চাষা হাবিব
১. ব্যথা বাড়ে
…………..
হাটতে থাকে
বুকের ব্যথা;
ব্যথায় কাতরায় পূব পাড়ার তফিরের বড়ভাই ছমির কাকা, শ্বাস ছেড়ে দম ভরে; আর রাতের শরীর জুড়ে শিশিরের কান্নায় ভিজে যাওয়া আঁচল শুকাতে দিয়েই বুকের ব্যথায় ফিট যায় আলতা বু’ নবিরের বেটি; আমরা হইচই করতে করতে ব্যথার কারন খুঁজি অথচ- হাটতে হাটতে ব্যথা বাড়ে; কইতে কইতে ব্যথা বাড়ে;
গায়ের মানুষ শহরত যায়, শহরের মানুষ গ্রামত যায়।
বৃদ্ধ জমির নানা রাজ্জাকের ভাই আগলে থাকে বাপের চাদর—খুইনি—হুক্কা আর পচাগড়ের জমি-জিরাত। বেবাকে কয়, ঢাকার লাল দালানে ব্যথা কেনাবেচা হয়; শহরের দালান হঠাৎ জেগে ওঠে গ্রামের বুক চিরে; চিন চিন ব্যথায় কাতরায়; ব্যথা বাড়ে আর বাড়ে; পঞ্চাশ বছরের ব্যথা জমা হয় লালবাগের শরীর জুড়ে;
হাঁটুর অস্থিতে ঘুণ ধরে, বুকের ছাতিতে রিং পরে, কোমারের সন্ধিতে বেড় পড়ে;
অথচ শিশির পড়তেই থাকে, আঁচল ভিজতেই থাকে।
পাড়াশুদ্ধ মানুষ শহরত যায়
শহরশুদ্ধ মানুষ গ্রামত যায়;
হিসাব মেলে না; ভোটের বাজারে ব্যথা বিক্রি হয়। আলতা বু’র শরীর ফুলে যায়-কাতরায়; ব্যথা বাড়ে আর বাড়ে। হাটতে হাটতে ভিতরগড়—পানামা—চট্টলা—শ্রীহট্ট;
বেবাক ব্যথায় ভরে যায়।
২. মে-মাছ
১ মে, ২০২৫ খ্রি. দিনাজপুর।
……………..
বটি দিয়ে মাছ কাটতে কাটতে—
বুকের কাপড় ঠিক করে আলেমা বেওয়া
-মাছ কাটাই তার পেশা— আঁইশ বেচাই তার নেশা
-আঁইশের জীবন-মাছ পঁচা গন্ধ— এ্যঁসটে বাঁধা দ্বন্দ্ব
-ভুড়ভুড় পেট পচা গন্ধ- গন্ধ করে তার সারা গতর
-তাতে তোর কি রে গোলামের বেটা— বকতে থাকে;
বলতে বলতেই পানি ছোড়ে কালুর শরীলে-কি নাটক করবি নাটক;
বুকের দিকে তাকাস ক্যান— এটা তো বুক নয় রে পাগলা গোরস্তান;
খোলা মাঠ, খেলবি তো খেল-বেবাকেই মাছ ধরে এ বুক গোরস্তান;
তোমরা তো বেবাক খাইছেন-ভিতর বাহির-বুকের ভিতর জমা থাকে—জমা থুই
হ’ বু কইতে কইতেই কালুর বউ কচু কাটে, শাক বান্ধে— নরম বুকের কাপড়ে
বুকে কাপড় থাকলেই কি,আর না থাকলেই কি- শরীল জ্বলে বু—বুক জ্বলে বুক;
বাহাদুর বাজারত— রাত জাগে; রাত জাগে লাল চাঁদ ফকির
ঘুমায় কেশরি বিবির নাতিন— বড় বড় মাঠ, বড় বড় জাত
দখল হয়, দখল করে— দখল কইরেই- মহাজন মহান হয়
হামার বুক—পেট সব খায়, হামার বুকত রাষ্ট্র দালান দেয়;
মাছ কাটলে দুঃখ নাই— মাছের দেহত রক্ত নাই- হামার বুকত কাপড় নাই
রাষ্ট্র রক্ত দেখে না—বুকের কাপড় দেখে, শরীওয়াত খোঁজে— মারিফত করে;
আজকাল মাছের আঁইশও চালান হয়, বুকের কাপড় খসলেই বু’ বাজার হয়
মাগনায় কাপড় টানে—পঁচা মাছের মতো হামার দাম নাই, বেবাক মাছ খায়
ঘামের শরীল ঘাম খায়— ঘামদালান দ্যাশ বেচে দেয়— মাছের শরীর মাছ হয়।
৩. দাঁড়দেয়াল
……………..
দাঁড়িয়ে যাওয়া দেয়ালে
শৈবালপ্রেম মাথা ঠুকে প্রলেপ দেয়।
দাঁড়িয়ে যাওয়া বৈকালিকরোদ স্নান সেরে গা মুছতে মুছতে
দেহের ভিতর ঢুকিয়ে দেয় সামাজিক নরবাদকষ;
অথচ দেয়াল জুড়ে আমাদের লাগানো লতাগুল্ম
হাইব্রিড জেনেমে কাজলরোদে অচল দেহসাজায়;
আমাদের রাষ্ট্রজ্ঞান শেখাতে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায় বিলাপদেয়াল
টাচস্ক্রিন ঘুষি মেরে ভেঙে দেয় দাঁড়িয়ে থাকা ছবিশব্দপ্রাণ;
তারপর থেকে দেয়াল জুড়ে আঁকা হয় গ্রাফিতি— দাঁড়দেয়াল;
লেখা হয় শ্লোগান— অশরীকবিতায় ছাপা হয় দশমিক এপিটাফ।
অথচ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে যৌবন শুকিয়ে পোয়াতিরোদে
ঢাকা পড়ে ধুলোসরে রক্তদেয়াল— আমার দাঁড়িয়ে রোদশুকোই।
৪. বোশেখে ছইমদ
এপ্রিল ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ, দিনাজপুর।
……………
বোশেখ যায় ফের বোশেখ আসে— আসে বারে বারে; তাতে কি— বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওপাড়ার ছইমদ ভাই আবুলের বাপ; শিশির মুছে রৌদ্রময় আলোয় শুকাতে দেয় তার রূপ-রস-সৌরভ। শুকে যায়- শুকিয়ে দেয় প্রত্নযৌবন। আবাদি শরীর ফেটে নাল হয়-নালাময় যাপিত নলজীবন;
আমরা নিস্তেজ হতে হতে সতেজ হই;
সতেজ হতে হতে নিস্তেজ হই— মরে যায় মাটিঘ্রাণ;
অথচ সানকিতে এই তো ক’দিন আগেই পান্তার শরীরে খেলে যেত গেরস্তি; মালশার সর জমতে জমতে বাড়ির চৌহদ্দে খেলে যেত রকমারি প্রসাদ। অথচ— বোশেখের শরীরে সুই ফুঁড়ে বেঁচে দেয়— বেঁচে খায়;
বলেই বাড়ির বড় ছেলে দঁড়ি গোছাতে গোছাতে মালকোচায় বুনে আদিপ্রেম। আমরা শরীরে বোশেখ মেখে শিশিরের হলিতে মুছে দেই; আর গায়ে মাখি ঠোঁঠকাটা রোদ— প্রথমবোশেখ।
অফিস পাড়ায়
শহুরের রাস্তায়
এ্যভুনির ফ্লাটে ফ্লাটে জমে ওঠে বোশেখ— লাল নীল আলোতে মিশে যায় হাহাকার- মাটি মাখে ছইমদ। আমরা প্রথমজ¦র নিয়ে জুম করি কোরাসে বোশেখ।
৫. দৃশ্যকাব্য
…………….
১.
তোমাকে চুমু খেতে গিয়ে
চপাং করে শব্দে ঠোঁট ফেটে যায় আমার
তারপর কাটাতার
সিমান্ত আর বুকপোড়া শহর
মাটি কেপে কেপে ফাটা ঠোঁটে আর্তনাদ।
চুমুতেই দেহভাগ
ধুতি আর সেলেয়ার।
তুমি চিৎকারে বললে শালা মালাউন
তারপর আমি ও ঠোঁটে আর চুমু খাই না
এখনো তৃষ্ণা
ফাটা ঠোঁটে আর্তনাদ
জ্বলজ্বলে আলোয় জাগে সিমানা পিলার।
২.
মৃত নদীরও পাড় আছে, আছে তপ্ত বালুচর
বাদামী খাড়িবিকেল। খুড়ো- অগভীর কিংবা গভীর
দেখবে জেগে আছে বোবা পানির পরত।
বালির বুকে সেও নিয়েছে চোখ বন্ধ দুপুর
সেও বোকাচরে বেচিয়েছে রূপালী যৌবন। তোমার ঘ্রাণে পাগল করা বুনো দীর্ঘশ্বাসে;
এখানে খেলা করা কুড়ানি স্রোত আজও শুধুই মৃত শরীর- যেন জেগে থাকা ধীবর।
শামুক মিছিলে জেগেছিল বালুতে— শিশিরের কান্না আর তো ভেজেনা চোখ
পোড়া মাটির খোলশে
মৃত বুকে ধূসর বকচর
ঠোঁটের আগায় বেয়োনেট লাগিয়ে ঘুমায় মৃত শরীর- নদীজীবন।
৩.
চিন্তার নাভিতে—
দুপুররাত এলামেলো করে দেয় তোমার আগ্রাসন।
আমি প্রাধিকারে মেনে নেই তোমার দখল।
দখলের উৎসবে তুমি
খেয়ে নাও দেহ বিপ্লব
থেমে যায় সামন্ত গৌরব। আমি মেনে নেই দুপুররাত
শালিসী বিচার আর চিন্তার নাভিতে এলোমেলোয়
আমি হই পতিত তখন তুমি
পতিতা মধ্য-দুপুর-রাত।
৪.
তুই শুয়ে পড়
আমি জেগে জেগে চাঁদ দেখি;
চাঁদের আলোয় কি করে কেঁদে ওঠে রাত
কি করে অন্ধকার জেগে তোলে শব্দের ঘর
কি করে আলোরা চুপ থেকে পড়ে ঘুমিয়ে
তুই ঘুমা—
আমি চাঁদ দেখি চাঁদ!
৫.
দেহকে দেহের ভাঁজে গুজে দিয়ে
কি তোমার উল্লাস;
অথচ দেহ ছিড়ে আমিও তোমাকে
সময়চিহ্নে তিলক কেটে—
আমার এ দেহকে করেছি ক্ষত-বিক্ষত;
আর তুমি দেহের স্কেচটা আঁকতে আঁকতে
ছিড়েই ফেললে শেষে।
জোড়াতালি দেয়া শতছিন্ন দেহ নিয়ে
এই আমি এখনো দেহে দেহ মিশিয়ে
চলছি রোজ বাজারের থলে হাতে।
৬. বিলাপদেয়াল ও বাবার হাত
………………
বিলাপের দেয়ালে বসে পড়ে হুদহুদ পাখি
বাবাও সেদিন এক শহর মানুষ আর একপ্রস্থ বাদামি-ধূসর সকাল পকেটে নিয়ে হাজির হয়েছিল বিলাপদেয়ালের সামনে। কৈশোরের উপস্থিত সমবেত গণনৃত্য আর বিলাপ ক্রন্দসীতে ঢেকে রাখা লাশগন্ধ পকেটে করে বাবা বাড়ি ফেরে। সেখানে নাকি বড়দিনের ক্রুশ্চেভে জলপাই তেল মাখানো হয় রোজকার। সেই দেয়ালে আরব-জয়তুন, গেরুয়া-চীবর, খোরমার খোসা আর রুদ্রাক্ষ কুচি কুচি করে মিশিয়ে দেয় শরবতী বেগানা নারী-পুরুষ।
বাবা ফিরে আসে খালি হাতে
ফিরে আসে ধূপদুপুর, জোব্বা ঝুলে পড়ে ঘামের ভারে। লুঙ্গির কোঁচায় ক্ষতের দাগে দজলা-নীলের আভা স্রোত হয়ে ফুঁসে ওঠে পোড়াশহর, জ্বলে ওঠে দগদগে দাউদের নক্ষত্র। নাফ থেকে আমুর-ইরাবতী-বমিয়ান-বুড়োগঙ্গা হয়ে পলি মাটির বুক চিরে সর্বত্র যেনো খসে পড়ে সাহসী বাবার হাত।
বাবা রোজ হাটে যায় কিনে আনে পাহাড়ি মলম
কখনো কখনো সঞ্জিবনী সালসা মদক, যেনো শরীর হয়ে ওঠে তাগড়া জোয়ান। অথচ বিলাপদেয়াল এঁকে নেয় গ্রাফিতি-ইলুমিনাস-লুসিফার একচোখা দজ্জাল। আর সেখানেই দাউদের কণ্ঠে এখনো বিলাপ কোরাসে গলায় গলা মিলিয়ে রব তোলে আর্তনাদ— হায় হোসেন হায় হোসেন।
মধুমাসের হাটবারে আমাতভর জমা হয়
ফিরতি পথে ছোকরার দল হাটখোলার সেই দেয়ালে পথ আগলায়। আর বাবার সদাই-পাতি জমা করে ব্যাগে ভরে একশহর দড়িতে— দাঁড়ি টেনে বাবার হাত কেটে নেয় দৃশ্য কিংবা অদৃশ্য বিলাপের দেয়াল।
লেখক পরিচিতি:
…………….
চাষা হাবিব নামেই লেখালেখি। জন্ম ১৬ নভেম্বর ১৯৮০। দিনাজপুরের ফুলবাড়ি উপজেলার কাজিহাল ইউনিয়নের দাদুল গ্রামে। পৈত্রিক নাম মো. হাবিবুর রহমান।
কলেজ শিক্ষকতার পাশাপাশি বর্তমানে উন্নয়ন গবেষণায় লিপ্ত। সম্পন্ন করেছেন মুক্তিযুদ্ধ এবং গণহত্যা বিষয়ক একাধিক গবেষণাকর্ম। কবি ও গবেষক চাষা’র জীবনে কবিতা অন্যতম অনুসঙ্গ। লিখে চলেছেন মনের আনন্দে। অংশ নিয়েছেন জাতীয় ও আন্তর্জাজাতিক সেমিনারে। তাঁর লেখা দেশি বিদেশী বিভিন্ন পত্রিকা ও অনলাইন মাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। তিনি দিনাজপুর যাদুঘর ও হেমায়েত আলী লাইব্রেরির নির্বাহী সদস্য। এছাড়াও যুক্ত রয়েছেন বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য সংগঠনে। সাহিত্যসম্পাদক হিসেবে যুক্ত আছেন দৈনিক আলোকিত দিনাজপুর পত্রিকায়। এছাড়া শব্দশর, পাতা সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনায় সহযোগি সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। নিজ সম্পাদনায় প্রকাশ করছেন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মননের চতুর্মাসিক সাহিত্যপত্রিকা বাহে’।
সম্পন্ন করেছেন মহান জুলাই বিপ্লব-২০২৪ এর চেতনা বাস্তবায়ন ও গণঅভ্যুত্থান নিয়ে দিনাজপুর জেলার উপর The Study Human Rights Violation (July-August 2024) in Bangladesh (Dinajpur district)
শীর্ষক গবেষণাকর্ম।
পেয়েছেন আন্তর্জাতিক সাহিত্য ও সংস্কৃতিক সংগঠন বিশ্বভরা প্রাণ কবি সম্মাননা-২০১৯; বিএল কলেজ খুলনা’র আবৃত্তি সংগঠন বায়ান্ন কর্তৃক কবি সম্মাননা–২০১৯; শব্দশর দিনাজপুর সাহিত্য সম্মাননা–২০২০; দিনাজপুর লেখক পরিষদ সম্মাননা–২০২১ ও কবিতার মাটি সাহিত্য পুরস্কার–২০২২ এবং সাহিত্য ও গবেষণায় অবদানের জন্য নাট্য ব্যক্তিত্ত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহন কুমার দাস স্মৃতি পদক—২০২২। সাহিত্য ও গবেষণার জন্য দিনাজপুর সরকারি সিটি কলেজ থেকে পেয়েছেন বিশেষ সম্মননা–২০২২।
প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম: প্রকাশিত গ্রন্থ– ১২ টি
কাব্যগ্রন্থ
১. অঞ্জলি ভরে ওঠে গন্ধ ভরা বাতাসে; ২০১২
২. বেগুনির ওপারে-২০২০;
৩. চাষা’র খসড়া-২০২০;
৪. যাযাবর ক’ছত্র-২০২১;
গবেষণাপ্রবন্ধ গ্রন্থ
৫. ‘কড়া’ সমতলের বিপন্ন আদিবাসী কড়া’র জীবনালেখ্য-২০২০
৬. ১৯৭১: গণহত্যা আটপুকুর হাট-২০২১
৭. কবি মাহমুদ আখতার জীবন ও কর্ম-২০২১
৮. ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ১০০ বছর: পুনপাঠ-২০২১
৯. সাঁওতাল বিদ্রোহ ও দিনাজপুরের সাঁওতাল-২০২২
১০. বঙ্গবন্ধুর ভাষণে গণমানুষ-২০২২
১১. ১৯৭১: ফুলবাড়ি, দিনাজপুর-২০২৩
শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ
১২. বোকা পালোয়ান-২০২৪
সম্পাদনা
বাহে’ সাহিত্যপত্রিকা (চতুর্মাসিক)- ২০২৩
প্রকাশিতব্য গ্রন্থ-২২টি
যোগাযোগ: Email : chasahabib@gmail.com
০১৭৮০-৮৪ ৮৫ ৪২