নূরুল হক
ভূমিকা: যে আগুন নিভে যায়নি
ইতিহাস কেবল ঘটনার ধারাবাহিকতা নয়, এটি এক একটি জাতির আত্মার রক্তরঞ্জিত অভিধান—যেখানে প্রতিটি পৃষ্ঠা লেখা হয় দ্রোহের আগুন, বেদনার ধূপকাঠি ও আশার চরণচিহ্নে। বাংলাদেশের ইতিহাসেও তেমন এক সন্ধিক্ষণ এসেছে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে—যে সময়টির প্রতিটি দিন যেন গনগনে জ্বলন্ত অক্ষরে লিখে গেছে এক নতুন মহাকাব্য; এক সংগ্রামী কাব্য, যেখানে নায়ক কেবল একটি ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দল নয়, বরং পুরো এক প্রজন্ম—তারুণ্যের সেই দল, যারা চোখে দেখেছিল দীর্ঘদিন ধরে চাপা পড়ে থাকা অন্যায়, বৈষম্য ও নিপীড়নের শেকড়-জমা স্তরগুলো।
এই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে, কিন্তু খুব দ্রুতই তা রূপ নেয় একটি বৃহত্তর জাতীয় আত্মসচেতনতায়। এ যেন বাঙালি জাতির দীর্ঘদিনের অন্তর্লীন রক্তক্ষরণ থেকে উঠে আসা এক গণ-অভ্যুত্থান, যেখানে কণ্ঠস্বর একটিই—ন্যায়, মানবতা ও মর্যাদার অধিকার। এখানেই এই জুলাই হয়ে ওঠে আরেকটি ভাষা আন্দোলন, আরেকটি গণঅভ্যুত্থান, কিংবা হয়তো এক আধুনিক ১৯৭১—যেখানে যুদ্ধের রণভেরি বাজে সত্য, সুন্দর ও সুস্থতার পক্ষে।
আমাদের ইতিহাসে এর আগেও এসেছে এমন বহু বাঁক ; ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, কিংবা ১৯৯০-এর স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন। তবে জুলাই ২০২৪-এর প্রতিবাদ-প্রবাহ যেন এসব সংগ্রামেরই এক ধারাবাহিক উত্তরাধিকার। এটি কেবল একটি প্রজন্মের নয়—এটি পুরো জাতির অভ্যন্তরীণ আলোর খোঁজ।
এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য কেবল ঘটনার বিবরণ দেওয়া নয়—বরং তা বিশ্লেষণ করা, যে কীভাবে এই রক্তাক্ত জুলাই হয়ে উঠল মুক্তির এক মহাবিস্ময়কর মহাকাব্য। কীভাবে এই আন্দোলন ভেঙে দিল একেকটি ভয়ের প্রাচীর, প্রশ্ন তুলল একেকটি প্রতিষ্ঠিত বৈষম্যমূলক কাঠামোর বিরুদ্ধে, এবং জাগিয়ে তুলল আত্মমর্যাদার এক নবজাগরণ।
এই যে আগুন, তা নিভে যায়নি। নিভে যাবে না। কারণ এটি কেবল ক্ষোভের আগুন নয়—এটি আশার শিখা, যা আলো জ্বালায় ভবিষ্যতের পথে। যে আগুন জ্বলে ওঠে হৃদয়ের গভীরে, যা জ্বলে কেবল ধ্বংসের জন্য নয়—বরং সৃষ্টি আর মুক্তির জন্য—তা সময়ের চাদরে ঢেকে রাখা যায় না। এ আগুন ছড়িয়ে পড়ে চেতনায়, সাহসে, এবং স্বপ্নে।
সেই সাহস আর স্বপ্নেরই এক প্রামাণ্য দলিল হতে যাচ্ছে এই প্রবন্ধ—যা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় লিখবে একটি প্রজন্মের অনন্য যাত্রা, জাতির অন্তর্লীন আলোর অন্বেষণ।
অভ্যুত্থানের অন্তর্নিহিত শেকড়: ক্ষোভ, হতাশা ও নিপীড়নের দলিল
তরুণদের আন্দোলন আকস্মিক ছিল না; বরং এটি একটি সমাজিক চেতনার স্বাভাবিক বিস্ফোরণ। বিগত দশকে বাংলাদেশ একপাশে অর্থনৈতিক অগ্রগতির বাহারি প্রচার দেখে গেলেও অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় দমননীতি, বাকস্বাধীনতার সংকোচন, দুর্নীতি, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও ভিন্নমত দমনের মতো প্রবণতা দিন দিন তীব্রতর হয়েছে।
এই পরিস্থিতি এক প্রকার অদৃশ্য নিঃশ্বাসরোধকারী সমাজের জন্ম দেয়। বিশেষ করে তরুণরা—যারা জীবনের শুরুতেই দেখতে পায়, মেধা নয়, পরিচয়ই ভবিষ্যতের নিয়ামক। তারা বুঝে যায়, শিক্ষার অর্জন কোনো নিশ্চয়তা দেয় না, যদি না তাদের পেছনে কোনো ক্ষমতাসীন বলয় থাকে। এই অভিজ্ঞতাই তৈরি করে বঞ্চিত এক প্রজন্ম, যারা আর পিছনে ফিরে তাকাতে চায় না।
রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা, নেতৃত্বহীনতা ও জনগণের ভাষা হারিয়ে ফেলা—সব মিলিয়ে ছাত্রদের হাতে নেতৃত্ব আসাটা ছিল সময়ের দাবি। তাদের আন্দোলন অরাজনৈতিক হলেও রাজনৈতিক অর্থে তা ছিল গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক। কারণ, এই প্রজন্মের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল এক ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন, যেখানে রাষ্ট্র জনগণের সেবক, প্রভু নয়।
সে বিবেচনায় জুলাইয়ের অভ্যুত্থান ছিল শুধু রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি এক ধাক্কা নয়, বরং মূল্যবোধের পুনর্নির্মাণের একটি ঐতিহাসিক সূচনা। এটি প্রতীক হয়ে উঠেছে দেশপ্রেম, ন্যায়, এবং নাগরিক মর্যাদার। তবে এটি শুরু মাত্র। এই শক্তিকে যদি সঠিকভাবে প্রয়োগ না করা হয়, তবে তা হারিয়ে যেতে পারে কালের গর্ভে। তাই প্রয়োজন এক নতুন কর্মপদ্ধতির, যা আবেগের ঊর্ধ্বে গিয়ে বিবেচনায় চলবে।
গণতান্ত্রিক নবযাত্রার রূপরেখা: সম্ভাবনা ও পথনির্দেশ
১. সাংবিধানিক সংস্কার ও প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন
একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্রের ভিত্তি তার সংবিধান ও প্রতিষ্ঠানসমূহ। আজ বাংলাদেশের যে সমস্যাগুলো সামনে এসেছে, তার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবিত প্রতিষ্ঠান এবং অকার্যকর প্রশাসনিক কাঠামো।
নির্বাচন ব্যবস্থা: একটি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: সুপ্রিম কোর্ট থেকে নিম্ন আদালত পর্যন্ত সকল স্তরে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ দূর করে বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও ন্যায়নিষ্ঠ করতে হবে।
সংবিধান পর্যালোচনা: অসাংবিধানিক এবং গণবিরোধী ধারাগুলো সংশোধন বা বাতিল করা জরুরি, যেমন সাইবার নিরাপত্তা আইন ও প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ সংক্রান্ত বিধান।
২. সুশাসন ও দুর্নীতি দমন
দুর্নীতির অভিশাপ থেকে মুক্তি না পেলে কোনো গণতন্ত্রই স্থায়ী হয় না।
দুদকের স্বাধীনতা: দুর্নীতি দমন কমিশনকে প্রকৃত স্বাধীনতা ও কার্যক্ষমতা দিতে হবে।
প্রশাসনিক জবাবদিহিতা: নাগরিক সেবায় স্বচ্ছতা আনতে ই-গভর্ন্যান্স চালু করা, তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা এবং ন্যায়পাল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা দরকার।
অতীতের অনিয়মের শ্বেতপত্র: বিগত বছরগুলোর বড় দুর্নীতির ঘটনা অনুসন্ধান করে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে।
৩. অর্থনৈতিক সাম্য ও কর্মসংস্থান
রাজনীতির চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বেকারত্ব, বিশেষত শিক্ষিত বেকারদের ক্ষেত্রে। একটি সুস্থ সমাজ গড়তে হলে অর্থনৈতিক সাম্য ও সুষ্ঠু সম্পদ বণ্টন অপরিহার্য।
তরুণ উদ্যোক্তা তৈরিতে সহায়তা: সহজ ঋণ, দক্ষতা প্রশিক্ষণ, এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উদ্যোক্তা সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।
বৈষম্যহীন সমাজ গঠন: সকল শ্রেণি, সম্প্রদায় ও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য দূর করতে সাংবিধানিক নিরাপত্তা ও আইনি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।
মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য: গবেষণা-ভিত্তিক, চিন্তাশীল ও মানবিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা এবং সবার জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা চাই।
৪. জাতীয় ঐক্য এবং সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ
একটি জাতি তখনই অগ্রসর হয়, যখন বিভেদ নয়, সংহতি হয় চালিকাশক্তি। অতীতের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, ধর্মীয় বিদ্বেষ এবং শ্রেণিভেদ ভুলে একটি সমন্বিত বাংলাদেশ গড়ার সময় এখন।
জাতীয় সংলাপ: সব রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিকে নিয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন রূপরেখা তৈরি করা।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা: ইতিহাসের সঠিক পাঠ এবং মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় গণ্ডি থেকে মুক্ত করে জাতীয় পরিচয়ের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
সত্য ও পুনর্মিলন কমিশন: গুম, খুন, সত্য প্রকাশ ও ভুক্তভোগীদের স্বীকৃতি দেওয়া।
উত্তরণের পথে সম্ভাবনা ও দায়বদ্ধতা
নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নপূরণ কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়। এটি নির্মিত হবে পরিকল্পিত সংস্কার, কঠিন সিদ্ধান্ত, এবং জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—এই পরিবর্তনের নেতৃত্ব যাদের হাতে ছিলো , সেই তরুণদের বিশ্বাস ধরে রাখা এবং তাদেরই সাথে নিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজেদের মেলে ধরা । কোনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা জাতীয় সরকার গঠিত হলে তার দায়িত্ব হবে এই রূপরেখার ভিত্তি গড়ে তোলা—not just managing transition, but architecting the future.
উপসংহার: যাত্রা শুরু হলো, গন্তব্য আরও দূরে
বাঙালি জাতির ইতিহাসে জুলাই শুধু একটি ক্যালেন্ডারের মাস নয়, বরং এক রক্তাক্ত প্রতিচ্ছবি — যেখানে ঘৃণা ও ষড়যন্ত্রের অন্ধকারে হারিয়ে যেতে বসেছিল একটি জাতির গণতান্ত্রিক স্বপ্ন। এই রক্তাক্ত জুলাই, যার প্রতিটি দিন বহন করে নিষ্ঠুরতা, বিশ্বাসঘাতকতা ও রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্তের অমোচনীয় ছাপ, তা একদিকে যেমন শোকাবহ, তেমনি অন্যদিকে তা আমাদের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য অনন্ত সংগ্রামের অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই প্রবন্ধে আমরা দেখেছি, কীভাবে ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে জাতির বিবেক ও সাহসিকতা বিপদের মুখেও মাথা নত করেনি। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বীরোচিত নেতৃত্ব, তাঁর আদর্শের প্রতি সৈনিক ও সাধারণ মানুষের অমোঘ আস্থা, এবং ১৯৭৭ সালের সফল পাল্টা প্রতিরোধ কেবল একটি রাজনৈতিক প্রয়াস ছিল না — এটি ছিল বাঙালির আত্মমর্যাদার পক্ষে উচ্চারিত এক মহাকাব্যিক প্রতিবাদ।
তবে এ রক্তাক্ত অধ্যায় আমাদের শুধু অতীত স্মরণ করায় না, আমাদের সামনে রাখে ভবিষ্যতের প্রতিজ্ঞা — রাষ্ট্র যদি আবার গণতন্ত্রের পথচলা থেকে বিচ্যুত হয়, জনগণের মৌলিক অধিকার হরণে তৎপর হয়, তবে ইতিহাস আবার জেগে উঠবে। প্রতিবারের মতো বাঙালি আবারও সত্য, ন্যায় ও স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাবে।
২০২৪-এর জুলাই আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে, ইতিহাস কখনও একঘেয়ে নয়; কখনও তা ঘুমন্ত থাকে, আবার কখনও তা জেগে উঠে বজ্রনিনাদের মতো। এই জাগরণ যদি সঠিক পথে চালিত হয়, তাহলে তা হবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপকার। এখন সময় এসেছে ইতিহাসের এই বাঁকবদলকে অর্থবহ করে তোলার।
এই মুক্তির মহাকাব্যে জাতির অন্তর্লীন আলোর অন্বেষণ আজও চলছে। সেই আলো কেবল একটি রাজনৈতিক পরিত্রাণ নয়, বরং তা এক আত্মিক জাগরণ ; যেখানে মানুষ মুক্ত হয় ভয় থেকে, অপশাসন থেকে, এবং ইতিহাসবিমুখতা থেকে। “রক্তাক্ত জুলাই ও মুক্তির মহাকাব্য” কেবল একটি ঘটনাপুঞ্জ নয়, এটি একটি চলমান অন্বেষণ, একটি জাতির আত্মসন্ধান, যা আমাদের হৃদয়ে প্রজ্জ্বলিত রাখে অন্ধকার ছিন্ন করার শপথ।
সত্য, ইতিহাস বারবার নিপীড়িত হয়; তবে নিপীড়িতরাই শেষ পর্যন্ত ইতিহাস সৃষ্টি করে।