spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাম্প্রতিক'প্রথম আলো'র বিকল্প

শাহরিয়ার জামান সিহাম

‘প্রথম আলো’র বিকল্প

শাহরিয়ার জামান সিহাম

প্রথম আলো বা ডেইলি স্টার বয়কটের প্রসঙ্গ আসলেই আমরা ‘বিকল্প দেখান তত্ত্ব’ হাজির করি। কিন্তু প্রথম আলোর বিকল্প কেন নেই—সেই প্রসঙ্গে আমরা খুব একটা আলোচনা করি না। আমাদের অনেকের ধারণা প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার যেহেতু ইসলামোফোব, সেহেতু নামাজ পড়ার সুব্যবস্থা থাকলে (মানে মোটাদাগে ইসলামী পরিবেশ থাকলে) ও ভালো স্যালারি পাওয়া গেলে খুব সহজেই একটা প্রথম আলো বা ডেইলি স্টারের বিকল্প তৈরী করে ফেলা সম্ভব! তবে আমি বিষয়টাকে এতটা সহজ বলে মনে করি না। কোনো গণমাধ্যম তখনই মানসম্মত হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পাবে যখন তা সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণি কর্তৃক মানসম্মত হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। প্রথম আলো পড়ে একজন মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক সন্তুষ্ট হন, অন্যদিকে একজন ফকিন্নিরও খবর পড়ার ‘চাহিদা মেটে’। কিন্তু বিকল্পগুলো পড়ে ফকিন্নিদের চাহিদা মিটলেও তা এলিট ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য সন্তোষজনক হয় না। কেন হয় না—এই প্রশ্নের উত্তর কোয়ালিটেটিভ এবং কোয়ান্টিটেটিভ গবেষণার মাধ্যমে বের করে আনা সম্ভব। আমরা কোন রিসার্চটা করেছি? 

আমি একটা হাইপোথিসিস দিচ্ছি। প্রথম আলোর এই গ্রহণযোগ্যতার কারণ হলো তারা শুধু ‘খবরের’ মধ্যে নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখেনি। তারা সব স্তরের পাঠককে পাঠক হিসেবে সম্মান করার একটা রাস্তা খুঁজেছে। খবর পরিবেশন করাটাকে তারা সেকেন্ডারি হিসেবে নিয়েছে।

একদম ছোটো বাচ্চাদেরকে দিয়েই শুরু করলেন নাহয়। আমার ধারণা একটা ছোটো বাচ্চাকেও প্রথম আলোর সাথে অন্য একটা পত্রিকা দেখিয়ে যদি কম্পেয়ার কর‍তে বলা হয় কোনটা বেটার, তাহলে সে প্রথম আলোকেই বেছে নেবে। কারণ প্রথম আলো বুঝেছে যে সব বাচ্চারা এক হয় না। কোনো কোনো বাচ্চাদের কমিক পড়তে ভালো লাগে। তাদের জন্য আছে বেসিক আলী, বাসার ভাই, ন্যান্সি টাইপের কমিকগুলো। কারো কারো আগ্রহ থাকে মজার মজার ফ্যাক্ট জানতে। সে ‘রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট’ অংশটা পড়ে। কেউ ভাষা নিয়ে আগ্রহী হয়, তার জন্য থাকে শব্দভেদ সেকশনটা। কেউ গণিত নিয়ে আগ্রহী হয়, সে সুডোকু পছন্দ করে। এছাড়াও বড়োদের উদ্ধৃতি শেখা যায় ‘কথা অমৃত’ সেকশন থেকে, এসব এক-দুই লাইনের কথাগুলো বাচ্চাদেরকে চিন্তাশীল বানায়। আর কৌতুকের কথা তো বাদই দিচ্ছি। খেয়াল করে দেখেন, এই একটা পাতায় প্রথম আলো সকল টাইপের বাচ্চাদের কাছে নিজেদেরকে পৌছানোর চেষ্টা করেছে। অন্য কয়টা পত্রিকা শুধু বাচ্চাদের সম্মানে এতকিছু করে? এখন কি ছোটো বাচ্চারা লেইম-লেইম ছড়া পড়তে আগ্রহ পায়? আমার ডান হাতের তিনটা আঙুল না থাকলেও আমি যেই ছবিটা আঁকতে পারতাম, সেটা এবার নয়া দিগন্তের ঈদ সংখ্যার প্রচ্ছদ হয়েছিল।

এখনকার যুগে প্রেম করার আগে মেয়েরা জোডিয়াক সাইন দেখে। অথচ আমি জন্মের পর থেকে দেখতেছি প্রথম আলোর ক্রোড়পত্রে রাশিফল দেওয়া থাকতো। সবাই যে রাশিফলে বিশ্বাস করে তা কিন্তু নয়, এটা প্রথম আলোও জানে। তবে যারা যারা রাশিফল দেখে মজা পেতো তাদেরকে প্রথম আলো সম্মান করেছে। পাশে একজন মনোবিজ্ঞানী মানুষকে রিলেশনশিপ অ্যাডভাইস ও নানান জীবনঘনিষ্ঠ প্রশ্নের উত্তর দিতেন। প্রথম আলোর ম্যাগাজিনে রান্নার রেসিপি থাকে, নানারকম ঘরোয়া টিপ্স অ্যান্ড ট্রিক্স থাকে, সংসারের হ্যাক থাকে। যে মহিলাটা বাচ্চাকে স্কুল থেকে আনা বাদে বাসার বাহিরে বের হয় না তাকে পাঠক হিসেবে সম্মান করার কথাও প্রথম আলো ভেবেছে। এখন কোন ফ্যাশন ট্রেন্ডি, কোন ডিজাইনকে ‘বাহারি ডিজাইন’ বলে এই সবকিছু নিয়ে প্রথম আলো কেয়ার করেছে। কারণ কেউ-না-কেউ এসব পড়তে চায়।

যেহেতু এই লেখা কোনো গবেষণামূলক লেখা না, তাই আমি সব কিছু উপরে-উপরে বলে যাচ্ছি। তবে এখানে আরও অনেক অনেক গভীরে যাওয়া সম্ভব। সেগুলো আমার কাজ না, বরং এই লাইনের এক্সপার্টদের কাজ। উদাহরণস্বরূপ, প্রথম আলোতে যেই ফন্টে লেখা হয় (সূর্য ফন্ট), সেটাও তারা একজন বিদেশী টাইপফেস ডিজাইনের স্পেশালিস্টকে দিয়ে বানাইছেন। ডিজাইনার জেকব থমাস অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক রিসার্চ প্রজেক্টের অংশ হিসেবে বিলুপ্ত উগারিতীয় ভাষার ফন্ট ডেভেলপমেন্টে কাজ করেছেন। অর্থাৎ যে বিষয়টা আমাদের কাছে চোখে না পড়ার মতো খুব সামান্য একটা ব্যাপার মনে হয়, সেখানেও প্রথম আলো এত বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তাহলে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলোতে (যেমন লেখার টপিক, শব্দচয়ন, ট্যাগিং, আর্ট) তারা কতটা গুরুত্ব দেয় অনুমান করেন। 

এগুলাই হলো কোয়ালিটি। ইচ্ছামতো টাকা ঢাললেই রুচির অভাব পুরণ করা যায় না। প্রবাসীরা প্রচুর টাকা-পয়সা নিয়ে গ্রামে ফেরত এসে যেই টাইলস লাগানো বিল্ডিং করে সেগুলো দেখলে বুঝবেন আমি কী বলতে চাচ্ছি। রুচি ডেভেলপ করার জন্য সমাজের সবার সাথে মিশতে হবে। আমরা তার কতোটুকু করতেছি সেটা হচ্ছে আসল প্রশ্ন।

আরও পড়তে পারেন

2 COMMENTS

  1. চমৎকার কিছু পয়েন্ট এসেছে আলোচনায়। বাদ পড়েছে প্রায়
    নির্ভুল বানানের দিকটা। আমি শুধু ওই কারণে পছন্দ করি। টাইপ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যেটা নজর কেড়েছে সেটা হলো শার্পনেসের পরিবর্তে বাংলা অক্ষরের একটু ভোঁতা চেহারা ধরে রাখার দিকটা। নয়া দিগন্তের ঈদ সংখ্যার প্রচ্ছদের প্রসঙ্গ এসেছে। ওই সংখ্যার সম্পাদক হিসেবে আমাকে আমার পাঠকের রুচির দিকটা মনে রাখতে হয়েছে। আশা করি আলোচক এবং এই মন্তব্যের পাঠক বুঝবেন কী বলতে চাইছি। শেষ কথা বলব, প্রথম আলো পৃথিবীর বাইরে থেকে আসা লোকেরা বের করে না। দেশের বাইরেরও না। আর কঠিন হলেও সত্য পত্রিকা তো দূর, কেউ বা কোনো কিছুই অবিকল্প নয়।

  2. খুব ভালো একটা লেখা। এই দিকগুলো অনুসরণ করে আরো এক/দুইটা দৈনিক যে গড়ে উঠবে সেই অনুসরণ/অনুকরণ করার যোগ্যতাও কারো দেখি না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on বাংলা একাডেমির মুখোস উন্মোচন
কাজী জহিরুল ইসলাম on বাংলা একাডেমি এবং আমার গ্লানি
কাজী জহিরুল ইসলাম on ‘প্রথম আলো’র বিকল্প
পথিক মোস্তফা on মানবিক কবি ফররুখ আহমদ