ড. মাহবুব হাসান
আমাদের ছোটো দেশ তাই এর আবার ভূরাজনৈতিক অবস্থান এমন কি হতে পারে– এই রকম একটি বোধ বিদ্বৎসমাজে চালু আছে। ফলে সেই শিক্ষিত, প্রগতিশীল মনে ও মননে কখনোই একথা জাগেনি যে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি অবহেলিত হচ্ছে। নিরাপত্তা বলতে তারা মনে করেন যে সীমান্ত প্রতিবেশি ভারতের মতো একটি দেশের সঙ্গে আমাদের পেরে ওঠা সম্ভব নয়। এই মানসিক অবদমনই মূলত আমাদের হীনবল করে রেখেছে বলে আমার মনে হয়। আমরা সামরিক শক্তিতে দুর্বল বলে কোনো বৈদেশিক আক্রমণ থেকে নিজেদের জনগণ ও সম্পদের নিরাপত্তা দিতে পারবো না। এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই আমাদের প্রধান শত্রু।
১.০
আক্রমণ বিষয়ে কথা বলা উচিত। একুশ শতকে এসে কোনো দেশ কোনো দেশের ওপর সামরিক আগ্রাসন চালানোর বিষয়টি সুবিবেচনাপ্রসূত বলে মনে করে না। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ আর ইসরাইলের ফিলিস্তিনি ভূমি গাজা দখলের অপচেষ্টাকে এর সঙ্গে মেলানো যাবে না। ওই দুটি বিষয় সামরিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের অন্তর্গত। তারপরও আমরা দেখছি রাশিয়ার মতো পরাশক্তি ইউক্রেনের সঙ্গে আপোষে আসার প্রস্তাব করেছে। ইসরাইলকেও মাথা নত করতে হবে। কারণ, তারা শিখন্ডি। ফিলিস্তিনের ভূমিতে শেকড় গেঁড়ে বসার পেছনে আছে আমেরিকা ও ব্রিটেনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবদমনের বিষয়। সেই সঙ্গে আছে পরাশক্তির প্রভুত্ব বিনির্মাণের মনন ও মানসিকতা। আর আছে সম্পদ শুষে নেবার সামরিক ও বাণিজ্যিক কৌশল। এই কৌশলই হচ্ছে ক্ষমতা ও তার সাংস্কৃতিক বলয় নির্মাণের অভিযাত্রা।
১.১
আমরা যেমন ভাবতে পারি না যে অমুকের সঙ্গে পারবো না। কারণ, আমাদের মন ও মানসিকতাকে শাসন করছে ঔপনিবেশিক শিক্ষা ও তাদের চাপিয়ে দেয়া সাংস্কৃতিক আধিপত্য। আমরা চিন্তা ক্ষেত্রে যেমন পরাধীন, তেমনি সেই পরাধীনতার শেকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টাও প্রায় নেই বললেই হয়। কিন্তু তারপরও, সমাজের কিছু মানুষ তো নতুন কিছু চিন্তা করে। তারাই দেশের কৌশলগত সম্পর্ক ও ভূরাজনৈতিক অবস্থানের ব্যাপারে চিন্তা করেন। কি করে দেশের সম্পদ নিরাপদ ও রক্ষা করা যায়, কি করে দেশের সম্পদ জনগণের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগিয়ে সামগ্রিক পরিস্থিতিকে বদলে দেয়া যায়, সেই চিন্তাও তো করেন। এই শ্রেণির মধ্যে ড.মুহাম্মদ ইউনূসকে আমরা দেখতে পাই মহাসমুদ্রের মধ্যে ভাসমান শৈলখন্ডের শিখর হিসেবে। তলে যে বিপুল অংশ, যাদেরকে জনগণের সঙ্গে চিহ্ণিত করলে তা শ্রেয়তরই হবে।
১.২
আমরা চিন্তাশীল জাতি নই। আমাদের প্রধান শক্তি রাজনৈতিক আবেগ। আমাদের প্রধান শত্রুও রাজনৈতিক আবেগ। এই রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক আবেগের ঘাড়ে চেপে আমরা চলেছি ৭৭ বছর ( পাকিস্তানি ২৩ বছরসহ ) ধরে। এই আবেগেরই প্রাধান্য রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে একটি সংহত অবস্থানে পৌছাতে দেয়নি। চিন্তা-ভাবনাকেও গঠনমূলক ও নিরাপত্তাময় করার চেতনায় আনেনি বা আনতে সহায়তা দেয়নি। গত ৫৪ বছরের স্বাধীনতার সূর্য় উদিত থাকলেও, সেই সার্বিক বিষয়টিকে আমরা কেবল বাউন্ডারী স্বাধীনতা দিয়ে মোড়েছি। বিগত ৫৪ বছরের মধ্যে মাত্র একবার রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের সময় দেখেছি। দ্বিতীয়বার দেখেছি বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে, সামান্য একটু। তাঁর পুর্বমুখী দৃষ্টিভঙ্গি পররাষ্ট্র নীতির চেতনায় একটি মাইল ফলক গেড়েছিলো মাত্র। তাকে নতুন বিন্যাসে সাজানোর সময় তিনি পাননি। তাঁর চিন্তা-চেতনাই আমাদের উদ্দীপিত করেছিলো। তাঁর কাছে থেকে ক্ষমতাহরণের পর দেখা যায়, পূর্বমুখী নয়, বাংলাদেশ ফার্স্ট নয়, তা ঝুঁকে পড়ে পশ্চিম দিগন্তের সীমারেখায় ইন্ডিয়া ফার্স্ট। এর পশ্চিমে তারা যেতে পারেনি। এই নতজানু চেতনাই আমাদের অন্যতম প্রধান বাধা ।
১.৩
১৯৭১ সালে, আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধে সামিল হই, তখন ইন্ডিয়া এবং রাশিয়া বিপুলভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। প্রায় এক কোটি বাংলাদেশিকে জায়গা দিয়ে ইন্ডিয়া আমাদের মাথার টোপর হয়ে যায়। আর রাশিয়ান অস্ত্র আমাদের স্ট্রাইকিং সামরিক শক্তি হিসেবে সাহস জোগায় মুক্তিযুদ্ধের দিন-রাতগুলোতে। কৃতজ্ঞচিত্তে আমরা তা স্মরণ করি এবং তাদের অবদানকে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে স্বীকার করি। কিন্তু বিগত আওয়ামী সরকার সেই অবদানের স্বীকৃতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে। ফলে গত পনেরো বছরে দেশের জনগণ বোঝে যে তারা একটি নব্য ইন্ডিয়াপন্থী ফ্যাসিস্টের অধীনে ইন্ডিয়ান সাম্রাজ্যবাদী করদের ভূমিকায় পরিনত হয়েছিলো। সেই করদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছে তরুণ শিক্ষিত ছাত্র সমাজ, এবং দ্রোহী চেতনার নিপীড়িত-নির্য়াতিত, শোষিত মানব সমাজ। তারা কোটা সংস্কারের আন্দোলন দিয়ে হাসিনার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠলেও, ধীরে ধীরৈ সেই আন্দোলণ গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ, চূড়ান্ত গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয়। সেই উত্তাল গণসুনামির প্রেক্ষিতে হাসিনা পালিয়ে যান ইন্ডিয়ায় এবং সেখানে আশ্রয় পান। এর ভেতর দিয়ে এটাই প্রমাণ হয় যে, তিনি ছিলেন দিল্লির শাসনাধীন এক করদ শাসক।
১.৪
কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মনে ও মননে নেই নতুন চিন্তার স্ফূরণ। তাই তাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভেদ ও রাজনৈতিক কেওয়াস আমরা লক্ষ্য করছি। এদের মধ্যে দেশের আপামর জনগণের জন্য তেমন কোনো উজ্জ্বল চিন্তার বাতি জ্বলতে দেখি না। তারা অবশ্য জনগণের কথাই বক্তৃতায় বলেন। কাজে কর্মেও তাদের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়, কিছু কিছু উন্নয়নেরঅবকাঠামোও আমাদের প্রগতি চিন্তার পথে সায় দেয়। তবে তার পেছনে আছে জনগণের প্রতি দরদ নয়, দলীয় স্বার্থ, ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল। সেই ধারাবাহিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আওয়ামী লীগ সরকার যোগ করে গুম-খুনের ভীতি আর লুটেপুট দেশকে রিক্ত করার এক আত্মধ্বংসী প্রবণতা, যা অতীতের শাসকদের মধ্যে ছিলো না। তাদের মধ্যে ভুল-ভ্রান্তি ছিলো, চিন্তা ভাবনায় সীমাবদ্ধতা ছিলো কিন্তু মানুষকে হত্যা করে, গুম খুন করে ভীতির সাম্রাজ্য কায়েমের প্রবণতা ছিলো না। দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থ ও আর প্রচলিত রাজনৈতিক ধ্যানের বাইরে তারা ছিলেন অনড় প্রতিভাবান।
একমাত্র ব্যতিক্রম বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি দেড় বছর আগে, কিংবা তারও আগে ৩১ দফা ঘোষণা করেন। সেই ৩১ দফা রাষ্ট্রযন্ত্র সংস্কারসহ এমন কিছু বিষয়ে, যা প্রকৃতঅর্থেই জনগণের মৌলিক আশার প্রতিফলন। তবে, এ-দলের অভ্যস্ত রাজনীতিক, কর্মীবাহিনী চিন্তাহীন নেতাদের অনুসারী থাকায় তাদের মধ্যে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। তারা তারেক রহমানের দেয়া নতুন চিন্তার কথা জনসভায় জোর গলায় বলেন, কিন্তু তারা তাতে মনে-প্রাণে সায় দেন না। এ-দলের ভেতরে কিছু চিন্তাশীল মানুষ আছেন, যারা পরিবর্তন ও সংস্কার চান, কিন্তু তাতে রয়েছে তাদেরই গোষ্ঠীস্বার্থ ও প্রচলিত ধ্যান ধারণা । এই বাধা থেকে বিএনপিকে বেরিয়ে আসতে হবে।
২.০
এবার আসা যাক কৌশলগত ভূরাজনৈতিক অবস্থান এবং কূটনৈতিক কৌশলের বিষয়ে। এর প্রধান বিষয় হচ্ছে দেশের মানুষের নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও সম্পদ রক্ষা ও তার নিরাপত্তা বা নিরাপদ রাখার উদ্যোগ আয়োজন। বাংলাদেশের অবস্থান দুই প্রতাপশালী রাষ্ট্রের পাদদেশে—- উদীয়মান শক্তি ভারত আর নয়া পরাশক্তি চীন। রাজনৈতিক, সামাজিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতে এই দুটি দেশের বিপুল সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক ও চাহিদার চাপ এবং একই সঙ্গে নীরব বহুমাত্রিক হুমকি আমাদের পররাষ্ট্র চিন্তাকে বারে বারেই ডিরেইলড করে ফেলে। বিশেষ করে ভারতের প্রত্যাশা এতোটাই যে তাকে আগ্রাসী বলেও চিহ্নিত করা যায়। আমাদের ভারসাম্যময় পররাষ্ট্র নীতিকে ব্যালন্সড করতে হলে যেমন নিজেদের সম্পদ ও সামর্থের বিষয়ে সজাগ ও সচেতন হতে হবে, প্রাগ্রসর প্রযুক্তির সহায়তার মাধ্যমে নানান বিষয়ের তথ্যগত উপাদানের খবর রাখতে হবে, তেমনি নিজেদের রাষ্ট্রীয় ইন্টেগ্রিটি বিষয়ে থাকতে হবে টান টান সজাগ। আর তার জন্য অবশ্যই দেশের সামরিক ও সামাজিক শক্তির মধ্যে ইন্টারেক্টটিভ সমন্বয় ও বৌদ্ধিক চেতনার মধ্যে থাকতে হবে মিল-মহব্বত। কেন না, দেশের জনগণের প্রতি আমাদের যেমন বিশ্বাস ও ভালোবাসা আছে, তেমনি তাদের সহায় সম্পদের নিরাপত্তার প্রশ্নটিও জড়িত। বিশেষ করে মিনেরালস বিষয়ক উপাত্তের আপডেট রাখা এবং তা কার্যকরভাবে আহরণের উদ্যোগ আয়োজনের অন্য কোনো বিকল্প নেই। এই বিষয়গুলো কেবল সরকার করবেন এমন কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই। সরকারকেসাহায্য করতে হবে গবেষণার ফল দিয়ে, যা করবে বেসরকারি থিঙ্কট্যাঙ্ক। বিশেষ করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও চিন্তক প্রতিষ্ঠান (থিংকট্যাঙ্ক) এ-ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। সম্প্রতি ঢাকায় একটি চিন্তক প্রতিষ্ঠান তাদের কার্য়ক্রম পরিচালনার একটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকাশ্যে এসেছে। সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন দেশের সেরা সব চিন্তক,শিক্ষাবিদ, উপাচার্য় , অধ্যাপক ও গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক এবং বর্তমান সামরিক ও সাবেক সামরিক উচ্চস্তরের কর্মকর্তাগণ। যোগ দিয়েছিলেন সেনাপ্রধান, বিমানবাহিনী প্রধান এবং নৌবাহিনী প্রধান। বিশেষত্ব এখানেই যে সেনাপ্রধান দেশের সার্বিক নিরাপত্তা ও উন্নয়ন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে কাজের সমন্বয়ের কথা বলেছেন। বিশেষ করে ভূরাজনৈতিক কৌশলগত নিরাপত্তা এবং সম্পদের সুরক্ষা করতে হলে দেশের পররাষ্ট্রনীতি তার সঙ্গে সমন্বয় জরুরি বলে মনে করছেন। সেই সমন্বয় সাধিত হতে পারে, যদি চিন্তক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের গবেষণার মাধ্যমে প্রকৃত সত্য তুলে ধরতে পারে,তা পারলে সরকারও তার প্রয়োজনের বিষয়ে সচেষ্ট হবে। এবং সেই উপাত্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে কার্য়কর পদক্ষেপ নিতে পারে।
গবেষণা ও নিরাপত্তা বিষয়ক থিংকট্যাঙ্ক ফাউন্ডেশন ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ডেভেলপডমেন্ট স্টাডিজ (এফ এস ডিএস) এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান, সাবেক সেনাপ্রধান নূরউদ্দিন খান, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড.মাহবুবউল্লাহ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চ্যেধুরী, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কামরুল আহসান, বিমানবাহিনী প্রধান হাসান মাহমুদ খান, নৌবাহিনী প্রধান নাজমুল হাসান। সেনাবাহিনী প্রধান তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন ,` শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কোন কোন ক্ষেত্রে জোর দেওয়া উচিত, তা গবেষণার মাধ্যমে বের করতে হবে। একই সঙ্গে খাদ্য, পানি, জ্বালানি নিরাপত্তাসহ সব ক্ষেত্রেই গবেষণার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন তিনি। এফএসডিএস প্রতিষ্ঠাকে সময়োপযোগী উদ্যোগ হিসেবে বর্ণনা করেন সেনাপ্রধান। তিনি বলেন, সুশাসন, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জাতীয় সংহতির জন্য গবেষণাভিত্তিক নীতিকাঠামো দরকার। কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে নতুন এই প্রতিষ্ঠানকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন সেনাপ্রধান।
২.১
অনুষ্ঠানে এফএসডিএস-এর চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর বলেন, তাদের এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হলো জাতীয় সংহতি ও অগ্রগতির স্বার্থে সবার মধ্যে সহযোগিতা ও সংযোগ বৃদ্ধি করা। তিনি বলেন, একই লক্ষ্য নিয়ে দেশে আরও কিছু চিন্তন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের মূল দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় চেতনার মশাল প্রজ্বলিত করে–‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ নীতি অবলম্বন। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান মনোযোগ থাকবে জাতীয় নিরাপত্তা, বেসামরিক ও সামরিক খাতের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি ভারসাম্যময় পররাষ্ট্রনীতি বজায় রাখতে সহযোগিতা করা।’ (প্রথম আলো/২৪/২/২৫)
জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চেন্সেলর ড. কামরুল আহসান বলেছেন আমি একটি উদাহরণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করছি, যাতে আমরািইতিহাসের একটি বিশেষ বিষয়ের মাধ্যমে এটা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি। আমার মনে আছে ১৯৭৮ থেকে ৮১ সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আমরা যদি তৎকালীন সময়ের নীতিমাল পর্য়ালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব যে,পররাষ্ট্রনীতি ছিল মিূলত একটি শিল্পকর্ম। আমি ডেভিড ফ্রস্টের একটি উক্তি উল্লেখ করছি।তিনি বলেছিলেন কূটনীতি হল অন্য কাউকে আপনার পথে নিয়ে আসার শিল্প। আমার শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কথা মনে পড়ছে। তিনি মানুষকে কিভাবে তাঁর কাছে টানতেন। এবং তিনি মানুষকে কিভাবে টানতেন এবং তার গন্তব্যে নিয়ে যেতেন।….. তিনি প্রতিবেশি দেশ ও বাংলাদেশের মধ্যে কিছু নিরাপত্তা সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমাদের নিশ্চয়েই মুরারজি দেশাইয়ের কথা মনে আছে।… দুই রাষ্ট্রপতি মিরে গঙ্গা নদীর পানি সমস্যার সমাধান করতে পেরেছিলেন।… আমরা মনে করি বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশী দেশের মধ্যে রাজনৈতিক ও ভালো প্রযুক্তিগত সম্পর্ক থাকা জরুরি।’
পররাষ্ট্র নীতি এবং এর ব্যবহারকারীদের মানসিক ও মননগত চর্চা ও অধিকার এমন হওয়া উচিত যাতে মনে হতে পারে, এটা একটি পরিশীলিত শিল্পকর্ম, যা অনুধাবন করবে তাদের প্রতিপক্ষ। কথা ও তার যুক্তি যতটা অকাট্য হবে, তার সঙ্গে উপস্থাপনও হতে হবে সুন্দর, যাকে কামরুল আহসান শিল্পকর্মের সঙ্গে তুলনা করেছেন। রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়ার ওই স্বল্পকালীন শাসনামলে আমরা তা লক্ষ্য করেছি, তিনি অসাধাারণ দক্ষতার সঙ্গে পররাষ্ট্র বিষয়ক আলোচনা বা তর্ককে বন্ধুত্ব ও সহাবস্থানের মানবিকপ্রেক্ষিত থেকে বিবেচনা করতে শিখিয়েছিলেন। সেই সৌন্দর্য়ের কথাই ড. কামরুল বলেছেন।
শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবকাঠামো গড়ে তুলতে কোন কোন ক্ষেত্রে জোর দেয়া প্রয়োজন, সেটা জেনারেল ওয়াকার যতটা জানেন, তারচেয়েও বেশি ভালো জানবেন এ-বিষয়ের জ্ঞানবান গবেষকরা। সেটাই বলতে চেয়েছেন সেনাবাহিনীপ্রধান। আবার গবেষণার ফলাফল বিষয়ে সরকার বা নীতিনির্ধারকগণ অবহেলা করেন বা চুপ থাকেন, তাহলেও দেশের ও ক্ষতি হবে জনগণের। কারণ প্রতিটি চিন্তার ফসল যদি প্রয়োগ ক্ষেত্রে না লাগে বা না লাগানো যায়, তাহলে তা অপচয় বলে পরিগণিত হবে।
এফএসডিএস প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আকবর এলাহী বলেন `জাতীয় নিরাপত্তায় বেসামরিক ও সামরিক খাতের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি নির্মাণে যে সহযোগিতার কথা বলেছেন, তাকে স্বাগত জানাই। জেনারেল ওয়াকার উজ জামানও এই প্রতিষ্ঠানটিকে সময়োযোগী বলে মন্তব্য করেছেন। তার মানে আমাদের কিছু চিন্তন প্রতিষ্ঠান থাকার পরও তাদের গবেষণার কাজে লাগানো হয়নি—, সে-ব্যাপারে বিগত সরকারের অনীহা ছিলো, এই সত্যই ফুটে উঠেছে তার কথায়।
অন্যান্য আলোচকদের মধ্যে অধ্যাপক ড.মাহবুবউল্লাহ বলেছেন শুল্ক বাধা আরোপের নীতিগুলো আমার মনে হয় বিশ্বায়নের জন্য খুবই ক্ষতিকর। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর সাবেক অধ্যাপক ড.দিলারা চৌধুরী বলেছেন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ আসলে একটি অত্যন্ত ঐতিহাসিক এবং সমালোচনামূলক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড.বোরহানউদ্দিন খান বলেছেন জুলাই বিদ্রোহের অপূর্ণ আকাঙ্খার প্রতিনিধিত্ব করে আন্তরিকভাবে আশা করি এফএস ডিএস বিভিন্ন শাখার মেধাবী মননকে একত্রিত করবে।
উল্লিখিত প্রাজ্ঞজনদের বক্তব্য থেকে যে আশার স্ফূরণ এসেছে, তার কেন্দ্রে রয়েছে বাংলাদেশ ফার্স্ট চেতনা। আমরা তো বাংলাদেশকেই সমৃদ্ধির শিখরে নিয়ে যেতে চাই।
২.২
আমাদের ব্লু রিসোর্স ইকনমিক এরিয়ার নাম বে অব বেঙ্গল। বঙ্গোপসাগরের সম্পদ কি পরিমান আছে, তা আমরা জানি না। সরকারও তা পুরোপুরিভাবে জ্ঞাত বলে মনে করি না। কেন না, বঙ্গোপসাগরের সম্পদ নিয়ে গবেষণা হয়েছে বলে মনে পড়ে না। স্বাধীনতার পর, মনে পড়ছে, রাশিয়ার একটি গবেষক দল বে অব বেঙ্গলে খনিজ সম্পদ বিষয়ে অনুসন্ধানের কাজ করেছিলো। সেই সময় তারা জানিয়েছিলো যে বে-তে বহু তেল ও গ্যাসের সন্ধান তারা পেয়েছেন। কিন্তু সেই ১৯৭২ থেকে ৭৫ সালের সরকার সেই ব্যাপারে উৎসাহ দেখায়নি। পরে, সেই রাশিয়ান গবেষক দলটি ফিরে যায়। ওই সময়ের সংবাদপত্রে ওই সংক্রান্ত কিছু তথ্য পাওয়া দুষ্কর হবে না।
এর বাইরে, বঙ্গোপসাগরের খনিজসম্পদ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা ও তৎপরতা আমরা দেখিনি। বেগম খালেদা জিয়ার সময় ওই সব এলাকার সম্পদ আহরণের জন্য বিভিন্ন দেশের তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী কয়েকটি কোম্পানিকে ব্লক চিহ্নিত করে লিজ দেয়া হয়। তারা কাজ চালাতে থাকলেও ওই সাগরের সম্পদ ব্যবহারের উল্লেখযোগ্য কিছু হয়নি। আজকে যে দেশের গ্যাস সংকটের মধ্যে শিল্প সেক্টর ধুঁকছে, তার জন্য কে বা কারা দায়ী, সেটা আগে দেখতে হবে। পেট্রোবাংলার প্রতিষ্ঠান বাপেক্স বিভিন্ন গ্যাস ক্ষেত্রে কূপ খনন করে সম্পদের সন্ধান পেলেও বিগত সরকার সেই আবিস্কারকে উত্তলনের দোরগোড়ায় নিয়ে আসেনি। বরং বিগত সরকার ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ছিলো উদগ্রভাবে আগ্রহী। এর পেছনে যে ছিলো দুর্নীতি তা বোঝার জন্য খোলাদৃষ্টিই যথেষ্ট। ফ্যাসিস্ট হাসিনার মানি লন্ডারিংয়ের বিভিন্ন অপতৎপরতার এটিও একটি নালা। এই পথে যে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে তা দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসবেই। বিশাল বিশাল উন্নয়ন প্রকল্পের নেবার পেছনে ছিলো দেশের অর্থ পাচার করে নেবার আরো একটি ধারবাহিক চর্চা। বর্তমান সরকার এ-ব্যাপারে অনেকটাই সজাগ জানতে পেরেছি, কিন্তু ওই ছিদ্রগুলোর মুখ বন্ধ করে দেবার ক্ষেত্রে তৎপরতা তেমন সচল ও গতি লাভ করেনি। এর কারণ, হাসিনার ফেলে যাওয়া দলজীবী প্রশাসনের অনেকেই এখনো নানা গুরুত্বপূর্ণ পদ/পজিশনে রয়েছে, যারা হাসিনার দুর্বৃত্তায়নের অংশীদার ও সুবিধাভোগী। এদের শেকড়-বাকড় উপড়ে ফেলতে না পারলে ২৪-এর জুলাইয়ে যে রক্ত ঝরেছে, তার প্রতি অবহেলা করা হবে। সেই সঙ্গে নতুন চেতনার যে ফল্গুধারা আমরা মৌল চিন্তা হিসেবে পেয়েছি, সেই চেতনার আলোকে নতুন দেশ গড়ে তোলা ইতিকর্তব্য বলে বিবেচনা করি। কেন ওই বিজয়কে দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে চিহ্নিত ও চিত্রিত করা হচ্ছে, তার মূল আকাঙ্খাও উপলব্ধি করতে হবে আজ।
২.৩
আমরা এতোকাল কেবল ইলিশের গল্পই শুনে এসেছি। বে-এর মিনারেলসের সংবাদ তেমন একটা পাই না। ইলিশ আমাদের মৎস ইকনোমির একটি সোনার খনি এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু নেই খনিজ সম্পদ আহরণে ইতিবাচক তৎপরতা। ইলিশের প্রজনন ও বৃদ্ধির জন্য যে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমাদের সরকারি কার্য়ক্রম তেমন একটা সচল ছিলো না। আজো সেই বিষয়ে নতুন গবেষণার ভেতর দিয়ে একে বড় অর্থনৈতিক উৎস করে তোলা হয়নি। কেন হয়নি বা হচ্ছে না, সেই ব্যাপারে সরকারকে এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে এর প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে হবে। আমরা লক্ষ্য করেছি, প্রতিবছরই আমাদের মৎস্য সম্পদ লুটে নিয়ে যায় প্রতিবেশি ভারত ও মিয়ানমারের জেলেরা। বিশেষ করে ইলিশের প্রজননকাল হিসেবে যে সময় ইলশ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এবারই প্রথম তা নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে অবকাশকালের ১৫ দিনের ব্যবধানে ভারতীয় চোরা ট্রলারগুলো ইলিশ ধরে নিয়ে যেতে না পারে।
তাদের অবৈধ তপরতা বন্ধ করতে হলে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর শক্তি বাড়ানোর অন্য কোনো বিকল্প নেই। সমুদ্র সম্পদ ও আমাদের সমুদ্রের নিরাপত্তা বিধান, নৌপথের বাণিজ্যিক সুযোগ সৃষ্টি এবং একে ইন্দো-প্যাসিফিকের নৌ-রুটের একটি বহুমুখি উৎসের কথা বিবেচনা করে সেই সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের তলদেশে কি পরিমান খনিজ সম্পদ আছে তা নিরীক্ষা খুবই জরুরী বিষয়। আবার এটাও মনে রাখতে হবে যে কৌশলগত দিক থেকে বে অব বেঙ্গল বিশ্ব নৌ-বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাব হয়ে উঠতে পারে, যদি সময়মত আমরা প্রস্তুত হই।মনে রাখতে বলি দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দো প্যাসিফিক সামদ্রিক অঞ্চলের নৌ-বাণিজ্যের সহজ ও সুন্দর একটি পথ হতে পারে বে অব বেঙ্গল। বিশ্ব বাণিজ্য অধিপতিদের দৃষ্টি পড়ছে আমাদের এই স্ট্যাটেজিক অবস্থানের জন্য। নৌ-বাণিজ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দক্ষিণ চীন সাগর , যার প্রবেশ পথ মালাক্কা প্রণালী হয়ে বাণিজ্য জাহাজগুলো চলাচল করে— সেই বাণিজ্যের পরিমাণ বছরে ৫.৩ ট্রিলিয়ন ডলার। কিন্তু সাংসাৎসরিক গোলমাল লেগে থাকে আমেরিকা ও চীনের মধ্যে, এই সাগরের সম্পদ নিয়ে। সেই সঙ্গে আছে তাইওয়ান সমস্যা, যা মূলত চীনকে যেমন খোঁচায়, তেমনি প্রতিবেশি দেশগুলোকেও। ওই সাগরের ৮০ শতাংশই চীন ব্যবহার করছে। এই বাণিজ্য নৌ-রুটটি বহু বাণিজ্য-অধিপতিরাই এড়াতে চায়। সেই ক্ষেত্রে বে অব বেঙ্গল হতে পারে তাদের সহজ নৌরুট। এই রুট নতুন দিগন্তু খুলে দিতে পারে যদি বে অব বেঙ্গলকে নিরাপদ করে তোলা যায়। এই ক্ষেত্রে আমাদের নৌ-বাহিনী বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। ঠিক এ-কথাটিই সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার বলেছেন সুস্পষ্টভাবে। সেটা আজ সরকারকে বুঝতে হবে। আমাদের দুইশ মাইল দীর্ঘ সমুদ্রের সামগ্রিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর সৃষ্টি করতে কাজ করছে বাংলাদেশ সরকার। এই প্রতিষ্ঠান সচল হলে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় যে, আমাদের অর্থনৈতিক সাফল্য আসবেই। আর সামরিক দিকটি যদি বিবেচনায় নিই, তাহলে বিবাদমান ইন্ডিয়া ও চীনের মাঝখানে বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে ট্যাগ অব ওয়ারের মধ্যে শান্তির সেতু নির্মাতা দেশ। আমরা ভারসাম্যময় পররাষ্ট্র নীতিই কেবল আবাহন করি না, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে শান্তিপূর্ণ ও শক্তিশালী সহাবস্থান। আমরা লাভবান হতে পারি আরো বহুবিষয়ে, যদি দেশের সরকারকে চিন্তক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের গবেষণার মাধ্যমে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারে। জেনারেল ফজলে এলাহি আকবর, সেই সুযোগ সৃষ্টির কথাই বলেছেন। আর জেনারেল ওয়াকার চান এই প্রতিষ্ঠানটি যেন সামরিক বাহিনীকেও সহায়তা করে। বাংলাদেশ ফার্স্ট’ যদি হয় চিন্তাগত ক্ষেত্র , তাহলে এফএসডিএস হতে পারে একটি ভারসামপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান। আমরা কি এরকম আশা করতে পারি না?
ড. মাহবুব হাসান : চিন্তক, গবেষক, লেখক এবং সাংবাদিক।
০৪/২৪-২৬/২০২৫