১। আপনার প্রথম প্রকাশিত বই কোনটি? কবে প্রকাশিত হয়েছিল? প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি কেমন ছিল?
১৭৩ পৃষ্ঠার আমার প্রথম বইটির নাম ‘কলাচ্ছলে বলা’। প্রকাশ করেছিল আগামী প্রকাশনী ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে ঢাকায় একুশের বই মেলায়। অভিজ্ঞতাটি ছিল দারুন উত্তেজনায় পূর্ণ। প্রথম কয় রাত ভাল ঘুম হয় নাই, ভালমত খেতেও পারতাম না। জেগে জেগেই স্বপ্ন দেখতাম ক্রেতাদের লম্বা লাইনটি বইমেলা প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে শাহবাগের মোড়ে চলে গেছে। একই সাথে প্রচণ্ড ভয় পেতাম বানান বা তথ্যের ভুল ধরে ওরা যদি বইটি ছুঁড়ে ফেলে দেয়! তাহলে আমার প্রথম বইটি কি ফেব্রুয়ারীতে প্রকাশিত কয়েক হাজার বইয়ের সাথে অসংখ্য বুদবুদের মতোই মিলিয়ে যাবে?
২। সাহিত্যে আপনি কার উত্তরাধিকার বহন করেন?
আমি সাহিত্যের কোন সিরিয়াস পাঠক নই । হাতের কাছে যখন যা পেয়েছি বা পাই তাই পড়েছি ও পড়ি। ফলে কখনো বিশেষ কোন লেখককে অনুসরণ করে লিখিনি। তাই কার উত্তারাধিকার বহন করছি তা বলা মুশকিল। তবে পাঠক ও সমালোচকরা কে কি বলছেন তা এখানে উল্লেখ করতে পারি।
আমার রম্য রচনাতে অনেকে সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখার সাথে সামঞ্জস্য পেয়েছেন । অন্যান্য গল্প রচনা পড়ে কারো-কারো মনে পড়েছে গাই দ্যা মোপাসা-র লেখা, কারো মনে পড়েছে ভিক্টর হিউগো-র, এবং জি কে চেস্টারটন এর লেখার কথা। কিন্তু আশ্চর্য এঁদের কারো-কারো লেখা আমি এখনো পড়িনি!
ঢাকা কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের প্রাক্তন শিক্ষক ও কলামিস্ট জিয়াউদ্দিন চৌধুরী লিখেছেন, ‘লেখক হেনরি মিলার ও শ্রীনীরদ চৌধুরীর মতোই আশরাফ লেখালেখি শুরু করেছে পরিণত বয়সে, যে বয়স মানুষকে এক অনন্য পরিপ্রেক্ষিত দান করে’।
লেখক ও কলামিস্ট ওয়াহেদ হোসেনী লিখেছেন, ‘লেখাগুলো সমাজের অনৈতিকতার লাগাম ধরে চাবুক মারার মত’।
কবি, প্রাবন্ধিক, ও দৈনিক পত্রিকার কলামিস্ট আলমগীর খান লিখেছেন, ‘প্রায় সব লেখাই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে ঘিরে কিন্তু ব্যক্তি-লেখকের উপস্থিতি তাতে গৌণ, আর থাকলেও তা এক অপরাধীর’।
আমার বিজ্ঞান বিষয়ক লেখার ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে কবি, প্রাবন্ধিক ও গীতিকার আবিদ আনোয়ার লিখেছেন, ‘আমাদের বিজ্ঞান সাহিত্য মূলত দুই ধরণের : বিজ্ঞানের নানা বিষয়য়ে কট্টর আলোচনা কিংবা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। আশরাফ আহমেদ এর লেখাগুলো এর কোন শ্রেণীতেই পড়ে না। ফলে একে বলা যায় বিজ্ঞান-সাহিত্যে এক নতুন ধরণের প্রয়াস’।
ঠিক একই কারণে মন্টগোমারি কলেজের বায়োলজি বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক রশীদুল আলম বলেছেন, ‘বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞানকে অবলম্বন করে হাস্যরসাত্মক কোন বই আজও প্রকাশিত হয় নাই। সেই হিসেবে বইটি বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন মাত্রিক লেখা, এবং আশরাফ আহমেদ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করছেন’।
কবি, প্রাবন্ধিক ভাষাতত্ত্ববিদ, ও ভয়েস অফ আমেরিকার সংবাদ ভাষ্যকার আনিস আহমেদ বলেছেন, ‘লেখক তাঁর জ্ঞানের ব্যাপ্তি থেকে আরব্যোপন্যাস, আধুনকি বৈজ্ঞানিক গবেষণা, বেঁচে থাকা বাস্তব চরিত্র, আরবি-ফারসি ভাষা, ইত্যাদি নানা জায়গা থেকে নানা তথ্য ও নানা উপাত্ত নিয়ে এসেছেন। এই তথ্য ও উপাত্তের সংমিশ্রণে ঘটেনি, তিনি সৃষ্টি করেছেন তা তাঁর নিজস্ব’। ‘এই ছোট-ছোট কথা ছোট-ছোট ফ্রেইজ দিয়ে তিনি প্রচণ্ড আঘাত হেনেছেন সমাজের কাছে, সমাজের ত্রুটি বিচ্যুতির কাছে’।
৩। এ যাবত সর্বমোট আপনার কতটি গ্রন্থ প্রকাশতি হয়েছে? এর মধ্যে কোনটি বা কোন–কোন কাজকে বা কোন বইকে আপনি আপনার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বলে মনে করেন?
ছয়টি –‘কলাচ্ছলে বলা‘, ‘জলপরি ও প্রাণপ্রভা‘, ‘অন্যচোখে বাংলাদেশ‘, ‘মার্তি মনীষের প্রেতাত্মা‘, ‘একাত্তরের হজমিওয়ালা‘, এবং‘হৃদয় বিদারক‘।
সবগুলোকেই উল্লখেযোগ্য বলে আমি মনে করি। কারণ লেখার পরিশ্রম ছাড়াও বিষয় নির্বাচনের দিক থেকে প্রতিটি বই ভিন্ন এবং বৈচিত্র্যময়। যেমন, প্রথম বইটি বিভিন্ন ধরণের লেখার সমাহার। এই বইটি পড়ে পাঠকরা কখনো হেসেছেন এবং কখনো কেঁদেছেন।
‘জলপরি ও প্রাণপ্রভা’ বিজ্ঞান-ভিত্তিক রম্যরচনা । এর মুদ্রিত কপি বাজারে আর নেই। অনেক তথ্য উল্লেখ করে ‘অন্যচোখে বাংলাদেশ’ বইতে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে বাংলাদশেরে আর্থ-সামাজিক-ভৌগলিক ও মানসকি বিবর্তনের চিত্র তুলে ধরেছি এক প্রবাসীর চোখে স্বদেশ দেখার ভেতর দিয়ে।
‘মার্তি মনীষের প্রেতাত্মা’ পর্তুগালের ইতিহাস ভিত্তিক একটি প্রেমের উপন্যাস। এই বইতে পর্তুগাল ভ্রমণকারী এক আধুনিক যুগল তাদের জীবনের, তাদের প্রতিটি পর্যবেক্ষণের প্রতিবিম্ব খুঁজতে চেয়েছেন দেশটির ইতিহাসে ফলে সৃষ্টি হয়েছে দ্বিতীয় প্রেমিক যুগলের। দ্বিতীয় যুগলের সময়কাল প্রায় এক হাজার বছর আগে, দেশটির জন্মলগ্নে ঐতিহাসিক সময়ের এই দ্বিতীয় যুগলের পুরুষ চরিত্রের নামই হচ্ছে– মার্তি মনীষ। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী সে পর্তুগালের প্রথম রাজার একজন সাহসী যোদ্ধা। তখন পর্তুগালের রাজধানী লিসবনের নাম ছিল আল উসবুনা। আল উসবুনা দুর্গের ফটকটি সে দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে খোলা রেখেছিল বলইে ইউরোপের সম্মিলিত খ্রিস্টান ক্রুসেডার বাহিনী দুর্গটির দখল নিতে পেরেছিল। ঘটেছিল অবর্ণনীয় রক্তপাত। এভাবে মুর মুসলমানদরে পতন ঘটিয়ে পর্তুগাল দেশটির জন্ম হয়ছেলি ১১৪৭ সালে। কিন্তু আমার কল্পনায় এই বইয়ে মার্তি মনীষ আবির্ভুত হয়ছেনে একজন প্রেমিক হিসেবে, একজন সংসারী হিসেবে যে তাঁর স্ত্রী-পুত্রকে ভালবাসে, মানুষকে ভালবাসে, মনুষ্যত্বকে ভালবাসে এবং পর্তুগালের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে। কোন-কোন পাঠক এই বইটিকে আমার পূর্বতন সব প্রকাশনা থেকে সবচেয়ে ভাল লেগেছে বলেছেন ।
৪। সম্প্রতি প্রকাশতি আপনার নতুন বই সম্পর্কে বলুন।
এ বছর আমার প্রকাশিত গ্রন্থ দুটি। দুটোই প্রকাশ করেছে ঢাকার ‘আগামী প্রকাশনী’।
প্রকাশ নতুন হলেও ৮৭ পৃষ্ঠার ‘একাত্তরের হজমিওয়ালা’ নামে কিশোর উপন্যাসের প্রথম পাণ্ডুলিপিটি শেষ করছেলিাম চার বছর আগে। মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব ঘটনা নিয়ে লেখা বলে তথ্যগুলো আবার যাচাই করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার এবং অভিমত নিতে মাঝের সময়টি গেছে।
গল্পটি এ রকম : ২০১৭ সালরে গ্রীষ্মে অনাথ কিশোরী ফুলবানু বৃদ্ধ হজমিওয়ালার খোঁজে জয়বাংলা আচার ঘরে ঢুকে পড়ে উঁচু তাক থেকে আচারের বয়াম নামাতে গিয়ে হাত ফসকে ভেতরের পুরনো একটি দরজা খুলে যায়। ঠিক তখন বন্দুকের ক্যাট-ক্যাট শব্দের সাথে বারুদের গন্ধের এক দমকা হাওয়া ওর গায়ে লাগলে সে ভয়ে ছুটে পালিয়ে যায়। পরে আবার এসে ভেতরে ঢুকলে সে একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে অত্যাচারিত, বন্দি এক যুবকের দেখা পায়। ফুলবানু বুঝতে পারে ঘটনাক্রমে সে এক জাদুকরী দরজার সন্ধান পেয়েছে যার ভেতর দিয়ে অনায়াসে বর্তমান থেকে অতীতে যাতায়াত করতে পারে। কাউকে বললে জাদুর গুণ চলে যাবে ভেবে ঘটনাটি গোপন রাখে। বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেতে যুবকটি সাহায্য চায়। সাহায্যের খোঁজে বেরিয়ে ফুলবানু পাকিস্তানি ধ্বংসযজ্ঞ, অত্যাচার, এবং যুদ্ধের নিদর্শন দেখতে পায়। কিন্তু ফিরে এসে দ্যাখে যাদুকরী দরজাটি কেউ ভেঙে ফেলেছে! এখন তো জাদুকরী দরজার কথা কেউ করবে না! তা হলে সবই কি ওর কল্পনা ছিল? হজমিওয়ালা লোকটিই বা কি? তাই অত্যাচারিত বন্দি যুবককে খুঁজে ওর বের করতেই হবে। ওর কাছাকাছি বয়সের কয়কেটি ছেলে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। কিন্তু সেই যুবক এখন আর যুবক নেই।
বইয়ের পরবর্তী অংশ ফুলবানুর সেই যুবককে খুঁজে পাওয়ার কাহিনী।
বাংলাদেশ এবং বিশ্বের সবকিছু আর পয়তাল্লিশ বছর আগের মত নেই। ফলে নতুন প্রজন্মের প্রয়োজন, চিন্তা ভাবনা, এবং মনমানসিকতাও আগের মত নেই। আগের তুলনায় তাদের সামনে বিনোদনমূলক কর্মকান্ডের সুযোগ অনকে বেশি আকর্ষণীয়। সে সব বিনোদনের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দিকে মনযোগ টানতে হলে কী ধরনের উপস্থাপনা ওদের উপযোগী হবে সেদিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। কিশোর বয়সের ছেলেমেয়েরা তাদের প্রিয় খেলা খেলতে গিয়ে বন্ধুদের সাথে কথা বলে বা টেলিভিশিন দেখতে মনে মনে নিজের মত কাল্পনিক জগতের চিত্র আঁকে। তাদের কল্পনার কথা মাথায় রেখেই এই কিশোর উপন্যাসটি লেখার চেষ্টা করেছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটি অলিখিত ঘটনা ও পরিপার্শ্বিকতা বর্ণনা করেছি। এই বইয়ে আমার প্রচেষ্টা ছিল নতুন প্রজন্মের পাঠকরা যেন প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কিশোর-যুবক মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝেই নিজেদের আবিষ্কার করতে পারে। এই প্রচেষ্টা কতটুকু সফল হয়েছে, কিশোর পাঠকরাই তা নির্ণয় করবে। ঢাকায় ভিকারুন্নেসা স্কুলের বার্ষিক বইমলোর প্রথম দিকেই ৩৫টি কপি বিক্রয় হয়ে গেলে পরের দুদিন অনেক ক্রেতা বইটির কিনতে চেয়েও পায়নি বলে খবর পেয়েছি।
এবার প্রকাশিত আমার ১৩৪ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় গ্রন্থের নাম ‘হৃদয় বিদারক’। রম্য রচনার আকারে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে হৃদপিখণ্ডেছি র ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে লেখা। এতে ব্যক্তির প্রতি মানুষের প্রতি সমাজের প্রতি ভালবাসা উঠে এসেছে বারবার। পৃথিবীর সব জাতিতে সব সভ্যতায় হৃদয় বা হৃদপিণ্ডকে প্রেম ও ভালবাসার উৎস এবং আধার বিবেচনা করা হয়। অথচ সেই হৃদয়টি বিশেষ খাবার বা জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে প্রেম-ভালবাসার পরিবর্তে শারিরীক যন্ত্রণা, এমন কি অসময়রে মৃত্যুকেই লালন করে থাকে আবার আদর্শ খাবারে ও জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়েও আমার মত কেউ-কেউ হৃদরোগে ভুগতে পারে। তেমনই এক মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে আমি আমার ভালবাসার জগতকে আবষ্কিার করছেলিাম, অনুভব করছেলিাম, যা স্বাভাবকি অবস্থায় কেউ করতে পারে না। হৃদপিণ্ডে অস্ত্রোপচারের আগে এবং পরে শারিরীক-মানসিক চিন্তা ও কষ্ট প্রকাশ করেছি একজন রোগীর অভিজ্ঞতায়। খটমটে ডাক্তারি সংজ্ঞা দিয়ে নয়, একজন সাধারণ মানুষের অনুভব দিয়ে হৃদরোগ-জনিত মৃত্যু বাংলাদেশের মৃত্যুর প্রধান কারণ। ফলে হৃদরোগে ভোগা ব্যক্তির সংখ্যাও পৃথিবীর অনকে দেশের চাইতে এখানে বেশি মূলতঃ সংখ্যাগরিষ্ঠ সেই গোষ্ঠীকে সামনে রেখেই গ্রন্থিত হয়েছে এই বই। এটি বোঝার এবং প্রতিকারের জন্য ডাক্তার বা বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই ।
এই বইয়ের অধিকাংশ রচনাই লিখেছিলাম প্রায় তিন বছর আগে হৃদপিণ্ডে প্রচেষ্টা অস্ত্রোপচারের পর, এবং ধারাবাহিকভাবে প্রকাশও করছেলিাম। নিকটজনকে দুশ্চিন্তায় ফেলতে পারে ভেবে সাথে হাস্যকৌতুক জুড়ে দিয়েছিলাম। তা পড়ে কেউ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, কেউ আমার দাম্পত্য জীবন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। কেউ দুঃখ পেয়েছিলেন, আবার অনেকে হাসতে-হাসতে আত্মহারাও হয়েছিলেন। কয়েকটি বিবেচনা থেকে লেখাগুলোকে বই আকারে প্রকাশ করতে আমাকে অনুপ্ররেণা দেয় । প্রথমত, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে মৃত্যুর প্রধান কারণ হচ্ছে হৃদরোগ। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে ও বহির্বিশ্বে ডাক্তার ও বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিতে অনেক লেখা আছে কিন্তু হৃদরোগীর মানসিক এবং শারিরীক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে কোন লেখার কথা আমার খুব জানা নেই। তৃতীয়ত, এক পাঠক তার এক নিকট আত্মীয়ের হৃদপিণ্ডে অস্ত্রোপচারের আগে ও পরে আমার লেখা গুলো চেয়ে-চেয়ে তাকে পাঠিয়ে দেন। তখন মনে হয়ছেলি লেখা গুলো হয়তো পুরোপুরি আত্মজৈবনিক কিছু নয়। এর পর বছর দেড়েক আগে একদিন ‘আগামী প্রকাশনী’র স্বত্তাধিকারী ওসমান গনি সাহেব নিজেই হৃদরোগী হয়ে গেলেন। বিছানায় শুয়ে-শুয়ে সেই লেখা গুলো পড়ে হাসতে-হাসতে সুস্থও হয়ে উঠলেন। তিনিই এই বই প্রকাশের উৎসাহ দিয়েছেন।
৫। আপনি নিজেকে কোন দশকের কবি–লেখক বলেন? কেন?
বছর আটেক নিয়মিত বাংলায় লেখালেখি করছি সেই সুবাদে আমি এই শতাব্দির প্রথম ও দ্বিতীয় দশকের লেখক। আমার অনেক লেখায়ই অতীত এসে পড়ে। কিন্তু তা আসে বর্তমানকে বুঝতে বা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে জাবর কাটা বা চর্বিত চর্বন করার উদ্দেশ্য নয়। কাজেই আমি আমার সময়েরই সৃষ্টি ভবিষৎ নিয়ে ভাবলেও বর্তমানেরই একজন প্রতিনিধি আমি।
৬। আপনার সমকাল নিয়ে বলুন
আমার লেখালেখির সমকালে প্রযুক্তি এবং আর্থিক সচ্ছলতার কল্যাণে লেখক ও কবির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে জ্যামতিকি না হলেও গাণিতিক হারে এটি একটি ভাল লক্ষণ। আগে প্রকাশকের বিবেচনা ও করুণা-নির্ভর লেখকরা আমার সমকালে ইচ্ছামত তাদের মনোভাব প্রকাশ করছেন স্বাধীনভাবে সংখ্যায় বেশি বলে তাঁদরে মাঝ থেকে ভাল লেখকের সংখ্যাও বেশি হওয়া উচিত। ফলে তাদের থেকেই বেরিয়ে আসবে এক বা একাধিক যুগান্তরকারী লেখক। ভাল লেখা গুরুত্ব পায় না বলে অনেকে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাধিক্যকে দোষারোপ করেন। কিন্তু আপনি তো কাউকে লেখা বন্ধ করতে বলতে বা বাধ্য করতে পারেন না! আমার মনে হয় শুধু বই বেচা বা কেনা নয়, আমাদের পাঠ্যাভ্যাস বাড়িয়ে সমস্যাটির সমাধান করা উচিত।
বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির প্রসারের ফলে আজকের পাঠকের হাতে বই পড়ার বিকল্প অনেক। পকেটে নিয়ে ঘোরা একটি ছোট্ট পর্দায় সচিত্র প্রতিবেদন, সংবাদ, এবং গল্পের দিকেই তাদের ঝোঁক বেশি। রিক্সায়, গাড়িতে, বাড়িতে ,বেড়াতে, খেতে খেতে, ঘুমাতে এমন কি বাথরুমে বসেও কিছু না কিছু পড়তে, লিখতে বা দেখতে নিচ্ছে। কাজেই ছাত্রাবস্থায় আমরা যত বই পড়ছি এখনকার ছাত্রদের হাতে বই পড়ার তেমন সময় কম। অনেকে তাই বলে এবং আক্ষেপ করে থাকেন। ব্যপারটি নিয়ে লেখকদের ভাবতে হবে প্রযুক্তিগত উন্নতি,পাঠকের ব্যস্ততা ও সময় স্বল্পতার কথা মাথায় রেখে বইয়রে ভবিষ্যতের কথা আমাদের ভাবতে হবে।
৭। সাম্প্রতিক কালে কারা ভাল লিখছেন বলে মনে করেন?
সাহিত্যের ছাত্র বা কোন গোষ্ঠীবদ্ধ নই, এবং বিদেশে থাকি বলে আমি বেশির ভাগ ভাল লেখার সাথেই পরিচিত নই। কাজেই প্রকৃত সাহত্যিবোদ্ধাদের সাথে আমার পছন্দের বিস্তর পার্থক্য থাকবে। যাদের লেখা ভাল লাগে তাদের মধ্যে আছেন : অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, গোলাম মুরশিদ, শ্যামাপ্রসাদ বসু, হাসান ফেরদৌস, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, হাসনাত আবদুল হাই, হাসান আজিজুল হক, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সম্প্রতি প্রয়াত মীজান রহমান, লুৎফর রহমান রিটন, নওশাদ জামিল, আলমগীর খান, খালেদ সরফুদ্দীন, সাজ্জাদ বিপ্লব, আবু রায়হান, এবং পূরবী দত্ত। বিভিন্ন ব্লগে অনেক নবীন ও ভাল কবি লেখকের দেখা পাই। তেমনি একজন হিমু ছদ্মনামে লেখেন।
৮। কতদিন আপনার প্রবাস জীবন? কোথায় আছেন? কি করছেন? পারিবারিক পরিচিতি জানতে চাই
প্রায় উনচল্লিশ বছর। আমেরিকায় আছি চৌত্রিশ বছর থেকে মাঝের তিনটি বাদ দিয়ে মেরিল্যান্ড রাজ্যে একটি সরকারী সংস্থায় স্বাস্থ্য-বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করছি। কর্মজীবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে শুরু করছেলিাম বলে পেশাটি খুব ভাল লাগে। ফলে এদেশে একটি মেডিক্যাল স্কুলে মার্স্টাস-পিএইচডি পর্যায়ে শিক্ষকতা করেছি বছর তিনেক। এখনো কোন কোন বছর সময় পেলে স্থানীয় কলেজে একটি সেমেস্টার পড়াই। জন্ম হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, আট ভাইবোনের মাঝে পঞ্চম। শিশু ও বাল্যকাল কেটেছে কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বিয়ে করেছি ১৯৮২ সালের শেষ নাগাদ। স্ত্রী একটি বড় হাসপাতালে মাইক্রোবায়োলজিস্ট হিসেবে কাজ করেন। অবসরে কবিতা পড়েন, মাঝে মাঝে কবিতা লেখেনও। বড় ছেলে এন্ডোক্রিনোলজিস্ট ডাক্তার, বিয়ে করেছে। আমি দাদাও হয়েছি। তিন বছর আগে ছোট ছেলে ফিজিক্সে বিএস করে আমরেকিার মহাশূন্য সংস্থা নাসা-তে স্যাটলোইট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছে। গড়ে প্রতি দুই মাসে আমরা ছয়জনের সবাই একত্রে কাটাই দুই তিন দিন।
৯। প্রবাস জীবনে সাহিত্য চর্চায় প্রতিবন্ধকতা বা সুবিধা –কি কি? কোথায়?
সুবিধা হচ্ছে গতানুগতিক ধারার বাইরে থাকা যায়, প্রতিষ্ঠিত লেখকের প্রভাব বলয়ের বাইরে ফলে লেখক হিসেবে স্বকীয়তা রক্ষার সুযোগ বেশি হওয়া উচিৎ।
প্রতিবন্ধকতা অনেক প্রতিষ্ঠিত, অগ্রজপ্রতিম লেখকের অভিভাবকত্ব বা আশীর্বাদ বঞ্চিত হওয়ায় প্রবাসী সাহিত্যিকের প্রতিষ্ঠা পাওয়া কঠিন । প্রয়োজনের সময় হাতের কাছে ভাল রেফারেন্স বই পাওয়া যায় না। নিজের অনেক ভুল থাকে, তারপরও বানান এবং ফন্ট একটি বড় সমস্যা। পাণ্ডুলিপি এবং প্রুফ কয়েকবার আটলান্টিক পাড়ি দিতে গিয়ে কিম্ভুতকিমাকার ধারণ করে। বাংলা সাহিত্যের পাঠক যেহেতু বাংলাদেশেই বেশি তাদের কাছে আমি পৌঁছাতে পারি না। সাহিত্য সাময়িকী বা দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য বিভাগে লেখা পাঠিয়ে বা চিঠি লিখে কোন উত্তর পাওয়া যায় না। প্রকাশের কথা বাদই দিলাম। ফলে আমার মত প্রবাসী লেখককে দেশের কেউ চেনে না। আমার প্রকাশতি বই কয়টি বিক্রয় হলো, বা আদৌ হলো কিনা তা আজ পর্যন্ত জানতে পারলাম না।
১০। আপনি কখনো কি কোন পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন অথবা সংকলন সম্পাদনা করেছেন? বিস্তারিত বলুন।
১৯৯৫ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ওয়াশিংটন ডিসি এলাকার বাংলাদেশ এসোসিয়েশন বিএএআই এর ত্রৈমাসিক ইংরেজি মুখপত্র ‘প্রতিধ্বনি’ সম্পাদনা করেছি নিয়মিত ভাবে। সংগৃহীত সংবাদ নিজেই লিখতাম। এছাড়া প্রতি সংখ্যার জন্য স্থানীয় এক বা একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে অনেকটা জোর জবরদস্তি করে একটি রচনা আদায় করতাম, যারা এর আগে কখনো কিছু লেখেননি। ফলে লেখাটিকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, ইংরেজিতে তর্জমা, টাইপ, ও পত্রিকা ছাপানোর কাজটিও আমাকেই করতে হতো। প্রতিটি আট থেকে ষোল পৃষ্ঠার মোট ষোলটি সংখ্যা ছাড়াও দুটি ঈদ ও বৈশাখি মেলা উপলক্ষে বিশেষ বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করতাম। বিএএআই এর নিজস্ব সংবাদ ও বিজ্ঞপ্তি ছাড়াও এতে থাকতো কমিউনিটি সদস্য এবং তাদের পরবিারের সাফল্য– সুখ-দুঃখের সচিত্র সংবাদ, ইমিগ্র্যান্ট সহায়ক জানার বিষয়, এবং বাংলাদেশ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের সুচিন্তিত প্রবন্ধ। পত্রিকাটি বিদগ্ধ এবং সাধারণ পাঠকের মাঝে দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। পত্রিকাটির মাধ্যমে আমেরিকার বিভিন্ন শহরে বিএএআই এর পরিচিতি দৃঢ়তর হয়, এবং নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত, অধুনালুপ্ত বাংলা সাপ্তাহিক ‘প্রবাসী’তে এই পত্রিকা ও থেকে বিএএআই এর কর্মকাণ্ডের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছিল। আমি হাল ছেড়ে দেয়ার পর মাত্র একটি সংখ্যা প্রসবের পর এটি মৃত্যুবরণ করে ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে..।
১৯৯৮ সালে ওয়াশিংটন এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাইদের সম্মিলন উপলক্ষে স্মরণিকাটির সম্পাদক ছিলাম আমি। এখানেই বাংলায় আমার প্রথম লেখা প্রকাশ করেছিলাম। দীর্ঘ বিরতির পর গত বছরের সম্মিলন স্মারণিকাটিও সম্পাদনা করলাম যৌথভাবে। এক্ষেত্রেও জোর জবরদস্তি করে আদায় করা লেখা থেকে উন্নত মানের লেখকের জন্ম দিয়েছি।
‘দ্যা ফেন্স’ নামে একটি ইংরেজি মাসিকের সম্পাদনা বোর্ডের সদস্য ছিলাম বছর দুয়েক। ২০০৬ সাল থেকে আমি ইংরেজি ভাষার চারটি আন্তর্জাতিক গবষেণা-বিজ্ঞান সাময়িকীর সিনিয়র এডিটর বা এডিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।
১১। লিটল ম্যাগাজিনের সংজ্ঞা কি? এ নিয়ে আপনার ভাবনা বলুন।
সংজ্ঞাটি আমার জানা ছিল না। আপনার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে অন্তর্জাল ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। যা পেলাম তা হচ্ছে ‘অপরিচিত শিল্পী, কবি, এবং লেখকদের অপ্রচলিত ও সৃজনশীল সৃষ্টি সম্বলিত একটি প্রকাশনা যার কোন বাণিজ্যিক ভিত্তি বা উদ্দেশ্যে নেই’।
আরো যা বুঝলাম, ‘লিটল’ মানে এর শব্দার্থ ‘ছোট’ বোঝায় না। তবে ‘নগণ্য’ বিবেচনায় এগুলো খানদানি গ্রন্থাগারে বেশিদিন রাখা হয় না। বাণিজ্যিক স্বার্থ নেই বলে এই ধরনের ম্যাগাজিনের সম্পাদকরা আমার মত নগণ্য ‘লেখকের’ লেখা হয়তো ছাপাতে চাইবেন। লেখার গুণ এবং সময়ের বিচারে আমি অচিরেই ঝরে পড়বো, তাও জানি কিন্তু সুযোগ পেয়েছিলেন বলেই পরবর্তীতে অনেক প্রথিতযশার সাহিত্যাঙ্গণে পদার্পণ ঘটছেলি এই লিটল ম্যাগাজিনের কল্যাণেই।
কাজেই লিটল ম্যাগাজিন দীর্ঘজীবী হোক! তবে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের বয়স তো কম হলো না! বাংলায় একশ এবং পাশ্চাত্যে দেড়শ’ বছর তো হতে চললো! তাই আমি দোয়া করলেও এর আয়ূ খুব দীর্ঘায়িত হবে না। নতুন কিছু পুরাতনের স্থান দখল করে নেবে। সেটাই নিয়ম। ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীবদ্ধ অসংখ্য ব্লগ ইতোমধ্যে সেই কাজ শুরুও করে দিয়েছে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক ক্রান্তিকালে। আজকাল বিভিন্ন বৈদ্যুতিন মাধ্যমে প্রকাশ করা সহজলভ্য হওয়ায় বই, ম্যাগাজিন, বা সংবাদপত্রের মতোই মুদ্রিত লিটল ম্যাগাজিনের আয়ূও সীমিত হয়ে পড়বে। তবে পরমায়ূর কথা আলাদা। অসংখ্য অখ্যাত লেখক ও ব্যক্তির সৃষ্টিকে বাংলা ও বিশ্ব সাহিত্যের শীর্ষে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বলে লিটল ম্যাগাজিনকে শিল্পী-সাহিত্যিকরা স্মরণ করবে গভীর শ্রদ্ধার সাথে, অনন্তকাল ধরে। আমি তাকইে বলছি পরমায়ূ।
সাক্ষাৎকার গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব, ২০১৭