মীর সালমান শামিল
২৫ তারিখ কিভাবে ক্রিসমাস হল এই ব্যাপারে পরিস্কার ধারনা না থাকলে ভুল বোঝার সম্ভাবনা শতভাগ। এমনকি সৈয়দ মুজতবা আলীর মত মানুষও কনফিউজড ছিলেন। তিনি দেশ-বিদেশে বইতে ২৫ ডিসেম্বর নিয়ে খোঁচা দিয়েছেন ইসলাম এবং খৃষ্টিয়ানিটি দুইটা ধর্মকেই। কারন জিসাস ক্রাইস্ট আ. এর জন্মের ব্যাপারে বাইবেলের গসপেল অব লুকের বর্ণনা—
❝ জিসাস জন্মের সময় একদল মেষ পালক তাদের ভেড়ার পাল নিয়ে বেথেলহামের পাশেই ছিল। একজন দেবদূত তাদের কাছে গিয়ে জিসাসের জন্মের সুখবর দেন। ❞ [২:৯:৮]
কুরআনের সূরা মরিয়মের ২২-২৭ নম্বর আয়াত থেকে ঈসা মসিহ আ. এর জন্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে, মারিয়াম আ. মরুভূমিতে গিয়ে একটি খেজুর গাছের নিচে ছায়ায় ঈসা আ: জন্ম দেন।
মুজতবা আলীর যুক্তি হল ডিসেম্বরে ফিলিস্তিনে বরফ পরা ঠান্ডায় সব ঘাস ধূসর হয়ে তুষারের নিচে চাপা পরে। এই শীতে কোন রাখাল ভেড়া নিয়ে মাঠে থাকে না। কিংবা এই ভয়াবহ শীতে কিভাবে একটা শিশুর জন্ম হয় খেজুর গাছের তলায়? বইতে তিনি নিজেই নিজের সাথে কথা বলছেন এই ভাবে—
❝…মা মেরি ও যিশুর যে গল্প বললে সে হল বাইবেলি কিচ্ছা। মুসলমান-শাস্ত্রে আছে, বিবি মরিয়ম খেজুরগাছের তলায় ইসা-মসিহকে প্রসব করেছিলেন।
বিবেকবুদ্ধি- সে কী কথা! ডিসেম্বরের শীতে মা মেরি গাছ তলায়?
বেয়াড়া মন- কেন বাপু, তোমার বাইবেলেই তো রয়েছে, প্রভু জন্মগ্রহন করলে পর দেবদূতরা সেই সুসামাচার মাঠের মাঝখানে গিয়ে রাখাল ছেলেদের জানালেন। গয়লার ছেলে যদি শীতের রাতে মাঠে কাটাতে পারে, তবে ছুতারের বউই পারবে না কেন। শুনি? তার ওপর গর্ভযন্ত্রণা-সর্বাঙ্গে তখন গলগল করে ঘাম ছোটে!!
ধর্ম নিয়ে তর্কাতর্কি আমি আদপেই পছন্দ করিনে। দু-জনকে দুই ধমক দিয়ে চোখ বন্ধ করলুম ❞ [পৃ: ৪৯]
অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই মুজতবা আলীর যুক্তি অকাট্য। বরফ পরা শীতে এ দুটোই অসম্ভব। তবে মজার ব্যাপার হল বাইবেল বা কুরআনে জিসাস ক্রাইস্টের জন্ম কি মাস বা কোন তারিখে হয়েছে সে ব্যাপারে কোন উল্লেখ নেই। তাহলে কিভাবে ২৫ ডিসেম্বর ক্রিসমাস ডে শুরু হল?
◾
খৃষ্ঠধর্মের ইতিহাসে অনান্য ধর্মের মত বেশ কিছু বড় বড় মোড় আছে। ঈসা আ. এর পরে সেন্ট পল খৃষ্ঠধর্মের সবচেয়ে প্রভাবশালি ব্যক্তি। সেন্ট পল খৃষ্ঠধর্মে বেশ কিছু সংস্কার আনেন। খৃষ্ঠধর্মের একাধিক ধারা চালু হয়। যেমন জেমস ধারা, বারনাবাস ধারা, পলিন ধারা ইত্যাদি। সেন্ট পলের মূল কথা ছিল, জিসাস এসেছেন পূর্বের সব আইন বন্ধ করতে।
তখনো ট্রিনিটির ধারনা ছিল না খৃষ্ঠধর্মে। পলিন খৃষ্টিয়ানিটিতে ট্রিনিটি ধরনাটি দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষের দশকে চালু হয়। সেন্ট আগস্টিন এবং সেন্ট টেরটোলিয়ান ট্রিনিটি ধারনা প্রতিষ্ঠার পেছনে সবচেয়ে প্রভাবশালি ব্যক্তিত্ব হিসেবে ধরা হয়। ক্রমেই পলিন খৃষ্টিয়ানিটি সবচেয়ে প্রভাবশালী ধারায় পরিণত হয়। সম্রাট কন্টাসটাইন রোমান সাম্রাজ্যের সংহতি রক্ষার্থে খৃষ্ঠধর্ম গ্রহণ করেন। কন্টাসটাইন ৩৩০ সালে তুরস্কের নাইসির শহরে খৃষ্ঠধর্মের সব ধারার ধর্ম গুরুদের নিয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেন এবং তাদের দ্বায়িত্ব দেন খৃষ্টিয়ানিটির একটি একক ধারা নির্ধারন করতে। এই সম্মেলন ঐতিহাসিক নাইসির সম্মেলন নামে পরিচিত।
এই সম্মেলনের বেশিরভাগ ধর্মগুরু পলিন খৃষ্টিয়ানিটিকে খৃষ্ঠধর্মের বিশুদ্ধতম রুপ হিসেবে মত দেন। তবে সবাই নয়। সেন্ট আরিয়াস এর প্রবল বিরোধিতা করেন। আরিয়াসের বিরোধিতা প্রবল মতের সামনে টেকে না। সম্মেলন সংখ্যা গরিষ্ঠায় পলিন খৃষ্টিয়ানিটিকে খৃষ্ঠধর্মের একক রুপ হিসেবে গ্রহন করে।
সম্রাট কন্টাসটাইন অন্য সব ধারার যাবতীয় লিটারেচারকে নষ্ট করার আদেশ দেন। আরিয়াস নাইসির থেকে পালিয়ে সিরিয়ার দিকে চলে যান। তাকে আর পাওয়া যায়নি। এবং ট্রিনিটি খৃষ্ঠ ধর্ম বিশ্বাসের একটি মৌলিক উপাদানে পরিনিত হয়।
[ নোট: আরিয়াস ট্রিনিটি মতবাদে বিশ্বাসি ছিলেন না। ৭ম শতাব্দীতে ব্রাজেন্টাইন ইতিহাসবেত্তা এবং থিয়োলজিয়ান সাপতায়াজ ভি “ইসলামকে” অভিহিত করেছিলেন “আরিয়াস খৃষ্ঠিনিয়াটি” এর পরবর্তি রুপ হিসেবে- Continuation of Arious Christianity ]।
◾
ইউরোপের প্যাগানদের খৃষ্টধর্মের অধীনে একত্রিত করতে কন্টাসটাইনের একটা উৎসবের দরকার ছিলো।
প্রাচীন কালে পুরো ইউরোপে প্যাগানদের মধ্যে ডিসেম্বরের শেষের দিকে বেশ কয়েকটা উৎসব প্রচলিত ছিল। উত্তর গোলার্ধে ২২ ডিসেম্বর সবচেয়ে ছোট দিন এবং বড় রাত। তারা ভাবতো, সূর্য দেবতার অসুখ হয়েছে। তারা পুজা করতো যেন সূর্য আবার সুস্থ হয় উঠে তারাতারি। সবুজ গাছের ডাল ছিল সেই উৎসবের একটা প্রধান অনুষঙ্গ। সবুজ ডাল মনে করিয়ে দিতো, আবার সূর্য আলো দেবে, তুষার কেটে সুবুজে ভরে যাবে। [ক্রিসমার্স ট্রি এই উৎসব থেকেই নেওয়া।]
স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলোতে এই সময়ে শীতকালে খাবার জন্য প্রচুর প্রাণী জবেহ করে মাংস সংরক্ষণ করা হতো। বছরের এই সময়ে তারা তাজা মাংস পেতো। এই সময়েই ওয়াইন এবং বিয়ার ফ্রাগমেন্ট হয়ে খাবার উপযোগী হতো। জার্মান প্যাগানরা তাদের প্রাচীন দেবতা ওডেনের উপাসনা করে উৎসব করতো এই সময়েই।
তবে এ সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব ছিল রোমে। ১৭ থেকে ২৫ ডিসেম্বর, এক সপ্তাহব্যাপী এই উৎসবের নাম ছিল সাটুরনালিয়া[Saturnalia]। এটা ছিল রোমের সবচেয়ে বড় উৎসব। প্যাগান রোমানদের কৃষি দেবতা স্যাটানের সম্মানে ছিল এই উৎসব।
সম্রাট কন্টাসটাইনের থিংক ট্যাংক সবদিক বিবেচনা করে সাটুরনালিয়ার শেষ দিনকে জিসাসের জন্মদিন হিসেবে ঘোষণা করে। প্রথমে চার্চ একে স্বীকৃতি দেয়নি। কয়েক বছর পরে পোপ জুলিয়াস ২৫ ডিসেম্বরকে জিসাসের জন্ম তারিখ বলে ঘোষণা করে।
ট্রিনিটি অর্থ ঈশ্বরের তিনটি রুপ। পিতা, পুত্র এবং পবিত্র আত্না। তাদের ন্যারেটিভ হল পবিত্র আত্নার স্পর্শে ডিসেম্বরের ২৫ তারিখে জিসাস ক্রাইস্ট আ. কুমারি মা মেরির গর্ভে জন্ম গ্রহন করেন। জিসাস হলেন ঈশ্বরের পুত্র এবং তিনিই হলেন ঈশ্বর।
এই তথ্যগুলো গোপন কিছু না। সব তথ্য অন্তজালে আছে। ক্যাথলিক চার্চের সবচেয়ে বড় ধর্মগুরু, ঈশ্বরের ছায়া (shadow of God) পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট তার ‘Jesus of Nazareth’ বইতে উল্লেখ করেছেন, ২৫ ডিসেম্বর যে জিসাস জন্ম নিয়েছেন এ ব্যাপারে কোন প্রমান নেই।
তাহলে প্রশ্ন তারপরেও কেন খৃষ্টানরা এই দিন উদযাপন করে!? উত্তর হল, ইসলাম ধর্মে বিদাত বলে একটা তত্ত্ব আছে। সহজ করে বললে এই তত্ত্ব অনুসারে মুসলমানরা কুরআন বা হাদিসে উল্লেখ নেই এমন কোন আচারকে কখনো, কোনভাবেই ধর্মীয় আচার হিসেবে পালন করতে পারবে না। এটা ইসলামে বেশ কঠিন ভাবে মানা হয়। তবে খৃষ্টান ধর্মে এমন কিছু নেই। যদি কোন একটা অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায় এবং সেটা ভাল হয় তাহলে খৃষ্টান ধর্মতত্ত্ব অনুসারে সেই উৎসব পালনে কোন সমস্যা নেই। তাই তারা ক্রিসমাস ডে বা বড়দিন পালন করে।
প্রশ্ন হল তাই বলে সব খৃষ্টানই এটা মেনে নিল? উত্তর হল না। ইংল্যান্ড এবং আমেরিকার পিউরিটান খৃষ্টানেরা প্রবলভাবে ক্রিসমাসের বিরোধী ছিল। আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস শহর ১৬২৬ সালে ক্রিসমাস পালন নিষিদ্ধ করেছিলো।
আরেকটা বিষয় উল্লেখ্য শুধুমাত্র ওয়েস্টার্ন খৃষ্টানেরা ২৫ ডিসেম্বর ক্রিসমাস ডে পালন করে ইস্টার্ন খৃষ্টানেরা (অর্থোডক্স, আরমেনিয়ান, ওরিয়েন্টাল এবং কাপটিক খ্রিষ্টানেরা) পালন করে জানুয়ারি ৬ এবং ৭ ।
লেখক : গবেষক : ব্রেমেন ইউনিভার্সিটি, জার্মানি।