spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদবই নিয়েমানুষ মারার এত তরবারি দেখে কবি আশাহত

লিখেছেন : পৃথা চট্টোপাধ্যায়

মানুষ মারার এত তরবারি দেখে কবি আশাহত

পৃথা চট্টোপাধ্যায়

মানুষের কাছে প্রতিনিয়ত গড়তে গড়তে ভেঙে যায় জীবনের ছন্দ। প্রাত্যহিক বদল হয় জীবনের গতি। তবুও একই রাস্তার গতানুগতিক ভোরে অথবা নিবেদন দুপুরে একাকী নিঃস্ব বোধ করেন কবি তৈমুর খান। কবির ‘ইচ্ছারা সহমরণে যায়’ ও ‘নির্ঘুমের হ্রস্বধ্বনি’ এই দুটি কাব্যগ্রন্থে যে সব কথা অবিরত উঠে এসেছে তার হৃদি খাদের পাশে কবি তৈমুর নামিয়ে রেখে আসেন আশ্চর্য সব কাব্যালাপ। কবির সহজ সরল ভাবনা আলোকের অভিসারী। ‘আলোর মুদ্রা’ কবিতায় দারুণ অকপট হয়ে তাই তিনি হৃদয় উন্মুক্ত করে আহ্বান জানান: ‘এসো আলো আমার অসুখ/সারিয়ে নিই শহরের জটিল পরামর্শ ভুলে’। এই পরাঙ্মুখ আলোর ছোবলে উদ্ভ্রান্ত শহরের ছোট্ট কুটিরে নিজের সন্ধানে তিনি জেগে থাকেন ও নীরবে দেখেন: ‘এই শহরে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে সব রাধা, আমি শুধু কিনে নিচ্ছি শোক’। কবি কখনোই হাতের মুঠোয় নিতে চায়নি চোখ ঝলসানো রমণী/তবু কেউ কেউ তোমরা বলেছো সুযোগসন্ধানী’ এই অভিধায় ক্ষতবিক্ষত করেছে তাঁর হৃদয়। তিনি আশ্চর্য হয়ে ভাবেন কাদের ‘হৃদয়ে এতো ফণীমনসা’ জন্মায়। বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মানবিক চেতনাসম্পন্ন কবির মন ভারাক্রান্ত হয়েছে, দুরু দুরু বুক কেঁপে উঠেছে তাঁরও। চোখের সামনে উড়ে এসেছে মুঠো মুঠো ছাই। তিনি ব্যথিত হয়ে বলেছেন ‘মানুষ মারার এতো তরবারি কখনো দেখিনি আগে’। মর্মের বিষাদে জীবনের ছবির মতো সব দিন হারিয়ে গেছে কবির চোখের সামনে। ‘সভ্যতা পরিচালিত’ কবিতায় দুঃখের সঙ্গে বলেছেন আমরা সকালে ‘শালিনী কাপে চা পান আর দুপুরে তস্তুরি ভরে মাংস পোলাও/খেতে খেতে আমাদের ঠোঁট থেকে খসে পড়ছে বাঁকা হাসি’। এই সব মুখোশের আড়ালে যে বন্যতা ও ব্যক্তিগত নীচতা লুকিয়ে থাকে তা কবি স্পষ্টভাবে বলতে দ্বিধাবোধ করেননি। মানুষ আজ ভুলে গেছে মানুষের ঈশ্বরকে তাই ‘ধর্ম এসে কেড়ে নেয় ভাত’। আজ ‘ধর্মের ডাঁশ এসে রক্ত শোষে’, ‘মৌলবাদ ছুরি হাতে ঘোরে’। চেনা মানুষের ভিড়ে অচেনা শহরকে জেগে উঠতে দেখে কবি শঙ্কিত হয়েছেন। সভ্যতা কাঁপে রক্তপাত ‘আর বিস্ময়ের জ্বরে’ তাই ‘মেঘমল্লার’ বা ‘বর্ষামঙ্গল’ রাগিণী অধরাই থেকে যায়; মানুষের অস্তিত্ব পুড়ে যায়, ‘ইচ্ছারা সহমরণে যায়’। কবিতা যেমন আলোর তেমনই অন্ধকারের। কবি তৈমুর খানের ‘নির্ঘুমের হ্রস্বধ্বনি’ কাব্যেও তাই দেখা যায় ‘মধ্যরাত বিক্রি হয় নগদ পয়সায় শেষরাতে নিষ্কলঙ্ক সূর্য ডাকে, জীবিকা এমনি করে বাঁচে। সব কিছু দেখে কবির মনে এখন আর কোনো যন্ত্রণা তেমন নতুনভাবে বাজে না। অন্ধকার পৃথিবীতে কবির দুঃখের গাছে অজস্র ‘দুঃখ ফুল’ ফোটে। সেই ফুলের নিবিড় ঘ্রাণে ভরে থাকে তাঁর ঘরদোর। সেই নিঃসঙ্গ ঘর তিনি একাই সামলান। কবি তৈমুরের কাব্যগ্রন্থ দুটিতেই কবির একাকিত্ব বোধের যন্ত্রণা রয়েছে ‘একা, আমি সর্বনাম/ দীর্ঘ রাত জেগে আছি/আমারই বিকেলের খোঁজে’। এই বিকেল কবির কাছে খুব আকাঙ্ক্ষিত সময়। শৈশবের ও কৈশোরের অনেক সুখস্মৃতি জড়িয়ে আছে এই সময়ের সঙ্গে। এইরকম সময়ে এক বিস্ময় চৈতন্য এসে আমাদের সতর্ক করে দিয়ে যাক তাই কবি চেয়েছেন। কবি তৈমুরের ভাবনা অবশ্যই নৈরাশ্যে শেষ হয়নি, আবার নতুন করে গল্প শুরু করতে চান বলেই ‘ভাঙা নৌকায় বিকশিত’ দেখতে চান জীবনকে, ‘বিশ্বাসী নূপুর বেজে উঠুক তবে/ কাছে এসে হাত ধরে বসুক/আমরা অপেক্ষায় আছি’। কবির কবিতায় অপূর্ব ভাবনা ও চিত্রকল্পের ব্যবহার দেখা যায়। বর্তমান সময়কে আত্মসাৎ করে নিজের শব্দে গ্রথিত করেছেন তাকে ‘আলোকিত গহ্বরের নিচে/কেবল আমারই বিচ্যুতি’: ‘জানালাগুলি অনুসন্ধানের মুখ’, ‘আমাদের সনাতন ঘুড়ি/মোহিনী আকাশে উড়ে যায়’, ‘নীলার্ণবে প্রেমের সাম্পান/আত্মা যার মাঝি’, ‘মুঠো মুঠো কোলাহল ছড়িয়ে দিচ্ছে সময়রঞ্জিনী’ প্রভৃতি খুব সহজ সাবলীল বাক্যবন্ধে কবির স্বকীয়তার পরিচয় পাওয়া যায়। ক্ষুদ্র কাব্যগ্রন্থের অল্প কবিতা পড়ে আশ মেটে না, পাঠক হিসাবে আমার মতো সকলেরই কবির কাছে আরো অনেক কবিতা প্রত্যাশা থেকে যায়।
#
নির্ঘমের হ্রস্বধ্বনি: তৈমুর খান,স্রোত পাবলিকেশন, দাম ৬০ টাকা।
#
ইচ্ছারা সব সহমরণে যায়:তৈমুর খান, তাবিক, দাম ৩০ টাকা

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সাদ আব্দুল ওয়ালী on ৩টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on ৩টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on ৩টি কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
রাবেয়া আখুঞ্জী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
শামসুল হক এস এইচ নীর on নাকাবা কিংবা বিপর্যয়ের দিনগুলো