আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
মৃত্যু থেকে কে না বাঁচতে চায়? চার মাসের কিছু বেশি সময় আগে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বাংলাদেশের স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। গতকাল দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন দুই যুগ ধরে গায়ের জোরে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখা সিরিয়ায় একনায়ক বাশার আল-আসাদ। কেউই দেশের জন্য, দেশবাসীর জন্য মরতে বুক চিতিয়ে দেয় না। যারা স্বৈরাচারী হয়ে উঠেন, তাদের মুখে ‘দেশের জন্য দেশের মাটিতে মরার’ সদম্ভ ভাষণ, অনেকটা রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের মতো ব্যাপার। বলতে হয়, তাই তারা বলেন। এমন কথাবার্তা বললে মুর্খ জনগণ খুশি হয়।
বাশার আল আসাদ কি বলতেন? “আমি সিরীয়! সিরিয়া আমাকে তৈরি করেছে। আমি সিরিয়ায় থাকব এবং আমি সিরিয়ার মাটিতে মরব।” এই স্বৈরশাসক আরও বলতেন, “একটি জাহাজের ক্যাপ্টেন তার নিজের মৃত্যু বা জীবন নিয়ে ভাবেন না, তিনি তার জাহাজ রক্ষা করার কথা ভাবেন।” এমন ধারার কথা শেখ হাসিনা যখন তখন বলেছেন: “শেখ হাসিনা পালায় না। শেখের বেটি পালায় না। আওয়ামী লীগ কখনো পালায় না, পালিয়ে যায়নি কখনো।” কিন্তু আওয়ামী লীগের ইতিহাস যে পালিয়ে যাওয়ার এবং পালিয়ে থাকার ইতিহাস ১৯৭৫ এর আগস্টের পর দলটির সকল পর্যায়ের নেতারা আরেকবার প্রমাণ করলেন চার মাস আগে।
শক্তিবলে, বিরোধীদের কঠোর হাতে দমন করে বাশার আল আসাদের পিতা ৩১ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। ২০০০ সালে যখন তার মৃত্যু হয়, তখনও তার তাবেদাররা বাশারকে ক্ষমতায় আনার পথ সৃষ্টি করে সংবিধান সংশোধন করে। সংবিধান অনুযায়ী সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য বয়সের বিধান ছিল ন্যূনতম ৪০ বছর। পিতার মৃত্যুর সময় বাশার আল-আসাদের বয়স ছিল ৩৪ বছর। সংবিধান সংশোধন করে প্রেসিডেন্ট হওয়ার ন্যূনতম বয়স ৪০ থেকে কমিয়ে ৩৪ বছর করা হয়। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সিরিয়ার পার্লামেন্টের সময় লেগেছিল ২২ মিনিট।
পাঠকদের চোখে কি বাংলাদেশের চিত্র ভেসে উঠে না? বাংলাদেশে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে একদলীয় বাকশাল কায়েমের জন্য সংবিধান সংশোধনী করতে জাতীয় সংসদের সময় লেগেছিল ১৩ মিনিট। বাকশালই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল শেখ মুজিবের এবং দেশেরও। নিজের ক্ষমতা না বাড়িয়ে তিনি যদি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করে তুলতেন, তাহলে বাংলাদেশকে আজ এ দিন দেখতে হতো না।
তবুও ক্ষমতায় থাকা যায় না। শাসক স্বৈরাচারী হয়ে উঠলেই তার পতনের সকল রাস্তা উন্মুক্ত হয়ে যায়। মানুষ হত্যা করেও পতন ঠেকানো যায় না। পলায়ন অনিবার্য হয়ে উঠে। শেখ হাসিনাকেও পালাতে হয়, বাশার আল-আসাদকেও পালাতে হয়। না পালালে সাদ্দাম হোসেনের মতো ফাঁসিতে ঝুলে মরতে হয়, অথবা গাদ্দাফির মতো বিক্ষুব্ধ সৈন্য বা জনতার পিটুনি খেয়ে মরতে হয়। অতএব, ‘য: পলায়তি, স: জীবতি,’ – যে পালায় সেই বাঁচে।
কিন্তু আসলে কি কেউ বাঁচতে পারে? অথবা মৃত্যু থেকে কে কাকে বাঁচাতে পারে? তবে সৎকর্মে কিছু পাপ স্খালনের সম্ভাবনা আছে
ইহুদিদের পবিত্র গ্রন্থ তালমুদে বলা হয়েছে:
‘মৃত্যু যখন মানুষকে সৃষ্টিকর্তার কাছে হাজির হওয়ার জন্য তলব করে, তখন তার তিনটি বন্ধু থাকে :
*প্রথমটি হচ্ছে, অর্থযা সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। কিন্তু অর্থ তাকে এক পা-ও সঙ্গ দিতে পারে না।
*দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তার আত্মীয়স্বজন। কিন্তু তারা তাকে শুধু কবর পর্যন্ত সঙ্গ দিতে পারে এবং বিচারকের সামনে তাকে রক্ষা করতে পারে না।
*তৃতীয়টি হচ্ছে: যে বিষয়টি সম্পর্কে তার ধারণা কখনো ভালো নয়, তা হচ্ছে তার ভালো কাজ, যা তার সঙ্গে যেতে পারে এবং বিচারকের সামনে সেগুলো উপস্থিত হয়ে তাকে মুক্ত করতে পারে।’