spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধবাংলার শ্রেষ্ঠ ছড়াকার ভবানীপ্রসাদ মজুমদার

লিখেছেন : তৈমুর খান

বাংলার শ্রেষ্ঠ ছড়াকার ভবানীপ্রসাদ মজুমদার

তৈমুর খান

বাংলার বিখ্যাত ছড়াকার ভবানীপ্রসাদ মজুমদার (বিদায় ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)। নিপাট মাটির মানুষ, খুব আন্তরিক, খুব কাছের সকলেরই আপনজন। শিশু-কিশোর থেকে বড়রাও তাঁর ছড়ায় মুগ্ধ না হয়ে পারত না। বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মুখে মুখে আবৃত্তি হত তাঁর ছড়া। শিশু মনস্তত্ত্বের উপর এতটা বেশি প্রভাব তিনি ফেলতে পেরেছিলেন।
ভবানীপ্রসাদ জন্মগ্রহণ করেছিলেন হাওড়া জেলার জগাছা থানার অন্তর্গত দাশনগরের কাছে দক্ষিণ শানপুর গ্রামে ৯ এপ্রিল ১৯৫৩ সালে। তাঁর পিতা নারায়ণচন্দ্র মজুমদার এবং মাতা নিরুপমা দেবী। কবির শৈশব জীবন তাঁর গ্রামেই কেটেছিল। পেশায় ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান শিক্ষক। কর্মস্থল ছিল হাওড়া জেলার শানপুর গ্রামের কালিতলা প্রথমিক বিদ্যালয়। পরে তিনি এই বিদ্যালয়টিরই প্রধান শিক্ষকের পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
প্রধানত ছোটদের উপযোগী মজার মজার ছড়া-কবিতা লেখায় তাঁর জুড়ি ছিল না। তাঁর প্রকাশিত ছড়ার সংখ্যা কুড়ি হাজারেরও বেশি। ছড়া নিয়ে নিরন্তর নানান রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করতে ভালোবাসতেন। তাঁর ছন্দে পর্বমিল ও অন্ত্যমিলের ব্যবহার, চলিত-সাধুরীতির শব্দগুচ্ছকে একইসঙ্গে বসানো, ছড়ার শরীর বেয়ে নির্মল হাস্যরসের প্রবাহ, ভাব-ভাষায় শ্লেষ-ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও প্রতিবাদের আমদানি, কল্পনা ও বাস্তবতাকে তুলে আনা সবকিছুতেই শিশুমন মুক্তি পেত।
ছোটরা সেই হাস্যরসের ভিয়ানে লুটোপুটি খেত, বড়োরাও তেমনি মজা পেত। নির্ভেজাল শুধু মজাই। তাঁর ছড়া-কবিতায় একদিকে সমাজমনস্কতার ছাপ, অন্যদিকে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের পাশাপাশি সৌন্দর্যের আশ্চর্য জগৎও খুলে যেত। প্রতিটি ছড়াকেই মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত আনন্দময় আধার বলেই মনে হবে। তাই ছড়াগ্রন্থগুলি স্বাদে, বৈচিত্র্যে, প্রকরণে, ভাবনায়, চরিত্রে এবং বিষয়ে সমাহারে স্বতন্ত্র। আকাশ, তারা, গ্রহ, নক্ষত্র, ফুল, পাখি, মেঘ, নদী, পশুপাখি, ভূত-পেত্নি, টিকটিকি, ব্যাং, কাক, পায়রা, চড়াই, শালিক, ছাগল, হাতি, বিড়াল, ফড়িং, স্বদেশপ্রীতি, জীবনী, স্বাস্থ্য, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান-সবই এসেছে তাঁর ছড়ায়। সব মিলিয়ে প্রায় চল্লিশ খানা ছড়াগ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন।তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল: মজার ছড়া, ছন্দ গাঁথা এ কলকাতা, যাদের বলে সমাজ চলে, যাচাই করা বাছাই ছড়া, জীবন সূর্য বাজায় তূর্য, সদ্য গড়া পদ্য ছড়া, মিঠে কড়া পশুর ছড়া, নাম তাঁর সুকুমার, ছড়ায় ছড়ায় সত্যজিৎ, রবীন্দ্রনাথ নইলে অনাথ, টাপুর টুপুর ছড়ার নূপুর, ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের ছড়া-১, ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের ছড়া-২ ইত্যাদি।
এগুলি শহর থেকে গাঁ-গঞ্জ, শিশু থেকে বুড়ো সবাই গোগ্রাসে গেলে। মজা পায় ও প্রাণ খুলে হাসে। শুধু হাসি নয়, গভীর প্রত্যয় আর বিশ্বাসের ছবি আঁকা থাকে তাঁর লেখায়। তাঁর বিখ্যাত দুটি ছড়ার নাম: ‘আ-মরি বাংলাভাষা’ ও ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’।
‘বাংলাটা ঠিক আসে না’ ছড়াটির কিছুটা অংশ:
“ছেলে আমার খুব ‘সিরিয়াস’ কথায়-কথায় হাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।
ইংলিশে ও ‘রাইমস’ বলে
‘ডিবেট’ করে, পড়াও চলে
আমার ছেলে খুব ‘পজেটিভ’ অলীক স্বপ্নে ভাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।
‘ইংলিশ’ ওর গুলে খাওয়া, ওটাই ‘ফাস্ট’ ল্যাঙ্গুয়েজ
হিন্দি সেকেন্ড, সত্যি বলছি, হিন্দিতে ওর দারুণ তেজ।
কী লাভ বলুন বাংলা প’ড়ে?
বিমান ছেড়ে ঠেলায় চড়ে?
বেঙ্গলি ‘থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ’ তাই, তেমন ভালোবাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।”
তারপর ছড়াটির শেষে লিখলেন:
“কাজী নজরুল- রবীন্দ্রনাথ
ওদের কাছে তুচ্ছ নেহাত
মাইকেল হেরে বাংলায় ফেরে, আবেগে-উচছ্বাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না।”
বর্তমান সময়ের মানুষেরাই বাংলা ভাষার প্রতি যেভাবে অবহেলা করেন, তাচ্ছিল্য করেন, ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ান তাদের প্রতি এক চরম প্রতিবাদ এই কবিতাটি।
আবার আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘সব দুর্গাই সুখে থাকুক’-এ লিখেছেন আমাদের চোখে দেখা নিত্যদিনের দুর্গাদের কথা, যে দুর্গারা দেবী হয়েও যেভাবে দুঃখে-কষ্টে দিনাতিপাত করে চলেছেন:
“এক দুর্গা রিক্সা চালায় কুচবিহারের হাটে
এক দুর্গা একশো দিনের কাজে মাটি কাটে।
এক দুর্গা রাস্তা বানায় পিচ ও পাথর ঢালে
এক দুর্গা রোজ চুনো মাছ ধরছে বিলে-খালে।
এক দুর্গা করছে মাঠে দিনমজুরের কাজ
এক দুর্গা খিদেয় কাঁদে, পায়নি খেতে আজ।
সবাই জানি, এদের কারো হয় না কোনও পূজো
এরা তো মা তোমার মতো নয়কো দশভুজো।
সব দুর্গার চোখে-মুখেই ফুটবে হাসি কবে?
মাগো, তোমার পুজো সেদিন সত্যি সফল হবে।”
কবির দরদি মনের পরিচয় এবং বাস্তব জীবনের অসাধারণ পর্যবেক্ষণ কবিতাটিতে ধরা পড়েছে। আমরা মৃত্তিকার দুর্গা বানিয়ে পুজো অর্চনা করি, কিন্তু প্রকৃত রক্তমাংসের দুর্গারা হয় অবহেলিত উপেক্ষিত। এই কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি সমাজকে জাগাতে চেয়েছেন।
বিভিন্ন সময়ে ভবানীপ্রসাদ বিভিন্ন সাহিত্য সম্মানও পেয়েছিলেন। ‘শিশুসাহিত্য পরিষদ পুরস্কার’, ‘অভিজ্ঞান স্মারক’, ‘ছড়া” সাহিত্য পুরস্কার’ ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শতাধিক পুরস্কার এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও তাঁকে দেওয়া হয়েছে।
লেখালেখির পাশাপাশি বহু পত্রপত্রিকা সম্পাদনও করেছেন। একসময় তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়: ঝালাপালা, হিজিবিজি, একতারা, হিং টিং ছট ইত্যাদি শিশু-কিশোর পত্রিকা।
এই কবিকে আমরা কোনোদিন ভুলতে পারব না।দেশে-বিদেশে যেখানেই বাংলা ভাষাভাষী মানুষ বাস করেন, ভবানীপ্রসাদ তাদের কাছেই পরম আপনজন হয়ে থাকবেন। আমাদের শৈশব,আমাদের প্রতিবাদ, আমাদের মানব দরদি মন তাঁর ছড়ার কাছেই যেমন উদ্ভাসিত হয়,তেমনি আমাদের শিশুরাও তাঁর ছড়ার কাছে নিজেদের খুঁজে পায়। মানব সত্তার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে চেতনার বিকাশকেও নানাভাবে সহায়তা করে। তাই তিনি চিরদিন মানুষের মনেই বেঁচে থাকবেন।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সাদ আব্দুল ওয়ালী on ৩টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on ৩টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on ৩টি কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
রাবেয়া আখুঞ্জী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
শামসুল হক এস এইচ নীর on নাকাবা কিংবা বিপর্যয়ের দিনগুলো