spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধবারুদের এক-একটি খণ্ড নিয়ে ঝলসে ওঠে সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিতা

লিখেছেন : আবু তাহের সরফরাজ

বারুদের এক-একটি খণ্ড নিয়ে ঝলসে ওঠে সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিতা

আবু তাহের সরফরাজ

স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে গণমানুষের ঐক্যবদ্ধ যে আন্দোলন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এই দৃশ্য আর কখনো দ্যাখা যায়নি। কেন এই গণরোষ? বাংলাদেশের মানুষ খুবই নীরিহ প্রকৃতির প্রাণী। সাত চড়ে এরা সাধারণত রা কাড়ে না। বউ-বাচ্চা নিয়ে কোনোমতে ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে পারলেই বাঙালির তৃপ্তি। কিন্তু হাসিনা বাঙালির অতটুকু তৃপ্তিকেও অতৃপ্ত করে তুলেছিল। হেন কোনো উপায় নেই যেই উপায়ে তিনি বাংলাদেশের মানুষকে শোষণ করেননি। দীর্ঘ পনের বছর ধরে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়নে প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। নৃশংসতার চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে দমন করেছেন সকল বিরোধী পক্ষকে। তার অত্যাচারের বিরুদ্ধে কেউ টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করতে পারেনি। ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে গড়ে তোলেন বিশাল পোষ্যবাহিনী। তিনবার একতরফা জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করেছেন। রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। নিজে তো করেছেনই, পাশাপাশি পোষ্যবাহিনীকেও রাষ্ট্রের টাকা লুটপাটের সুযোগ করে দিয়েছেন। সবমিলিয়ে দেশের মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল। তারা আর পারছিল না হাসিনার মতো জগদ্দল এক পাথরকে মাথার ওপর বইতে। দীর্ঘদিন ধরেই দেশের মানুষের ভেতর হাসিনার প্রতি ঘেন্না বাড়ছিল। দাঁতে দাঁত পিষে মানুষ সেই ঘেন্না হজম করে যাচ্ছিল। না করে তো উপায় নেই। হাসিনার বিরুদ্ধে একটা শব্দও উচ্চারণ করলে তার কী নির্মম পরিণতি হয়, দেশের মানুষ চোখের সামনেই সেসব দেখছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নেতৃত্বে যখন বিক্ষোভ সমাবেশ আরম্ভ হলো, সেই আন্দোলনে প্রাণখুলে অংশগ্রহণ করলো দেশের মানুষ। হাসিনার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হলো আন্দোলন দমাতে। দেশবাসীর পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হলো হাসিনার পতন ঘটাতে। এই দুই পক্ষের মাঝামাঝি যে নৃশংস গণহত্যা ঘটে গেল, তা এখন ইতিহাস। ইতিহাস সাক্ষ্য দ্যায়, বাঙালি নীরিহ প্রজাতির প্রাণী হলেও অস্তিত্ব রক্ষার চূড়ান্ত সময়ে এই জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়। গড়ে তোলে সম্মিলিত প্রতিরোধ। হাসিনার বিরুদ্ধেও বাংলার ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছিল দূর্গ। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও বাবা-মা সন্তানকে রাজপথে পাঠিয়ে দিয়েছেন হাসিনার পতনকে নিশ্চিত করতে। বিপ্লবের পথটাই এমন। মৃত্যুভয়ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে দমিয়ে রাখতে পারে না। সমগ্র বাঙালির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ছিল হাসিনার স্বৈরশাসন থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে। এই সংগ্রামে প্রত্যেকের নিজ-নিজ অবস্থান থেকে অংশগ্রহণ করে। কারো হাতিয়ার ছিল গণ-আন্দোলনে স্বশরীরে উপস্থিতি, কারো হাতিয়ার ছিল নৈতিক সমর্থন। দেশের কবি-সাহিত্যিকরাও বসে ছিলেন না। শেখ হাসিনার পোষ্য সাহিত্যিক ছাড়া বেশির ভাগ সাহিত্যিক ফেসবুকে তাৎক্ষণিক স্ট্যাটাস দিয়ে আন্দোলনে একাত্ম ঘোষণা করেন। দেশের বাইরে প্রবাসী সাহিত্যিকরাও স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লেখালেখি করে তাদের ঘেন্না প্রকাশ করেন। তাদেরই একজন নব্বইয়ের দশকের ধীমান কবি সাজ্জাদ বিপ্লব। সুদূর আটলান্টায় বসে তিনি একের পর এক কবিতা লিখে পোস্ট দিতে থাকেন ফেসবুকে। জেনে ভালো লাগছে যে, সেসব কবিতা নিয়ে এবার একটি বই হতে চলেছে। এ ধরনের কাজ আসলে ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকে। সেই হিসেবে সাজ্জাদের বইটি গুরুত্বপূর্ণ। হাসিনাবিরোধী আন্দোলন যেহেতু গণরোষের বহিঃপ্রকাশ, সেহেতু ওই সময়ে লিখিত কবিতাগুলো গনমানুষের প্রতিনিধিত্ব করবে সেটাই স্বাভাবিক। গণমানুষের বোঝার মতো করে ভাষাশৈলী ও বলার বিষয় নিয়েই সেসব কবিতাকে হয়ে উঠতে হবে শিল্পের অনন্য মাধ্যম। নব্বইয়ের বেশির ভাগ কবির কবিতায় শব্দের বিন্যাস এলেমেলো। বলার কথা সাবলীল নয়। আমার ধারণা, কবিতা লিখবে বলেই তারা কবিতা লিখতে বসে। কবিতার বোধে তাড়িত হয়ে তারা কবিতা প্রকাশের মাধ্যম হয়ে ওঠে না। কিন্তু সাজ্জাদের যে কোনো কবিতা পড়লেই বোঝা যায়, তিনি সেই দলের নন। তিনি কবিতা লেখেন না। কবিতাই বরং তাকে দিয়ে লিখিত হয়। গণ-আন্দোলনে উত্তুঙ্গ সময়ে তিনি যেসব কবিতা লিখেছেন সেসব কবিতার শব্দ বুনন ও বিষয়-বৈচিত্র্য গণমুখি। গণ-মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে সেসব কবিতায়। দেশের মানুষ যখন মরণ-কামড় দিয়ে রাজপথে আন্দোলণ করছে সেই সময় আটলান্টায় বসে সাজ্জাদ লিখছেন ‘এ মিছিলে আমিও ছিলাম’ কবিতাটি।

এ মিছিলে আমিও ছিলাম

আমিও হেঁটেছি পথে, দিয়েছি স্লোগান
কিন্তু তাড়াতে পারিনি সেই ডাইনি, ডাকিনী

তবু থেমে থাকিনি। বসে থাকিনি।

রাজপথে কেউ বসেও থাকে না, মিছেমিছি
জানি, তুমিও বসে নেই। থাকো না।

রান্নাঘর ছেড়ে, সন্তান-সন্ততি ছেড়ে তুমি আজ রাজপথে, আমার সঙ্গে, আমাদের সঙ্গে, মিছিলে

ডাকিনীদের কোনো ঘর থাকে না।
পরিবার থাকে না। দেশ থাকে না।

তারা মানুষ বোঝে না।

তারা তোমাকে বোঝেনি। আমাকে বোঝেনি। আমাদের কাউকে বোঝেনি

শুধু রক্ত হাতে বসে থাকে সাধের রঙ্গভবনে…

সাধারণ কথামালায় তৈরি হওয়া প্রতিটি বাক্যও সাধারণ। কবিতাকে কবিতা করে তোলার অপকৌশল নেই। বরং, সহজ শব্দে সহজ কথা বলার দিকেই সাজ্জাদের ঝোঁক। এখানেই তার শিল্প-কৌশল। কবিতায় সাজ্জাদের বলার কথা বুঝতে পাঠকের মাথা চুলকাতে হয় না। পড়ামাত্রই পাঠক বাক্যের ইশারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। কেবল পারেই না, সাজ্জাদের লেখা বাক্যগুলো পাঠকের নিজেরই অব্যক্ত উচ্চারণ হয়ে যায়। ফলে, পাঠকের আবেগ উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। স্বৈরশাসকে হটাতে যারা রাজপথে নেমেছে সেই দলে সাজ্জাদ নিজেকেও শামিল করছেন। মানে, তিনি হয়ে ওঠেন আন্দোলনকারীদের সহযোদ্ধা। তবে নিজের ব্যর্থতা তিনি স্বীকার করে নিচ্ছেন। ডাইনিরূপী স্বৈরশাসককে তিনি রাজপথে নেমেও ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেননি। কিন্তু তিনি যে বসে নেই, একথাও জানিয়ে দিচ্ছেন। মাথার ওপর খাঁড়ার ঘা নিয়ে কেউ বসেও থাকে না। অত্যাচারী রক্তখেকো ডাইনিকে হটাতে তার পাঠক এখন সন্তান ছেড়ে গেরস্ত-জীবনের সুখনীড় ছেড়ে মৃত্যুকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে পথ থেকে পথে। দেশের প্রত্যন্ত অ লে বাংলার জনগণ ফুঁসে উঠেছে, যেন অগ্নি-উদ্গীরণ। যে বহ্নি এতদিন তারা বুকের ভেতর নিয়ে জ্বলছিল, তা আজ রাজপথে ঢেলে দিতে সকলেই উত্তেজিত, উদ্গ্রীব। এটাই হওয়ার কথা ছিল। ইতিহাস আমাদেরকে এই সত্য শিখিয়েছে। কিন্তু ক্ষমতার মত্ততায় ডাইনি সেই সত্য বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল। হওয়ারই কথা। ডাইনিদের কোনো আবাসভূমি থাকে না। প্রাকৃতিক নিয়মে সন্তান প্রসব করলেও স্নেহ-বাৎসল্য কী অনুভূতি, সেটাও তারা বোঝে না। তারা মানুষের যন্ত্রণা ও অধিকারও বোঝে না। তারা বোঝে কেবল ‘আমিত্ব’। ক্ষমতার দম্ভ ছাড়া জীবনের আর কিছুই তারা উপভোগ করে না। মানুষের রক্ত সারা গায়ে মেখে নিয়ে তারা ক্ষমতার উল্লম্ফন নৃত্যে জীবন কাটায় রঙ্গভবনে বসে। বস্তুত, জীবনটা ডাইনিদের কাছে রঙ্গ ছাড়া আর কিছুই নয়। স্রেফ একটি শব্দ ‘ডাইনি’, তাতেই স্বৈরশাসকের তাবৎ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সাজ্জাদ বিপ্লব।
আন্দেলানে প্রকম্পিত বাংলা পথঘাট। রক্তের স্রোতে ভিজে উঠছে বাংলার সবুজ প্রান্তর। এরপরও স্বৈরাচার ডাইনি ভাবছে, তার ক্ষমতা চিরস্থায়ী। দেশজুড়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে রেখে তিনি জনগণের ওপর লেলিয়ে দিয়েছেন পুলিশ বাহিনী। তখনো তার দৃঢ় বিশ্বাস, আন্দোলন থেমে যাবে। এটা তার দূরদর্শীতার অভাব। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে এটা তার ব্যর্থতা। দূরদর্শী না হলে সফল রাষ্ট্রনায়ক হওয়া যায় না। কিন্তু সাজ্জাদ দূরদর্শী। আন্দোলনের গতিমুখ লক্ষ্য করে তিনি নিশ্চিত হয়ে যান, অজস্র ফ্যাসিবাদী রাইফেলের সামনে বুক চেতিয়ে রক্তাক্ত বাংলাদেশ একদিন ঘুরে দাঁড়াবে। মরতে গিয়েও আলিফ বর্ণের মতো সটান খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। সেই বিশ্বাস তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন ‘রক্তাক্ত স্বদেশ’ কবিতায়। এই বিশ্বাস রেখেই তিনি আন্দোলনকারীদেরকে রাজপথে থাকতে উদ্বুদ্ধ করেন ‘রাজপথ ছাড়বেন না, কখনো’ কবিতায়। সাজ্জাদ লিখছেন:

রাজপথ ছাড়বেন না, কখনো

বারবার মরে যাবার আগেই
প্রকৃত বীর আবু সাঈদের মতো

একটিবার মরুন

দেখবেন, জাতি বেঁচে গেছে।

মাত্র পাঁচটি বাক্য। অথচ উপলব্ধির দিক থেকে বাংলাদেশের সীমানার মতো বিস্তৃত। শেখ হাসিনার দীর্ঘ পনেরো বছরে বাংলাদেশের মানুষ শোষিত হতে হতে মৃতের মতো পড়ে ছিল। সাজ্জাদ বলছেন, বারবার মরার চেয়ে একবার মরাই শ্রেয়। সেই মৃত্যু হবে প্রকৃত বীরের মৃত্যু। সেই মৃত্যুর মধ্যদিয়ে বেঁচে উঠছে গোটা জাতি। ‘এতো ঘৃণা তুমি রাখবে কোথায়’ কবিতায় স্বৈরশাসককে সাইকো হিসেবে আখ্যায়িত করছেন সাজ্জাদ। তার এই আখ্যা যর্থার্থ কিনা, সেটা এখন বাংলাদেশের ছোট্ট একটি শিশুও জানে। সাজ্জাদের ভাষ্যমতে, দীর্ঘ বছর এই সাইকো দেশের মানুষকে জিম্মি করে রেখেছিল নিজের নৃশংসতাকে উপভোগ করতে। মানুষ সুন্দরকে উপভোগ করে। কিন্তু নিষ্ঠুরতা কি উপভোগের কোনো বিষয়? এটা ডাইনিদের কাজ, মানুষের নয়।
এই বইয়ের কবিতাগুলোর বিষয়-বৈচিত্র্যকে মোটামুটি তিন ভাগে আমরা বিভক্ত করে পাঠ করতে পারি। ক. স্বৈরশাসকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। খ. গণ-আন্দোলনের প্রতি কবির একাত্মতা প্রকাশ। গ. স্বৈরাচার-উৎখাতের পরবর্তী দিনগুলোতে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান।
এরই মধ্যে স্বৈরাচারের চরিত্রের কিছু দিকের সঙ্গে সাজ্জাদ আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ‘ শেষরক্ষা হবে না তোমার’ কবিতায় সাজ্জাদ আমাদেরকে উৎসাহী করেন ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে। তিনি লিখছেন, ‘তোমার পিতা গেছেন যেই পথে/তুমি নিজেই তোমার যাবার সুড়ঙ্গ খুঁড়ছো সেই পথে।’ শেখ মুজিবর রহমান শাসক হিসেবে কেমন ছিলেন, সেটা জানা এখন আর কোনো কঠিন বিষয় নয়। তার সুযোগ্য কন্যা দীর্ঘকাল ভুংভাঙ দিয়ে সত্যিকারের ইতিহাস লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেগুলো খুঁজে বের করাই যায়। পিনাকী ভট্টাচার্যের ইউটিউবে লেকচারেও তার কিছু নমুনা আমরা শুনতে পাব। ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে হেন কোনো অপকর্ম নাই, যা শেখ মুজিব করেননি। বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে তিনি দেশের গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করেন। দেশকে শোষণমুক্ত করতেই সেনাবাহিনীর কয়েকজনের কর্নেল সেই সময় এগিয়ে আসেন। পিতা-কন্যার পারম্পর্য এই বাংলা বুকে আবার আমরা দেখেছি দীর্ঘ পনেরা বছরের স্বৈরশাসনে। ভারতের বগল-দাবায় বসে মুজিব-কন্যা দেশকে ভারতের ক্রীড়ানক করে তুলেছিলেন। দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিক এসব বিষয়ে ওয়াকিবহাল। তার লুটপাটের কীর্তি এখন সর্বজন বিদিত। এই প্রেক্ষাপটে দেশের প্রতি প্রগাঢ় অনুভূতি থেকে সাজ্জাদ আশা করেন, ১৫ আগস্টের মতো আরেকটি নতুন ভোরের। ‘বিপ্লবের পদধ্বনি’ কবিতায় সাজ্জাদ লেখেন:

যিনি মেঘ, বৃষ্টি, ঝড় দিয়েছেন
তিনি প্রত্যাশিত সূর্যও দেবেন

আসবে নতুন দিন, নতুন জোয়ার
ভেসে উঠবে পলি, চাষের যোগ্য হিয়ে, দিকে দিকে

শোনা যাবে, যাচ্ছে, নতুন কোলাহল, মুখরিত গ্রাম-নগর

এই জুলাইয়ে। চব্বিশের মধ্য জুলাইয়ে।
বিপ্লবের পদধ্বনি।

প্রকৃতির নিয়মেই জগৎ-সংসার পরিচালিত হয়। প্রকৃতি কোনো প্রকার অনিয়মই সহ্য করে না। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলে কখন কোন পথে কিভাবে প্রকৃতি প্রতিশোধ গ্রহণ করে, সেই প্রক্রিয়া বোঝার মতো সূক্ষ্ম ক্ষমতা মানুষের নেই। তবে জুলাইয়ের গণ-বিপ্লব দেখে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, অত্যাচারীর নির্ধারিত সময় এখন অতিক্রান্ত। সামনে আসছে নতুন দিনের ভোর। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের সাথে সেই ভোরের অপেক্ষায় ছিলেন আটলান্টা প্রবাসী কবি সাজ্জাদ বিপ্লব। সেখানেই তার ভর-ভরন্ত সংসার। বাংলাদেশে কখনো ফিরবেন কিনা, তা অনিশ্চিত। তবু তিনি কেন চান ডাইনির ক্ষমতাচ্যুতি? এ বিষয়ে সাজ্জাদ একটি কবিতায় লিখছেন, ‘আমি মানুষ, বিবেকহীন নই বলে চুপ থাকতে পারি না।’ চুপ কিন্তু ছিলেন এ দেশের অনেক শিল্পী ও সাহিত্যিক। দেশে থাকতে হবে জেনেও তা কেবল চুপই ছিলেন না, আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করতেও নানা অপকৌশল চালায় তারা। ‘আলো আসবেই’ গ্রুপ থেকে একদল অভিনেতা-অভিনেত্রী ও নির্মাতা কী কী মন্তব্য করেছিল, জাতি এখন সেসব জানে। অভিনেত্রী অরুণা বিশ্বাস আন্দোলনকারীদের ওপর হেলিকপ্টার থেকে গরম পানি ঢেলে দিতে বলেছিলেন। অবশ্য তার প্রাণপ্রিয় নেত্রীর মতো অরুণাও এখন দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এসব নপুংশক ও নতজানু শিল্পী-সাহিত্যিকদের বিরুদ্ধে সাজ্জাদ তার কবিতায় তীব্র শ্লেষ উৎপাদন করেছেন। ক্ষমতার উচ্ছিষ্টে প্রতিপালিত হওয়া যাদের স্বভাব তারা সব সরকারের আমলেই পোষ্যবাহিনীতে অংশ নেয়। এরপর চাটতে থাকে ক্ষমতাধরের চরণামৃত। বাইরে থেকে মানুষের মতো দেখতে হলেও এরা প্রকৃতপ্রস্তাবে মানুষ নয়, সারমেয়। সাজ্জাদ এ সব সারমেয়কে ঘেন্না করেন। তাই তার প্রতিবাদ কেবল ফ্যাসিস্টেও বিরুদ্ধেই নয়, ফ্যাসিস্টকে টিকিয়ে রাখতে যারা নিজের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে, তাদের বিরুদ্ধেও।
স্বৈরাচার শেষমেষ দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু এরপর? ‘বিজয়’ কবিতাটিতে এই প্রশ্নের চমৎকার জবাব দিয়েছেন সাজ্জাদ।

কোনো বিজয়ই শেষ কথা নয়

এখনো অনেক পথ যেতে হবে
পার হতে হবে অনেক ঝড় ও ঝঞ্ঝা

মাড়াতে হবে অনেক কাঁটা
আসবে অনেক খানাখন্দ

অনেক ধোঁকা অনেক অন্ধকার
অনেক মিথ্যা আশ্বাস, ফাঁকা বুলি

প্রলোভন প্ররোচনা
ঘুরবে তোমার আশেপাশে

তুমি থাকবে অটল।

রাষ্ট্র-ক্ষমতা খুবই বিপজ্জনক একটি অধিষ্ঠান। নিজের ওপর যার নিয়ন্ত্রণ নেই, এই ক্ষমতা তাকে স্বৈরাচার বানিয়ে দ্যায়। সাজ্জাদ এই সত্য জানেন বলেই তিনি বিজয়কে শেষ হিসেবে দেখছেন না। বরং দূরদর্শী দৃষ্টিতে তিনি দেখতে পাচ্ছেন আমাদের সামনে দীর্ঘ পথ। পথের বাঁকে বাঁকে রাজনীতির ধোঁকা লুকিয়ে রয়েছে। সাধারণ মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে রাজনীতিবিদরা আবারও দেশকে লুটপাটে নামতে পারে। সেই সম্ভাবনা রয়েই যায়। ফলে সাজ্জাদ ‘মানুষ-ফুল’ কবিতায় লিখছেন, ‘আর কোনো বিভেদ নয়/এসো ঐক্য গড়ে তুলি।’ গণমানুষের মুক্তির মূলমন্ত্রই আসলে এই ঐক্য। দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোনো শাসকই ফ্যাসিস্ট হতে পারে না। হওয়া সম্ভব নয়।
বইয়ের কবিতাগুলো গণমানুষের কবিতা। গণ-আন্দোলনের কবিতা। প্রাঞ্জল ভাষায় গড়ে ওঠা কবিতাগুলো অবয়বে ছোট-ছোট। কিন্তু উপলব্ধির ব্যপ্তিতে বিস্তৃত। কবিতার শব্দগুলো যেন বারুদের এক-একটি খণ্ড। সময়ের দরকারে নিজের থেকেই ঝলসে ওঠে। তবে নিভে যায় না। পাঠকের চেতনার জগতে মজুদ হয়ে থাকে আগামীর কোনো আরেক সময়ে ঝলসে উঠবে বলে। সেই অর্থে এই বইয়ের কবিতাগুলোর আবেদন বিশেষ কোনো সময়ের নয়, চিরকালের।

আরও পড়তে পারেন

5 COMMENTS

  1. চমৎকার আলোচনা।কবি ও আলোচক উভয়কে অভিনন্দন।

  2. ভালো লেগেছে।
    জুলাই এর সাথে তাঁর আত্মীয়তা গৌরবজনক।

  3. আলোচনাটি ভালো লাগলো। কবি ও আলোচকের জন্যে অনেক শুভকামনা।

  4. চমৎকার আলোচনা করেছেন। নব্বই দশকের কবিদের নিয়ে আলোচনার বই করুন ভালো হবে।

  5. কবি আবু তাহের সরফরাজের আলোচনা বরাবরই চমৎকার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on কবিতার স্ফুলিঙ্গ, স্ফুলিঙ্গের কবিতা