কাজী জহিরুল ইসলাম
পড়াশুনা করেছেন ইংরেজী সাহিত্যে কিন্তু হয়েছেন প্রকৃতিপ্রেমিক এবং পরে প্রকৃতিবিজ্ঞানী। প্রকৃতিবিজ্ঞান বিষয়ে পরে নিশ্চয়ই তিনি একাডেমিক পড়াশুনাও করেছেন, আর এ বিষয়ে তাঁর মুক্ত জ্ঞান চর্চা ছিল নিরন্তর। ঘুরেছেন পৃথিবীর নানান দেশে, হাওরে-বিলে পড়ে থেকেছেন মাসের পর মাস, চোখে বাইনোকুলার, খুঁজছেন বিরলতম বিহঙ্গপ্রজাতীর ডানা, চঞ্চু, জীবনাচার। এতো দেশ বিদেশ ঘুরলেও, সব সময় বলতেন, জহির, আমি মুন্সিগঞ্জেই চলে যাব। হ্যাঁ, তিনি ঢাকা শহরের ঝলমলে পরিবেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মুন্সিগঞ্জেই চলে গেছেন।
মুন্সিগঞ্জের এই মহামুন্সির সঙ্গে আমার পরিচয় হয় আশির দশকে, তাঁর বন্ধু ছড়াকার শহীদুল্লাহ সবুজ তাঁকে নিয়ে আসেন বাড্ডায়, কবি জসীম উদদীন পরিষদে। তখন তিনি শিল্প-সাহিত্যের একজন অনুরাগী মানুষ ছিলেন। এরপর দীর্ঘ দীর্ঘ বিরতি, তাঁর সঙ্গে আর দেখা নেই।
নব্বুইয়ের দশকের শেষের দিকে তিনি রীতিমতো স্টার, শীতকাল এলেই টিভিতে তাঁর মুখ, বাইনোকুলারে চোখ, মাথায় হ্যাট, ছুটছেন বিল থেকে বিলে, হাওর থেকে হাওরে। পাখিবিদ সাজাহান সরদারের নাম কে না জানে তখন। শুধু যে পাখি দেখছেন, পাখি নিধন বন্ধের জন্য বক্তৃতা করছেন সভা-সমাবেশে তাই নয়, লিখছেনও দুই হাতে। কত কত পাখি এই দেশে, কত কত পাখি উড়ে আসে ভিন দেশ থেকে, তিনি আমাদের চিনিয়ে দিচ্ছেন সেইসব পাখি, জানাচ্ছেন তাঁদের বংশ পরিচয়, উৎপত্তির ইতিহাস, খাদ্য, আবাস, নাম-ধাম আরো কত কী। তাঁর রচিত পাখিবিষয়ক গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের পাখি’ বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ হয়ে ওঠে পাখিপ্রেমিদের কাছে।
২০০৩-এর এপ্রিল মাসে আমি কসোভো থেকে ফিরে আসি। যোগ দেই ঢাকাস্থ ইউএনডিপি অফিসে। নিকেতনে ফ্ল্যাট কিনেছি, আমাদের ছোট্ট পাখির নীড় নিকেতনে, সেই পাখির বাসায় একটি পক্ষিশাবক অগ্নি, জল আসি আসি করছে। ডাক্তারের কড়া নির্দেশ, সুখের চর্বি গলাতে হবে, সকালবেলার আরামের ঘুম হারাম করে হাঁটতে হবে। হাঁটতে বেরিয়েই দেখি সাজাহান সরদার, এতো বছরে আমার গায়ে অনেক মাংস হয়েছে, গাল ফুলেছে, কিন্তু তিনি ঠিকই চিনে ফেলেছেন। তিনিও নিকেতনে থাকেন। ব্যাস, সেদিন থেকে সাজাহান সরদার আমার প্রতিদিনের বন্ধু, আড্ডাজন। তাঁর উৎসাহে আমি দুটি কাজ করেছি, একটি হচ্ছে রোজ সকালে ১ ঘণ্টা হাঁটা আর পত্রিকায় কলাম লেখা। তিনি তখন সাপ্তাহিক খবরের কাগজে একটি কলাম লিখতেন। আমাকে বলেন, আপনি লিখতে পারেন, আমি উৎসাহী হই, এ-ফোর সাইজের তিন পাতা হাতে লিখে তাঁকে দেই। তিনি বলেন, পত্রিকায় জমা দেবার আগে আমি পড়ে দেখি, দরকার হলে ভাষাটা এডিট করে দেব। আমি মনে মনে হাসি। তিনি পরদিন আমাকে বলেন, কলম ছোঁয়ানোর জায়গা পেলাম না, আপনার গদ্য আমার চেয়েও ভালো। আমি তাঁকে কিছু বলি না। লেখাটি ছাপা হয় এবং আমাকে নিয়মিত কলাম লেখার অনুরোধ করা হয়। আমি মেঘনা কাজী ছদ্মনামে সাপ্তাহিক ‘খবরের কাগজ’ (দৈনিক আজকের কাগজ গ্রুপের) পত্রিকাটিতে কলাম লিখতে শুরু করি। কারণ তখন বিএনপি সরকারের কট্টর সমালোচনা করতাম কলামটিতে, ঢাকাস্থ জাতিসংঘে কাজ করে তা করা কঠিন ছিল।
একদিন তিনি আমাকে নিয়ে যান দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকায়। দেখা হয় অনু হোসেনের সাথে। আমি সাথে করে ৩/৪টি কবিতা নিয়ে যাই। কবিতাগুলো অনু হোসেনকে দেই। তিনি আমার কবিতা আগে পড়েননি, আমার নামও শোনেননি। কিছুক্ষণের আলাপচারিতায় বুঝলাম তিনি লিটলম্যাগ কেন্দ্রীক লেখক/কবি। আমাকে বলেন, আপনি তো লিটল ম্যাগে লেখেন না, এ-কারণে আমাদের অভিমান থাকতেই পারে। না, তিনি অভিমান করে আমার কবিতা ছাপা বন্ধ রাখেননি, কবিতাগুলো ভোরের কাগজের সাহিত্য পাতায় ছেপেছেন। সম্ভবত ওই একবারই আমি ভোরের কাগজে কবিতা দিয়েছি। অনু হোসেনের কথায় আমি লিটল ম্যাগে লিখতে অনুপ্রাণিত হই। ঢাকা এবং কোলকাতার বেশ কিছু পত্রিকায় সেই সপ্তাহেই কবিতা পাঠাই। প্রায় সবগুলোই ছাপা হয়। তাঁর মধ্যে খন্দকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত একবিংশ-তে একগুচ্ছ এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত কৃত্তিবাস-এ একগুচ্ছ ছাপা হয়। একবিংশ আমি পেয়েছি এবং দেখেছি কিন্তু কৃত্তিবাস দেখিনি, কৃত্তিবাসে কবিতা ছাপা হওয়ার খবরটি আমাকে জানান কবি জাহিদ হায়দার। একবিংশ-তে যে আমার একগুচ্ছ কবিতা ছাপা হয়েছে সেটি কিভাবে জানতে পারি সেটাও এক মজার ঘটনা। বইমেলায় কবি মারুফ রায়হানের হাতে একবিংশ, আমি নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখছি। দেখি সেখানে আমার একগুচ্ছ কবিতা। মারুফ রায়হান দেখে বলেন, আশরাফ ভাই তো এখনো আমার একগুচ্ছ ছাপেনি। অবশ্য এর পরে আমি আর কখনো একবিংশ-তে কবিতা পাঠাইনি।
সাজাহান ভাই আমাকে পাখিপ্রেমিক বানিয়ে ছাড়েন, বৃক্ষপ্রেমিক বানিয়ে ছাড়েন। যেখানেই যান, আমাকে যেতে হবে। আমিও যেখানেই যাই তাঁকে সাথে করে নিয়ে যাই। নেচার কনজারভেশন মুভমেন্ট, বার্ড ওয়াচার ক্লাব প্রভৃতি সংগঠনের তিনি প্রধান ব্যক্তি, কোনো কোনোটার তিনিই জন্মদাতা। সেইসব সংগঠনের বড় ধরণের অনুষ্ঠান যখন হয়, তিনি আমাকে বলেন অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে, আমি সানন্দে তা করি। অনুষ্ঠান শেষ হলে তিনি বলেন সবাই বলেছে, আপনি বেস্ট উপস্থাপক। আমি খুশি হই। প্রথম প্রথম দেখেছি তাঁর অনুষ্ঠানগুলো খুব হযবরলভাবে হয়। এর কারণ হল, তিনিই একমাত্র অর্গানাইজার এবং তিনিই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক। তিনি যখন সঞ্চালনায় থাকেন তখন অন্যকিছু সামলানোর কেউ থাকে না। তাঁকে এই অবস্থা থেকে বাঁচাতে আমিই সঞ্চালনার দায়িত্বটি নিই। প্রথমবার নেবার পরে এটি অবধারিত হয়ে যায় যে সব অনুষ্ঠান আমিই সঞ্চালনা করব। তিনি বোটানিক্যাল গার্ডেনে পহেলা জৈষ্ঠ তারিখে শুরু করেন ‘হিজল বরুণ কদম উৎসব’। সেই উৎসবে আমি কবি আল মাহমুদকে নিয়ে যাই, কারণ মাহমুদ ভাইও তখন আমার খুব কাছের মানুষ। প্রকৃতপক্ষে আমি, সাজাহান সরদার আর আল মাহমুদ প্রায় প্রতি সপ্তাহেই এক সঙ্গে হতাম, আড্ডা দিতাম। হিজল বরুণ কদম উৎসবে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, আল মাহমুদ, সমুদ্র গুপ্ত এবং আমি বক্তৃতা করি।
একদিন সকালে এসে বলেন, কাল সকালে চিড়িয়াখানায় যেতে হবে, চিড়িয়াখানায় অনেক অতিথি পাখি এসেছে। আমরা ঘটা করে পাখি দেখতে যাই। সকল ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সাজাহান সরদার সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন, পাখিদের প্রজাতিতত্ব ব্যাখ্যা করেন, আচার আচরণ ব্যাখ্যা করেন।
রোজ সকাল ছয়টায় তিনি এসে আমার ঘুম ভাঙান। আমরা একসাথে হাঁটতে বের হই, হেঁটে এসে দেখি মুক্তি টেবিল সাজিয়ে রেখেছেন। আমরা একসাথে নাস্তা খাই, চা খাই, শুক্র-শনিবারে তা চলে দীর্ঘ সময় অব্দি। কখনো কখনো ড্রাইভারকে বলি, যাও, মাহমুদ ভাইকে নিয়ে এসো, তখন তিনজন আড্ডা জমিয়ে তুমি। মাহমুদ ভাই একদিন বলেন, সরদার তুমি কি কি পাখির মাংস খেয়েছো? সাজাহান ভাই এতে দারুণ ক্ষেপে যান। আমি পাখির জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন দিচ্ছি আর আপনি আমাকে পাখিহত্যার কথা বলেন! সাজাহান ভাই ভীষণ রগচটা মানুষ। তিনি যখন-তখন ক্ষেপে যান, যার-তার ওপর ক্ষেপে যান। শুধু আমার ওপর কোনোদিন ক্ষেপেননি। একদিন তাঁকে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক একটি সভায় দাওয়াত দেই। সেখানে দুজন মন্ত্রীও ছিলেন। মন্ত্রীরা পরিবেশ বিষয়ে ভুল-ভাল বলছিলেন, সাজাহান ভাই দাঁড়িয়ে চিৎকার করে তাঁর প্রতিবাদ করেন, শুধু প্রতিবাদ করেই থেমে যাননি, ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে মঞ্চের দিকে এগুতে থাকেন। তখন কয়েকজন তাঁকে জাপটে ধরেন এবং আমি লজ্জা পেয়ে যাই ঘটনার আকস্মিকতায়, কারণ তিনি ছিলেন আমার অতিথি। শুধু এই ঘটনাই নয়, বন বিভাগের মহাপরিচালক, পরিবেশ মন্ত্রী, সচিব সকলেই তাঁর ভয়ে তটস্থ থাকতেন। তিনি অনেকগুলো পরিবেশ বিষয়ক জাতীয় কমিটির সদস্য ছিলেন, সেইসব সভায় তাঁকে সামলাতেই নীতিনির্ধারকদের হিমশিম খেতে হত।
একদিন আমি ভুল করে তাঁর নাম লিখি সাজাহান সর্দার। তিনি হাসতে হাসতে বলেন, আমারে তো ডাকাইতের সর্দার বানাইয়া দিলেন। আমিও হাসি, বলি, নাকের ওপর কাটা দাগ, গোঁফ, বড় বড় চোখ আর মেজাজ, সব মিলিয়ে ডাকাতের সর্দার হওয়ার যোগ্যতা আপনার পুরোপুরি আছে। এ-জাতীয় রসিকতা তাঁর সাথে করতে আমার কোনো দ্বিধা ছিল না, যদিও অন্য সকলেই তাঁর সঙ্গে খুব মেপে কথা বলতেন। আমার আত্মবিশ্বাস ছিল যে তিনি এটা ভালো করেই বোঝেন আমি তাঁকে ভালোবাসি, এবং এই ভালোবাসা খুব সহজেই ভাঙবে না। তিনি সব সময় অর্গানিক খাবার খুঁজতেন। বাসায় ফ্রিজ রাখতেন না। ফ্রিজে রাখা খাবার খেতেন না। আমাকে এক শনিবারে বলেন, জহির চলেন, আজ আমি আপনাকে বাজার করে দেব। আমরা গুলশান এক-এর ডিসিসি মার্কেটে যাই। তিনি আমাকে খুঁজে খুঁজে ছোটো মাছ, লতি, সরিষা শাক, ছোটো ছোটো পিয়াজ এইসব বেঁছে বেঁছে কিনতে সাহায্য করেন। সেদিন দুপুরে আমাদের বাসায় অর্গানিক এবং দেশি ভোজ।
সাজাহান ভাই মদের আসরে অতি অল্পতেই মাতাল হয়ে যেতেন এবং তখন তাঁর একটা গেঁয়ো মেজাজ বেরিয়ে আসত, অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে শুরু করতেন। এমন না যে যাকে অপছন্দ করেন শুধু তাকেই গালি দিচ্ছেন, যে কাউকে এবং যে কোনো বিষয় নিয়ে কথা উঠলেই গালি দিয়ে শুরু করেন এবং নেশা না কাঁটা পর্যন্ত সারাক্ষণ গালাগালির মধ্যেই থাকতেন। শুধু এই একটি কারণে আমি কিছু কিছু মদ্যপানের আসরে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো থেকে বিরত থেকেছি। বিশেষ করে যেগুলোতে ডিস্টিংগুইস্ট অতিথি থাকতেন।
হলিসউড, নিউ ইয়র্ক। ২১ মার্চ ২০১৮।
অসাধারণ একটি লেখা ।
মুগ্ধ হলাম।