশ্রান্ত পাখী!
যাও ডাকি ডাকি
অবাধ মুক্তির মত।

ভারানত
আমরা শিকলে,
শুনিনা তোমার সুর, নিজেদেরি বিষাক্ত ছোবলে
তনুমন করি যে আহত।
কবি ফররুখ আহমদ’র কবিতায় যারা কেবল ধর্মীয় আবহের ধুয়া তুলে তাকে একপেশে করে রাখতে চান, বলা যেতে পারে, তাদের কবি ফররুখ বা সার্বিক অর্থে কবিতার সৌন্দর্য উপলব্ধিতে কোনো গলদ রয়েছে।

যার বা যাদের কবি ফররুখ আহমদকে চিনতে ভুল হয়েছে, তারা পড়ে নিতে পারেন কবির ‘লাশ’ কবিতাটিও। বিখ্যাত এই কবিতার সবটুকু জুড়েই রয়েছে ১৩৫০ বঙ্গাব্দের দুর্ভিক্ষের চিত্র, যাকে বাংলার ইতিহাসে ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ বলা হয়ে থাকে। এই দুর্ভিক্ষ কোনো প্রাকৃতিক কারণে ঘটেনি বরং এটি ছিলো মানবসৃষ্ট। “এই করুণ পরিণতির জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ‘উইনস্টন চার্চিল’কে সরাসরি দায়ী করা হয়েছে। ‘চার্চিলস সিক্রেট ওয়ার’ গ্রন্থের ভারতীয় লেখিকা মধুশ্রী মুখার্জি এই দুর্ভিক্ষকে মানবসৃষ্ট বলে নিন্দা করেছেন। চার্চিলের বিরুদ্ধে বইটিতে তিনি অভিযোগ তোলেন, এই দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির পেছনে বর্ণবৈষম্যও তাকে কিছুটা উসকে দিয়েছে।” (সূত্র: যঃঃঢ়ং://নহ.রিশরঢ়বফরধ.ড়ৎম/রিশর/প াশের মন্বন্তর)। আর কবি ফররুখ আহমদ’র ভাষা এমন–
যেখানে প্রশস্ত পথ ঘুরে গেল মোড়,
কালো পিচ-ঢালা রঙে লাগে নাই ধূলির আঁচড়,
সেখানে পথের পাশে মুখ গুঁজে প’ড়ে আছে জমিনের ‘পর;
সন্ধ্যার জনতা জানি কোনদিন রাখে না সে মৃতের খবর।
মন্বন্তর সৃষ্টিকারী শোষকশ্রেণির বিরুদ্ধে কবি বলেন–
পৃথিবী চষিছে কারা শোষণে, শাসনে
সাক্ষ্য তার রাজপথে জমিনের ‘পর
সাড়ে তিন হাত হাড় রচিতেছে মানুষের অন্তিম কবর।
কবিতার অন্যত্র কবির ভাষা আরো সুকঠিন ও দ্রোহদৃপ্ত–
এ পাশব অমানুষী ক্রুর
নির্লজ্জ দস্যুর
পৈশাচিক লোভ
করিছে বিলোপ
শাশ্বত মানব-সত্তা, মানুষের প্রাপ্য অধিকার,
ক্ষুধিত মুখের গ্রাস কেড়ে নেয় রুধিয়া দুয়ার,
মানুষের হাড় দিয়ে তারা আজ গড়ে খেলাঘর;
সাক্ষ্য তার প’ড়ে আছে মুখ গুঁজে ধরণীর ‘পর।
কবির আহ্বান দেখুন– কতোটা মানুষের পক্ষে; অত্যাচারীর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য উপমহাদেশ তথা ব্যাপক অর্থে বিশ্বময় মজলুম মানবতাকে রুষে ওঠার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি–
মৃত-সভ্যতার দাস স্ফীতমেদ শোষক সমাজ।
মানুষের অভিশাপ নিয়ে যাও আজ।
তারপর আসিলে সময়
বিশ্বময়
তোমার শৃঙ্খলগত মাংসপিণ্ডে পদাঘাত হানি
নিয়ে যাব জাহান্নাম দ্বার-প্রান্তে টানি;
আজ এই উৎপীড়িত মৃত্যু-দীর্ণ নিখিলের অভিশাপ বও;
ধ্বংস হও
তুমি ধ্বংস হও \

কবি ফররুখ আহমদ যতোখানি মানবিক বোধে জাড়িত তার সিঁকি-আধুলির সমান অনেক কথিত খ্যাতিমান কবিও হবেন না। বিচারের মানদণ্ডে, কিংবা সাহিত্যের সমালোচনায় কবি ফররুখকে যারা একপেশে, একঘরে করে রাখেন, তাদের মধ্যে দুই দলই দলকানা। একদল, আপন পাতে ঝোল টানতে গিয়ে কবিকে নিয়ে বাক্সবন্দি করেন, আরেক পক্ষ, সেই বাক্স থেকে কবিকে মুক্ত না করেই ‘মলাট দেখে বইয়ের বিচার করেন’। কবি ফররুখ আহমদ’র মানবতাবোধ ও সর্বজনিনতা কোনো প্রমাণসাপেক্ষ বিষয় নয়। কবিকে মুক্তপাঠে যে কোনো পাঠকই নিরেট সাহিত্যস্বাদ লাভ করতে পারবেন। আর তার কবিতা বা সাহিত্যে যদি ইসলামি মূল্যবোধ ফুটেও ওঠে তাতে যদি দোষের হয়, তাহলে ধর্মীয় গোড়ামিপূর্ণ বিখ্যাত সাহিত্য ও সাহিত্যিকের তালিকা তৈরি করা আবশ্যক হয়ে পড়বে।

শুধুই মনস্তাত্ত্বিক বিচারে একজন কবি বা সাহিত্যিকের সাফল্য, সার্থকতা পরিমাপ করা যায় না। কবিতা বা সাহিত্যের সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড না থাকলেও কাল থেকে কালোত্তীর্ণ সাহিত্যের ধরন-প্রকরণ বিবেচনায় এটির একপ্রকার পরিমাপক তৈরি হয়ে গেছে। সেই পরিমাপে কবি ফররুখ আহমদকে নিরিখ করলেও তিনি নিঃসন্দেহে বাংলাসাহিত্যের এক দিকপাল সাহিত্যিক। তিনি একটি যুগের স্রষ্টা। আজ আমরা অনেকেই বহুপাটি দন্তের বাহার দেখিয়ে যে সব কবিদের বন্দনায় ত্রিকাল ভুলে গেছি, কবি ফররুখ কেবলই নিরেট সাহিত্য বিচারেও তাদের থেকে অনেক বিষয়ে এগিয়ে থাকবেন। কবির কাব্যভাণ্ডারও কম সমৃদ্ধ নয়।

বিষয় বৈচিত্র্য আর আঙ্গিক বিচারেও কবি ফররুখ আহমদ’র কাব্যধারা বিস্তৃত। ১৯৪৪ সালে কবির প্রথম গ্রন্থ ‘সাতসাগরের মাঝি’ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই কবি চলে আসেন আলোচনায়, আবার কখনও সমালোচনার শেন দৃষ্টিতে। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় তার অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ: সিরাজাম মুনিরা (১৯৫২), নৌফেল ও হাতেম (কাব্যনাট্য-১৯৬১), মুহূর্তের কবিতা (১৯৬৩), ধোলাই কাব্য (১৯৬৩), হাতেম তায়ী (মহাকাব্য-১৯৬৬), নতুন লেখা (১৯৬৯), কাফেলা (১৯৮০), হাবিদা মরুর কাহিনী (১৯৮১), সিন্দাবাদ (১৯৮৩), দিলরুবা (১৯৮৪)।

‘সিরাজাম মুনিরা’ কাব্যগ্রন্থে কবি রসুল প্রেমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তদুপরি তার এই কাব্যের আগাগোড়া কোথাও কাব্যমানের একবিন্দু পতন ঘটেনি। ধর্মগোত্র নির্বিশেষ যে কোনো পাঠকের অন্তরে এই কবিতার ভাব, ভাষা ও ছন্দ এক অভূতপূর্ব শিহরণ জাগাবে। রসুল প্রেমই শুধু নয়; কাব্যপ্রেমিকও তার রসাস্বদনে পরিতৃপ্ত হবে। যেমন কবি বলেন–
তুমি না আসিলে মধু ভাণ্ডার ধরায় কখনো হ’ত না লুট,
তুমি না আসিলে নার্গিস কভু খুলতো না তার পর্ণপুট,
বিচিত্র আশা-মুখর মাশুক খুলতো না তার রুদ্ধ দিল;
দিনের প্রহরী দিত না সরায়ে আবছা আঁধার কালো নিখিল।
কী ভাষা, আর কী কাব্য মধুরিমা! ছন্দলালিত্য আর অলঙ্কার ব্যবহার এই কবিতাকে করে তুলেছে ভাবের অধিক এক অপরূপ সৌন্দর্যের আকর। রূপক ও উপমার ব্যবহার কবিতাকে গড়ে তুলেছে সর্বজনীন পাঠরসের শুরাপাত্র হিসেবে। একই কবিতায় কবি অন্যত্র বলেন–
কে আসে, কে আসে সাড়া পড়ে যায়
কে আসে, কে আসে নতুন সাড়া।
জাগে সুষুপ্ত মৃত জনপদ, জাগে শতাব্দী ঘুমের পাড়া।
হারা সম্বিত ফিরে দিতে বুকে তুমি আনো প্রিয় আবহায়াত,
জানি সিরাজাম-মুনীরা তোমার রশ্মিতে জাগে কোটি প্রভাত,
তব বিদ্যুৎকণা-স্ফুলিঙ্গে লুকানো রয়েছে লক্ষ দিন,
তোমার আলোয় জাগে সিদ্দিক, জিননুরাইন, আলী নবীন,
ঘুম ভেঙে যায় আল ফারুকের-হেরি ও প্রভাত জ্যোতিষ্মান
মুক্ত উদার আলোক তোমার অগণন শিখা পায় যে প্রাণ।
ভাষার এমন লালিত্য আর ছন্দের দ্যোতনায় পড়ে সর্বমহলের পাঠককুল মুগ্ধ হতে বাধ্য। কাব্যরসিকমাত্রই এই কবিতার সৌন্দর্য পিপাসু হয়ে উঠবেন। এই যে সুন্দর কবিতার বুনন, তা জগদ্বিখ্যাত মসলিন কারুকাজের সাথে তুল্য হতে পারে। ধর্মের ব্যবহার কবিতার কোন অঙ্গকে ছেদ করতে পারে? কবি ফররুখ আহমদ দেখিয়ে দিয়েছেন, লিখতে জানলে আর মেধা থাকলে বিষয় কোনো বড়ো বিবেচ্য নয়; কবিতার অঙ্গকে গড়ে তোলা যায় ষোড়শির লাবণ্য দিয়ে। কবি সেখানে শত ভাগ সফল।

বাংলা সাহিত্যে সনেটের সার্থক প্রবর্তক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি ১৮৬৫ সালে ফ্রান্সের ভার্সাই নগরে অবস্থানকালে তার আত্মচেতনার ভাবাবেগকে সনেট কবিতায় প্রকাশ করেন। সনেটের প্রবক্তা ইতালিয় কবি পেত্রার্ক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখলেন, সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা। ১৮৬৬ সালেই কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের চতুর্দশপদী কবিতাবলি গ্রন্থিত হয়। কাব্য চেতনায় কবি ফররুখ আহমদ মাইকেল মধুসূদন দত্তের আধুনিকতা ও নতুন ধারাকে সমীহ করতেন। তাই তিনি মাইকেলের অনুসরণেই লিখলেন সনেট কবিতা। তিনি শুধু মাইকেলকে অনুসরণ করেই নয়, তিনি সনেট নিয়ে বেশ গবেষণা করলেন। কীভাবে বাংলা সাহিত্যে সনেটকে আরো হৃদয়গ্রাহী করে তোলা যায়, আত্মগত গীতলতা কীভাবে আরো বেশি মন থেকে মনময় করে তোলা যায়, সেই ভাব-আঙ্গিকে কবি সনেটের অধিকতর নতুন রূপ দিলেন। কবি ফররুখ আহমদ রচিত সনেটের বিষয় বৈচিত্র অধিকতর পাঠকগ্রাহ্যতাও লাভ করলো। তিনি তার রচিত ‘মুহূর্তের কবিতা’-(১৯৬৩) কাব্যগ্রন্থে একশটি সনেট সন্নিবেশিত করেছেন। এ ছাড়াও তিনি তার অন্য কাব্যগ্রন্থেও সনেট প্রকাশ করেছেন। বাংলা সাহিত্যে আধুনিক কবিতার জনক মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার সনেট ও অন্যান্য কবিতায় যে শব্দ ব্যবহার করেছেন, তা ছিলো কতোকটা সংস্কৃত ঘেঁষা। কোনো ক্ষেত্রে আমপাঠকের জন্য তা দুর্বোধ্যও বটে। তবে ফররুখ আহমদ তার চেষ্টা ও সাধনার দ্বারা সনেটের বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখেও ভাষা ও শব্দের ব্যবহারে অধিকতর লালিত্য নিয়ে এসেছেন। ‘মুহূর্তের কবিতা’ কাব্যগ্রন্থে কবির কয়েকটি সনেট-পরম্পরাও লক্ষ্য করা যায়। ফররুখ জীবনের প্রথম প্রকাশিত কবিতা সনেট। কবির বন্ধু ‘আবু রুশদ’ তার আত্মজীবনী ‘জীবন ক্রমশ’ তে উল্লেখ করেন, তিনি নিজেই ফররুখের ‘রাত্রি’ নামক সনেটটি ১৯৩৭ সালে হবিবুল্লাহ বাহার সম্পাদিত মাসিক ‘বুলবুল’ পত্রিকায় প্রকাশের জন্য দেন। তবে ‘আবু রুশদ’ এর মতে এই কবিতাটির নাম ছিলো ‘ঝড়’। সম্ভবত সম্পাদক কবিতাটির নাম পরিবর্তন করে ‘বুলবুল’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। যাই হোক কবির ‘রাত্রি’ প্রথম প্রকাশিত সনেট। আর আশ্চর্যের বিষয় হলো– সর্বশেষ কবির মৃত্যুর দুমাস আগে লেখা অপ্রকাশিত ‘১৯৭৪’ কবিতাটিও একটি সনেট। যা কবির মৃত্যুর পর তার কাগজপত্রের মধ্যে পাওয়া যায়। যাতে তারিখ উল্লেখ করা ছিলো- ‘১লা আষাঢ় ১৩৮১, ২৩ শে জমাদিয়ল আউয়াল ১৩৯৪’। সনেটের উদাহরণ হিসেবে আমরা কবির সর্বশেষ কবিতাটি উল্লেখ করতে পারি–
স্বপ্নের অধ্যায় শেষ। দুঃস্বপ্নের এ বন্দী শিবির
সাত কোটি মানুষের বধ্যভূমি। দেখ এ বাংলার
প্রতি গৃহে অপমৃত্যু ফেলে ছায়া তিক্ত হতাশার,
দুর্ভিক্ষের বার্তা আসে, আসে মৃত্যু নিরন্ধ্র রাত্রির।
বাষট্টি হাজার গ্রাম উৎকণ্ঠিত, নিভৃত পল্লীর
প্রতি পথে ওঠে আজ হাহাকার তীব্র বুভুক্ষার
চোখে ভাসে চারদিকে অন্ধকার– কালো অন্ধকার;
ক্ষুধা, মৃত্যু, ভাগ্য আজ স্তিমিত এ ভ্রান্ত জাতির।

এ মুহূর্তে কী উজ্জ্বল রাজধানী। –নতুন শহর
অত্যুগ্র যৌবন– মদে মত্তা যেন নটিনী চ ল,
কাটায় উল্লাসে তার জীবনের উদ্দাম প্রহর।
উপচিয়া প’ড়ে যায় পানপাত্র ফেনিল; উজ্জ্বল;
নির্লজ্জের রঙ্গমে অকল্পিত বিলাসের ঘর,
দু-চোখ ধাঁধানো রূপে; নগ্ন, মেকী ঐশ্বর্যে উজ্জ্বল \

    (১৯৭৪: একটি আলেখ্য)

তৎকালীন সমাজবাস্তবতার ঐতিহাসিক দলিল মাত্র এই ১৪ লাইনের কবিতাটি। অপরূপ কাব্য সৌন্দর্যে কবির এ নির্মাণ। কোথাও সোজাসাপ্টা আবার কোথাও বক্রোক্তির মাধ্যমে কবিতাটি রচনা করেছেন তিনি।

সনেট কবিতার কলারীতি মেনেই নিজের মতো করে আলাদা ভুবন সৃষ্টি করেছেন কবি। তিনি গতানুগতিক ধারায় ১৪ লাইনের সাথে ১৪ অক্ষর মিলিয়ে তার সনেট রচনা করেননি। তিনি ১৪ লাইনের সাথে ১৮ অক্ষরের ধারা অনুসরণ করেন। তিনি হয়ে ওঠেন বাংলা সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সনেট রচয়িতা। তার এই শ্রেষ্ঠত্ব আজও বিদ্যমান। কবির বন্ধু ও সমালোচক কবি ‘আবু রুশদ’ ফররুখ আহমদ’র দুটি সনেট ‘ক্লান্তি’ ও ‘সিলেট স্টেশনে একটি শীতের প্রভাত’ ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন।

কবি ফররুখ আহমদ তার কাব্যনাট্য ‘নৌফেল ও হাতেম’ রচনায়ও বেশ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। এই কাব্যনাট্যটি রচনায় ঘটনার বাহুল্য বর্জন করেছেন কবি। আর কাব্যিক সংলাপে অসাধারণ রূপকল্প তৈরি করেছেন। এই নাটকের প্রারম্ভিক তিনটি চরিত্রের সংলাপ উল্লেখ করা যেতে পারে–
(১ম)
দেখ নাই
ইরানী গালিচা? মেশ্ক? অথবা যা শিশিরে মিলায়
দেখোনি সে মসলিন–যাদু-মন্ত্র বিদেশী তাঁতের?
(২য়)
দেখেছি অনেক কিছু এ মেলায়, কিন্তু জুয়া খেলা …
(৩য়)
জাহান্নামে যাক জুয়া খেলা। সর্বস্বান্ত গরীবেরা
মারা পড়ে প্রতিদিন আজাজিল জুয়াড়ীর চালে;
আসে তবু মৃত্যু আকর্ষণে?
এমন সাবলিল সংলাপের মধ্য দিয়ে তিনি যেমন নাটকীয় গুণ বজায় রেখেছেন, তেমনি নৈতিক অবক্ষয় ও মানবিক গুণের বিষয়টি সচেতনভাবে লক্ষ্য রেখেছেন।

কবির অন্যান্য কাব্যগ্রন্থও নানান বিষয় বৈচিত্র নিয়ে হাজির হয় পাঠকের সামনে। তার ‘সিন্দাবাদ’ ও ‘হাতেম তা’য়ী’ চরিত্র দুটি বাংলা সাহিত্যের জন্য এক অনবদ্য সংযোজন। তিনি বাংলার পৌরানিক কাহিনীর বাইরে গিয়েও আরব্যকাহিনীকে নতুনভাবে ব্যবহার করলেন। সিন্দাবাদ ও হাতেম তা’য়ীর অভিযাত্রা ও আদর্শ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

আরব্য-উপন্যাসের চরিত্র হাতেম তা’য়ীকে নিয়ে ফররুখ আহমদ মহাকাব্য ‘হাতেম তা’য়ী’ রচনা করেন। বাংলা সাহিত্যে মহাকাব্যেরও প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্ত পৌরানিক কাহিনী থেকে ‘রাবণ’কে নতুন করে উপস্থাপন করে মহাকাব্য ‘মেঘনাদ বধ’ রচনা করেন। কবি ফররুখ আহমদও আরব্য চরিত্র ‘হাতেম’কে বাংলা সাহিত্যে এনে এক নতুন রূপ দান করেছেন। তার অভিযাত্রা ও দানশীলতার আদর্শ মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় প্রকাশিত হয়েছে। মহাকাব্য সম্পর্কে সাফল্য বা ব্যর্থতার মূল্যায়ন থাকতে পারে, কিন্তু বিষয় আঙ্গিক ও কাব্যিক প্রকাশনায় কবির সফলতা এখানে অনস্বীকার্য। কবি ও গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ কবি ফররুখ আহমদ রচনাবলি সম্পাদনার ভূমিকায় বলেন, “হাতেম তা’য়ী’কে আমি মহাকাব্য হিশেবে বিবেচনা করি। … অভিযাত্রিকতা ও কল্যাণকামিতা এমন একটি ব্যাপ্তি ও মহত্ত্ব দান করেছে হাতেমের চরিত্রে, যে, মহাকাব্যের ধীরোদাত্ত নায়কের গুণাবলি অর্শেছে তার উপর।”

কবি ফররুখ আহমদ-এর শিশুসাহিত্য ও সঙ্গীতও সাহিত্যমানোত্তীর্ণ সৃষ্টি। আজকের শিশুদের কাছে কবি ফররুখকে আড়াল করে রাখার কী কারণ থাকতে পারে তা আমার বোধগম্য নয়; এটা আমার এই কলেবরের আলোচ্য বিষয়ও নয়। তবে তা আমাদের বিবেকে ভাবনার উদ্রেক করে বটে। ছোটোবেলার সেই ‘বৃষ্টির ছড়া’–
বিষ্টি এল কাশ বনে
জাগল সাড়া ঘাস বনে,
বকের সারি কোথা রে
লুকিয়ে গেল বাঁশ বনে।

নদীতে নাই খেয়া যে,
ডাকল দূরে দেয়া যে,
কোন সে বনের আড়ালে
ফুটল আবার কেয়া যে।

গাঁয়ের নামটি হাটখোলা,
বিষ্টি বাদল দেয় দোলা,
রাখাল ছেলে মেঘ দেখে,
যায় দাঁড়িয়ে পথ-ভোলা।

মেঘের আঁধার মন টানে,
যায় সে ছুটে কোন খানে,
আউশ ধানের মাঠ ছেড়ে
আমন ধানের দেশ পানে।
কবি ফররুখ আহমদ’র শিশু-কিশোর কবিতার সংখ্যা প্রচুর। প্রকাশিত অপ্রকাশিত মিলিয়ে তার ২০টিরও বেশি শিশু-কিশোর গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। এর মধ্যে তার জীবদ্দশায় ৪টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়– (১) পাখীর বাসা-(১৯৬৫), বাংলা একাডেমি, (২) হরফের ছড়া- (১৯৬৮) বাংলা একাডেমি, (৩) নতুন লেখা-(১৯৬৯), আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা ও (৪) ছড়ার আসর-১ (১৯৭০), বাংলা একাডেমি। কবির অন্যান্য ছাড়গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপিগুলো হলো– চিড়িয়াখানা, ফুলের জলসা, কিস্সা কাহিনী, ছড়ার আসর-২, ছড়ার আসর-৩, সাঁঝ সকালের কিস্সা, আলোকলতা, খুশীর ছড়া, মজার ছড়া, পাখীর ছড়া, রং মশাল, জোড় হরফের ছড়া, পোকামাকড়, ফুলের ছড়া, দাদুর কিসসা, সাঁঝ সকালের কিসসা প্রভৃতি। এই বিচারে কবির যে পরিমাণ শিশু-কিশোর কবিতা-ছড়ার ভাণ্ডার রয়েছে, তার মধ্যে যে রঙের বাহার রয়েছে তার ঝাঁপি না খোলার কারণে আমাদের শিশু-কিশোররা সেই রঙ বি ত হচ্ছে। আর কবি ফররুখের কবিতার যে রঙ তা আলোকিত জীবনেরই পথিকৃৎ। কবির এই বিশাল শিশু-কিশোর সাহিত্যের ভাণ্ডারও আমাদের প্রজন্মের কাছে পরিচিত না করানোর দায়ও আমরা অস্বীকার করতে পারি না। কবি ভালোবাসতেন ফুল-পাখি ও প্রকৃতি। কবির ভালোবাসার ফুল নিয়ে লিখে ফেললেন ‘ফুলের জলসা’। তিনি লিখলেন দারুণ করে–
ঝুমকো জবা বনের দুল
উঠলো ফুটে বনের ফুল
সবুজ পাতা ঘোমটা খোলে
ঝুমকো জবা হাওয়ায় দোলে
সেই দুলুনির তালে তালে
মন উড়ে যায় ডালে ডালে।
সবকিছু ছাপিয়ে কবির গানও কম সমৃদ্ধ নয়। সাহিত্য, সুর ও কথার বিচারে সেই গান হয়ে ওঠার কথা গণমানুষের আপনার। কিন্তু সকল যোগ্যতা থাকলেও আমাদের মতো গাফেল প্রজন্মের কারণে তার প্রসারতা তেমন ঘটেনি। তিনি যেমন স্রষ্টার প্রতি মানুষের আত্মসমর্পণ ও নির্ভরতার কথা বলেছেন–
তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া
তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়া
তেমনই এই গানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে মানুষকে আত্মপরিচয়ে বলিয়ান হওয়ার আহ্বান। কবির আরেকটি গানের কথা না বললেই নয়; ‘ফারাক্কা বাঁধ’। এই গানের ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের অমানবিক নিষ্ঠুরতার বিবৃতি। এখানে কবির ভাষা এমন–
শোনো মৃত্যুর তূর্য-নিনাদ
ফারাক্কা বাঁধ ফারাক্কা বাঁধ।
মরণও বার্তা কোটি মানুষের
মরণও বার্তা গণজীবনের
মরণও বার্তা সুখ স্বপনের
হানে বিষাক্ত শায়ক নিষাদ।
কবির জীবন ও সাহিত্য বিবেচনা করে আরো যতো দিক আলোচনা করা যায়, তা একটি নিবন্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা সম্ভব নয়। কবিকে বিশ্লেষণ করা মানে তার সমসাময়িক সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থব্যবস্থা, ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীদের আচার-আচরণ এবং অন্যান্য কবি-সাহিত্যিকদের মন-মননের বিষয়টিও বিচার্য হয়ে দাঁড়ায়। কবি ফররুখ আহমদ তার মতাদর্শের ও ধর্মের ব্যবহার সাহিত্যে নিয়ে আসার জন্য কেনই মহলবিশেষের বিবেচনায় অপাংক্তেয় হলেন, আবার অন্যান্যরা নিজ নিজ ধর্ম ব্যবহার করেও কেনই আদৃত হলেন তারও একটি সনোগ্রাফি প্রয়োজন। সেই বিচার ও যৌক্তিক প্রস্তাবনাসমূহ অনুসন্ধান বিস্তর গবেষণার অংশ। সেই অংশে কবিকে উত্থাপনের জন্য যে আর্থ-সামাজিক ও নৈতিক মনোভূমির প্রয়োজন তা আমাদের কোনো কালেই ছিলো কিনা, বা আদৌ সে দিন আসবে কিনা সেটিও ভাবিয়ে তোলে। এই ভাবনার আঁধার রাজ্য থেকে হয়তো কোনো দিন বেরিয়ে পড়বে এক চিলতে আলো। আর সেই আলো জ্বেলেই আমরা খুঁজে বের করবো আমাদের মানবিক ও সর্বজনীন কবি ‘ফররুখ আহমদ’কে। সেই সূর্যোদয়ের প্রত্যাশায় আমরা।

সূত্র:
১। আবদুল মান্নান সৈয়দ, ফররুখ আহমদ: জীবন ও কর্ম-(১৯৯৩)
২। আবু রুশদ, জীবন ক্রমশ- (১৯৮৯)
৩। কিশোরকণ্ঠ, অক্টোবর ২০১২
৪। বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা ও মিডিয়া
৫। বাংলা উইকিপিডিয়া
৬। কবি ফররুখ আহমদ রচনাবলি

লেখক: প্রভাষক, বাংলা
কবি ও গবেষক

আরও পড়তে পারেন

2 COMMENTS

  1. বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকের কবি বাংলাসাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি।
    তাঁর কবিতা আদর্শবাদের ভিত্তি হিশেবে পরিগণিত হচ্ছে।

    কবি ও সমালোচক পথিক মোস্তফা অসাধারণ আলোচনা করেছেন তাঁকে নিয়ে।
    ধন্যবাদ বাংলা রিভিউর সম্পাদক কবি সাজ্জাদ বিপ্লবকে।

  2. কবি ফররুখ আহমদ’র সাহিত্যসম্ভার অত্যন্ত সমৃদ্ধ, সে তুলনায় এই আলোচনা অপ্রতুল; কবিকে নিয়ে আরো কাজ করার ইচ্ছা রাখছি, ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on বাংলা একাডেমির মুখোস উন্মোচন
কাজী জহিরুল ইসলাম on বাংলা একাডেমি এবং আমার গ্লানি
কাজী জহিরুল ইসলাম on ‘প্রথম আলো’র বিকল্প
পথিক মোস্তফা on মানবিক কবি ফররুখ আহমদ