এদেশের সহজ সরল ও উদাসীন সাধারণ মানুষ সরল বিশ্বাসে ও আনন্দের উপকরণ হিসেবে পহেলা বৈশাখের প্রভাতে রমনার বটমূলে এলোকেশী রমনীদের “এসো হে বৈশাখ, এসো এসো!” গান, (আরো পরে) পান্তা ইলিশ চর্চা এবং (আরো পরে) হিন্দু ধর্মীয় মূর্তি ও প্রতীক নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা– এ সকল কিছুকে গ্রহণ করেছে নির্বিবাদে, এবং প্রকারান্তরে নিজেদের বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের প্রচণ্ড ক্ষতি করেছে, এক ধরনের মেকি আবেগে ভেসে গিয়ে, না বুঝেই!
‘বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের সাংস্কৃতিক অভীক্ষায় বাংলা নববর্ষ, রবীন্দ্রধর্ম ও ছায়ানটের বর্ষবরণ: একটি পর্যালোচনা’—শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল ২০২৫, ৩৯ পাঁচলাইশ আ /এ, চট্টগ্রামস্থ মাটি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা করেন শিক্ষাবিদ, কবি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক কর্নেল (অব:) আশরাফ আল দীন।
চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্র আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কথাশিল্পী, সংস্কৃতি সংগঠক ও চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্রের আদর্শ ও প্রশিক্ষণ বিভাগের আহ্বায়ক আমীরুল ইসলাম। কেন্দ্রের মহাসচিব ও চলচ্চিত্রকর্মী ইসমাইল চৌধুরীর পরিচালনায় আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কবি-প্রাবন্ধিক-শিক্ষাবিদ ও কেন্দ্রের যুগ্ম-আহ্বায়ক মাঈন উদ্দিন জাহেদ, কথাশিল্পী ও শিক্ষক তানবীর মুহাম্মদ, প্রবীন সংস্কৃতি সংগঠক, রাজনীতিবিদ ও শিল্পী আজিজুল হক, ইতিহাস গবেষক ও প্রাবন্ধিক জাকারিয়া হাবিব, সংস্কৃতিকর্মী ও ব্যাংকার মুহাম্মদ আক্তারুজ্জামান।
মেহেদী হাসান পলাশকে উদ্ধৃত করে কবি আশরাফ আল দীন বলেন, মূলত বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতিতে পৌত্তলিকতা অনুপ্রবিষ্ট করানোই ছিল ছায়ানটের মূল লক্ষ্য। প্রতিষ্ঠার পর থেকে তারা এই একই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে এসেছে। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ছিল তাদের প্রধান টুলস বা হাতিয়ার। পৌত্তলিক বিশ্বাস ও আচারের উপরে সাহিত্যের মোড়ক লাগিয়ে নির্মাণ করা রবীন্দ্রনাথের মতো শক্তিশালী কবির সৃষ্ট উন্নত সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে অসচেতন মুসলিম সমাজের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট করানো তাদের পক্ষে খুব সহজ হয়েছিল।
তিনি বলেন, রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী অধ্যাপিকা সনজিদা খাতুনের স্বামী ওয়াহিদুল হক ছিলেন ছায়ানট প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। মুসলিম নাম থাকা সত্ত্বেও তিনি নাস্তিক ছিলেন। তার লাশকেও সৎকার করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে দিয়ে। এবং শেষে ঢাকা মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের জন্য দান করা হয়েছে।
সদ্য প্রয়াত সনজিদা খাতুনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ঘটনাপ্রবাহ উল্লেখ করে কর্নেল আশরাফ বলেন, লাশের পাশে দাঁড়িয়ে একদল নারী-পুরুষ গাইলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান:
‘আমার এই দেহখানি তুলে ধরো– তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো’। তিনি বলেন, কোন মুসলিম তার দেহখানি কোনো দেবতার সামনে তুলে ধরে তার দেবালয়ের বা মন্দিরের প্রদীপ করার কামনা করতে পারেন না। আমরা জানি কোন হিন্দু মারা গেলে তার মুখাগ্নি করা হয়। এবং শেষে লাশ আগুনে পোড়ানো হয়। এতে হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য দোষের কিছু নেই। কিন্তু মুসলিম হয়ে কেউ কামনা করতে পারে না যে, তার লাশকে হোমাগ্নির ছোঁয়া দিয়ে পবিত্র করা হবে। কোন মুসলমানের লাশকে ‘দহন দান’ করে বা আগুনে পুড়িয়ে ধন্য করা হয় না। এটা ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
কর্নেল আশরাফ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে উল্লেখ করেন, কিন্তু সনজিদা খাতুনের লাশের পাশে দাঁড়ানো শতাধিক মুসলিম নারী-পুরুষ যেভাবে এই গানটি গাইলেন তা বিস্ময়কর। কেননা তারা শিক্ষিত এবং সচেতন। তারা সবাই হয়তো সানজিদা খাতুনের মতো ধর্মহীন জীবন যাপন করতেন না। তারপরেও তারা এই সাধারণ ব্যাপারটি ধরতে বা সনাক্ত করতে সক্ষম হননি। এটাই ওয়াহিদুল হক, সনজিদা খাতুন ও ছায়ানটের সাফল্য।
বাংলার রাজনীতিবিদ এবং মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের অদূরদর্শীতা ও উদাসীনতার কথা তুলে ধরে নিরাপত্তা বিশ্লেষক কর্নেল আশরাফ বলেন, ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক ছায়ানটের এমন ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠিত হতে পারার জন্য বাঙালি মুসলিম বিশেষ করে মুসলিম ধর্মীয় নেতারাও কম দায়ী নন। তারা বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতির কোন রূপরেখা দাঁড় করাতে পারেননি। একদিকে তারা স্থানীয় সংস্কৃতিকে বিদআত বলে বিদায় দিয়েছে, অন্যদিকে আরব সংস্কৃতিকে মুসলিম সংস্কৃতি বলে বাঙালি মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। এই দুইটার কোনটাই বাঙালি মুসলিম সমাজে খুব বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। আর এই সুযোগ নিয়েছে ছায়ানাটিরা। তারা সংস্কৃতির নামে, উৎসবের নামে বাঙালি মুসলিম ও মুসলিম তরুণ সমাজের সম্মুখে তাদের সাজানো উৎসব, আনন্দ ও সংস্কৃতির বরণডালা পরিবেশন করেছে। সেই ডালার উপরিভাগে বাঙালির পরিচিত ধান, দুর্বা, জবা, পদ্ম, দুধ, কলা প্রভৃতি থাকলেও ভেতরে ঢাকা ছিল বেদ, গীতা, উপনিষদ প্রভৃতি। উপরিভাগের পরিচিত ধান, দূর্বা, জবা, পদ্ম ও দুধ-কলার পরিবেশন দেখে বাঙালি মুসলিম ও তরুণ সেই সংস্কৃতি গোগ্রাসে গিললেও কোনদিন তার ভেতরের রূপটি দেখতে পায়নি বা দেখতে চায়নি। এটাই ঘটেছে এবং এখনো ঘটছে সর্বত্র।
উত্তরণের পথনির্দেশ করে কর্নেল আশরাফ বলেন, এ থেকে বাঙালি মুসলিম সমাজকে রক্ষা করতে হলে তাওহীদ বা একত্ববাদ এবং ইসলামী হারাম-হালালের বিধান মেনে স্থানীয় বাঙালির হাজার বছরের আবহমান সংস্কৃতির সাথে সমন্বয় করে বাঙালি মুসলমানদের জন্য সাংস্কৃতিক রূপরেখা দাঁড় করাতে হবে। এটাই একমাত্র পথ।
কর্নেল আশরাফ সচেতনতার প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেন, বর্তমান সচেতনতার দাবি হচ্ছে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মগুলোকে ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে হবে এবং কঠোরভাবে বর্জন করতে হবে ছায়ানট, উদীচি এবং এ জাতীয় বাংলাদেশের গণবিশ্বাস বিরোধী বর্ণচোরা সংগঠনগুলোকে।
…………..
নিজস্ব প্রতিবেদক