আবু তাহের সরফরাজ
১৬ জুলাই বুধবার ছিল ‘জুলাই শহিদ দিবস’। গত বছর এই দিনে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে প্রথম শহিদ হন রংপুর কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি উদযাপনের আয়োজন করা হয়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দিবসটি নিয়ে বাণীও দেন। দেশজুড়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। দেশজুড়ে যখন এই আয়োজন চলছে ঠিক সেই সময় গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশ ঘিরে পতিত স্বৈরাচারের রাজনৈতিক দলের পাণ্ডারা সহিংসতার জন্ম দেয়। দুপুরের পর থেকে দেশের মানুষের চোখ ছিল গোপালগঞ্জে কী ঘটছে, সেই দিকে। ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে শুরু করে নিউজ পোর্টালগুলোতে দেশবাসীর চোখ ছিল। পক্ষে-বিপক্ষে নানা মন্তব্য ও সংবাদে দিনটি হয়ে উঠেছিল সার্কাসমুখর। সার্কাস লিখছি কারণ, ফেসবুকে নানাজনের মন্তব্য কিংবা নিউজ পোর্টালের একপেশে সংবাদ পড়ে সূক্ষ্ম বিচারবোধসম্পন্ন মানুষের কাছে বিষয়টি সার্কাসই মনে হচ্ছিল। বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো হয় পুলিশের প্রতিবেদন। গোপালগঞ্জে আসলে কী ঘটেছিল সেই বিষয়টির সাধারণ পাঠক আমরা ওই প্রতিবেদন থেকে নিতে পারি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে:
১. ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান স্মরণ করতে এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া মানুষের কথা শুনতে ১ থেকে ৩০ জুলাই সারা দেশে মাসব্যাপী ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। জুলাই পদযাত্রার কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৬ জুলাই ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচিতে বেলা ১১টায় গোপালগঞ্জ পৌর উন্মুক্ত মঞ্চে এনসিপি জনসমাবেশ ঘোসণা দেয়। সমাবেশে অংশ নিতে সকাল সাড়ে ১০টায় বরিশাল মহানগরীর সদর থানার সার্কিট হাউজ এলাকা থেকে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা রওয়ানা দেন।
২. সমাবেশের নিরাপত্তার জন্য সকাল থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন তৎপর থাকে। সকাল ৯টা নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের একটি সন্ত্রাসি দল গোপালগঞ্জ সদর থানার উলপুরে আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত পুরিশ সদস্যদের ওপর হামলা করে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় একজন পুলিশ পরিদর্শকসহ পুলিশের তিন সদস্য আহত হয়।
৩. বেলা ১১টায় গোপারগঞ্জ সদর থানার কংশুর বাসস্ট্যান্ডে গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট সড়কে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ পৌর শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ওমর ফারুক খান রিপনের নেতৃত্বে ৪০-৫০ জন আওয়ামী লীগ সমর্থক সড়কে গাছ ফেলে এবং কাঠ দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় গোপালগঞ্জ ইএনওর গাড়ি ওই স্থানে গেলে গাড়ি ভাঙচুর করে তারা সড়ক অবরোধ করে রাখে।
৪. বেলা সাড়ে ১১টায় কোটালীপাড়া থানার অবদার হাট এলাকায় কোটালীপাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম দারিয়ার নেতৃত্বে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মিছিল করে কোটালীপাড়া-পয়সারহাট সড়কে গাছ ফেলে ব্যারিকেড দিয়ে ২ হাজার ৮০০ জন থেকে ৩ হাজার নেতাকর্মী রাস্তা অবরোধ করে রাখে। বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে সদর থানার কাঠিবাজার এলাকায় গোপালগঞ্জ-কোটালীপাড়া সড়কে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ পৌরসভার মামুনের নেতৃত্বে ২০০ থেকে ৩০০ জন আওয়ামী লীগ সমর্থক দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সড়কে গাছ ফেলে ব্যারিকেড দিয়ে অবরোধ করে।
৫. জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতৃবৃন্দ গোপালগঞ্জ পৌরপার্ক সভাস্থলে পৌঁছানোর আগে দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের ৫০ থেকে ৬০ জনের একটি সন্ত্রাসী দল ককটেল বিস্ফোরণ করে ঢাল ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মঞ্চে আক্রমণ করে। তারা মঞ্চের ব্যানার ও চেয়ার ভাঙচুর করে। দুপুর ২টা ১ মিনিটে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা মঞ্চে ওঠেন।
৬. এরই মধ্যে দুপুর সোয়া ২টায় গোপালগঞ্জ সদর থানার সাতপাড় বাজার এলাকায় দুর্বৃত্তরা দুটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। তারা দুটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করে। উচ্ছৃঙ্খল জনগণ রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে ব্যারিকেড দেয় এবং বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগ করে।
৭. দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে পদযাত্রা সভা শেষ করে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা সভাস্থল ত্যাগ করেন। পদযাত্রা সভায় আনুমানিক ২০০ জন উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে তাদের গাড়িবহর পরবর্তী পদযাত্রা সভাস্থল মাদারীপুরের উদ্দেশে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর প্রহরায় রওয়ানা দিলে গোপালগঞ্জ পৌরসভার লঞ্চঘাটে আওয়ামী লীগ এবং এর নিষিদ্ধ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের লোকজন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ৩টায় গাড়িবহর আটকে দেয়।
৮. সেনাবাহিনী ও পুলিশ উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে বোঝাতে চেষ্টা করে। কিন্তু তারা কোনো কথা না শুনে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে এবং দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীসহ এনসিপির নেতাকর্মীদের ওপর আক্রমণ করে। এছাড়া নাশকতাকারীরা গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারসহ অন্যান্য সরকারি স্থাপনায় হামলা চালায়। এসময় সংঘর্ষে চারজন নিহত হন। এসব ঘটনায় প্রায় ৪৫ পুলিশ সদস্য ও সাংবাদিকসহ অর্ধশতাধিক লোকজন আহত হয়।
৯. নাশকতাকারীদের আক্রমণে সেনাবাহিনী ও পুলিশ এনসিপি নেতাকর্মীদের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নিয়ে আসে। পরে ৪টা ৫৮ মিনিটে পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে যৌথবাহিনীর সহায়তায় জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা গাড়িতে করে বাগেরহাট হয়ে খুলনার উদ্দেশে চলে যান।
১০. আনুমানিক সন্ধ্যা ৭টায় উচ্ছৃঙ্খল জনতা নিহত চারজনের মরদেহ পোস্টমর্টেম করতে না দিয়ে জেলা হাসপাতাল থেকে জোরপূর্বক নিয়ে যায়।
পুলিশের এই প্রতিবেদন থেকে ঘটনার প্রেক্ষাপট আমরা ধারণা করে নিতে পারি। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও নিউজ পোর্টালগুলোতে দিনভর যেসব তথ্য আমরা পেয়েছি সেসবে বিভ্রান্তিকর নানা তথ্য ছিল। মোটামুটি সকল নিউজ পোর্টালই আওয়ামী ও ছাত্রলীগের হামলা উল্লেখ করলেও দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি জাতীয় দৈনিকের পোর্টাল হামলাকারী ‘একদল লোক’ বলে উল্লেখ করে। তাদের সংবাদ পাঠে মনে হয়, এনসিপির সমাবেশে হামলা ও গাড়ি পোড়ানোর ঘটনা স্থানীয় লোকজন কিংবা অজ্ঞাত কোনো দল বুঝি করেছে। এর মানে, ঘটনার দায় গোপালগঞ্জবাসীর ওপর বর্তায়। কিন্তু তা তো নয়। গোপালগঞ্জে অনেক নীরিহ সাধারণ মানুষ রয়েছে যারা এই অপকর্মের সাতে-পাঁচে নেই। গোটা দেশের মানুষ যখন ফেসবুক ও আরসব নিউজ পোর্টালের মাধ্যমে হামলায় জড়িত আওয়ামী লীগের কথা জানতে পারছে সেই প্রেক্ষাপটে নির্দিষ্ট ওই নিউজ পোর্টাল কী উদ্দেশ্যে ‘একদল লোক’কে হামলাকারী হিসেবে উল্লেখ করলো? বিষয়টি মোটাদাগে চোখে পড়ার মতো। এরই পাশাপাশি ফেসবুকে নানাজন নানা মন্তব্যের ভেতর দিয়ে ঘটনাটিকে ভিন্নপথে ঘোরানোয় ব্যতিব্যস্ত ছিল। কেউ লিখছে, গোপালগঞ্জে সমাবেশ করতে যাওয়া এনসিপির উচিত হয়নি। কেন উচিত হয়নি, সেই প্রশ্নের সহজ কোনো জবাব তারা দিতে পারেনি। তবে বোঝা যায়, বিভ্রান্তি ছড়াতেই তারা যা-ইচ্ছে তা-ই মন্তব্য লিখে গেছে। আমাদের প্রশ্ন, দেশের ৩৩টি জেলায় এরই মধ্যে এনসিপি সমাবেশ করেছে। তাহলে গোপালগঞ্জে কেন তারা সমাবেশ করতে পারবে না? গোপালগঞ্জ কি বাংলাদেশের বাইরে? ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গোপালগঞ্জে সমাবেশ করে। সেই সময় কিন্তু এসব পাণ্ডারা হামলা করেনি। এর মানে কি এই যে, বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্য তৈরি হয়েছে? আর যেহেতু এনসিপির শীর্ষনেতারা স্বৈরাচার আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন তাই তাদের ওপরই স্বৈরাচারের পাণ্ডাদের সকল আক্রোশ? ফেসবুকের স্ট্যাটাসে কেউ আবার আরেক কাঠি সরেস। তারা লিখেছে, এনসিপি নাকি শেখ মুজিবের সমাধি ভাঙতে সেখানে গেছে। এজন্যই গোপালগঞ্জবাসী তাদের ওপর চড়াও হয়েছে। কী হাস্যকর প্রোপাগাণ্ডা! কেউ কেউ আবার এনসিপির গোপালগঞ্জে সমাবেশ করতে যাওযার পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র কথা ব্যক্ত করেছেন। তাদের ভাষ্য, দেশকে অস্থিতিশীল করতেই মূলত এনসিপি গোপালগঞ্জে কর্মসূচি দিয়েছে। এনসিপি নাকি পায়ে পাড়া দিয়ে গোপালগঞ্জে সংঘাত সৃষ্টি করেছে। কারো মন্তব্য, জনগণ নাকি এনসিপির ওপর হামলা করেছে। এনসিপি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এহেন কত যে হাস্যকর মন্তব্য সারাদিন ঘুরেছে ফেসবুকে, তার কোনো হিসাব নেই। অথচ গণমাধ্যমসহ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যারা ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করছিল তাদের ফেসবুক স্ট্যাটাসে অস্ত্রধারী সাবেক ফ্যাসিস্ট সরকারের গুণ্ডাবাহিনীর ছবি সকলের চোখে পড়েছে। কিন্তু এরপরও চোখের সামনে দেখা সত্য ঘটনাকে নানাভাবে পেঁচিয়ে কেউ কেউ মিথ্যার আবরণে ঢেকে দিতে সরব হয়ে ওঠে। সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্যে রূপান্তরিত করতে তাদের চেষ্টার কোনোই ত্রুটি ছিল না। এরা কারা? এসব করে এদের স্বার্থই বা কী, সেদিকে এবার একটু চোখ ফেরানো যাক। এদের মধ্যে বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ কিংবা তার মদদপুষ্ট ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত মাসোহারায় জীবিকা নির্বাহ করছে। ফলে, যার নুন খায় তার গুণ তো গাইতেই হবে। এই শ্রেণির লোকজন টাকা খেয়ে লীগের পক্ষে ইউটিউবে নিয়মিত ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করছে। সেসব কনটেন্টে তারা নানাভাবে অন্ধের মতো বেকুবের মতো লীগের সাফাই গাইতে গাইতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। আরেক শ্রেণি আওয়ামী সিস্টেমে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে। ফলে, সত্যকে চোখের সামনে পরিষ্কার দেখতে পেয়েও মিথ্যের কালো কাপড়ে সত্যকে তারা ঢেকে ফেলছে।
আমাদের ধারণা যে, আওয়ামী লীগের সরকার পতন হয়েছে, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত হয়েছে এবং ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হয়েছে মানেই আওয়ামী লীগের প্রভাবমুক্ত হয়ে গেছে রাষ্ট্র। তা যে হয়নি গোপালগঞ্জের ঘটনা তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশের বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক দল হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দীর্ঘ বছর বিএনপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নেই। তার মানে এই নয় যে, বিএনপির কোনো প্রভাব রাষ্ট্রে নেই। দেশের অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিএনপির প্রভাব রয়েছে। বিএনপি নেতাদের মালিকানায় পরিচালিত হয় দেশের অসংখ্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। দেশজুড়ে বিএনপির জাল ছড়ানো। একইভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না-থাকলেও তাদের লোকজন দেশের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে আছে। এই সংখ্যা এখনো সরকারি নানা প্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি। আওয়ামী লীগের এসব সমর্থকরা যেন ভাইরা ভাই। একজনের সঙ্গে আরেকজনের গভীর প্রণয়। গোপনে তারা নিজেদের ভেতর নানা-কিছুর লেনদেন চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাইরে ধোয়া তুলসিপাতা। লীগের চিহ্নিত লোকেরা অনেকে ভারতে পালিয়ে গেছে। যারা পালাতে পারেনি তাদের অনেকে এখন আশ্রয় নিয়েছে গোপালগঞ্জে। তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। এই চিত্র এনসিপির ওপর হামলার সময় আমরা দেখেছি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গোপালগঞ্জের ঘটনার বিষয়ে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য ছিল, কিন্তু এত পরিমাণ যে হবে সে তথ্য ছিল না। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, দেশজুড়ে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে নামানো হয়েছে তারা কি গোপালগঞ্জে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে পারেনি এতদিনেও? প্রায়ই আমরা সংবাদপত্রে দেখি, দেশের কোথাও না কোথাও আওয়ামী লীগ কিংবা ছাত্ররীগের কাউকে পেলে জনতা ধোলাই দিয়ে কিংবা ধোলাই না-দিয়েও পুলিশের হাতে সোপর্দ করে দিচ্ছে। এর মানে, সাবেক স্বৈরশাসকের পাণ্ডাদেরকে আইনের হাতে তুলে দেয়ার প্রবণতা জনগণের ভেতর রয়েছে। প্রশাসনও এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। পতিত সরকারের সাহায্যকারী যে-কাউকে পেলেই পুলিশ গ্রেফতার করে আদালতে তুলছে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, গোপালগঞ্জ যে এখন তাদের আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে উঠেছে এই খবর কি সরকারের কাছে নেই? আছে তো নিশ্চয়ই। তার খানিকটা আভাস আমরা দেখতে পাই বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কথায়। আমরা বুঝতে পারি, অন্তবর্তী সরকার আসলে কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে। চাইলেও এই সরকার কার্যকর পদক্ষে গ্রহণ করতে পারছে না। সমাবেশে আক্রশন-মুহূর্তে সারজিস আলম তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট দেন, গোপালগঞ্জে খুনি হাসিনার দালালেরা আমাদের উপরে আক্রমণ করেছে। অনেক পুলিশ দাঁড়িয়ে নাটক দেখছে, পিছু হটছে। আমরা যদি এখান থেকে বেঁচে ফিরি তাহলে মুজিববাদের কবর রচনা করেই ফিরব, নাহয় ফিরব না। সারা বাংলাদেশের মানুষ গোপালগঞ্জে ছুটে আসুন। গোপালগঞ্জের বিবেকবান ছাত্র-জনতা জেগে উঠুন। দালালদের কবর রচনা করার আজকেই শেষ দিন।
সারজিসের এই পোস্ট থেকে আমরা তিনটি বিষয় চিহ্নিত করতে পারি। ক. আক্রমণকারীরা হাসিনার দালাল। খ. পুলিশ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। গ. গোপালগঞ্জের ছাত্র-জনতাকে তিনি জেগে উঠতে বলছেন। যারা বলছিল এনসিপির ওপর স্থানীয় জনতা আক্রমণ করেছে তারা যে মিথ্যে বলছে সেটা সারজিসের তিন নম্বর পয়েন্টে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। গোপালগঞ্জের জনতা যদি তাদের আক্রমণ করতো তাহলে সারজিস সেই জনতাকেই সম্বোধন করে জেগে ওঠার আহ্বান জানাতেন না। প্রথম পয়েন্টে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন আক্রমণকারী কারা ছিল। এরপরও যারা বিষয়টি নিয়ে দিনভর বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে তারা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই সেটা করেছিল। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে পয়েন্টটির দিকে বিশেষভাবে চোখ রাখা যাক। ‘জুলাই শহিদ দিবস’ উপলক্ষ্যে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠান শেষ করে ঢাকায় ফিরছিলেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান। গোপালগঞ্জের ঘটনার প্রতিবাদে সৈয়দপুর বিমানবন্দরের সামনে তাদের গাড়িবহর থামিয়ে দেয় স্থানীয় এনসিপি নেতারা। সেই সময় আইন উপদেষ্টা বলেন, “আমরা যে পুলিশ বাহিনী নিয়ে কাজ শুরু করেছি সেই পুলিশ আওয়ামী সরকারের নিয়োগ করা। তারা আমাদের পুরোপুরি সহযোগিতা করছে না। শেখ হাসিনা পুরো রাষ্ট্রকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে গেছে।”
গোপালগঞ্জের ঘটনায় পুলিশের প্রতিবেদনে আমরা ধারাবাহিক দশটি পয়েন্ট দেখতে পেয়েছি। এনসিপির সমাবেশ মঞ্চে হামলার সময় সেখানে কি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি ছিল না? ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু হামলাকারী কাউকে তারা গ্রেফতার করেনি। এনসিপির গাড়িবহর যখন আটকে দেয়া হলো তখনো কাউকে গ্রেফতার করেনি। অথচ দেশজুড়ে আওয়ামী কিংবা ছাত্রলীগের কাউকে পেলে প্রশাসন গ্রেফতার করছে। গোপালগঞ্জে কেন করল না? বিষয়টি সন্দেহজনক নয় কি? এর মানে, প্রশাসনের ভেতরও আওয়ামী লোকজন রয়েছে।
গণমাধ্যমের সংবাদে আমরা জানতে পেরেছি, গুলিবিদ্ধ হয়ে চারজন নিহত হয়েছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা আছে কিনা, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কেউ বলছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে তারা নিহত হয়েছে। কেউ বলছে, পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনীর গুলিতে তারা নিহত হয়নি। বলা হচ্ছে, গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। এলাকাটি প্যারা মিলিশিয়া বাহিনীর হোম গ্রাউন্ড। প্রশিক্ষিত মিলিট্যান্টরা এইখানে ঘরে-ঘরে অস্ত্র রাখে। এনসিপির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে তারা প্রস্তুতি নেয় জুলাই বিপ্লবীদের হত্যা করার। এজন্য তারা নাকি তিন দিনের ট্রেনিং ক্যাম্পও করে। কিন্তু ঘটনার দিন তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। ফলে তারা পুলিশ ও সেনা সদস্যদের ওপর হামলা চালায়। এতে পুলিশ ও সাংবাদিকসহ কয়েকজন আহত হয়। কিন্তু প্রতি-আক্রমণ না-পেয়ে তারা চারজন সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে সার-বেঁধে গুলি চালায়। এরপর ফেলে আসে বিভিন্ন স্থানে। পুলিশের প্রতিবেদনের দশ নম্বর পয়েন্ট থেকে আমরা জানতে পেরেছি, আনুমানিক সন্ধ্যা ৭টায় উচ্ছৃঙ্খল জনতা নিহত চারজনের মরদেহ পোস্টমর্টেম করতে না দিয়ে জেলা হাসপাতাল থেকে জোরপূর্বক নিয়ে যায়। এই পয়েন্টেই ওপরের বিষয়টি আরও দৃঢ় হয়। কারণ, পোস্টমর্টেম করলে সত্য বেরিয়ে আসতো।
বৃহস্পতিবার আন্তঃবাহিনীর জনসংযোগ পরিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গোপালগঞ্জ জেলায় একটি রাজনৈতিক দলের জুলাই পদযাত্রার অংশ হিসেবে আহ্বান করা জনসমাবেশকে কেন্দ্র করে এলাকার একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতা ১৬ জুলাই সংঘবদ্ধভাবে সদর উপজেলায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। সেনাবাহিনী হামলাকারীদের মাইকে বারবার ঘোষণা দিয়ে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেও তারা সেনাবাহিনীর ওপর বিপুলসংখ্যক ককটেল ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগে বাধ্য হয় সেনাবাহিনী। এ ঘটনায় প্রাথমিকভাবে কয়েকজন পুলিশ সদস্য ও সাংবাদিক আহত হন।
লক্ষ্যণীয় যে, বিজ্ঞপ্তিতে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ উল্লেখ নেই। আছে একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতা। আবার, এনসিপিরও নাম নেই। এই গোপনীয়তার কারণ কি? বিষয়টি ভেবে দেখার সুযোগ রয়েছে। সহিংস এই ঘটনার প্রকৃত কারণ সরকারি তদন্ত প্রতিবেদনে আমরা বিস্তারিত জানতে পারবো। আপাতত গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব তথ্য জানতে পারছি সেসব বিশ্লেষণে একটি বিষয় বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে কয়েকটি চক্রটি বেশ সক্রিয়। দেশের বৃহত্তর একটি রাজনৈতিক দলের ভূমিকাও এক্ষেত্রে সন্দেহজনক। তবে গোপালগঞ্জের সকল বাসিন্দাই যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত তা নয়, আবার দেশের সকল নাগরিকই যে রাজনৈতিক ফায়দা অর্জনে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে তা-ও নয়। সাধারণ মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে চায়। দেশে স্থিতিশীলতা চায়। ক্ষমতার কামড়া-কামড়িতে তারা থাকে না। এই বিবেচনায় অন্তবর্তী সরকারসহ দেশের সকল রাজনৈতিক দলের কাছে আমাদের প্রার্থনা, আপনারা জাতীয় স্বার্থে এক্যমতে পৌঁছান। নৈতিকতার মানদণ্ডে যে-কোনো বিষয়কে বিচার-বিশ্লেষণ করুন। সামান্য কোনো ভুল সিদ্ধান্তের কারণে মারাত্মক বিপদ ঘটে যেতে পারে। সেই অবকাশ তৈরি করা আমাদের উচিত হবে না।