spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদকবিতামিতরোভিৎসা

লিখেছেন : মঈনুস সুলতান

মিতরোভিৎসা

মঈনুস সুলতান

।। এক।।

মিতরোভিৎসা নগরীর মৃদু ট্র্যাফিক উপেক্ষা করে— অটোমানি জামানার স্থাপত্যকলার নিটোল বার্তা পৌছে দেয় বাজরাম পাশা মসজিদ। সার্ব-কসোভার দ্বন্ধে যদিও জখম হয়েছে দেয়ালের কারুকাজ, খুশি হই— ভারা বেঁধে সংস্কারের কাজ চলছে দেখে। প্রঙ্গনে জানু বিড়িয়ে বসেছেন এক বৃদ্ধ, হাতে তার গোলাগুলিতে বিক্ষত নীলাভ টাইল, মানুষটি তাতে তসবি ছুঁইয়ে চোখ বুজে প্রার্থনা করেন , তারপর রঙতুলিতে ফোটাতে শুরু করেন সুচারু নকশা। ধীর গতিতে ফরাসি শান্তিরক্ষী বাহিনীর একটি সাঁজোয়া যান এসে দরোওয়াজায় ব্রেক কষে। কাজ থামিয়ে তসবি তুলে চুমো খেয়ে দৃষ্টিকে প্রসারিত করেন দিগন্তের দিকে। চশমার ভারী কাঁচে তাঁর প্রতিফলিত হয়—সাঁজোয়ার বনেটে বসানো মারণাস্ত্রের ধাতব লিঙ্গম।

।। দুই।।

মিতরোভিৎসায় নদী কিন্তু একটি নয়, দুটি—শুনেছি, ইভার নদীর জল এসে অবলীলায় মিশেছে সিটনিকার ধারাস্রোতে। সংগমের সন্ধানে হাঁটতে হাঁটতে এসে দাাঁড়াই ছোট্টমোট্ট এক লগ-কেবিনের সামনে। চিলতে উঠোনে দ্রাক্ষা কুঞ্জ, ছায়ায় পাতা জং-ধরা দুটি কেদারা। ছন্নের মতো উসকো-খুসকো চুলের এক পুরুষ গাছ বেয়ে নেমে এসে ইশারায় বসতে বলেন। চিটচিটে তরলে মাখামাখি হাতটিতে ধরা মৌচাকের ভাঙ্গা টুকরা-টাকরা, কোমরবন্ধের হুকে আটকানো হাড়িও। ফোকলোরে প্রচ্ছন্ন সুরছন্দে মোহগ্রস্থ হয়ে যেন বয়ে যাচ্ছে স্রোত, জলের বহতা ধ্বনিতে সম্মোহিত হয়ে লগকেবিনের দেয়ালে চোখ রাখি। উইপোকার কাতারবন্দী ফৌজ তৈরী করছে পরিখা, ট্রেঞ্চ ও টানেল, কোথাও কোথাও ঝুরঝুরে কাঠে ডিসপ্লে করছে তাদের সূচিকর্মও। দেয়ালের কিনার থেকে ঝুলছে, আদ্যিকালের গাদাবন্দুক ও হরিণের করোটি। দুয়ার ঠেলে বেরিয়ে আসেন মৌচাক নিধনের হোতা পুরুষটি, নিমকদানীর মতো ছোট্টমোট্ট একটি পাত্রে আমার দিকে বাড়িয়ে দেন তিনি তরতাজা মধু।

।। তিন।।
ভিলায়েত বারদাশি নামে যে ভেকেশন হোমে যাপন করছি নিরুদ্বেগ নিশিরাত, তার কাছেই—নদীর পাড় ঘেঁষা বার্চ বৃক্ষের ছায়ামেদুর উদ্যান। ওখানে হাঁটতে আসি সকাল-বিকাল, কাঁচাপাকা চুলদাড়িতে মারকুটে মতো প্রৌঢ়ের সঙ্গে দেখাও হয় হামেহাল। রাগি চোখ তুলে তাকান বটে তিনি, তবে যখনই জানতে চাই আছেন কেমন? চোখমুখে খুশির রৌদ্রকরোজ্জ্বল সূর্যমুখি ফুটিয়ে বলেন, ‘খুব খারাপ নয় হে, গতকাল ওপারের সার্বিয়া থেকে, সঙ্গোপনে, স্টোন-ব্রিজ পেরিয়ে এসেছিল হাইস্কুল জামানার সুইটহার্ট, বুঝতেই পারছো আমি মুসলিম কসোভার, চাইলেই হালফিল যেতে পারি না ওপারে—সার্বদের অর্থডক্স সম্রাজ্যে, বর্ণীল এক স্কার্ফে গলায় ঝুলানো ক্রুশকাঠের প্রতীকটি লুকিয়ে এসেছিল সে, চুপিসারে তোমাকে বলি, ‘শি স্টিল লুকস্ সো কিউট এন্ড ওয়ান্ডারফুল।’

।। চার ।।

অপরাহ্ণ পড়ে এলে উদ্যানে এসে বসে নওল বয়সী এক যুগল। আজও এসেছে, আর ছেলেটিকে লেদার জ্যাকেট দেখাচ্ছে রক স্টারের মতো ঝলমলে। অফ শোল্ডার টপে মেয়েটিও মনে হয়—সন্ধেবেলা অপেরা গেয়ে মাতাবে সে মঞ্চ। তাদের অন্তরঙ্গতায় দূর দেশের কোন চবুতরার আবডালে খুনসুটিরত জোড়া কপোতও হার মানবে নিশ্চিত। আমার করোটিতে কাকতাল এক ভাবনা ঘাই মেরে ওঠে, ভবি—শরীরী সংরাগের আবেশে মেয়েটি চোখ মুদে স্মৃতিতে ফোটায় কী তার ভিন্ন কোন স্তাবকের মুখ—কিংবা মেঘের সায়রে বিদ্যুৎ বিষ্ফোরণের সম্ভাবনায় অধীর হয়ে ছেলেটি পরিকল্পনা করে অ্যাডভেঞ্চার ট্রেকিং এর?

।। পাঁচ।।

অপ্রাসঙ্গিক ভাবনার পরিধি বিস্তৃত হতে পারে না তেমন। খেয়াল করি, চাপা স্বরে মেতেছে এরা তুমুল কলহে। চোখমুখ থেকে ছিটকাচ্ছে দারুণ ক্রোধের দগ্ধ ক্রিস্টাল। অনুমান করি, কাছাকাছি হতে পারবে না দিন দুয়েক, মাটি হলো বুঝি-বা আলোছায়ার সম্মোহন ছড়ানো বিকাল। চোখে পড়ে— ঠিক তাদের মাথার ওপর ঔক বৃক্ষের শাখায় পাশাপাশি বসে খটাখট ঠুকছে বর্ণাঢ্য দুটি কাঠঠোকরা। ছেলে ও মেয়ে ফের খেপে পরষ্পরের দিকে তেড়েফুঁড়ে গেলে—মানবিক বিবাদে বোধ করি বিব্রত হয় পাখি দুটি। পত্রালির সাবুজিক ক্যানোপি চুঁইয়ে পড়ে বেলা শেষের এক পশলা আলো, তাদের গ্রীবা ও অননে দিব্য অর্কিড ওঠে ফোটি। খোঁড়াখুঁড়ির প্রকল্প মুলতবি করে ঘাড় বাঁকিয়ে খেচর যুগল তাকায় নিচের দিকে , তর্কবিতর্কের তামাদি হয়, নেমে আসে নীরবতা—ভাবি বিবাদ বুঝি-বা হয়ে এলো ফিকে।

।। ছয় ।।

আমার চোরা পর্যবেক্ষণে উত্যক্ত হয়ে বোধ করি চলমান কলহের খসড়ায় তারা বসিয়ে দেয় সেমিকোলন। তারপর দুজনে সরাসরি তাকায় আমার দিকে। আমি জোড়া কাঠঠোকরার কবোষ্ণ খুনসুটির দিকে ইশারা দেই। আওয়াজ দেয় ছেলেটি,‘ দিজ বার্ডডস্ আর লাভলি, বাট ইউ নো.. উই হেইট ইচ আদার’, মেয়েটিও শাসায় তাকে.. ‘লিসেন ইউ স্টুপিড ফেলো.. আই অ্যাম গোয়িং টু কিল ইউ টু নাইট’, বলতে বলতে ঝুঁকে সে চুমো খায় তরুণটির গন্ডদেশে, ভাবি— যাক বিসংবাদের মীমাংশা হলো পরিশেষে।

।। সাত।।

জোড়া স্তম্ভের ওপর দাঁড় করানো মনুমেন্টের তলায়ও মানুষজন পায়চারি করে বিকেলে। একটু আগে— ওয়াকার ঠেলে ঠুলে ঠিরঠিরিয়ে এসে পৌঁচেছেন এক বৃদ্ধা। চেষ্টা করেন বাজাতে তিনি তারের সনাতনী বাদ্যযন্ত্র সিফতেলি। কিন্তু বার বার কেঁপে ওঠে তাঁর শরীর, গুলিবিদ্ধ আবাবিলের হৃৎপিন্ডের মতো ছিন্ন ভিন্ন হয় ধ্বনিতরঙ্গ। প্রবল কাঁপুনিতে বিরতি নেন, কপাল কুঁচকে ভাবেন—কেন আজ হচ্ছে বারংবার সুরভঙ্গ? ধকল সামলে অতঃপর ফের সৃজন করেন সেরেনাদ, প্রচ্ছন্ন সয়লাবে নিমেষে ভেসে যায় অন্তর্গত বাাঁধ, কিন্তু লহরীর বেনোজল বেশিক্ষণ থাকে না বহমান, কাঁপুনিতে ফের উন্মতাল হয় তাঁর অশক্ত দেহ, হার্মনী থেকে তিরোহিত হয় প্রাণ, বাঁশেঝাড়ে আটকে যাওয়া কাঁটাঘুড়িতে যেন বাতাস ফেলছে ঝড়ো নিঃশ্বাস, দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ—শুনি, সিফতেলির তারতন্ত্রী থেকে উৎসারিত হচ্ছে ঐকতানের বিপরীত ধ্বনি।

।। আট ।।

সিফতেলির প্রত্যাশিত ঝংকার থেকে কম্পনের তোড়ে যে তিরোহিত হচ্ছে সুরসঙ্গতী, তা বুঝি বুঝতে পারেন বৃদ্ধা। বাদ্যযন্ত্রটি ওয়াকারের হুকে ঝুলিয়ে সামনে বাড়িয়ে দেন পিতলের বাটি, ঝনাৎ করে তাতে ফেলি ইউরোর ঝকঝকে কয়েন, ভাবি, বাদ্যবাজনা না হয় নাই জমলো— মানুষটি তো নিখাদ খাঁটি। মুখের মাংশপেশীতে ফুটিয়ে ঊর্মিবহুল রেখাচিত্র, ভারি সুন্দর করে হেসে বলেন,‘ ঠিক চিনতে পেরেছি, জোৎস্নারাতে এসেছিলে একবার কাছে— হয়েছিলে পরম মিত্র ?.. .. .. ..প্রতিসন্ধ্যায় আসতে না ওই পানশালায়, যেখানে লাইভ শোতে বাজাতাম আমি সিফতেলি, মনে নেই, কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে.. একদিন পাঠও করে ছিলে শেলী?’

।। নয় ।।

প্রতিক্রিয়ায় বলি না কিছু। আমার মৌনতাকে আমলে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানান,সো স্যারি— ‘তোমারও স্কন্ধে চেপেছে দেখছি ডাইমেনশিয়ার কবন্ধ।’ কথা থামিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে দেন ক’খানা সাদাকালো আলোকচিত্র, নিরিখ করে আমার করোটিতেও ছড়ায় বিপুল ধন্দ! ছড়িয়ে অনাবিল রূপের সহস্র সংরাগ— তন্বী এক বাজাচ্ছে সিফতেলি, ফের কথা বলেন,‘ মনে নেই একদিন আমি ছিলাম তোমার কল্পলোকের সেহেলি?’ পরের ছবিতে তাঁকে মেডেল পরিয়ে দিচ্ছেন— যুগশ্লাভিয়ার কিংবদন্তী খ্যাত এক রাষ্ট্রপতি, বুঝতে পারি না, সীমান্ত অতিক্রান্ত সুনামে তাঁর কী ভাবে পড়লো যতি? ভরসা দিয়ে বলেন, বিষ্মরণ নিয়ে অত ভেবো না তো, সুরতালে আমারও তো ভুলবাল হয় হালফিল তুমুল, তারপরও সংগীতের সঙ্গে দিব্যি করে যাচ্ছি ঘর, ঝংকারের বনানীতে এখনো হইনি উন্মূল।?

।। দশ।।

মিমোজার সঙ্গে দেখা—সাঁজগোধূলির আধোন্ধকারে এক কফি-বারে। পেশায় ট্যুর-গাইড সে, তবে শরীরে অবলীলায় ফোটাতে পারে ছন্দসুর, বলে— এসো তো, কাছেই স্মৃতির সহজাত সওদায় পরিপূর্ণ বিপনী, না, তোমাকে যেতে হবে না বহুদূর, কিছু একটা বিক্রি হলে জুটবে যৎসামান্য কমিশন—রোজগারের হবে আজ বউনি। ম্যামোরি মর্মরিত ভিনটেজ শপ থেকে প্ররোচনায় কিনি সিলভারের কারুকাজ করা বাইনোকুলার, ফিসিফিসিয়ে বলে— এ সন্ধ্যায় লেপ্টে আছি তোমার ললাটে, পারো তো করো আমার সঙ্গ পরিহার?

।। এগারো।।

ল্যাম্পপোস্টের টিমটিমে আলোয় আস্তে-ধীরে উঠে পড়ি অনতিউচ্চ টিলায়। বহতা জলের রেখার দিকে চোখ রেখে শুনি, খানিক দূরে— বার্চবনের নিরল পরিসরে বেজে যাচ্ছে রিদমিক ধ্বনি, অদৃশ্য এক ড্রামবিটের তোড়ে পিচঢালা সড়ক বুঝি-বা স্পর্শ করছে অশ্বখুর, প্রস্তাব করে মিমোজা— চাইলে আপ্যায়িত করবে না নৈশভোজে, তোমাকে তো মনে হয় না তেমন নিষ্ঠুর, দেখি—প্রফুল্ল হয়ে আছে অনন তার প্রত্যাশার সরোজে। বুঝতে পারি— হরেক লীলারঙ্গে মিমোজা পারঙ্গম, বলে— তাকাও তো— জোড়া নদীর সমাহরে সৃষ্টি হয়েছে বহতা জলের সংগম, অশ্বের খুরধ্বনিতে ফের সরগরম হয়ে ওঠে নিচের বার্চবন, অনুভব করি— তার সান্নিধ্যে অন্য কিছুর দিকে দৃকপাত করা নিতান্ত নিষ্প্রোয়োজন।

।।বারো।।

রেস্তোরাঁটি পাহাড় চূড়োয়, বাইনোকুলার হাতে মিমোজার প্রতীক্ষায় এসে বসি বেলকনিতে, বিভাজিত স্টোন-ব্রিজের ওপারে সার্বিয়া, ত্রিতল এক ভিলার আঙিনায় দানা খুঁটছে গোটা কতক সবুজ পাখি, হতে পারে অজানা কোন প্রজাতি কিংবা বনের টিয়া। চিলেকোঠার জানালায় বৃদ্ধা এক চেষ্টা করছেন সুচে সুতো পরাতে, কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পৌঁছবে মিমোজা— কবোষ্ণ সান্নিধ্য হয়তো জুটবে বরাতে।

।। তেরো।।

সামবুচার পাত্র হাতে পাশেই বসেছেন ফেজ টুপি মাথায় এক টার্কিশ, মুখরোচক তরলে ভাসমান তিনটি কফি বিনে জ্বলে ওঠে প্রদীপ্ত ফ্লেম—ছড়ায় নীলাভ আগুন, বিড়বিড়িয়ে কথা বলেন তিনি, লাইটার ধরা করতল করে ওঠে নিশপিশ, চোখাচুখি হতেই হুংকার ছুড়েন ‘হেইট ইউরো কানুন’। পূরাতাত্ত্বিক প্রস্তরে গড়া পুলের ওপারে— ত্রিতলের আঙিনায় জ্বলে ওঠে জোড়া লন্ঠন, সাঁজগোধূলির আলোছায়ায় চোখে পড়ে ছিপছিপে এক প্রোফাইল, মিমোজার মৃদু পদশব্দে রোমাঞ্চিত হয় প্রাঙ্গনের সাবুজিক বন।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সাদ আব্দুল ওয়ালী on ৩টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on ৩টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on ৩টি কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
রাবেয়া আখুঞ্জী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
শামসুল হক এস এইচ নীর on নাকাবা কিংবা বিপর্যয়ের দিনগুলো