শান্তা মারিয়া
আমার খুব ভালো একজন বন্ধু আছেন যিনি পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মীর অংশে বাস করেন। তিনি মনে করেন যুদ্ধ হলে দুই দেশেরই ক্ষতি হবে। পৃথিবীতে কোন ভালো মানুষ যুদ্ধ চায় বলে আমার জানা নেই। কিন্তু এখন এসব কথা বোকার মতো শোনায়।
একসময় বলিউডে ভারত পাকিস্তান সম্প্রীতির বাণী ধারণ করে সিনেমা তৈরি হতো। হেনা ছবিটি তো কাশ্মীরের প্রেক্ষাপটেই তৈরি। জেবা বখতিয়ার এবং রণধীর কাপুরের সেই চলচ্চিত্র বলিউডের ক্ল্যাসিক। পিঞ্জর, বীরজারা, ম্যায় হু না, পিকে, বজরাঙ্গি ভাইজানের মতো ছবি এক সময় বলিউডে তৈরি হয়েছে।
লেখা হয়েছে মানবতাবাদী সাহিত্য। কিন্তু সেসব অতীত। কৃষণ চন্দরের ‘গাদ্দার’ বইটির কথা এখন সবাই ভুলে গেছে।
সুনীল দত্ত, খাজা আহমদ আব্বাসের মতো মানুষ তখন বলিউডে ছিলেন। এখন তৈরি হয় ‘ছাবা’র মতো উগ্র হিন্দুত্ববাদী ছবি যা হিন্দু-মুসলিম বিভেদকে আরও উসকে দেয়।
এখন আর কেউ বলে না, ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান’ কিংবা ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?’
অসাম্প্রদায়িক চেতনার দিক থেকে একসময় ভারতের সবচেয়ে অগ্রসর রাজ্য ছিল পশ্চিমবঙ্গ। তখন বামপন্থীরা সাম্প্রদায়িকতার পিছনে যে ধনিক শ্রেণীর কায়েমি স্বার্থের বিষয়টি আছে সেটি তুলে ধরতেন। এখন সেখানেও মূর্খ রঞ্জনদের দাপট।
বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লবের সময় দেখেছি এক স্বৈরাচারকে যখন এদেশের মানুষ ঘৃণায় প্রত্যাখ্যান করছে তখন পশ্চিমবঙ্গের কতিপয় উগ্র সাম্প্রদায়িক মানুষ সেই বিপ্লবকে ‘হিন্দু বিদ্বেষী’ বলে কালারড করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
কাশ্মীরের পহলগাঁওয়ে পর্যটকদের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়েছে সারা বিশ্ব। সেই হামলায় মুসলিমরাও মরেছে। কিন্তু তাদের নাম সেভাবে উচ্চারিত হয়নি। বরং সাম্প্রদায়িকতার আগুনে আলুপোড়া খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে রাজনীতিবিদরা।
অমিত শাহর প্রত্যক্ষ মদদে গুজরাটের হত্যাকাণ্ডে অসংখ্য মুসলমান প্রাণ হারিয়েছে, নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সেই হত্যাকাণ্ডেও যেমন রাজনীতিবিদরাই লাভবান হয়েছিল তেমনি এবারের কাশ্মীরের ঘটনাতেও সেই নেপোরাই দই মারছে।
আমার ইচ্ছা করে যারা যুদ্ধকে উসকে দেয় তাদেরকে একটা স্পেশাল ব্যাটেলিয়নে করে একেবারে ফ্রন্টে পাঠিয়ে দিতে। নিজেদের গায়ে যখন গুলি বিঁধবে তখন মজা টের পাবে। পালাতে যেন না পারে সেজন্য দুদেশের বিশেষ বাহিনী পিছন থেকে বন্দুক উঁচিয়ে তৈরি থাকুক।
ওই যুদ্ধবাজরা জানে তাদের কোনদিন যুদ্ধে প্রাণ দিতে হবে না। তারা শুধু যুদ্ধের আগুনে নিজেদের হাত পা সেঁকবে।
সত্যি কথা হলো আমরা দক্ষিণ এশিয়ার মানুষরা বড্ড গরীব। আমাদের কাছে যুদ্ধ তো গরীবের ঘোড়ারোগ। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ লাগলে দুই দেশের সাধারণ মানুষেরই যন্ত্রণা বাড়বে। আমরা কেউ জানি না, ‘ফর হুম দি বেল টলস’। সাধারণ মানুষের কপালেই দুর্ভোগ আর মৃত্যু।
এই উপমহাদেশেই জন্ম নিয়েছেন শান্তির বাণী প্রচারক গৌতম বুদ্ধ, মহাবীর, ভক্ত কবীর, লালন সাঁই। সুফি দরবেশরা এখানেই শান্তির ধর্মের জয়গান গেয়েছেন। এখানেই মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি আর আজানের সুর উষা ও সায়াহ্নকে শান্তিময় করেছে। এই মিলিত সুর কি যুদ্ধের দামামাকে থামাতে পারে না?
বাংলাদেশ থেকে আমরা কি উদ্যোগ নিয়ে দুই দেশের সম্ভাব্য যুদ্ধ থামানোর জন্য কাজ করতে পারি না? ‘সার্ক’কে আবার ভালো করে জাগিয়ে তোলা দরকার। আসুন আমরা বাংলাভাষীরাই আবার বলি ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’