আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
ভারতীয় উপমহাদেশের কিংবদন্তিতূল্য স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের দৌহিত্রী, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ফেলো (বর্তমানে অধ্যাপক) শর্মিলা বোস বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর তার “ডেড রেকনিং: মেমোরিজ অফ দ্য ১৯৭১ বাংলাদেশ ওয়ার” গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে গ্রন্থটিকে কল্পকাহিনী নির্ভর ইতিহাসের বিভ্রান্তি দূর করে ইতিহাসকে তথ্যভিত্তিক ও সত্যাশ্রয়ী করার প্রয়াস বলে উল্লেখ করেছেন।
গত ১৫ মার্চ মঙ্গলবার ওয়াশিংটন ডিসি’তে হোয়াইট হাউজের অদূরে বিখ্যাত উডরো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারস এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিয়েজিত সাবেক আমেরিকান রাষ্ট্রদূত এবং ওয়াশিংটন কেন্দ্রিক উড্রো উইলসন সেন্টারের সিনিয়র পলিসি স্কলার উইলিয়াম বি মাইলাম, ব্রুকিংস ইন্সটিটিউটের বিশিষ্ট গবেষক স্টিফেন কোহেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে দায়িত্ব পালনকারী অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের ব্যুরো চীফ আরনল্ড জেটলিন, হাওয়ার্ড ইউনির্ভার্সিটির প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কাশেম, ফেডারেল সেন্সাস ব্যুরোর সিনিয়র অফিসার খন্দকার মনসুর, মুক্তিযোদ্ধা ড. নূরনবী, ভয়েস অফ আমেরিকার দুই সাংবাদিক আরশাদ হোসেন ও আনিস আহমেদসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
(২০১১ সালের ১৫ মার্চ লেখা এই রিপোর্টের বয়স প্রায় ১৪ বছর। একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানের রিপোর্ট। প্রকাশিত বইটির নাম “ডেড রেকনিং : মেমোরিজ অফ দ্য ১৯৭১ বাংলাদেশ ওয়ার।” লেখক শর্মিলা বোস। আমি সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে রিপোর্টটি করেছি এবং ওই সময় বেশ ক’টি দৈনিক ও সাপ্তাহিক সংবাদপত্র এবং বিভিন্ন ব্লগে এটি প্রকাশিত হয়েছে। আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ, প্রিয় লেখক (একই নগরীতে বসবাস করেও এখনো তার সাথে সাক্ষাৎ হয়নি) শিবলী আজাদ মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যার ওপর একটি পোস্ট দেওয়ায় আমি বেশ খোঁজাখুজি করে পুরনো রিপোর্টি বের করলাম। মুক্তিযুদ্ধের ওপর যারা গবেষণা করেন বইটি তাদের কাজে লাগবে।)
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি এন্ড গভর্নমেন্ট’ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি নেয়া শর্মিলা বোস দীর্ঘদিন যাবত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন এবং তার গবেষণামূলক কিছু লিখা ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে এবং সেগুলো পাঠকমহলে তীব্র আলোড়ন ও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। তার সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থটির তথ্য সংগ্রহ করতে তিনি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ব্যাপক সফর করেন এবং যুদ্ধে সরাসরি জড়িত সৈনিক ও ক্ষতিগ্রস্তদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, ঘটনাস্থল পরিদর্শন, এবং সংশ্লিষ্ট দলিলপত্রের সাহায্য নিয়েছেন। যুদ্ধের নয় মাসে পাকিস্তানী সৈনিক ও তাদের সহযোগীদের দ্বারা নিহত ও ধর্ষিতের যে স্ফীত সংখ্যা দেখানো হচ্ছে সে সংখ্যাকে তিনি অবাস্তব ও অতিরঞ্জিত বলে তার গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন এ নিয়ে অদ্যাবধি বাংলাদেশে কোনো গবেষণা বা জরিপ হয়নি এবং নিহত ও ধর্ষিতের যে সংখ্যা দাবী করা হচ্ছে তা গ্রহণযোগ্য করার পক্ষে কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। বরং ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার হতাহতের সংখ্যা নিরূপনে যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল সে কমিটির কাছে নিহতের দাবী নিয়ে আসার ঘটনা ছিল মাত্র ২,০০০টি। ফলে কমিটির কাজ আর অগ্রসর হয়নি।
গ্রন্থটির ভূমিকায় শর্মিলা বোস বলেছেন, “বিভ্রান্তিকর, অসম্পূর্ণ ও অনির্ভরযোগ্য তথ্য থেকে সত্য বের করার চেষ্টায় ভুলের অবকাশ থাকতে পারে, কিন্তু সাহসে ভর করে, প্রমাণ ও সংশ্লিষ্টতার উপর ভিত্তি করে, সকল পক্ষের প্রতি সুবিচার করার লক্ষ্যে খোলা মনে গবেষণায় নিয়োজিত হলে একটি আদর্শ গন্তব্যে অবশ্যই উপনীত হওয়া সম্ভব।”
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের ওপর আক্রমণ শুরু করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’টি ছাত্রাবাস জগন্নাথ হল ও ইকবাল হল ছিল আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য। সে হামলায় অগণিত ছাত্রশিক্ষক ও কর্মচারি নিহত হয়েছেন দাবী করা হলেও শর্মিলা বোস তার গ্রন্থে সেই রাতের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত হিসাবের উল্লেখ করে বলেছেন যে ২৫ মার্চ রাতে ক্যাম্পাসে ও যুদ্ধের নয় মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে নিহতদের যোগ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১৪৯ জন নিহত হয়েছেন। অনুরূপ, পরদিন ২৬ মার্চ পুরনো ঢাকার হিন্দু প্রধান শাখারি পাড়ায় ৮,০০০ নিহত হয়েছে দাবী করা হলেও তিনি গুলির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে সেদিন শাখারি পাড়ায় নিহত হয়েছে ১৪-১৫ জন পুরুষ ও একটি শিশু।
তার গ্রন্থে আরো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় স্থান পেয়েছে, তা হলো ১৯৭১ সালের ১লা মার্চের পর থেকে এপ্রিল মাসের কিছুদিন পর্যন্ত অর্থ্যাৎ পাকিস্তান বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার পূর্বে এবং যুদ্ধ শেষে দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ সমর্থক ও মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা অবাঙালি মুসলমানদের হত্যা, ধর্ষণ ও তাদের সম্পদ লুণ্ঠণের ঘটনা। বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে এ ঘটনাগুলোর ছিটকে যাওয়াকে তিনি রহস্যজনক বলে মনে করেন। কারণ অবাঙালি মুসলমানরা উপমহাদেশে একটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ভারত থেকে নিজেদের ভিটামাটি ছেড়ে যেখানে আশ্রয় নিয়েছিল সেখানে তাদের করুণ পরিণতি ইতিহাসে ঠাঁই পায়নি। তার মতে যুদ্ধের শুরুতে ও যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশে অন্তত এক লাখ অবাঙালি নারী পুরুষ ও শিশু নিহত হয়েছে।
গ্রন্থটি সম্পর্কে ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউটের এ ডার্ক মোজেস বলেছেন, “শর্মিলা বোসের ‘ডেড রেকনিং’ এ ইতিহাসের বিভ্রান্তি শুধরে দেওয়া হয়েছে এবং তিনি সততায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহসিকতার সাথে গ্রন্থটি রচনা করে মানবিক গুণাবলীরই বিকাশ ঘটিয়েছেন। এটি ওই অঞ্চলের ইতিহাসের কালো অধ্যায় নিয়ে বিতর্কে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করবে।”
‘দি আইডিয়া অফ পাকিস্তান’ এর লেখক স্টিফেন কোহেন বলেছেন, “ইতিহাসের তথ্যকে সঠিক করার ক্ষেত্রে গবেষণার কঠোর পরিশ্রম ও আবেগপূর্ণ আগ্রহের ফসল ‘ডেড রেকনিং’। ১০৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশ যুদ্ধেও সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মর্ম অনুসন্ধানে এটি চমৎকার একটি গবেষণা। শর্মিলা বোস সত্যের সন্ধানে এবং সত্যের সেবা করার জন্য লিখেছেন। আমরা তার কাছে ঋণী।”
ড. নূরনবী মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা ৩০ লাখ মানুষ হত্যা ও দুই লাখ মহিলাকে ধর্ষণ সম্পর্কিত দাবীর পক্ষে তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরলে শর্মিলা বোস এসব পরিসংখ্যানকে ‘ওয়াইল্ড ইমাজিনেশন’ বলে নাকচ করে দেন।
‘ডেড রেকনিং’ গ্রন্থটি রচনা করে শর্মিলা বোস একটি প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছেন। হত্যাকান্ড এমনিতেই নৃশংস ঘটনা, তার ওপর যদি একটি মৃতদেহকে ক্ষতবিক্ষত করা, চোখ উপড়ে ফেলা বা বুক ফেড়ে হৃদপিন্ড বের ফেলার মতো কাহিনি যোগ করা হয় তা নিঃসন্দেহে পৈচাশিকতার পর্যায়ে পড়বে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দু’জন চিকিৎসকের নাম আছে, চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরী এবং হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফজলে রাব্বি। শর্মিলা বোসকে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের পরিচালক যে প্রকাশনাগুলো দেন তাতে বর্ণনা রয়েছে যে ডা. চৌধুরীর চোখ উৎপাটন করা হয়েছিল এবং ডা. রাব্বির হৃদপিন্ড বের করে ফেলা হয়েছিল বক্ষ বিদীর্ণ করে। শর্মিলা বোস দুই শহীদের স্ত্রীর কাছে জানতে চান যে মৃতদেহগুলো তারা কেমন দেখেছেন। তারা তাদের স্বামীদের দেহে একাধিক গুলীর ক্ষত দেখেছেন, কিন্তু ডা.আলীমের চোখ জায়গামত ছিল এবং ডা রাব্বির বক্ষও বিদীর্ণ ছিল না বলে শর্মিলাকে জানান।
গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে এধরণের নারকীয় বর্ণনা দিয়ে মূলত শহীদদের প্রিয়জনদের আরো আহত করা হয়েছে এবং প্রকৃতপক্ষে যা ঘটেছিল সেই বর্ণনা থেকে সরে আসা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি তথা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা নিগৃহীত হওয়ার ভয়ে যেসব গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কোনকিছু নিয়ে নিরপেক্ষভাবে গবেষণা ও জরিপ চালাতে সক্ষম হননি, শর্মিলা বোসের গ্রন্থটি তাদের চোখ খুলে দিতে পারে। বাংলাদেশের কোন গবেষণা প্রতিষ্ঠান দায়িত্বটি গ্রহন করলে নিঃসন্দেহে আরো তথ্য বের হয়ে আসবে এবং মুক্তিযুদ্ধ তথা দেশের ইতিহাস আরো সমৃদ্ধ হবে।
শর্মিলা বোস পাকিস্তানি নন, ভারতীয় বংশোদ্ভুত হলেও ভারতে বাস করেন না, তিনি ইতিহাসের সত্য বের করতে পাকিস্তানের স্বপক্ষ শক্তি বা স্বাধীনতা বিরোধী বলে যারা পরিচিত তাদের কাছে যাননি, বরং স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যারা লালন করেন তাদের কাছেই গিয়েছেন। যারা ’৭১ হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ সব ধরণের নিগ্রহ প্রত্যক্ষ করেছেন তারা এখনো জীবিত আছেন, তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ইতিহাসে যদি ভুল থাকে তা শুধরানোর উদ্যোগ নেয়া জরুরী।
শ্রোতাদের মধ্য থেকে একজন জানতে চান যে এধরণের বই রচনার জন্য তিনি পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ‘আইএসআই’ এর কাছ থেকে অর্থ লাভ করেছেন কিনা, শর্মিলা বোস এক শব্দে উত্তর দেন, ‘না’।
অনুষ্ঠান উপস্থিত শ্রোতাদের অধিকাংশই ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশী। তাদের অনেকে শর্মিলা বোসের গবেষণার সাথে দ্বিমত প্রকাশ করলেও তার ২৩৯ পৃষ্ঠা সম্বলিত ৩৭.৫০ ডলার মূল্যের বইটি আগ্রহের সাথে কিনে তার অটোগ্রাফ নেন। অনুষ্ঠানস্থলে আনা বইগুলো অল্প সময়ের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়।