spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদবই নিয়েকবি প্রকাশনী সংস্করণ প্রকাশের লগ্নে

লিখেছেন : আহমাদ মাযহার

কবি প্রকাশনী সংস্করণ প্রকাশের লগ্নে

যেভাবে লেখা হলো ‘ছড়াতত্ত্ব ছড়াশিল্প’ বইটি

আহমাদ মাযহার 

আমার লেখালিখির শুরু ছড়া দিয়েই। প্রথম বইও ছড়া-কবিতার। এরপর ছড়া লেখায় দীর্ঘ ভাটা পড়লেও ছড়াপাঠ বন্ধ থাকেনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছেলেভুলানো ছড়া’, যোগীন্দ্রনাথ সরকার সংকলিত বাংলার অন্যতম সেরা লোকায়ত সাহিত্যের সংকলন ‘খুকুমনির ছড়া’র ভূমিকায় রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী ও অন্নদাশঙ্কর রায়ের ভূমিকা, অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘ছড়াসমগ্র’-র ভূমিকা সব সময় এর তাত্ত্বিক দিক অনুধাবনে আমার সহযোগী হয়েছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে কর্মসূত্রে বিচিত্র ছড়া পাঠ করতে হয়েছে নানা সংকলনের জন্য লেখা সংগ্রহ ও বাছাইয়ে নানাজনকে সহযোগিতা করতে গিয়ে। ছড়ার বিষয় ও আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমার শিক্ষক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গেও বিভিন্ন সময় হয়েছে দীর্ঘ আলোচনা। সেই সব আলোচনায় তাঁর সঙ্গে আমার দুই বন্ধু দেশের অন্যতম সেরা দুই ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন ও আমীরুল ইসলামকেও পেয়েছি অধিকাংশ সময়। এ ছাড়া ছড়ার রূপ ও রীতি, এর নান্দনতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে তাঁদের দুজনের সঙ্গে কত যে তর্ক হয়েছে! নব্বইয়ের দশকে ‘কিশোর-কবিতা’ নাম দিয়ে ছড়ার সঙ্গে এর পার্থক্য নির্দেশ করার একটা প্রচেষ্টা চলে। যাঁরা এ প্রচেষ্টার নেতৃত্বে ছিলেন তাঁদের অনেকেরই সঙ্গে এ নিয়ে তর্ক হয়েছে। প্রায় এক দশক ধরে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বিভিন্ন শহর থেকে প্রকাশিত ছড়াবিষয়ক সংকলনের অনেক লেখায় যে ছড়াভাবনা বৃত্তাবদ্ধ থাকতে দেখেছি তাতেও আমার মনে নানা প্রশ্ন জেগেছে। এই সব কিছু মিলেমিশে আমার মনে গড়ে উঠেছে ছড়ার শৈল্পিক রূপ সম্পর্কে ধারণা। ২০০৯ সালে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও সংকলনে ছড়া সম্পর্কে লেখার আহ্বান পেয়ে এ বিষয়ে পর পর কয়েকটি রচনা লিখি। একটির পিঠে আরেকটি করতে করতে ওই বছরই ছয়টি রচনা লেখা হয়ে যায়। ২০১০ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত ছড়া উৎসবের সেমিনারের জন্য আহ্বান পাই প্রবন্ধ পাঠের। লিখে ফেলি আরো একটি প্রবন্ধ। রচনাগুলো লেখার সময় মনে রেখেছিলাম একটিতে যেন অন্যটির বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। পুনরাবৃত্তি পুরোপুরি এড়ানো না গেলেও পরিপ্রেক্ষিতের ভিন্নতায় বক্তব্যের খানিকটা প্রতিসরণ ঘটাতে পেরেছি বলে মনে করি। 

এগুলো যখন লেখা হচ্ছিল তখনো ছড়া নিয়ে আস্ত একটা বই প্রকাশের কথা আমার মনে আসেনি। গত বছর বইমেলার মাস দুয়েক আগে রচনাগুলো গোছাতে গিয়ে এ রকম একটা রচনা সংকলনের ধারণা মনে আসে। দেখলাম এলোমেলোভাবে থাকা লেখাগুলো একত্র করে দিলে ঠিক সামগ্রিকতা আসে না। তখন আমার পুরনো লেখার তহবিলে হাত দিলাম। মনে পড়ল যে কয়েক বছর আগে থেকে লুৎফর রহমান রিটনের বিভিন্ন ছড়ার বইয়ের জন্য ফ্ল্যাপের ভাষ্য রচনা করেছি। আমার সম্পাদিত বই-সমালোচনার সংকলন ‘বইয়ের জগৎ’-এর প্রথম সংকলনের জন্য তাঁর স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত ছড়ার বই ‘ধিতাং ধিতাং’ (২০০৮)-এর যে সমালোচনা লিখেছিলাম তার সঙ্গে তাঁর বইয়ের জন্য লেখা ফ্ল্যাপভাষ্যগুলো সংস্কার করে অনেকটা কোলাজের মতো জুড়ে দিয়ে সম্পন্নতর করার চেষ্টা করলাম রচনাটি। নাম দিলাম ‘লুৎফর রহমান রিটনের ছড়া : স্বাতন্ত্র্যের সূত্র’। আমীরুল ইসলামের ‘ছড়া আমাকে আদর দিও’ (২০০৯) বইটি আমার ছড়াভাবনাকে উসকে দিয়েছিল। ‘বইয়ের জগৎ’-এর প্রথম সংকলনে এ বইটিরও সমালোচনা লিখেছিলাম। মনে পড়ল এ ছাড়াও আমীরুল ইসলামের ছড়ার সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে ‘আমীরুল ইসলামের ছড়া : বিচিত্র ও বহুবর্ণ বিভা’ নামে সূত্রাকারে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম আমার ‘শিশুসাহিত্যের রূপরেখা’ (২০০৯) বইয়ে। অন্তর্ভুক্ত করে নিলাম ওই প্রবন্ধটিও। সব রচনা একত্রে নিয়ে বিন্যস্ত করতে গিয়ে মনে হলো এগুলো দুই ভাগে ভাগ করে নেওয়া যায়। একটি ভাগের বিষয় মূলত ছড়ার রূপের সন্ধান–অর্থাৎ কাকে ছড়া বলব কাকে বলব না, কোনটাকে আধুনিক ছড়া বলব কোনটাকে বলব না, লোকছড়ার রূপ থেকেই কিভাবে বিবর্তিত হয়ে রূপ পেল আধুনিক ছড়া, বাংলাদেশের ছড়ার সাম্প্রতিক বৈশিষ্ট্যগুলো কী–এসব নিয়ে পর্যালোচনা। এককথায় বলতে গেলে ছড়া সম্পর্কে যেসব তাত্ত্বিক ভাবনা আছে সেগুলো নিয়ে কথা বলা হয়েছে এগুলোতে। আরেকটি পর্ব সরাসরি মূল্যায়নের। দুই ভাগে ভাগ করার পর মনে হলো সংকলনটিতে আমার ছড়াচিন্তার একটা সামগ্রিকতা এসেছে। প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের আহমেদুর রশীদ টুটুলকে বললাম আমার একটা পাণ্ডুলিপি রূপ পেয়েছে ছড়া বিষয়ে। প্রকাশকেরা ছড়ার বই প্রকাশ করতে চান না অলংকরণসহ মুদ্রণের ব্যয়বহুলতার জন্য। সাধারণ পাঠকের কৌতূহল ছড়া বিষয়ে কতটুকুইবা! দু-চারজন ছড়াকার ছাড়া এ বিষয়ের প্রন্ধের বই কে পড়বে? এই দুর্ভাবনার কথাও বললাম তাঁকে। তা সত্ত্বেও টুটুল পিছ-পা হলেন না। ‘ছড়াতত্ত্ব ছড়াশিল্প’ প্রকাশের পর বইমেলায় শুদ্ধস্বরের স্টলে তরুণতর ছড়াকারদের কেউ কেউ নাকি বলেছেন, আমি এ বইয়ের মধ্য দিয়ে কেবল বন্ধুকৃত্যই করেছি। তাঁদের উদ্দেশে আমার কথা এই যে, ছড়া সম্পর্কে আমার চিন্তার যদি কোনো সারবস্তু থেকে থাকে তাহলে তা গড়ে উঠেছে বাংলা ছড়ার চিরায়ত ও আধুনিক ছড়াকারদের ছড়া পড়ে। আমার সমসাময়িক কালের ছড়াকারদের মধ্যেই নয় কেবল এ দুই ছড়াকারকে আমি সমগ্র আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচ্য সবচেয়ে প্রতিভাবানদের দলে ফেলি। ছড়া বিচারের ধারাবাহিকতায় সমসাময়িকদের মধ্যে অগ্রবর্তীদের কথা বলতে হবে বলেই তাঁদের সম্পর্কে লিখেছি। কোন নান্দনিক বিবেচনা থেকে তাঁদের কথা আলাদাভাবে লিখেছি তা এ বইয়ের ‘ছড়ার খোঁজে’ পর্বের লেখাগুলো পড়লেও হয়তো কিছুটা অনুধাবন করা যাবে।

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২

পুনশ্চ: প্রকাশের পর পরই বইটি নিয়ে তপন বাগচী কালের কণ্ঠ পত্রিকায় একটি আলোচনা লিখেছিলেন ২০১২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। বইটি নিয়ে অনেক ভালো ভালো কথা বলেছিলেন তপন। 

অনুজপ্রতিম আবদুল্লাহ আল মোহনের নেতৃত্বে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রাক্তনীদের একটি দলের উদ্যোগে আমার এই বইটি নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করেছিলেন। কোনো কেনো ছড়ালেখক দেখেছিলেন খানিকটা তির্যক দৃষ্টিতে–মোটামুটি ২ সমসাময়িক ছড়াকার বন্ধুতে আমার বিশ্লেষণ সীমিত রাখার অভিযোগে আমাকে অভিযুক্ত করেন তাঁদের কেউ কেউ। তাঁদের অভিযোগ আমলে নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখি তার কিছুকাল পরে। কবি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিতব্য বর্তমান সংস্করণে সেটিও যোগ করে দিচ্ছি! অভিযোগের তাতে নিশ্চয় অবসান হবে না, কিন্তু অভিযোগটি যে আমলে নেয়া হয়েছে সে ইশারা হয়তো অভিযোগ কারী পাঠকদের কেউ কেউ পাবেন!

প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ করে দিয়েছিলেন লুৎফর রহমান রিটন–যাঁকে আমি শিশুকালে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া চিত্রকর হিসাবেই প্রধানত চিনতাম। নতুন প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হচ্ছে বলে প্রচ্ছদটা বদলাতে হলো। তবে সব্যসাচী হাজরার বইনকশার ক্রিয়াকরস্পর্শ পাওয়ার মতো সৌভাগ্যের ঘটনায় পুরোনো প্রচ্ছদ হারানোর বেদনা টপকানো আনন্দে আমি আনন্দিত!

পুন পুনশ্চ

দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের লগ্নে আরেকজনের কথা না বললেই নয়! ব্যক্তিগতভাবে সৈকত হাবিব বইটির বেশ সমাদর করেছিলেন। প্রকৃতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশ করবেন বলে রয়্যালটি বাবদ আমাকে অগ্রিম টাকাও দিয়ে রেখেছিলেন। নানা বাস্তবতায় কয়েক বছর আন্তরিক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বইটি তিনি প্রকাশ করতে না পেরে অন্য সংস্থা থেকে প্রকাশের অনুমতি দিয়ে আমাকে ঋণগ্রস্ত করে রাখলেন। এবার আমি ঢাকায় গেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করে টাকা ফেরত দিয়ে সে ঋণ স্বীকারের চেষ্টা করব!

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on কবিতার স্ফুলিঙ্গ, স্ফুলিঙ্গের কবিতা