আবু তাহের তারেক
আমরা যারা সাহিত্যে পড়াশোনা করছি, আমরা ক্রিটিকাল এপ্রেসিয়েশন নামে একটা বস্তু পাঠ করছি। এইখানে, বিভিন্ন কবিতারে কাইটা ছিইড়া বিশ্লেষণ করা হয়। ইশকুল কলেজেও, একই জিনিস করানি হয় অবশ্য। তফাৎ হইল, লিটারারি টার্মস এন্ডস ফিগারের সহযোগে, সাহিত্যের উচ্চতর ক্লাশে যেইভাবে ব্যাখ্যা করতে হয়, নিচের ক্লাশগুলাতে আমরা সেইভাবে করি না। ( অন্তত, বাংলাদেশে।)
একটা কবিতার মিনিং কি, তা কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না। কিন্তুক, একটা কবিতার সম্ভ্যাব্য কি কি মিনিং হইতে পারে, তা আমরা আলবত বলতে পারি। এখন, এইগুলা কিভাবে বলতে পারি?
এইটা খুব সহজে বুঝতে পারবেন না, যদি সাহিত্যের ভাষা কি জিনিস, বা সাহিত্যে ভাষার রাজনীতি কি, তা আপনে কিছুটা না বুঝেন। একটা কবিতায় কবি কি বর্ণনা করতেছে, কুন ভংগিমায় করতেছেন, কি কি লিটারারি ফিগার ইউজ করতেছেন, কবিতার মূলভাবের লগে তাদের সকলের সংযোগ কেমন, তার মাধ্যমে কবিতার উদ্দ্যেশ্য ও স্বার্থকতা নির্ণিত হয়।
সিঁথি কবিতা গঠনগতভাবে, মানে দৃশ্যত, খুব রিলাক্সড। ছন্দের বান্ধন খুব একটা যুতসই নায়। কবিতার একটা অংশের লগে আরেকটা অংশের সুর তাল লয় আর ভাবের মিলন অল্প।
এই কবিতায় রস হিসাবে রুদ্ররসের উপস্থিতি সেইমত নাই। যেই দুই এক জায়গায় রুদ্র রসের হালকা দেখা মিলে, সেইগুলা করুণ রসের ছায়াতলে মুখ ঢাকে, আল্টিমেইটলি।
কবিতার টাইটেল কবিতার উদ্দ্যেশ্য আর মর্ম বিষয়ে অনেক কথা বলে। রোবায়েতের এই কবিতায়ও, সিঁথিই এইখানে সবচাইতে বড় ‘রূপক’। তিনি বাংলাদেশকে একটা নারী হিসাবে পারসনিফাইড করছেন। কল্পনায়, তার সিঁথিতে ‘অক্ত’ বা সিন্দুর আঁকছেন। ফলত, এই কবিতায় নুসরাত, রংপুর, কওমি তরুণ- এরা কেউ সিঁথির মত প্রবল না। অন্য কথায়, সিঁথি এবং সিন্দুর (অক্ত) ছাড়া এই কবিতায় আর কুনু প্রভাবশালী ইমেইজ নাই।
অন্যদিকে, ভাবের দিক থেকে, এই কবিতায় দার্শনিক বোঝাপড়া তেমন একটা নাই। মানে, আর দশটা সাধারণ বিপ্লবী কবিতার মতই, অক্ত মক্ত লইয়া কথা-বারতা।
এই কবিতা কি জুলাইয়ের রুদ্রমূর্তি ধারণ করে? জুলাই যদি তৃতীয় স্বাধীনতার মতন বড়, প্রভাবশালী, শক্তিমান ঘটনা হইয়া থাকে, এই কবিতা কি সেই শক্তিরে ধারণ করতে সক্ষম?
এতবড় একটা বিপ্লব নিয়া কবিতা। তার নাম হইল ‘সিঁথি’! এছাড়া, পুরা কবিতা ইনাইয়া বিনাইয়া গান গাইতে গাইতে, শেষ করল একটা বাংলাদেশের ছবি আইকা, যার কপালে সিন্দুর!
হাসান রোবায়েতের বিষয়ে উনার আগের মেন্টর, বড়ভাই, সোহেল হাসান গালিব বলছিল, রোবায়েত নাকি এখনকার কবিদের মৈদ্যে সবচাইতে বেশী ‘অসাম্প্রদায়িক’! কতটুকু কলকাতা একজন রাইটারের মাথায় ঢুকানো থাকলে, এখনো কেউ এই টার্মে কথা বলতে পছন্দ করবে!
রোবায়েত যে অসাম্প্রয়িক, এই বেপারটা সে আসলে, খুব প্রমাণ করতে চায়। আমার অনুমান এমন। (এইটা আসলে, একটা কবিরে এইভাবে প্রমাণ করতে হয় না)
তো, ‘অসাম্প্রদায়িক’ রোবায়েত বলতে পারে, কওমি তরুণ যদি আসে, তাইলে পরে, সিন্দুর পিন্দানো বাংলাদেশ আসলে কি সমস্যা! এইটা একটা খুব জটিল প্রশ্ন বটে! এত জটিল যে, অনেকেই বুঝেন না, পয়লা বৈশাখিতে মুসলমানরা ‘বৈশাগী র্যালি’ সানন্দে করতে যায়, কিন্তুক, ‘মংগল শোভাযাত্রায়’ সেই তারাই নাক সিঁটকায়।
কবিতার লগে কালচারাল পলিটিকসের যোগ বেশী কারণেই, ইফতেখার জামিলের মতন একজন আলিম, হাসান রোবায়েতরে এই সময়ের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী ভাবাদর্শ ধারণকারী কবি মনে করেন। মানে, কবিতা ত কবিতাই। কিন্তুক, যখন সে মুসলমানের রীতি-নীতিরে তার অংগে ধারণ করে, তখন সে আরো ‘স্পেশাল’, আরো ‘কালার’ যোগ করে। ঠিক যেমন, ‘বইশাগী র্যালি’ যতটা নিরীহ, মংগল শোভাযাত্রা ততটাই ছংগিল।
‘২৪ এর আন্দলন, আমরা জানি, মূলত পতিবেশী গোখরুর লগে আমরার একটা মরণপণ লড়াই আছিল। এই লড়াইয়ে, আমরার রক্ষাকর্তা হিসাবে, ইসলামের একটা প্রবল প্রতাপ ভূমিকা আছে। পুব বাংলার মানুষের মুসলমান পরিচয়, তাদের রক্ষাকবচও বটে।
এই পুব বাংলার মানুষের সাম্প্রতিক সময়ের সবচাইতে বড় লড়াই নিয়া লেখা কবিতায় সবচাইতে বড় ইমেইজ হইল সিন্দুর পিন্দা মাথা! এই লড়াই কি শেষ পর্যন্ত, প্রতীক হিসাবে, আমরারে তথাকথিত ‘দেশভাগের’ মেমোরির দিকে নিয়া যায় না!
রোবায়েত, মনে হয়, সরলসোজা এক বান্দা। যে ভাজা মাছটা উল্টাইয়া খাইতে জানে না। যিনি ‘কাব্যসাধনা’ করেন। কিন্তুক, কাব্যই যে ন্যারেটিভের আদিমাতা, উনি তা জানেন না! একটা ইমেইজ কালেকটিভ আনকনশাসের কত ডিপে যাইতে পারে, এবং তা কত বড় পলিটিকাল ঢেউ তুলতে পারে, তা উনি বুঝি বুঝতে অপরাগ!
সিঁথি কবিতা কারা পছন্দ করছে, কুন ক্রাইটেরিয়ায় পছন্দ করছে, এইটা জানা আমাদের আশু দরকার। বাংলাদেশের মাথায় যে সিন্দুর পিন্দাইতে চায়, মানে, যারা এই সিদুরমাখা কবিতা বাচ্ছাদেরকে খাওয়াইতে চায়, তারা রোবায়েতের চাইতে বেশী পলিটিকাল বৈকী! এদেরকে লোকেইট করতে হবে, জরুরী ভিত্তিতে।
এছাড়া, খালি ক্লাস সেভেনরেই বা কেন জুলাইয়ের কবিতা পাঠ করতে হইব। অন্যান্য ক্লাশদের আপত্তি কি, তাও আমরার জানা দরকার। কেন সকল ক্লাশেই বিপ্লবী লিটারেচার থাকবে না!
নিচে, আমাদের বন্ধু, হাসান রোবায়েতের তথাকথিত বিপ্লবী কবিতা রাখা হইল-
সিঁথি
হাসান রোবায়েত
ভাই মরল রংপুরে সেই
রংপুরই তো বাংলাদেশ
নুসরাতেরা আগুন দিল
দোজখ যেন ছড়ায় কেশ।
কওমি তরুণ দাঁড়ায়া ছিল
কারবালারই ফোরাতে
শাহাদাতের আগুন দিয়া
খুনির আরশ পোড়াতে।
লাশের মিছিল, গণকবর
খুনির কাতান শাড়িতে
যাত্রাবাড়ি ডুইবা গেল
আজরাইলের ফাঁড়িতে।
চিরকালই স্বাধীনতা
আসে এমন রীতিতে
কত রক্ত লাইগা আছে
বাংলাদেশের সিঁথিতে।