spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধস্বাধীনতার প্রশ্ন : ৪৭, ৭১ এবং ২৪ এর প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার রকমফের

লিখেছেন : আবু জাফর সিকদার

স্বাধীনতার প্রশ্ন : ৪৭, ৭১ এবং ২৪ এর প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার রকমফের

আবু জাফর সিকদার 

….

ক.

স্বাধীনতা আসলে কি?  স্বাধীনতা কি কেবল কোন ভূখণ্ড ঘিরে তৈরি হওয়া সুনির্দিষ্ট মানচিত্রের নাম কিংবা নতুন কোনো পতাকার জন্মকথা? সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার মধ্যে যে পুঁথিগত পার্থক্য- তাকে এখানে সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণে না গিয়ে দুটি শব্দের যে অন্তর্নিহিত বিশালতা তাকে একত্রে ধারণ করে আমরা অগ্রসর হবো।

মূলত ৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিজয়ের যে আকাঙ্খা ও প্রাপ্তি এবং তার ৫৩ বছর পর ২০২৪ এর সংগঠিত গণঅভ্যুত্থান/গণবিপ্লবের লড়াই, সংগ্রাম ও মুক্তির সাধ ও স্বাদ এর ভেতর যে মৌলিক পার্থক্য ও সাযুজ্য তা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক-কুতর্কের সূচনা করা হচ্ছে। এই সূত্র ধরে তৈরি করা হচ্ছে নানা বয়ান ও বিভ্রান্তি। আমরা মূলত এই বিষয়ে একটি নৈর্ব্যক্তিক আলোকপাত করার চেষ্টা করবো। 

খ.

ব্রিটিশ শাসনের আগে কি আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম ছিলাম? কবে থেকে আমরা প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা হারালাম?

হাজার বছরের বাংলার ইতিহাসটা আসলে কী? মহিপালের শাসন, লক্ষ্মণসেনের শাসন ও পলায়ন , ইখতিয়ারউদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতেয়ার খিলজির বাংলা বিজয়, বারভূঁইয়াদের রাজত্ব কিংবা মোগল শাসনের দীর্ঘকালের নানা উত্থান ও পতনের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লর্ড ক্লাইভের কাছে  নবাব সিরাজের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্ত যাওয়ার এই যে সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আমরা কতটা স্বাধীন ও সার্বভৌম ছিলাম তা বেশ জটিল ও বিতর্কিত বাইনারি। তখন স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে আধুনিক যে আলাপ তা- না একাডেমিক, না চেতনালব্ধ- কোন ভাবেই চর্চিত হতো না। 

প্রায় দুশ বছরের গোলামীর জিঞ্জির গলায় ঝুলিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষগণ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অধিকারকে নিজেদের মতো করে ফিরে পেতে যে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন তার ইতিহাস-ই মূলত স্বাধীনতার চেতনাবোধের অঙ্কুরোদ্গম। পরাধীনতার সময় কালের মতোই পরিব্যপ্ত, সমৃদ্ধ ও সমুজ্জ্বল। সিরাজের পতন থেকে মীর কাশিমের ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যর্থ প্রয়াস, 

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ থেকে শুরু করে এই লড়াই এর তীব্রতা বাড়তে বাড়তে ১৯৪৭ এ এসে পূর্ণতা লাভ করে।  ব্রিটিশ শাসনের অবসানে সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়েই এই লড়াই চললেও মূলত এই ভাটি বাংলা ছিলো সকল সংগ্রাম ও লড়াই এর পীঠস্থান। হাবিলদার রজব আলী থেকে শুরু করে সূর্যসেন, প্রীতিলতার স্বাধীনতার সংগ্রাম ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায়!  তিতুমীর এর বাঁশের কেল্লা, হাজি শরিয়তউল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলন, ফকির বিদ্রোহ  কিংবা নেতাজি সুভাস বসুর সংগ্রাম,স্বাধীনতা অর্জনের পথে  এক একটি কিংবদন্তী। তারই হাত ধরে এই বঙ্গীয় অঞ্চলের স্বাধীকার লাভের যে আকাঙ্ক্ষা ১৯৪৭ এ এসে পূর্ণতা লাভ করে।  

কেবল মুখের কথায় এই স্বাধীন ভূখণ্ড আসেনি, অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়েই ১৯৪৭ এ এই ভূখণ্ডের একটি পতাকা এবং মানচিত্র পাওয়া গেল। 

এখানে মনে রাখতে হবে এই 

পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশ হলো সেই প্রত্যাশিত সার্বভৌম ভূখন্ডেরই কার্বন কপি!

গ. 

কিন্তু এত রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সেই স্বাধীনতা আমাদের পূর্ব বাংলাকে বেশি দিন  ধারণ করতে পারলো না। কিছু দিন যেতে না যেতেই এই ভূখণ্ডের মানুষ বুঝতে পারলো আমরা উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে নিপতিত হয়েছি! ১৯৫২ সালে প্রথম আঘাতটা আসলো আমাদের ভাষার উপর, ভাষার জন্য দিতে হলো জীবন। ধীরে ধীরে পশ্চিম পাকিস্তানের জান্তা বাহিনী ব্রিটিশদের চেয়েও ভয়ংকর পিশাচ হয়ে ওঠলো। তারই এক অনিবার্য ও চুড়ান্ত পরিনতি হিসাবে এলো ১৯৭১।

এই ভূখণ্ডের মানুষ আবার একটি সর্বাত্মক জনযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়লো! ৯ মাসের এই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা পেলাম লাল সবুজের নতুন পতাকা, অজস্র নদীবিধৌত পলিসমৃদ্ধ এই বদ্বীপ যেন হাজার বছরের প্রত্যাশিত এক প্রমিজ ল্যান্ড। একটি ভূখণ্ড এবং একটি পতাকা নিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয়া এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের নাম-ই বাংলাদেশ।আক্ষরিক অর্থে-ই  এই সার্বভৌম অঞ্চলের মানুষের রক্ত দামে কেনা অর্জিত স্বাধীনতা। 

কাজেই ৭১ এর স্বাধীনতার সংগ্রাম হাজার বছরের লালিত স্বপ্নের এক অনিবার্য পরিনতি। 

যারা বা যেসকল দল ৪৭ এর পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন তারা ৭১ এর লড়াইয়ে  নিজেদের সম্পৃক্ত করার ব্যপারে দ্বিধান্বিত ছিলো মৌলিক দুটি রাজনৈতিক প্রশ্নে। 

এক. এই সংগ্রামে ভারতের সরাসরি যুক্ত হওয়া।

 দুই. যে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও চেতনাকে ধারণ করে পাকিস্তানের পত্তন হয়েছে তা থেকে বিচ্যুতি।

এছাড়া যারা  মুসলিম লীগের রাজনৈতিক অংশিদার ছিলেন,  তাদের কায়েমি স্বার্থের একটি ব্যাপারও ছিলো,  তবে যারা ইসলামী ধর্মীয় চিন্তা চেতনাকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে বিবেচনা করেছেন এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদকে বিপদজনক ভেবেছেন তারা ৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহন করলেন। কিন্তু তৎকালীন নতুন  প্রজন্মকে তারা নিজের সাথে রাখতে সক্ষম হলেন না, তারা বাংলাদেশকে স্বাধীন করবার লড়াইয়ে ব্যাপক হারে যুক্ত হলো। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের ভেতর দিয়ে অর্জিত হলো সেই প্রত্যাশিত স্বাধীনতা!

৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের যে ব্যাপকতা তা অল্প কথায় এখানে আলোচনা করে শেষ করা যাবে না। 

পাকিস্তানী জান্তা এদেশের সাধারণ জনগণের উপর যে ব্যাপক হারে হত্যা, লুণ্ঠন, জ্বালাও পোড়াও সংগঠিত করেছে, পৃথিবীর ইতিহাসে তা নজিরবিহীন।

যে আকাঙ্খাকে ধারণ করে পাকিস্তানের জন্ম হলো, তা আইয়ুব-ইয়াহিয়া-রাও ফরমান আলীদের মতো সামরিক জান্তা আর ভুট্টোর মতো রাজনৈতিক কুচক্রীর অপরিনামদর্শী ও উচ্চ বিলাসী ক্ষমতা লিপ্সার কারণে ব্যর্থ হলো। এর ফলে ৭১ এর লড়াই অনিবার্য হয়ে উঠেছিলো।

ঘ. 

সাম্য, মানবিক মর্যাদা  এবং সামাজিক ন্যায় বিচার – এই তিনটি মৌলিক স্তম্ভকে মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য বলে “Proclamation of Independence”- এ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। ১০ এপ্রিল ‘৭১ অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার কর্তৃক এটি গৃহীত হলেও ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে তা কার্যকর করা হয়। এটাই হলো মূলত স্বাধীনতা সংগ্রামের বা যুদ্ধের মূল চেতনা। এছাড়া গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত একটি গণপরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা এবং এতদঞ্চলের সাথে চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য সহ নানা ভাবে নিপীড়ন ও বিবর্তনের যে  ধারাবাহিক স্ট্রিমরোলার চলছিলো তা থেকে মুক্তির আর কোন পথ খোলা ছিলো না বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের। লক্ষ লক্ষ শহিদ আর অসংখ্য  মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা আমরা পেলাম। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ উড়লো এক লাল সবুজের পতাকা। রক্ত সাগর পেরিয়ে যে স্বাধীনতা পেলাম তা দিন মাস বছর ঘুরে ৫৩ বছর চলে গেলো। আমাদের কী আকাঙ্খা ছিলো, কী প্রত্যাশা ছিলো, কী চেতনায় আমরা মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরে জীবনবাজি রেখে লড়তে গিয়েছিলাম? অর্থনৈতিক বৈষম্য কি আমরা দূর করতে পেরেছি?  গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার কি আমরা গত ৫৩ বছরে অবাধ ও নিরঙ্কুশ করতে পেরেছি? সর্বস্তরে  সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও  ন্যায় বিচারের অধিকার আমরা কতটুকু প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি?  

এই ৫৩ বছরে বারবার এসব অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য সংগ্রাম, আন্দোলন করতে হয়েছে, কেন? একসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলো, তারা ছিলো বেনিয়া। তারপর এলো আধিপত্যবাদী শোষকশ্রেণী, তৈরি হলো ২২ পরিবার এবং পশ্চিমা জান্তা চক্রের সুবিধাভোগী শ্রেণি। তারাও মূলত বৈদেশিক সামন্তবাদী। কিন্তু  ৭১ এর স্বাধীনতার পর যারা আমাদের দণ্ডমুণ্ডের মালিক হয়ে বসলো- ওরা কারা, ওরা কোথা থেকে এলো! 

গণতন্ত্রে নামে, ভোটের নামে,  অর্থনৈতিক মুক্তির নামে গত ৫৩ বছর তারা আমাদেরকে শাসন করলো, শোষণ করলো, প্রতারিত করলো,খুন করলো, গুম করলো, জেল জুলুম হুলিয়া কোন কিছুই আর বকেয়া রাখেনি ওরা।  ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তানিরা যা করে দেখাতে পারেনি তার চেয়েও বেশি কলাকৌশলে এদেশীয় শাসকশ্রেণি বিগত ৫৩ বছরে এদেশের জনগণকে কড়ায়গণ্ডায় বুঝিয়ে দিয়েছেন!  মাত্রাগত হেরফের হলেও এই ৫৩ বছরের নেট ফলাফলও শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস। এই ইতিহাসের নানা বাঁক বদলে জনগণ বারবার রক্ত দিয়েছে।কিন্তু অর্জন হয়েছে এক একটি অশ্বডিম্ব। বেশি দূরে আমাদের যেতে হবে না প্রতিবেশী ভারতে অন্তত যেটুকু গণতান্ত্রিক চর্চা তাদের স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে চর্চা হয়ে আসছে সেরকম একটি ঐতিহ্য কেন আমাদের রাজনীতিবিদগণ এদেশকে দিতে    ব্যর্থ হলেন? এই হিসাব তাদেরকেই একে একে দিতে হবে। জাসদের গণবাহিনীর তাণ্ডব, ৭৪ এর দুর্ভিক্ষ, সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশাল কায়েম, ৭৫ এর নির্মম হত্যাকাণ্ড, ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লব, শহীদ জিয়ার বহুদলীয় গণতন্ত্র চর্চার প্রয়াস, জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড, হুসেইন  মোহাম্মদ এরশাদের ক্যু ও জাতীয় পার্টির শাসন ও শোষণ, ৯০ এর এরশাদ বিরোধী  আন্দোলন ও পতন পর্যন্ত সময়কালটি এদেশের জনগণকে প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ নিতে দেয়নি। এখানে বলা বাহুল্য শুধু একটি পতাকা এবং একটি ভূখণ্ডের মালিকানা অর্জিত হলেই স্বাধীনতা পাওয়া হয়ে যায় না। প্রকৃত স্বাধীনতা হলো এই দুটির পাশাপাশি নাগরিকদের সকল মৌলিক অধিকার সহ যাবতীয় সাংবিধানিক অধিকারকেও রাষ্ট্র ও সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি ও নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। তা কোনোভাবে খর্ব বা রহিত করা হলে বা করার চেষ্টা হলে তা মূলত নাগরিক স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা বা ভূলুণ্ঠিত করার শামিল। ভূখণ্ড এবং পতাকা থাকা সত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানী জান্তাগোষ্ঠী যখন নাগরিক অধিকার কেড়ে নিলো, তখন নতুনভাবে স্বাধীনতা অর্জনের প্রশ্ন উত্থাপিত হলো। স্বাধীনতার এই মৌলিক ধারণাটি মাথায় না রাখলে যে ধুম্রজাল ছড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে, তা বদ্ধমূল হবে। 

 যা হোক আগের আলোচনায় ফেরা যাক। পরবর্তীতে তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের যে ধারা প্রণিত হয়েছিলো এতে কিছুটা আশার আলো দেখা গিয়েছিলো। এটি চর্চিত হতে গিয়ে কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি দেখা গেলেও তা সংশোধন না করে অত্যন্ত শঠতা ও ধূর্ততার আশ্রয় নিয়ে শেখ হাসিনা পুরো ব্যবস্থাকে খেয়ে দিলো। তার ক্ষমতাকে ২০৪১ সাল বা কেয়ামত পর্যন্ত প্রলম্বিত করার এক দুর্দমনীয় লিপ্সা ও আকাঙ্খা তাকে পেয়ে বসলো, বিগত ১৬ টি বছরে তিন তিনটি জাতীয় নির্বাচনকে তিনি কেবল প্রহসনে পরিনত করেছেন তা-ই নয়, পুরো জাতি ও রাষ্ট্রকে পৃথিবীর ইতিহাসে এক কলঙ্কিত স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মর্যাদায় আসীন করে দিলেন, জনগণের নূন্যতম ভোটের অধিকারকে তিনি তামাশার বস্তুতে  রূপান্তরিত করলেন। স্বাধীনতার ৫৩ বছরের যেটুকু অর্জন- তা তার ১৬ বছরের শাসন আমলে এসে ভঙ্গুর এবং অকার্যকর একটি ব্যবস্থায় পর্যবসিত হয়ে গেলো। মাৎস্যন্যায় এর মতো,

সকল বিরোধী পথ মতকে     খেয়ে দিয়ে নিজে এক দানবীয় ফ্যাসিবাদের স্বরূপে আবির্ভূত হয়ে গেলেন! তার এই ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার জন্য ভূখণ্ডটিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জিম্মায় তুলে দিতে তার সামান্যতম অনুশোচনা কাজ করলো না। তিনি তাদের হাতের ক্রীড়নক হিসাবে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী কার্যকলাপকে অন্ধভাবে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছিলেন। ফলে ভারতীয় আধিপত্যবাদ পরিপূর্ণভাবে এদেশের যাবতীয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক  কর্মকাণ্ডের উপর চেপে বসলো। তাদের সম্মতি ও অনুমোদন ছাড়া দেশী কিংবা কোনো বিদেশনীতির সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকার নিতে অক্ষম হয়ে পড়লো। সরকার কিংবা তথাকথিত বিরোধী দল একযোগে বরকন্দাজের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো! অনেকেই হয়তো এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিতে চাইবেন। কলেবর বৃদ্ধি হয়ে যাচ্ছে বিধায় আমি বিস্তারিত আলোকপাত করতে পারছি না। শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রীবর্গের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য,  এরশাদ-সুজাতা সিং এর সেই বেফাঁস কথোপকথন, জিএম কাদের তার সর্বশেষ ভারত সফর শেষে যে নতজানু ও নির্লজ্জ বক্তব্য  পেশ করেছিলেন- সেসব একটু মিলিয়ে দেখুন, তখন বুঝবেন ভারতীয় আধিপত্যবাদ কতটুকু জেঁকে বসেছিলো শেখ হাসিনার রেজিমে এই বাংলাদেশের ঘাড়ের উপর!

এই আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসনের শিকড় কতটা গভীরে, তা বুঝতে হলে আরও একটু খোলাসা করা জরুরী। 

ঙ.

২০২৪ এর বিজয় দিবস উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে টুইট করেছিলেন তা নিশ্চয় সবার মনে থাকবে! আলোচনার সুবিধার জন্য এখানে বাংলা অনুবাদ তুলে ধরছি -“আজ, বিজয় দিবসে, আমরা সেই সাহসী সৈনিকদের সাহস ও আত্মত্যাগকে সম্মান জানাই, যারা ১৯৭১ সালে ভারতের ঐতিহাসিক বিজয়ে অবদান রেখেছিলেন। তাদের নিঃস্বার্থ নিষ্ঠা এবং অটল সংকল্প আমাদের দেশকে সুরক্ষিত করেছে এবং আমাদের গৌরব বৃদ্ধি করেছে। এই দিনটি তাদের অসামান্য বীরত্ব এবং অবিচল আত্মার প্রতি একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাদের আত্মত্যাগ চিরকাল প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে এবং আমাদের জাতির ইতিহাসে গভীরভাবে অমর হয়ে থাকবে।”

মোদির এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল তার ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, “তীব্র প্রতিবাদ করছি। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ছিল বাংলাদেশের বিজয়ের দিন। ভারত ছিল এই বিজয়ের মিত্র, এর বেশি কিছু নয়।”

এর আগে হাসনাত আবদুল্লাহ ফেসবুকে লিখেছেন, “এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু, মোদি দাবি করেছে, এটি শুধু ভারতের যুদ্ধ ও তাদের অর্জন। তাদের বক্তব্যে বাংলাদেশের অস্তিত্বই উপেক্ষিত।

যখন এই স্বাধীনতাকে ভারত নিজেদের অর্জন হিসেবে দাবি করে, তখন আমি একে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতার প্রতি সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখি। ভারতের এই হুমকির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চালিয়ে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী। এই লড়াই আমাদের চালিয়ে যেতেই হবে।”

ভারতের প্রাক্তন সেনাপ্রধান ফিল্ডমার্শাল মানেকশ’ কি বলেছেন দেখুন  – “বাংলাদেশের প্রতি আমরা ভালো আচরণ করিনি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সব ধরনের সাহায্য করা দরকার ছিলো আমাদের। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা তা করেননি। তারা বেনিয়ার মতো আচরণ করেছেন (স্টেটম্যান, ১৯ এপ্রিল ১৯৮৮)”। তিনি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে যুক্ত সরাসরি অংশীজন। তার ভাষ্যটা খুবই প্রণিধানযোগ্য। কিন্তু এটাই প্রকৃত সত্য- নেহেরু ডকট্রিন থেকে শুরু করে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ও কেবি হেডগেওয়ারদের ভাবদর্শন, ইন্দিরা গান্ধী ও তার কংগ্রেসের কর্মকাণ্ড , হালের নরেন্দ্র দামোদর মোদী ও তার বিজেপি , আরআরএস, সেবক সংঙ্ঘ সবাই একই নায়ের মাঝি। অখণ্ড এক ভারত-ই তাদের চুড়ান্ত লক্ষ্য। তাই তারা একটি শক্তিশালী, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ কখনই চায় না, তারা একটি নতজানু, দুর্বল পরনির্ভরশীল বাংলাদেশ চায় যা ধীরে ধীরে সিকিমের ভাগ্য বরণ করতে বাধ্য হবে। গত ১৬ বছরে ভারতের মোদি এই জালকে অনেকটাই গুটিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু ২০২৪ সাল তাদের বাড়াভাতে ছাই দিয়ে দিয়েছে এদেশের আপামর জনতা। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে 

স্বাধীনতার প্রশ্নটি নতুনভাবে উচ্চারিত হচ্ছে! মেজর জলিল বলেছিলেন- “অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা”। ভূখণ্ড, পতাকা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিষয়টি যেমন এখানে প্রশ্নাতীতভাবে ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তি মেনে নিচ্ছে না, আবার অবাধ ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করা, নাগরিক অধিকার সহ

দেশের অভ্যন্তরীণ যাবতীয় বিষয়ে রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে একটি বশংবদ গোষ্ঠীকে লালনপালন করার যে নীতি তারা গ্রহণ করেছিলো তা তাদের জন্যই গলার কাঁটা হয়ে বিঁধে গেছে। এবং তাই ২০২৪ এ জুলাই অভ্যুত্থানকে ভারত নিজেদের পরাজয় হিসাবে নেয়েছে এবং যারা এই বিপ্লব ও অভ্যুত্থানের  নায়ক, তাদের কাছেও নতুনভাবে স্বাধীনতার নব দিগন্ত হিসাবে এটি সমাদৃত হচ্ছে! মূলত ইন্ডিয়ান হেজিমনি ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশের নতুন যাত্রার যে শুভ সূচনা, ২০২৪ হলো তারই এক ল্যান্ডমার্ক বিজয়। কিন্তু এটা কোনোভাবেই ভূখন্ড ও পতাকা অর্জনের ঐতিহাসিক ১৯৭১ কে অস্বীকার করে নয়, বরং নেহেরু- মোদিদের ভ্রান্ত ও কাল্পনিক স্বপ্নসাধকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে ৭১ ও ২৪ পরস্পরকে একটি মজবুত ভিত্তির উপর এনে দাঁড় করিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে! তবে মোদিরা চুড়ান্তভাবে হাল ছেড়ে দিয়েছে এটা ভাবার তো কোন কারণ নেই, তারা হাতপা গুটিয়ে বসে থাকবে না, ‘র'( RAW) নতুন পরিকল্পনা নিয়ে দাবার চক সাজাচ্ছে, অনৈক্য ও বিভাজনের রাজনীতিকে সক্রিয় ও চাঙ্গা করতে তারা মরিয়া হয়ে ওঠেছে। রাষ্ট্রীয় পটোকল ও আন্তর্জাতিক রীতিনীতি বাদ দিয়ে তারা উলঙ্গভাবে পতিত স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্টদের লালনপালত, ভরনপোষণ ও পূনর্বাসনের কূটনৈতিক তৎপরতায় মেতে ওঠেছে। 

২০২৪ এর অর্জনকে সুসঙ্গত করতে হলে জাতীয় ইস্পাতদৃঢ় ঐক্যের কোন বিকল্প নেই।স্বাধীনতার পূর্ণ চেতনায় উদ্বুদ্ধ থাকতে হবে সমগ্র বাংলাদেশকে! এই দেশে কোন ঘষটি বেগম আর লেন্দুপ দর্জির চাষাবাদ যেন না হয় সেই সতর্কতা প্রতিটি সচেতন নাগরিকের জাতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য!

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on মরুভূমি