spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধনতুন কবিতা : ধারা, ভিন্নতা ও পরীক্ষার বিস্তার

লিখেছেন : মাসুদুল হক

নতুন কবিতা : ধারা, ভিন্নতা ও পরীক্ষার বিস্তার


মাসুদুল হক

কবিতা চিরকালই একটি রূপান্তরশীল শিল্প। একে আমরা কতকটা সীমার মধ্যে আবদ্ধ সাহিত্যরূপ হিসেবে ভাবলেও, প্রকৃতপক্ষে কবিতা সেই সব রূপান্তরের সেতুবন্ধন, যেখানে ভাষা কেবল তথ্য নয়, অনুভব ও ভাবনার একাধিক স্তরের বাহক হয়ে ওঠে। তাই কবিতাকে যদি কেবলমাত্র ‘লিরিক’ বা আবেগময় অভ্যন্তরীণ বয়ান হিসেবে ধরা হয়, তবে তা কবিতার প্রকৃত স্বরূপকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। বরং, আধুনিক ও উত্তরাধুনিক সাহিত্যবীক্ষায় কবিতা আজ এক বহুমাত্রিক, বহুবর্ণ ও বহুভাষিক এক শিল্পভাষ্য হয়ে উঠেছে—যেখানে ছন্দ, আঙ্গিক, বক্তব্য এবং প্রকাশভঙ্গি—সবই এক ধরনের চলমান সন্ধানের অংশ। এমন কবিতাকে কেউ কেউ হয়তো শ্রেণিবদ্ধ করতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন, কিন্তু এটি কবিতার সংকট নয়, বরং তার সম্ভাবনা।

এই সম্ভাবনার একটি দিক হলো চিত্রকর ও কবির যৌথ সৃষ্টিকর্ম—যেখানে কবিতা ও চিত্রশিল্পের সম্মিলনে তৈরি হয় চিত্রকবিতা বা ভিজ্যুয়াল পোয়েট্রি। এই সম্মিলিত রচনায় শব্দ ও দৃশ্য একত্রে একটি নতুন অভিজ্ঞতা নির্মাণ করে, যা পাঠের পাশাপাশি দর্শনেরও বিষয় হয়ে ওঠে। এমন কাব্যিক পরীক্ষা কবিতার ধারাবাহিক বিবর্তনের একটি চিহ্ন।

প্রথাগতভাবে কবিতা বলতে যা বোঝানো হতো—সুসংবদ্ধ ছন্দ, অন্ত্যমিল এবং আবেগভিত্তিক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা—তা বিংশ শতকের পর থেকে ক্রমেই ভেঙে পড়তে শুরু করে। রোমান্টিক যুগে কবিতা ছিল একক চেতনার একক বয়ান, যেখানে কবি তার নিজের অনুভবকে পরিশুদ্ধ ভাষায় প্রকাশ করতেন। কিন্তু সময় বদলেছে। শিল্প-সাহিত্য আর কেবল একক অভিজ্ঞতার মঞ্চ নয়; এটি হয়ে উঠেছে পারস্পরিক, সামষ্টিক ও অনিশ্চিত অভিব্যক্তির এক ক্ষেত্র। কবিতা, সেই অনিশ্চয়তার পথ ধরে এগিয়ে যেতে গিয়ে, নিজস্ব পরিচয়ের গণ্ডিও অতিক্রম করেছে। এর ধারা, গঠন এবং পাঠ-পদ্ধতিতে এসেছে বিস্ময়কর পরিবর্তন।

বর্তমান কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এটি এক ধরনের উন্মুক্ত ধারায় রচিত সাহিত্য হয়ে উঠেছে। কবিতা শুরু হতে পারে এক গল্প দিয়ে, যেখানে বর্ণনা চলতে চলতে হঠাৎ করেই ভেঙে পড়ে এক চিত্ররূপী বৃষ্টির ভিতর, কিংবা যেখানে শব্দ, দৃশ্য ও নীরবতা মিলে এক নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। এই নতুন অভিজ্ঞতা পাঠকের কাছে চমক তৈরি করে, এবং তার পাঠ-প্রক্রিয়াকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। একে অনেকে বলতে পারেন ‘অশ্রেণিবদ্ধ সাহিত্য’, আবার অনেকে বলবেন এটি “genre-defying”—যেখানে কবিতা, চিত্র, নৃত্য, সঙ্গীত এমনকি পারফরম্যান্সের মধ্যবর্তী অঞ্চল ধরে এগিয়ে চলে।

আধুনিক সাহিত্যতত্ত্ব, বিশেষ করে উত্তরাধুনিক পর্বের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, এই কবিতার সীমাহীনতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। যেমন, জ্যাক দেরিদা তাঁর ‘The Law of Genre’ রচনায় স্পষ্টভাবে বলেন—‘genre’ বা সাহিত্যধারা কোনো অনড় কাঠামো নয়। বরং, ধারা মানে এক ধরনের সীমা, এবং সীমা মানেই তা অতিক্রমযোগ্য। কবিতা, এই অতিক্রমের জায়গা থেকেই, নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথে হাঁটছে।

এই পরীক্ষানিরীক্ষা (experimentation) আজ কবিতার একটি কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। প্রথমত, কবিতার আঙ্গিকগত পরীক্ষা চলছে: দৃশ্যকবিতা (visual poetry), পারফরম্যান্স কবিতা, পলিপোয়েট্রি ইত্যাদি শৈলীতে কবিতা কেবল পাঠযোগ্য নয়, দর্শনযোগ্য ও শ্রবণযোগ্য শিল্পরূপে রূপান্তরিত হচ্ছে। শব্দ আর কাগজে সীমাবদ্ধ না থেকে কবিতা ছড়িয়ে পড়ছে ক্যানভাসে, পর্দায়, মঞ্চে, এমনকি শহরের দেয়ালে।

দ্বিতীয়ত, কবিতা এখন তার প্রচলিত ফর্ম বা অভ্যন্তরীণ কাঠামো ভেঙে দিচ্ছে। পাঠক কীভাবে কবিতার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, সেই দৃষ্টিভঙ্গিও কবিতা নির্মাণের প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে উঠেছে। এর ফলে কবিতা হয়ে উঠছে পাঠকের সঙ্গে এক সংলাপের ক্ষেত্র, যেখানে কবির ভূমিকা একক না হয়ে পাঠকও হয়ে উঠছে অংশীদার। এই ধরনের কবিতা এক ধরনের “বহির্মুখীতা” ধারণ করে—যেখানে কবিতার মনোযোগ কেবল অন্তর্জগতে সীমাবদ্ধ না থেকে বাইরের জগত, সমাজ ও রাজনীতির প্রতিও বিস্তৃত হয়।

তৃতীয়ত, পরীক্ষার আরেকটি পর্ব হলো, কবিতার ব্যাখ্যার পদ্ধতি নিয়ে কাজ করা। যেখানে কবিতাকে কেবল প্রতীকের ব্যাখ্যায় বিশ্লেষণ না করে, শব্দের গঠন, চিত্রকল্পের বিন্যাস ও চেতনার প্রবাহ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে কবিতা হয়ে উঠছে এক ধরনের ভাষাগত পারফরম্যান্স। ব্যাখ্যার এই নতুন পদ্ধতিও কবিতাকে নতুন অর্থভূমিতে দাঁড় করাচ্ছে।

এই সব পরীক্ষানিরীক্ষা এবং গঠনতত্ত্বের ভেতরে একটি বিশেষ ধারণা ক্রমেই গুরুত্ব পাচ্ছে—‘ভিন্নতা’ বা ‘otherness’। আধুনিক সাহিত্যতত্ত্বে ‘ভিন্নতা’ একটি জটিল, বহুমাত্রিক ধারণা। এটি কেবল সামাজিক পরিচয়ের বিভেদ বোঝায় না; বরং, এটি বোঝায় সেইসব সত্তাগুলিকে, যারা ‘প্রধান’, ‘স্বাভাবিক’ বা ‘স্বীকৃত’ পরিচয়ের বাইরে অবস্থান করে। কবিতা এখন এই ‘অন্য’ সত্তাগুলোর প্রতি গভীর মনোযোগী হয়ে উঠছে। এ এক ধরনের নৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, যেখানে কবিতা নিজের সীমানা থেকে সরে এসে এক নতুন সংলাপ তৈরি করছে।

এই সংলাপের দৃষ্টান্ত আমরা পাই জ্যাকি ইসলামের কবিতায়। এক মৃত শিশুর সঙ্গে কবির কথোপকথন সেখানে ‘অন্য’-এর ধারণাকে বাস্তব করে তোলে। কিংবা ফিরোজ এহতেশামের কবিতায় দেখা যায় দেয়াল থেকে মুখ বেরিয়ে কথা বলছে।আবার, অমিত রেজা চৌধুরীর কবিতায় “নখ” আর “জোড়া চোখ” যেন নিজের শরীরের মধ্য দিয়েই ‘ভিন্নতা’র অভিজ্ঞতা নির্মাণ করে। যেমন তিনি লেখেন—

“নখে নয়,
তুমি নেইল পলিশ মাখছিলে তোমার
নখরে উঠে আসা আমার জোড়া চোখে—

গত জীবনের লোককবির মেলা থেকে ফিরতে ফিরতে মনে হলো,
তোমাকে ভালোবাসা আসলে ওফেলিয়ার অমা-সরোবরে
বিভাকুসুম হয়ে ফোটা।”

এই কবিতায় ‘নেইল পলিশ’ একটি সামাজিক প্রসাধন, কিন্তু সেই সাজের মাঝেই লুকিয়ে আছে কবির একান্ত দৃষ্টি, যা আবার অন্য এক অস্তিত্বকে প্রতিফলিত করে। এই চিত্রকল্প কেবল বিমূর্ত নয়, বরং আত্মসন্ধানী ও সম্পর্কমুখী। ভিন্নতা এখানে এক বস্তুনিষ্ঠ উপলব্ধি নয়; বরং, এটি হয়ে ওঠে ‘নিজ’ এবং ‘অন্য’-এর মধ্যকার এক চলমান সংলাপ, কখনো দ্বন্দ্ব, কখনো আকাঙ্ক্ষা।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, কবিতা আজ একক সৃজন নয় বরং যৌথ সৃজনের দিকে এগোচ্ছে। interdisciplinary authorship এখন এক স্বাভাবিক বাস্তবতা। চিত্রকর, শব্দশিল্পী, নৃত্যশিল্পী ও নাট্যকার একত্রে কাজ করে নতুন ধরনের কবিতা নির্মাণ করছেন। এটি একটি hybrid ফর্ম, যা শুধুই পাঠ নয়, বরং দর্শন, শোনা এবং অনুভব করার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। শাহিন মমতাজ এবং মোস্তাক আহমাদ দীনের চিত্রকবিতায় এই ধারা লক্ষ করা যায়—যেখানে কবিতা একটি চিত্র হয়ে ওঠে, পাঠক তার সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বারবার দ্বিধাগ্রস্ত হয়, এবং সেই দ্বিধা বা বিভ্রান্তিই কবিতার প্রকৃত অভিপ্রায় হিসেবে প্রতিভাত হয়।

এইসব পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, কবিতা আর কেবল একটি নির্দিষ্ট কাঠামো নয়, বরং একটি প্রবাহ—যা ভাষা, দৃশ্য, শরীর ও ভাবনার বহু স্তরে প্রবেশ করে।
এটি কখনো আত্মজগতের, কখনো সমাজ-সংসারের, কখনোবা পাঠকের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বেরও আয়না হয়ে ওঠে। কবিতা এখন আর একক কণ্ঠের রোমান্টিক উচ্চারণ নয়, বরং বহু কণ্ঠ, বহু রূপ ও বহু দৃষ্টিভঙ্গির এক সম্মিলন।
non-lyric poetry”, “deslírica” বা “post-poetry” নামেও আজ কবিতা চর্চা হচ্ছে—যেখানে পরিচিত কাঠামো বা আঙ্গিকের পরিবর্তে অচেনা অনুভব এবং নির্মাণকৌশল গুরুত্ব পাচ্ছে। এই অনুভব, নির্মাণকৌশল,সম্মিলনই নতুন কবিতার প্রকৃত শক্তি—যা তাকে সীমাহীন করে তোলে, আবার অর্থবহও।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

শিকদার মুহাম্মদ কিব্রিয়াহ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on মা দিবসের কবিতা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম on শিপা, আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড হতে পারিনি