মীর সালমান শামিল
ক.
পূর্ব বাংলা স্বাধীন হয়ে এই মানচিত্র পেয়েছে ১৯৪৭ সালে।
তবে এই স্বাধীনতা বির্তকমুক্ত ছিল না। বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা ভারত ভাগ চায়নি। পূর্ব বাংলার আনুমানিক ২০ থেকে ২৫ ভাগ মানুষ ভারতের অঙ্গ রাজ্য হতে চেয়েছিলো। সিলেট ভারত অধিরাজ্যের সাথে যুক্ত হবে কি না তা নির্ধারণে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ও ৭ জুলাই গণভোট হয়। ভারতের অঙ্গরাজ্য হবার পক্ষে ভোট দেয় ৪৩ ভাগ মানুষ।
১৯৭১ সালে ভারত এবং অখন্ড ভারতপন্থীরা ধোঁকা দিয়ে আমাদেরকে দিয়ে যুদ্ধ করায়ে দেশকে ভারতের উপনিবেশ বানিয়ে নিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য সেই আধিপত্যবাদ এবং অখন্ড ভারত। এই সত্য উপলব্ধি করতে না পারলে আপনি এগাতে পারবেন না।
এই কথা বললেই অনেকে ধর্ম টেনে আনে। এটা ধর্মের কথা না ভাইজান, এটা রাজনীতি। এই রাজনীতি না বুঝলে বুঝবেন না আপনি কোন ফাঁদে আটকা আছেন। ৭১ সালে স্বাধীনতার প্রলোভন দেখিয়ে ভারতের উপনিবেশ বানানো হয়েছে।
ভারতের নেতারা দিনরাত এটা বলে। নেহেরু ডকট্রিন রেকর্ডেড। এরপরেও আপনি বুঝবেন না, না বোঝার ভান করে থাকবেন।
বাংলাদেশে ভারত তার উপনিবেশিক আধিপত্যবাদ কায়েম করেছে ৩ টা পয়েন্ট সামনে রেখেছে।
১। রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদ: আওয়ামী লীগ এবং মুজিবকে সামনে রেখে।
২। সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ: রবীন্দ্রনাথকে সামনে রেখে।
৩। মিডিয়ার ফ্যাসিবাদ: প্রথম আলো— ডেইলি স্টারকে সামনে রেখে।
খ.
শুধু আজকের সমস্যা না, বাংলার গত প্রায় ৩০০ বছরের যাবতীয় সমস্যার জন্য দায়ী ভারতের বর্ণ হিন্দুদের স্বার্থপরতা।
১৭৫৭ সাল নিয়ে আমরা মীরজাফরের মুণ্ডপাত করি, সেটা অবশ্যই ঠিক আছে, তবে পলাশীর মূল নাটের গুরু ছিল জগৎ শেঠ। তৎকালীন দুনিয়ার টপ-৫ ধনী ব্যক্তির একজন এই মাল্টি বিলোনিয়ার পলাশী ষড়যন্ত্রের যাবতীয় কূটচাল চালে।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলার মুসলমানেরা অর্থনৈতিকভাবে একটু সুবিধা পায়। কলিকাতার হিন্দুরা এটা সহ্য করতে পারেনি, বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তৈরি করে ফ্যানাটিক স-ন্ত্রা-সী দল। একের পর এক মিছিল, মিটিং, হামলা করে তারা বঙ্গভঙ্গ রদ করিয়ে নেয়। তারা এত সহিংস আন্দোলন করেছিলো যে ব্রিটিশরা তড়িঘড়ি করে, নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই রাজধানী কলিকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর করে।
এরপর ঢাকায় একটা বিশ্ববিদ্যালয় হবে সেটাও বর্ণ হিন্দুরা মানতে পারে নাই!! আবার শুরু করে মিছিল-মিটিং। রমেশচন্দ্র মজুমদার জীবনের স্মৃতি দ্বীপে বইতে লিখেছেন কলিকাতার যারা আগে কখনো কোন মিছিলে যায়নি তারাও রাস্তায় নেমে আসে। অন্যবর্ণের হিন্দুদের নেতা সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাস এই বিরোধিতার কারন ব্যাখ্যা করেছিলেন;
❝ পূর্ব বাংলায় তো সব মুসলমানের বাস। মুসলমান লেখাপড়া শিখলে তো কায়েদ বর্ণের মর্যাদা থাকে না, মান থাকে না, সম্মান থাকে না। মুসলমানের ছেলে ডাক্তার আবার ব্রাহ্মণের ছেলেও ডাক্তার। এটা হলে কি ব্রাহ্মণের জাত-মান থাকে? থাকে না। ❞
তাই বর্ণ হিন্দু চামারেরা বিক্ষোভ করে গেছে মাসের পর মাস। ১৮ বার স্মারকলিপি দিয়েছে ব্রিটিশ সরকারের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বন্ধ করতে! কি ভয়ংকর, নোংরা উগ্রবাদী ভাবা যায়!?
আর একটা জিনিস মনে রাখবেন,
❝ ভারত ভাগ করেছে বর্ণ হিন্দুরা। মুসলিম লীগ ভারত ভাগ করেনি ❞
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রস্তাব করেছিলেন স্বাধীন ভারতে পাঁচটি প্রদেশ হবে। তিনটি হবে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং দুইটি হবে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ, এতে হিন্দু-মুসলমানদের একটা অর্গানিক সম্প্রীতি বজায় থাকবে। একমাত্র অর্থ, বিদেশ নীতি, এবং দেশরক্ষা থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে। অন্য বিষয়ে প্রদেশগুলো আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রদেশগুলোর মত স্বাধীনতা ভোগ করবে। দেশের নাম হবে ইউনাইটেড স্টেটস অব ইন্ডিয়া বা ভারত যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু হিন্দুরা এটাও মেনে নিতে পারে নাই। দেশের দুইটা অংশ যবন মুসলমানদের হাতে ছেড়ে দেবো! তারা চেয়েছিল ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া সাম্রাজ্যে নতুন সম্রাট হয়ে বসতে। গান্ধী এবং নেহেরু প্রস্তাব নিয়ে কথা না বলে জিন্নাহকে লোভ দেখায়, আপনি হবেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যতদিন ইচ্ছা প্রধানমন্ত্রী থাকবেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলাফল ভারত ভাগ।
বাংলাও ভাগ করেছিল হিন্দুরা, মুসলমানরা না। কায়েদে আজম প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলা এবং আসাম মিলে হবে একটি দেশ। এই দেশে মুসলমান এবং হিন্দুর রেশিও হবে ৬৫:৩৫। কিন্তু মন্ত্রী পরিষদে হিন্দু এবং মুসলমানের সংখ্যা থাকবে ৫০:৫০, প্রধানমন্ত্রী হবে মুসলমান। কায়েদে আজম এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী চেষ্টা করেন এই দেশের জন্য। তবে কংগ্রেসের সব বর্ণ হিন্দু এমপিরা ভোটাভুটি করে বাংলা ভেঙ্গে ভারতে যোগ দেয়(নেহেরু ডকট্রিনে ছিল ভারত কিছুদিনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নেবে)। এই শয়তানগুলো কয়েক বছর আগে বঙ্গভঙ্গ রদ করেছিল আর তারাই বাংলা ভাগ করে।
আজ এই ২০২৪ সালেও দেশের সমস্যার জন্য ভারত দায়ী। এরা বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব স্বীকারই করে না। পার্লামেন্টের খোদাই করে একটা মানচিত্র টানিয়ে রেখেছে, যেখানে বাংলাদেশকে ভারতের অংশ দেখানো হয়েছে। তাদের পররাষ্ট্র নীতির যাবতীয় শক্তি ব্যবহার করে একের পর এক ভুয়া নির্বাচন করিয়ে জনবিচ্ছিন্ন, দুর্নীতিবাজ, স্বৈরাচার ডাইনি হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখেছিলো গত ১৬ বছর।
এর কারন ভারতের বর্ণ হিন্দুরা বাংলাদেশের মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সুশাসনের অধিকারকে স্বীকারই করে না। তাই হাসিনার পতন মেনে নিতে পারছে না। একের পর অপকর্ম করেই যাচ্ছে।
শক্তিই শক্তিকে সমীহ করে৷ ভারতকে থামানোর এই একটাই উপায়…
গ.
উপমহাদেশের গত ১২০০ বছরের ইতিহাসে মুসলমান সালতানাতগুলোর সাথে হিন্দু রাজাদের যুদ্ধে জেতার রেকর্ড একেবারেই নগন্য, যদিও এই এলাকায় ৮০ ভাগের বেশি মানুষ হিন্দু। এর বড় কারন হিন্দু মেটাফিজিক্স। হিন্দু মেটা ফিজিক্স বিশ্বাস করে ইনকারনেশন বা পূর্ণজন্ম তত্ত্বে। একবার জন্ম নেবেন, মারা যাবেন, আবার জন্ম নেবেন। এভাবে সাতবার মানুষ হিসেবে জন্ম নিতে পারবেন।
একজন হিন্দুর মেটাফিজিক্যাল জার্নি হল জীবাত্নার চক্র থেকে মুক্ত হয়ে পরম আত্নার সাথে মিলিত হওয়া। যুদ্ধে মৃত্যু হলে জন্ম-পূর্নজন্মের চক্রে হিন্দুর কোন লাভ নাই।
এখানে পাপ-পূর্ণ দেখা হয় কর্মফল তত্ত্ব দিয়ে। যদি এই জন্মে একটা খারাপ কাজ করেন তাহলে পরের জন্মে সমপরিমাণ শাস্তি পাবেন। অর্থাৎ, পুরস্কার এবং তিরস্কারের পরিমানটা কমপোনেনশিয়াল।
এজন্য তাদের যুদ্ধে যাবার কোন মোটিভেশন নাই। এবং এমনকি যুদ্ধ মরা যাওয়াকে মাহাত্ম্য দেবার মত কোন শব্দও হিন্দু মেটাফিজিক্সে নাই।
এছাড়া হিন্দু মেটাফিজিক্স অনুসারে যুদ্ধ করবে শুধুমাত্র ক্ষত্রিয়রা। আর যুদ্ধে মানুষ মারা যাবেই। এটাকে অনেকটা স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে গন্য করা হয়। অন্যবর্ণের হিন্দুদের যুদ্ধে যাওয়ার তেমন মোটিভেশানও নাই।
অন্যদিকে মুসলমানদের যুদ্ধে যাবার মোটিভেশন সর্বোচ্চ। আপনি যদি যুদ্ধে মারা যান, আপনার মর্যাদা একদম অন্য লেভেলে৷ আপনাকে বলা হবে শহীদ মানে সাক্ষী। আপনি আল্লাহর সাক্ষী! অর্থাৎ সর্ব শক্তিমান আল্লাহর কাছে আপনার ভিভিআইপি স্ট্যাটাস। একজন পরহেজগার মুসলমানেরও সাধারণ মৃত্যু হলে অনেকগুলো স্টেশন পার করতে হবে: কবর, প্রশ্ন-উত্তর, ইল্লিন-সিজ্জিল, হাশর, পুলসিরাত এরপর জান্নাত: বিশাল ঝক্কি। তবে শহীদ হলে মৃত্যুর পর সরাসরি বেহেশত, মাঝখানে কোন স্টেশন নাই। এজন্য সালমান মুক্তাদিরের মত প্রিভিলিজড মিডিলক্লাস সেকুলারও বলে আন্দোলনে মরে গেলে গেলাম৷ মরে গেলে শহীদ হব আর শহীদের মর্যাদা সবচেয়ে বেশি।
………..
লেখক : গবেষক, ব্রেমেন ইউনিভার্সিটি, জার্মানি।