মীর সালমান শামিল
…………
পৃথিবীর সবগুলো প্রধান ধর্মে এবং গ্রিক, মিশরীয়, ব্যবিলন, চীনা, ভারতীয়সহ সকল প্রধান সভ্যতায় বিস্ময়করভাবে কিছু বিষয়ে সাদৃশ্য আছে। তার মধ্যে একটি হল “নজর লাগা বা বদ নজর”।
অপরের ভাল দেখে হিংসা বা ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে তাকানোই হল বদ নজর। সব ধর্মই বদ নজর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে, আমি এখানে চারটি প্রধান ধর্মের অবস্থানের চুম্বকাংশ উল্লেখ করছি।
এক– ইহুদি ধর্ম,
হিব্র ভাষায় ইভিল আইকে হারা আয়িন [Hara Ayin] বলে। ইহুদি ধর্মের পবিত্রগ্রন্থ তোরাহ বা বাইবেলের আদিপুস্তকে উল্লেখ আছে,
❝…তোমাদের উচিত হবে না ভাইয়ের প্রতি অশুভ নজর দেওয়া, তার ব্যাপারে মন্দ চিন্তা করা। সে তোমাদের জন্য ঈশ্বরের কাছে ক্রন্দন করে প্রার্থনা করে। ❞
—Deuteronomy 15:9
ইহুদি ধর্মের অন্যতম পবিত্রগ্রন্থ তালমুদে,
❝ কেউ যদি শহরে প্রবেশ করার সময় অশুভ নজরের ভয় করে তার সে যেন বাম হাত দিয়ে ডান হাতের বুড়ো আঙুল ধরে এই প্রার্থনা করে— আমি অমুক, অমুকের সন্তান এবং আমি জোসেপের বংশধর। আমার উপর অশুভ নজরের কোন প্রভাব নেই। ❞
—Berakhot 55b
তালমুদে হারা আইন সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।
দুই– খৃষ্টধর্ম,
বাইবেলের আদি পুস্তক তথা ওল্ড টেস্টামেন্ট খৃষ্টানদেরও পবিত্র তাই ডিউটরনোমির পংক্তি এখানে সমান প্রাসঙ্গিক। এছাড়া বাইবেলের নতুন পুস্তক বা নিউ টেস্টামেন্টেও একাধিক জায়গায় বদ নজর নিয়ে বলা হয়েছে যেমনঃ
❝ যা আমার নিজের, তা আমার খুশীমতো ব্যবহার করার অধিকার কি আমার নেই ? আমি দয়ালু, এই জন্য কি তোমার ঈর্ষা হচ্ছে? ❞
—Matthew 20:15
❝ তোমার চোখ যদি সুস্থ থাকে, তবে তোমার সমস্ত দেহটি দীপ্তিময় হবে; কিন্তু তা যদি মন্দ হয় তবে তোমার দেহ অন্ধকারময় হবে। ❞
—Luke 11:34-36
তিন– হিন্দুধর্ম,
হিন্দুধর্মের গ্রন্থগুলোতে বদ নজরকে বলা হয়েছে “দৃষটি” যা “আওরা” এর জন্য হয়। বদ নজর থেকে রক্ষা পেতে হিন্দু পুরোহিতরা কপালে কালো টিকা বা কাজল পরতে বলেন।
চার– ইসলাম,
ইসলামে বদ নজর এতটাই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে পবিত্র কুরআনের দুইটা সম্পূর্ণ সূরা নাজিল করা হয়েছে এই সংক্রান্ত ব্যাপারে। [সুরা ফালাক এবং সূরা নাস]
❝ বলুন, আমি পানাহ চাচ্ছি প্রভাতের পালনকর্তার,
তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তার অনিষ্ট থেকে,
অন্ধকার রাত্রির অনিষ্ট থেকে, যখন তা সমাগত হয়,
গ্রন্থিতে ফুঁৎকার দিয়ে জাদুকারিণীদের অনিষ্ট থেকে
এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে যখন সে হিংসা করে। ❞
— আল ফালাক: ১-৫
রাসুলুল্লাহ সা. মুসলমানদের একাধিক বার বদ নজর নিয়ে সর্তক করেছেন,
❝ তোমরা বদ নজরের খারাপ প্রভাব থেকে রক্ষার জন্যে আল্লাহ তায়ালার সাহায্য প্রার্থনা কর। কেননা তা সত্য। ❞
—ইবনে মাযাহ: ৩৫০৮
রাসুলুল্লাহ সা. আরো বলেছেন,
❝ বদ নজর মানুষকে কবর পর্যন্ত পৌঁছে দেয় আর উটকে পাতিলে। ❞
— সহিহ মুসলিম: ২১৮৮
❝ নজর মানুষের ভাগ্যকে বদলে দিতে পারে। যদি কোনো কিছু তাকদিরকে অতিক্রম করতে পারত, তবে তা নজর হত। ❞
— মুসনাদে আহমাদ: ১৫৫৫০, তিরমিজি: ২০৫৯
১২শ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক এবং দর্শনিক ইবনুল কাইয়্যিম জাওযি নজর লাগার ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন,
❝…যুগ যুগের জ্ঞানীজনেরা(মুসলমান এবং অমুসলিম) বদ নজরকে অস্বীকার করেননি, যদিও তারা তার কারণ এবং দিক নিয়ে মতভেদ করেছেন।
আল্লাহ তায়ালা মানুষের শরীর ও আত্মায় বিভিন্ন প্রকারের ক্ষমতা ও প্রাকৃতিক ক্রিয়াশীলতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। আর এদের ভেতর অপরকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাও দিয়েছেন।
কোন জ্ঞানী ব্যক্তি শরীর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে আত্মার প্রতিক্রিয়ার অস্বীকার করতে পারবে না, কেননা এটা এমন একটি বিষয় যা আমরা দৈনন্দিন জীবনে পরিলক্ষিত ও অনুভব করতে পারি।
যেমন মানুষের চেহারা লাল রং ধারণ করে যখন তার দিকে কোন লজ্জাকারী ব্যক্তির দৃষ্টি পড়ে। তেমনি ভাবে ভয়ের কিছু দেখলে হলদে রং ধারণ করে। আর এসব আত্মার প্রভাবে হয়ে থাকে। আর যেহেতু আত্মার সম্পর্ক চোখের সাথে খুবই গভীর এজন্য এটাকে চোখ লাগা বলা হয় কিন্তু চোখের নিজস্ব এমন কোন প্রভাব নেই বরং প্রতিক্রিয়া কেবল আত্মার মাধ্যমে হয়ে থাকে। আর আত্মার মত, প্রকৃতি ও এর গুণ বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। সুতরাং হিংসুক থেকে হিংসার মাধ্যমে হিংসাকৃতের উপর স্পষ্ট কষ্টের প্রভাব পড়ে। ❞
রাসুল পাক সা. বদ নজর থেকে বাঁচাতে মুসলমানদের কয়েকটি আমল এবং দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন,
১। সূরা ফালাক এবং সূরা নাস: ইভিল আই এবং ব্লাক ম্যাজিক থেকে রক্ষা পেতে এই দুই সূরা। নিয়মিত পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
২। আয়াতুল কুরসি পাঠ।
৩। নিয়মিত দোয়া: একাধিক দোয়া আছে যা পড়তে হবে৷ একটা দোয়ার অর্থ—
আমি আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ কালামগুলোর মাধ্যমে তার সৃষ্টির সব ধরনের অনিষ্টথেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
— সহিহ মুসলিম: ২৭০৮
উপসংহারে বলা যায় তাই এই বিষয়ে প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য, সব দর্শনের, সব ধর্মের জ্ঞানী ব্যক্তিরা স্বামী- স্ত্রীর, সন্তান, বাবা-মা, ভাইবোনের আন্তরিকতাপূর্ণ সময়ের, উপহার লেনদেন, কোন অর্জন ইত্যাদির ছবি যত্রতত্র শেয়ার না করার পরামর্শ দেন।।
যদি ব্লাক ম্যাজিকের আশংকা থাকে অবশ্যই একজন পরহেজগার আলেমের সাথে পারামর্শ করে রুকিয়া করতে হবে।
সবগুলো প্রধান ধর্ম এবং সবগুলো সভ্যতা যে বিষয়ে এতটা গুরুত্ব দিয়েছে সেটাকে হেলায় উড়িয়ে দেওয়া অর্থ আপনি হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা মানুষের “collective intelligence” কে অবজ্ঞা করলেন।
…….
লেখক : গবেষক, ব্রেমেন ইউনিভার্সিটি, জার্মানি।