[ওমর আলীর কবিতা নিয়ে আমি লিখেছি এম আবদুল আলীমের অনুরোধে ও তাঁর সহযোগিতায়। যখন প্রয়োজন হয়েছে তখনই ওমর আলীর বইয়ের তথ্য, প্রয়োজনীয় কবিতা তিনি সরবরাহ করেছেন বলে আমেরিকায় বসেও আমি লিখতে পেরেছি। বঙ্গ রাখালও ওমর আলীর অনেকগুলো কবিতা স্ক্যান করে পাঠিয়েছেন। নিউ ইয়র্কবাসী কবি শামস আল মমীনের সংগ্রহে পেয়ে গিয়েছিলাম ওমর আলীর প্রথম কবিতা-সংকলন ‘এদেশের শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’। আমার ভালো লাগছে আবছায়া ভাবে জানা এই কবিকে কিছুটা মনোযোগ দিয়ে পড়তে পেরেছি বলে। সংস্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি!]
আহমাদ মাযহার
উনিশশো সাতচল্লিশ-উত্তর দেশভাগের পটভূমিতে বাংলাদেশের কবিতায় আধুনিকতার যে যাত্রা শুরু ওমর আলী (১৯৩৯-২০১৫) সেই যত্রীদলেরই প্রতিনিধি। তৎকালীন পাকিস্তনি শাসক গোষ্ঠীর আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবদমনের পরিপ্রেক্ষিতে সেই সময়ের বাংলা ও বাঙালির সমাজ-অভ্যন্তরে সংঘটিত বিচিত্র দ্বান্দ্বিকতাজাত বাংলাদেশে আধুনিক সাহিত্যের যে ভিত্তি-অনুষঙ্গ বিরাজিত ওমর আলীর কবিতারসদও সেখান থেকেই সংগৃহীত। আরো স্মরণীয়, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী, ফজল শাহাবুদ্দীন প্রমুখ কবিদের সমান্তরালেই তাঁরও কবি পরিচিতির বিস্তৃতি। গত শতাব্দীর চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের আধুনিক বাংলা কবিতার সবচেয়ে স্বীকৃত মাধ্যম বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় পূর্ববঙ্গের উপর্যুক্ত অগ্রগণ্য কবিদের মতোই ওমর আলীর কবিতাও বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশিত। সমকালে প্রকাশমান অপরাপর গণনীয় পত্রিকা হুমায়ুন কবির সম্পাদিত ‘চতুরঙ্গ’, অনিল কুমার সিংহ সম্পাদিত পশ্চিমবঙ্গের ‘নতুন সাহিত্য’ ও সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় কিংবা ঢাকার সিকান্্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকার মতো আধুনিকতার প্রতিনিধিত্বশীল প্রকাশ মাধ্যমে স্থান পেয়ে তিনিও ছিলেন পূর্বোক্তদের সঙ্গে একত্র-উচ্চার্য নাম। হয়তো সেই কারণেই পঞ্চাশের দশকে আবির্ভূত আধুনিক কবিদের মধ্যে ওমর আলীর নামটি পরবর্তী কালে আড়ালবাসী হয়েও খানিকটা অবিস্মৃত রয়ে গেছেন।
পঞ্চাশ ও ষাটের আধুনিকতামুখি কবিতা যেমন সে সময়ের বিশিষ্ট ভাব নৈরাশ্য ও নির্বেদ অবলম্বনে অগ্রাধিকারী তেমনি তাঁদের উজ্জীবন প্রবলতর নগর মানসের অনুষঙ্গেও! কিন্তু ব্যতিক্রম হচ্ছে, আধুনিক হয়েও ওমর আলীর কবিতা গ্রামীণ জীবন বোধ অবলম্বী। বিশ শতকের আধুনিকবাদ মূলত নগরে যপিত জীবনবোধ আশ্রয়ী। কিন্তু আধুনিকবাদ প্রভাবিত বাংলাদেশের সে সময়ের সাহিত্য মহল গ্রামজীবনকে কিভাবে আত্মস্থ করবে তা নিয়ে মননগত বিভ্রমে আচ্ছন্ন। ফলে আধুনিকতার প্রশ্নে ওমর আলীর কবিতা গোড়ায় কিছুটা মনোযোগ আকর্ষণী হয়েও পরে মূল্যায়নবঞ্চিত।
গত শতাব্দীর আশির দশকে তাঁর সক্রিয়তার সময়েও দেশের গুরুত্বপূর্ণ দু একটি প্রকাশনাসংস্থা থেকে নগণ্য সংখ্যায় তাঁর কবিতা-সংকলনের প্রকাশ অনেকটা ব্যতিক্রমের মতো মনে হতো। ১৯৮৫ সালে তাঁর একটি কবিতা-সংকলন প্রকাশনা সূত্রের একটি স্মৃতি এখনো আমার মনে জাগরূক। আমি সেদিন উপস্থিত বাংলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক ও তৎকালীন উপ-পরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদার কক্ষে। ওমর আলীর কবিতা-সংকলন প্রকাশনা নিয়ে চিত্তরঞ্জন সাহার প্রকাশনা-সংস্থা মুক্তধারার কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে তিনি তখন আলাপরত। ওমর আলীর পরিচয় দিতে এদেশে শ্যামলরঙ রমণীর সুনাম শুনেছি কবিতা-সংকলনের কথা বারংবার স্মরণীয় তাঁর কণ্ঠে। ঐ ফোনালাপে পাণ্ডুলিপি-রিভিউয়ার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা সংকলনটি প্রকাশের অনুকূলে কবির যে পরিচয় তুলে ধরছিলেন তাতে আমার সামনে ওমর আলীর পরিচয়-অখ্যাতির আড়াল কেটে যাচ্ছিল। তাঁর মতো একজন শক্তিমান কবির পরিচয়ে এত কথা ব্যয় করতে হচ্ছিল বলে মুহম্মদ নূরুল হুদা সেদিন কিছুটা বিব্রতও। কবিতার বইটি যে প্রকাশিত হয়েছিল তা মনে থাকলেও বইটির নাম এতদিনে আমি বিস্মৃত। পরে ওমর আলীর তথ্যভাণ্ডার এম আবদুল আলীম সূত্রে জানা, চিত্তরঞ্জন সাহার মুক্তধারা থেকে ঐ একটি বইই প্রকাশিত। বইটির নাম ডাকছে সংসার!
সম্ভবত আশির দশক পর্যন্ত টানা কয়েক বছর তাঁর একটা পর একটা কবিতা-সংকলন প্রকাশিত। কিন্তু আশ্চর্য, উন্মেষলগ্নেই কবি হিসেবে তাঁর স্বাতন্ত্র্য ও গুরুত্ব স্পষ্টভাবে চেনানোয় সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও ঢাকা-চট্টগ্রাম বা রাজশাহী-সিলেট নগরকেন্দ্রী কবিতার আলোচনায় ওমর আলীর নাম কম উচ্চারিত। প্রথম কবিতা-সংকলন এদেশে শ্যামলরঙ রমণীর সুনাম শুনেছি-ও শামসুর রাহমানের প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে, আল মাহমুদের সোনালি কাবিন কিংবা সৈয়দ শামসুল হকের বৈশাখে রচিত পঙ্্ক্তিমালা কিংবা শহীদ কাদরীর উত্তরাধিকারের মতো পরিচিত সেই ষাটের দশকেই।
২.
কবিতাযাত্রার একেবারে শুরুর দিকে তাঁর লেখা অন্তত দুটি কবিতা–এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি কবিতা-সংকলনের নাম কবিতাটি এবং ‘একদিন একটি লোক’ শিরোনামের কবিতাটি কবিতাপ্রেমিকদের স্মৃতিতে জ্বাজ্বল্যমান। এর মধ্যে প্রথম কবিতাটি অবশ্য বহুল উদ্ধৃত। মনে পড়ে আশির দশকের প্রথম দিকেই তাঁর ‘একদিন একটি লোক কবিতাটি’ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আমাদের প্রসঙ্গক্রমে স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। পরে নানা জনের উদ্ধৃতিতেও পেয়েছি। ওমর আলীর কবিতায় আধুনিকতার সবচেয়ে পরিশীলিত রূপের সেই কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত না করে তাঁর কবিতাভুবনে প্রবেশ করতে পারছি না! কবিতটি এমন,
একদিন একটি লোক এসে বললো, ‘পারো?’
বললাম, ‘কি’?
‘একটি নারীর ছবি এঁকে দিতে,’ সে বললো আরো,
‘সে আকৃতি
অদ্ভুত সুন্দরী, দৃপ্ত, নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে–
পেতে চাই নিখুঁত ছবিতে।’
“কেন?” আমি বললাম শুনে ।
সে বললো, ‘আমি সেটা পোড়াবো আগুনে।’
আরো বিভিন্ন জনের ভালো লাগার এই কবিতাটি প্রথমত ও মূলত আমার নানা জনের মুখেই শোনা। ফলে ওমর আলী আমার কাছে দীর্ঘকাল শ্রুতনাম হয়েই ছিলেন; এমনকি তাঁর বহুবিখ্যাত এদেশের শ্যামলরঙ রমণীর সুনাম শুনেছি বইটির প্রথম সংস্করণের কোনো কপি দীর্ঘকালেও দেখতে পাইনি। একটু বিস্তারিত ভাবে তাঁর কবিতা সামান্য পড়া হয়েছে তাঁর মৃত্যুর অল্প আগে ও পরে, অতি সাম্প্রতিক কালে। বাংলাদেশ থেকে এম আবদুল আলীম ও বঙ্গ রাখাল তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা ও অন্য বেশ কিছু কবিতা বাংলাদেশ থেকে স্ক্যান করে না পাঠালে নিউ ইয়র্কে বসে তাঁর কবিতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করা আমার পক্ষে কঠিন হতো। তাঁর মৃত্যূত্তর কালে ইন্টারনেটের নানা ওয়েব পোর্টালেও কিছু কবিতা পড়া গেল। তা সত্ত্বেও তাঁর কবিতাভুবনকে ঠিক মতো আস্বাদ করে উঠতে পেরেছি বলা যাচ্ছে না। কারণ কবিতাগুলো পড়তে পড়তে মনে হয়েছে বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু কবিতা পড়ে মোটের ওপর অনুধাবন করা গেলেও তাঁর কবিতার অনেক সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য হয়তো ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তাঁর কবিতা-সংকলনগুলোর প্রকাশ সময়কে অনুসরণ করে ধারাবাহিক ভাবে পড়ে নিতে পারলে হয়তো তাঁর কবিমানসের বিবর্তনকে আরো একটু গভীর ভাবে বুঝে নেয়া সম্ভব হতো।
৩.
এলোমেলো ভাবে পড়লেও অনুভব করা যায়, গ্রামীণ জীবনযাত্রার পটভূমিতে তাঁর কবিতা মাটি ও মানুষের প্রেমানুভূতির রোমাঞ্চকর আখ্যানে উত্তীর্ণ; সেই সূত্রেই তিনি ক্রমশ তাঁর সমকালীন আধুনিক অগ্রগণ্যদের চেয়ে আলাদা। চর্চায় কমতি না থাকা সত্ত্বেও মফস্্সলে থাকায় সমসাময়িকদের চেয়ে কবিতায় বিশশতকী আধুনিকতার প্রতিনিধিদের চোখের আড়ালে পড়ে যান তিনি। অন্য দিকে আত্মপ্রচারে যথেষ্ট উদ্যমী নন বলে আনুষ্ঠানিক ভাবেও তিনি কম উল্লিখিত; পরিণামে একসময় প্রায় অন্তরালবর্তী। তাঁর সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব যে ধরনের জীবন যাপন ও বোধ দ্বারা চালিত তাতে নাগরিক কৃত্রিমতার স্থান নেই। বরং ক্ষমতা ও প্রচারের চেয়ে জীবনবোধের অকৃত্রিমতা তাঁর প্রকৃত অনুশীলিত বিষয়ে পরিণত। হয়তো-বা নাগরিক জীবনযাত্রা থেকে স্বেচ্ছানির্বাচিত এই ধরনের জীবন যাপনসূত্রেই তাঁর কবিতা আধুনিক হওয়া সত্ত্বেও এক স্বতন্ত্র ভুবনের বাসিন্দা।
তবু যতটুকু পরিচয়ই তাঁর আছে, তাতে সামগ্রিক ভাবে অনুভূত যে, তিনি যুগপৎ আধুনিকবাদী ও রোমান্টিক কবি হিসেবেই চিহ্নিত। অবশ্য তাঁর রোমান্টিকতা কেবল নারীতে সীমাবদ্ধ নয় বরং নারী, দেশপ্রেম ও নিসর্গে প্রোথিত। বাঙালির কাছে স্বদেশ মানে মাতৃকা–অর্থাৎ নারীপ্রতীক; আবার বাঙালি কবি হিসেবে প্রেমার্দ্র মন নিয়ে তিনি আশ্রয়সন্ধানী শ্যামবর্ণা স্বাস্থ্যবতী আদিম নারীর কাছেই! এই ‘শ্যামল’ রূপও যুগপৎ নারী ও বাংলাদেশেরই পরিচায়ক! তাঁর প্রথম কবিতা-সংকলনের এইসব মুদ্রাচিহ্নবাহিতা যেমন ক্রমশ প্রবহমান পরবর্তী কালের কবিতায়ও তেমনি আবার ক্রমশ চলমান গ্রামীণ কৃষি-সংস্কৃতি প্রোথিত অকৃত্রিম জীবনের মনন-দ্বন্দ্বেরও অঙ্গীভবন। সমকালীন অপরাপর কবিদের সৃষ্টিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রভাব যতটা বাহ্যিক রাজনৈতিক অনুষঙ্গবাহী এর বিপরীতে তাঁর কবিতা ততটাই নিজের যাপিত জীবনের অন্তঃশীল বোধে ক্রমশ সঞ্জীবিত।
কবির চেতনায় স্বদেশবোধ যেমন গভীরভাবে স্বপ্নলালিত তেমনি স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায়ও তা অভিমানাহত। স্পষ্টতই সমকালীন অন্য অধুনিক কবিদের তুলনায় তাঁর কবিমানস গ্রামীণ জনপদ-অনুষঙ্গী। ফলে সমকালীন বাংলা কবিতার সাধারণ বৈশিষ্ট্য–যথা, বাংলাদেশের মানুষের আত্মপরিচয়, রাজনৈতিক অধিকার ইত্যাদি অনুষঙ্গ রাজনীতির ঝঞ্ঝায় দুর্বিষহ গ্রামীণ জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর কবিতায়ও সদাজাগরূক। সার্বিক অর্থে অন্য আধুনিক কবিদের মতোই সমাজ, সময় ও রাষ্ট্র-অভিজ্ঞতা তাঁর কবিতায়ও অঙ্গীভূত। যদিও শামসুর রাহমান বা হাসান হাফিজুর রহমানের মতো তাঁর দেশপ্রেমের উচ্চকিত ঘোষণা কবিমহলে নিনাদিত নেই, অথচ লক্ষ্যণীয়, এক অর্থে ওমর আলীর সব ধরনের কবিতাতেই দেশপ্রেম প্রবহমান। স্বদেশ চেতনা যে তাঁর পূর্বোক্ত দুই সহযাত্রীর মতোই তীব্র সে-পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর কবিতা-সংকলন ‘স্বদেশে ফিরছি’ পড়লে। কিন্তু এই সংকলনটির বা তাঁর স্বদেশ চেতনার কথা তেমন একটা প্রচারিত হয়নি বলে রসিক মহলের কাছে প্রায় অজ্ঞাতই রয়ে গেছে।
৪.
বিশশতকী আধুনিকবাদে যৌনতার অনুভূতি গাঢ়মান, বাংলার গ্রামীণতায় বিচরণ করেও তিনি তা থেকে অবিযুক্ত; বরং বলা চলে গ্রামীণ জীবনবোধে ব্যঞ্জিত রোম্যান্টিক বোধের সঙ্গে চিরকালীন যৌনানুভূতির আধুনিক পরিশীলন বর্তমান ওমর আলীর কবিতায়। একই সঙ্গে বিশশতকী আধুনিকবাদের প্রবল ও সাধারণ উপকরণ–যথা, নৈরাশ্য, ক্ষোভ, ক্রোধ এবং ঘৃণাও তাঁর রোম্যান্টিক বোধের সঙ্গী।
বিগত পাঁচ বৎসরাধিক কাল ধরে নিউ ইয়র্কের মতো আধুনিকতার পীঠস্থানে বসবাস সূত্রে কবিতা পাঠের আসরে উপস্থিত থেকে কবিতা শুনে ও বিভিন্ন সংকলনে ও পত্রিকায় নিবিড়ভাবে কবিতা পড়ার সুবাদে বিচিত্র মার্কিন কবিতার সঙ্গে পরিচিতিসূত্রে আমার কাছে অনুভূত যে, দৈনন্দিন জীবনের বহু আটপৌড়ে গুরুত্বহীন বিষয়ও এখানে পরিণত হয়েছে কবিতার মৌল বিষয়বস্তুতে! ওমর আলীর কবিতায়ও বাংলাদেশের অন্তঃশীল গ্রামজীবনের বিচিত্র অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু যা বাংলা কবিতায় প্রায় অদৃশ্যপূর্ব। এসবই তাঁর কবিতায় গড়ে দিয়েছে আধুনিকতার ‘স্বতন্ত্র স্বারূপ্য’।
‘লোকটা সূতী কাপড় পরেনি, পরেছে শুধু মাটি’–তাঁর রচিত এই চরণে যেমন কবির চেতনাপ্রবাহে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রাপণীয় তেমনি প্রাপ্ত আটপৌড়ে গ্রামজীবনের দৈনন্দিনতাকেও। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেনও যে, তিনি সংসারী মানুষ। গ্রামীণ সংসারবোধও তাঁর কবিসত্তায় আধুনিক পরিশীলনে দৃশ্যমান। যেমন, কবিতায় তাঁর ভাষ্য,
এখন শিবরামপুর কোশাখালী গা’র আনোয়ারা রহিমার
হাতে কিন্তু গোবরের কণামাত্র নেই
ফেনায়িত দুধের সুস্বাদ আর সুমিষ্ট ঝর্ণা
যুগল হাঁটুতে ধরা মাটির দোনায় সাদা চন্দ্রকিরণ টেনে
নামছে যে জন
কালো এক গাভীর ওলান থেকে কলিমের বউ সোনাভান…
[‘সবুজ সুনীল মাছরাঙার দেশে’, ডাকছে সংসার]
বাংলাদেশের নিসর্গস্পৃষ্ট মাটি ও মানুষের গন্ধ, যুগপৎ মা আর প্রিয়তমার পায়ের ছন্দ, কাঁকন আর কাঁকইয়ের ছবি ওমর আলীর কবিসত্তার রসদ যোগানদার বলে গাঁয়ের পথ, বাঁশঝাঁড়, কলাগাছ, বটগাছ, সাতভাই চম্পা, পাখ-পাখালি, ডিঙি নৌকা, পদ্মবিল, পুকুর, ট্যাংরা, পুঁটি, বক, শরবন, নারিকেল তলা, মুঠো মুঠো শস্য, ঢেঁকির শব্দ, বুনোলতা, ঘাস, বৃষ্টি, মৃত্তিকা, রোদ, বিটপী ছায়া, বনতল, কফিন, বেড়িবাঁধ, রূপসী মৃগয়া, হাইহিল জুতো, ভাত কাপড়, দেনমোহর, মেঠোফুলের মতো শব্দ তাঁর দ্বারা আকছার ব্যবহৃত; গ্রামীণ অনুষঙ্গের মধ্যে দূর থেকে এসে পড়া নাগরিক সামগ্রীর উপস্থিতিতে জীবন বোধে যে সংশ্লেষ ঘটায় তার প্রভাবে তিনি আধুনিকবাদীতে পরিণত; অন্যদিকে আধুনিক কালের মনোভঙ্গির প্ররোচনায় গ্রামীণ-সংস্কৃতিতে বিরাজমান তিনি একজন সংসারযাত্রীও। ‘গ্রামীণ সারল্য’ ও ‘সাধারণের সংসারলগ্নতা’–আধুনিকতার এই দুই বিপ্রতীপতায়ও তিনি আলাদা অন্য আধুনিকদের তুলনায়। এভাবেই তিনি ক্রমশ অগ্রসরমাণ থাকেন পৃথক ও স্বতন্ত্র এক কবিভুবনের দিকে। বিশেষত তাঁর কবিতার শব্দাবলিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থাননাম ও নারীদের নামের যে বিচিত্র ও প্রচুর সংখ্যক ব্যবহার দৃশ্যমান তা সামগ্রিক ভাবে যে ভৌগোলিকতা ও নারীর ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক তার সমরূপতা বাংলা কবিতায় আর প্রাপ্তব্য নয়! আশ্চর্য যে, তাঁর দুটি বইয়ের আলোচনা সূত্রে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে এই বিষয়টিরই উল্লেখ পাওয়া যায় আবদুল মান্নান সৈয়দের ভাষ্যেও। ওমর আলীর কবিতা সম্পর্কে তাঁর নির্দেশিত আরো কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পুনরুল্লিখিত হওয়া সঙ্গত। কারণ সামগ্রিক অর্থে তাঁর কবিতা ‘স্বাভাবিক লাবণ্যে’, ‘অকপট সবল উৎসারণে’, ‘ছলনাহীন নিষ্কপটতায়’, ‘সহজ স্বতঃস্ফূর্ততায়’ ও ‘প্রাকৃতিকতায়’ স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত।
আঙ্গিকগত প্রয়োগেও ওমর আলীর কবিতা বিশিষ্ট। ‘সেদিন একটি লোক’ কবিতায় যে ধরনের সংলাপধর্মিতা সেরকম কবিতা তাঁর আরও আছে যা বাংলা কবিতায় অদৃশ্যপূর্ব; আঞ্চলিক বাকভঙ্গি ব্যবহারের মধ্য দিয়েও তিনি কবিতায় স্বতন্ত্র আধুনিকতার নিরীক্ষা করেছেন। একটি গোলাপ কবিতা-সংকলনের ‘আনারকলি’ কবিতাটি একাঙ্ক নাটকের গুণসম্পন্ন। কিংবদন্তী-কাহিনিকে কাব্যপ্রয়োগে প্রচ্ছন্নে রেখেও নাট্যগুণ ধারণের মধ্য দিয়ে এক ধরনের আঙ্গিকগত নিরীক্ষা করেছেন তিনি।
বাংলাদেশের গ্রামীণ মানুষের আনন্দ-বেদনা কিংবা দুঃসহ জীবন যন্ত্রণা অবলোকনে ধরা পড়ে যাপিত দৈনন্দিন জীবনের প্রবাহ থেকে; অপরাপর নাগরিক কবিদের মতো কল্পিত জীবন থেকে কবিতার প্রেরণা আহরণ নয় তাঁর। হয়তো সেকারণেই জীবন যাপনের জন্যও নির্বাচন তাঁর গ্রামকেই। দেশ-কাল-সমাজ, রাষ্ট্র ও স্বাধীনতা, কিংবা জৈবতৃষ্ণার অনুভব প্রভৃতি অনুষঙ্গ যেভাবে নাগরিকতায় ক্রমশ প্রভাবশালী গ্রামীণ আবহে নিমজ্জিত থাকা সত্ত্বেও উচ্চশিক্ষা সূত্রে তাঁর চৈতন্যে জাগরূক সেই সব বোধও। ফলে গ্রামে বসবাস সত্ত্বেও তাঁর অনুভবে অনুভূত যে, এই সবই তো গ্রামীণ সমাজেরও অনুষঙ্গ! ফলে এই রকম শব্দাবলিতে আধুনিক জীবনের টানাপড়েনকে তিনি আবিষ্কার ও ধারণে সক্ষম এবং তা সমীক্ষিত তাঁর কবিতায়। এখানেও তিনি সমকালীন সহযাত্রীদের তুলনায় অনন্য।
৫.
অপরাপর আধুনিক কবিদের মতো দেশাত্মবোধ ওমর আলীর কবিতারও একটি প্রধান প্রসঙ্গ। স্বদেশের জন্য কবির মনে যেমন গভীর স্বপ্ন লালিত হতে থাকে তেমনি স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণাও বিদ্যমান। গ্রামীণ জনপদের মানুষের প্রতি সমানুভূতিতে তাঁর কবিতা ঋদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের আত্মপরিচয়ের প্রত্যয় ও রাজনৈতিক অধিকারের বোধ এবং রাজনীতির নামে শ্রমজীবী গ্রামের মানুষের দুর্বিষহ হয়ে ওঠা জীবনের কথকতা তথা স্বদেশের জন্য রক্তক্ষরণ। আর তাই সমাজ, সময়, রাষ্ট্র ও অভিজ্ঞতা তাঁর কবিতায় অঙ্গীভূত স্বতঃস্ফূর্তভাবেই,
কিছুতেই মনে পড়ে না যে আমার স্বদেশ কোথায় রেখেছি
কিছুতেই মনে পড়ে না যে এত কষ্টে পাওয়া যে স্বদেশ আমার
শরীরেই বদরক্তে বন্দী হয়ে আছে।
[স্বদেশ, স্বদেশে ফিরছি]
তবু সেই কষ্টের ভেতরে তাঁর প্রেমময় স্বদেশানুভব ধরা পড়েছে মা মাটি আর মানুষের অস্তিত্বের মধ্যে। মাতৃভূমির জন্য তিনি আজন্ম লালন করেছেন শ্যামল রঙ রমণীর মুখ। যাপিত জীবন শেষে যে মুখ দেখে বলতে পারে পুরুষ,
এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি
আইভি লতার মতো সে নাকি সরল, হাসি মাখা;
সে নাকি স্নানের পরে ভিজে চুল শুকায় রোদ্দুরে,
রূপ তার এদেশের মাটি দিয়ে যেন পটে আঁকা।
সে শুধু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে হরিণীর মতো
মায়াবী উচ্ছল দু’টি চোখ, তার সমস্ত শরীরে
এদেশেরই কোন এক নদীর জোয়ারে বাঁধভাঙা;
হালকা লতার মতো শাড়ি তার দেহ থাকে ঘিরে।
সে চায় ভালবাসার উপহার সন্তানের মুখ,
এক হাতে আঁতুরে শিশু, অন্য হাতে রান্নার উনুন,
সে তার সংসার খুব মনে-প্রাণে পছন্দ করেছে;
ঘরের লোকের মন্দ-আশংকায় সে বড় করুণ।
সাজানো গোছানো আর সারল্যের ছবি রাশি রাশি
ফোটে তার যত্নে গড়া সংসারের আনাচে-কানাচে,
এদেশে ম্যামল রঙ রমণীর এ ব্যাপারে খ্যাতি;
কর্মঠ পুরুষ সেই সংসারের চতুষ্পার্শ্বে আছে।
[‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’, এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি]
জীবদ্দশায় জীবিকা মানুষের প্রায় গোটা জীবনই অধিকৃত বলে সৃষ্টিশীলতা আর মননশীলতাকে লালন তাদর পক্ষে অনেক কঠিন। ওমর আলীর প্রাপ্ত জীবনতথ্য থেকে একথা স্পষ্ট যে শিক্ষকতার মতো পেশায় সারা জীবনে তাঁর উপার্জন নিতান্ত অপ্রতুল। সংসারের অভাব-অনটন সত্ত্বেও সাহিত্য যাত্রায় তাঁর জীবনব্যাপী সক্রিয়তা অবিরাম। মফস্্সলে বসবাস বলে ভালো প্রকাশক পাননি, খুব বেশি জনপ্রিয় নন বলে প্রকাশকেরাও তাঁকে খুঁজে নেয়নি। এমনিতেই কবিদের বই বিক্রি সচরাচর খুব বেশি হয় না। অথচ সেদিক বিবেচনায় ওমর আলীর বই কম বিক্রি হয়েছে বলেই কবি হিসেবে তাঁকে উপেক্ষা সঙ্গত নয়। ওমর আলী ঢাকায় কম প্রচারিত হলেও কোনো কোনো মফস্বল অঞ্চলের পরিশীলিত পাঠকের কাছে কিছুটা পৌঁছেছেন। সত্তরের ও আশির দশকে ঢাকার প্রকাশনা-সংস্থা বুক সোসাইটির অধিকর্তা মোস্তফা কামালের আগ্রহে তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতা-সংকলন প্রকাশিত যা তখনই পাঠকের কাছেই পৌঁছেছিল। পাঠকের কাছে না-পৌঁছলে বা অন্তর্গত প্রেরণার চাপ না থাকলে তিরিশাধিক কবিতা-সংকলন তাঁর পক্ষে প্রকাশ সম্ভব হতো না।
ওমর আলীর প্রথম কবিতা-সংকলন এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি (১৯৬০) প্রকাশ কালেই শুধু বিখ্যাত নয়, ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে পাঁচটি সংস্করণ। নিউ ইয়র্কের ‘মুক্তধারা’ বইমেলা থেকে কবি শামস আল মমীন সংগৃহীত ২০১২ সালে ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ প্রকাশিত সংস্করণটি আমি এই রচনার জন্য ব্যবহার করতে পেরেছি। বইটি এখানে হাতে পেয়ে আমার অনুভূতি এই যে, পাঠকদের অন্তর স্পর্শকারী এই সংকলনটি সকল সাহিত্যিক রাজনীতির সমকালীনতার প্রভাব অতিক্রম করেও প্রজন্মান্তর ঘটাতে পেরেছে।
৬.
ওমর আলীর প্রকাশিত কবিতা-সংকলনগুলোর নামকরণেও তাঁর কবিতার চারিত্র্যচিহ্ন লক্ষণীয়। অন্যান্য কবিতা-সংকলনের নাম যথাক্রমে: সোনালি বিকেল (১৯৬৫), অরণ্যে একটি লোক (১৯৬৬), আত্মার দিকে (১৯৬৭), একটি গোলাপ (১৯৬৮), নদী (১৯৬৯), নিঃশব্দ বাড়ী (১৯৭৩), প্রস্তর যুগ তাম্রযুগ (১৯৭৪), তেমাথার শেষে নদী (১৯৭৪), নরকে বা স্বর্গে (১৯৭৫), বিয়েতে অনিচ্ছুক একজন (১৯৭৫), স্থায়ী দুর্ভিক্ষ সম্ভাব্য প্লাবন (১৯৭৫), স্বদেশে ফিরছি (১৯৭৯), কিছুদিন (১৯৮০), ডাকছে সংসার (১৯৮৫), যে তুমি আড়ালে (১৯৮৭), এখনো তাকিয়ে আছি (১৯৮৭), ফেরার সময় (১৩৯৬), ছবি (১৯৯০), ভালোবাসার দিকে (১৯৯১), প্রসারিত করতল (১৯৯২), লুবনা বেগম (১৯৯৩), শুধু তোমাকে ভালো লাগে (১৯৯৪), তোমাকে দেখলেই (১৯৯৫), ভালোবাসার প্রদীপ (১৯৯৬), হৃদয় ছুঁয়ে আছে ঝড় (১৯৯৮), গ্রামে ফিরে যাই (১৯৯৮), আমার ভেতরে খুব ভাঙচুর হচ্ছে (২০০১), শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০০২), তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হয় (২০০৩), রুদ্ধ নিঃশ্বাসে ছিলাম নয় মাস (২০০৪), উড়ন্ত নারীর হাসি (২০০৪), কুমারী (২০০৮), জ্যোৎস্না অমিতা (২০০৯), মৌমিতা মুক্ত (২০১০), সাদা ফুল সাদা আগুন (২০১২)।
এ ছাড়াও খান ম্যানসনের মেয়ে (১৯৬২), কুতুবপুরের হাসনা হেনা (১৯৮২) তাঁর লেখা উপন্যাস।
একটি মাত্র ছোটদের কবিতা-সংকলন আছে তাঁর ফুল পাখিদের দেশ (১৯৮৩) নামে।
৬.
সাম্প্রতিক বাংলাদেশে সাহিত্য সমাজের ক্ষমতা বলয়ে না থাকায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১) ছাড়া জীবদ্দশায় পুরস্কার-সম্মাননাও বেশি পাননি তিনি। যদিও পেয়েছিলেন বন্দে আলী মিয়া পুরস্কার (১৯৮৮) ও আলাওল সাহিত্য পুরস্কারের (১৯৯১) মতো মর্যাদাসম্পন্ন দুটি বিশিষ্ট মফস্সলি পুরস্কার। একুশে পদক পেয়েছিলেন বটে, তবে মরণোত্তর কালে (২০১৭)।
৭.
ওমর আলীর জীবন ও কবিতাভুবনে সাম্প্রতিক বিচরণে অনুভব করেছি, যে-সময় কবিতার বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রামীণ জীবনযাত্রা তাঁর উপজীব্য সে সময় নগরাভিমুখিতাই ছিল বাংলাদেশের কবিসত্তার প্রবল পক্ষপাত; কারণ সে সময় নগরমুখিনতাই ছিল সামাজিক প্রগতির নিদর্শন হিসাবে বেশি স্বীকৃত। কিন্তু নগরমুখিনতার বাইরের যে বিপুল সংখ্যক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি তখন আবর্তিত তারও যে আরেক ধরনের অপ্রবল প্রগতি সমান্তরালে ছিল চলমান তা থেকে গিয়েছিল আমাদের বোধের অন্তরালে। ওমর আলী সেই আড়ালেরই প্রতিনিধি। ফলে তাঁর মতো গুরুত্বপূর্ণ কবির দিকেও বিশ্লেষণী মনোভঙ্গিতে তাকিয়ে দেখা হয়ে ওঠেনি আমাদের। সম্ভবত তাঁকে মূল্যায়নের এটাই ছিল প্রধান সমস্যা!