তৌফিক জহুর
প্রাককথন : তিনশ বছরের মধ্যে আমি তিনটি সাল উল্লেখ করে এই লেখা শুরু করতে যাচ্ছি। বিষয়ের গুরুত্ব বোঝার জন্য।
১৭৫৭, ১৮৫৭, ১৯৫৭। একটু অবাক হলেন বুঝি!!
না, অবাক হবেন, না। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের পতনের মধ্যে দিয়ে আমরা দুইশ বছরের গোলামীর জিঞ্জিরে বন্দী হই। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিপ্লবের এক ঐতিহাসিক ঘটনা আমাদের চেতনার মধ্যে নবতর উল্কার বিচ্ছুরণ হয়। আর ১৯৫৭ সালে একজন কবির জন্ম হয়। তিনি মাহমুদ কামাল।
আমাদের ভাষা আন্দোলনের পাঁচ বছর পর যে কবির জন্ম তিনি সেই ভাষার একজন বিশিষ্ট কবি আজ। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি চৌদ্দ বছরের কিশোর। আগুনের সেই ভয়াবহ তাপ তিনি অনুভব করেছেন। তিনি যে শহরে বেড়ে উড়েছেন, সেই শহরটি শিল্প,সাহিত্য, সঙ্গীত মুখর একটি শহর। এই লেখাটিকে আমি তিনটি ভাগে বিভক্ত করতে চাইছি। ব্যক্তি মাহমুদ কামাল, সংগঠক মাহমুদ কামাল এবং কবি মাহমুদ কামাল।
ব্যক্তি মাহমুদ কামাল : সংগঠক মাহমুদ কামাল
১৯৯৮ সালে উদ্যান লিটল ম্যাগাজিন প্রথম প্রকাশ করি। সে সময় সারা বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকদের বিষয়ে ধারণা নেই। আমার জন্মশহর বগুড়ায় সে সময় তত্ত্ব ও তথ্যের জন্য ছুটে গিয়েছি বহু জায়গায়। বগুড়ায় সে সময় পড়ুয়া লাইব্রেরি ছিলো আকবরিয়া মার্কেটে। আর মেরিনা সিনেমা হলের নাজ কমপ্লেক্স মার্কেটে ছিলো পার্বণ নামে একটি লাইব্রেরি ও স্টেশনারি দোকান। দু জায়গা থেকে প্রচুর বই কিনতাম। পার্বণের স্বত্বাধিকারী নিজেও একজন ছোটকাগজ সম্পাদক হওয়ায় তাঁর কাছ থেকে অসংখ্য তথ্য জেনেছি সেসময়, যা পরবর্তী সময়ে কাজে লেগেছে। সেখানেই প্রথম শুনি টাঙ্গাইল সাহিত্য ও সাহিত্যের ছোটকাগজ আন্দোলনের নায়কদের নাম। মাহমুদ কামাল এর নামটা প্রথম শুনি ১৯৯৭ সালে সম্ভবত। ২০০৩ সালে উদ্যান লিটল ম্যাগাজিনের তৃতীয় সংখ্যা ঢাকা থেকে প্রকাশ করে টাঙ্গাইলে পাঠিয়ে দিলাম। মাহমুদ কামাল ভাই এর দরবারে। এরপর আর যোগাযোগ হয়নি। টাঙ্গাইল কবিতা উৎসব (২০২০) এ দাওয়াত পেলাম কবি মাহমুদ কামাল ভাইয়ের দস্তখত করা আমন্ত্রণ পত্রে। টাঙ্গাইল যখন পৌঁছালাম তখন দেখি এলাহি কান্ড।বাংলাদেশ ও ভারত থেকে চারশ এর অধিক কবি এসেছেন। কবিদের এক বিশাল মিলনমেলা। যেদিকেই তাকাই শুধু দেখি কবি মাহমুদ কামাল ভাইয়ের ছায়া। মনে হলো অনুষ্ঠানের চারপাশে তাঁর কয়েক জোড়া জমজ ভাই বুঝি কাজ করছেন একসাথে। সমগ্র অনুষ্ঠানকে নিজস্ব চৌম্বকীয় শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করছেন। তিনদিনের সেই কবিতা উৎসব শেষে ঢাকায় চলে এলাম। যোগাযোগ বাড়তে লাগলো। একটা অদ্ভুত বিষয় অনুভব করলাম, পঞ্চাশের গুরুত্বপূর্ণ কবি আল মাহমুদ এর কাছ থেকে যে স্নেহ- ভালোবাসা একদিন পেয়েছি, আজ ঠিক তেমনি একটা স্নেহের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কবি মাহমুদ কামাল ভাই। আমি তাঁর এই স্নেহের মায়ায় নিজেকে আবদ্ধ করলাম। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম তাঁর স্নেহে হৃদয়ে যে মরুর শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিলো সেখানে মরূদ্যান তৈরি হয়েছে আবার।
করোনাকালীন সময়ে পৃথিবীর মানুষ যখন বন্দী হয়ে স্বেচ্ছায় গৃহবাস করছিলো, সে-সময় উদ্যান লিটল ম্যাগাজিনের পরিকল্পনায় শুরু করলাম অনলাইনে কবিতাপাঠের আসর। যতোবার কবি মাহমুদ কামাল ভাই কে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, তিনি কখনো না করেননি। মানুষকে ভালোবাসেন হৃদয় দিয়ে। ১৮ মে ২০২১ এ টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদের পাক্ষিক আসরে আবার আমন্ত্রণ জানালেন প্রধান অতিথি করে। সভাপতি করলেন তরুণ কবি স্নিগ্ধা বাউলকে। ঢাকা থেকে আমরা দুজনেই হাজির হয়েছিলাম তাঁর সেই অনুষ্ঠানে। ঝুম বৃষ্টির সেই সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান শুরু হয়ে তিনঘন্টা চলে।রাত সাড়ে নয়টায় তাঁর বাসায় নিয়ে যান নৈশভোজে। সেখানে বিভিন্ন নদীর মাছ, মুরগী, খাসির মাংসের পাশাপাশি বারো আইটেমের ভর্তা পরিবেশন করেন। একজন অনুজ কবির প্রতি অগ্রজ কবির এমন স্নেহ অস্বীকার করা যায়না। তাঁর আন্তরিকতায় সেই রাতে আমার বারবার মনে হয়েছিল, নিজের বড়োভাই তাঁর ছোটোভাইকে যেমন আদর করেন, তিনিও তেমনি। ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২২, আবার টাঙ্গাইল গেলাম তাঁর আমন্ত্রণে কবিতা পাঠ আসরে।এবার আয়োজন করেছেন টাঙ্গাইলের সোল পার্কে। ঢাকা থেকে অনেক অগ্রজ কবি, সমসাময়িক ও অনুজ কবিরা সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেন। প্রায় দুইশত অতিথি নিয়ে একা পুরো অনুষ্ঠান সামলেছেন। এ দৃশ্য দেখে শিখি।সংগঠকের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত। ঢাকায় ফিরে আসার পর আবার ফোন করলেন।বললেন, ০১ মার্চ আবার টাঙ্গাইল আসতে হবে। টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদের জমকালো আয়োজনে ঢাকা থেকে নিয়ে যেতে হবে ষাট দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবি আসাদ চৌধুরী ভাই কে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি কবি আসাদ চৌধুরী আর সভাপতিত্ব করতে হবে আমাকে।এমন এক বিরল সন্মান তিনি একজন অনুজকে দান করলেন। দুপুরে তাঁর বাসায় পৌঁছে স্মরণ কালের সবচেয়ে ভয়াবহ মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজনে শামিল হলাম। ঢাকা থেকে এই সফরে সঙ্গী ছিলেন আরো কয়েকজন কবি। কবি মুহম্মদ আবদুল বাতেন, কবি ফাতিমা তামান্না, কবি আরিফ নজরুল, উদ্যান লিটল ম্যাগাজিনের সহকারী সম্পাদক মাহবুব সেতু এবং কবি ফাতিমা তামান্না’র কন্যা রিফাত মারিয়াম। এতোগুলো মানুষকে তিনি পরম আদরে আপ্যায়িত করলেন। তাঁর বাসা থেকে বের হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে তিনি আমাকে উদ্যান লিটল ম্যাগাজিন দেখালেন, যেটা আমি ২০০৩ সালে পাঠিয়েছিলাম।
অনন্য এক মানুষ কবি মাহমুদ কামাল। মৃদুভাষী, স্মিতহাস্য তাঁর ঠোঁটের কোনায় লেগেই আছে। দেবদূতের মতো চেহারার মানুষটির মধ্যে কখনো অহংকারের চাদর দেখিনি। কবি আল মাহমুদ আমাকে বলেছিলেন, ” কবি হতে হলে আগে মানুষ হতে হয়”। আমি দ্ব্যর্থহীন স্বরে বলতে চাই তিনি একজন প্রকৃত মানুষ এবং কবি। তিনি এমন প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী, যাঁকে দেখলে শ্রদ্ধায় চোখ নতজানু হয়। তিনি তাঁর ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে তাঁর সমসাময়িক ও অগ্রজ,অনুজদের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন। এখানেই ব্যক্তি মাহমুদ কামাল ও সংগঠক মাহমুদ কামালের ক্যারিশমা।
মাহমুদ কামালের কবিতার অন্দরমহলে :
১.১
একজন কবিকে চিরটাকাল একাই পথ চলতে হয়। কবির কোনো বন্ধু থাকে না। যতো বেশি কবিতার পথে অগ্রসর হওয়া যায়, ততই একজন কবি নিঃসঙ্গ হয়ে যান। চারপাশের প্রচলিত ভালোবাসার কৃত্রিমতা, বিকৃতি, কবিকে পৃথিবী সম্বন্ধে কৌতূহলী করে তোলে। এই বিকৃতি, বিতৃষ্ণার হাত থেকে মুক্তি পেতে কবি ভালোবাসার বাসনাকে আরো বেশি তীব্র ও তীক্ষ্ণ করে তোলেন তাঁর লেখার মধ্যে। জড়তা ও অভ্যাসের দাসত্ব করা কবির কাজ নয়। কবির ধর্ম চৈতন্যের প্রহারে জড়তাকে বিধ্বস্ত করা। জ্ঞান বৃক্ষের ফল আস্বাদন করার ফলে তিনি পৃথিবীতে শান্তির জান্নাত তৈরিতে ব্রত হন কবিতার মাধ্যমে। রোমান্টিক ঘরানার কবি মাহমুদ কামাল। কিন্তু ছান্দসিক। শব্দের আদরে তাঁর কবিতার শরীর এমনভাবে নির্মিত হয়,যা পাঠে চোখের ও মনের ঠুলি খুলে যায়। কবি জানেন, নারীর নতুন ননীর মতো কোমল দেহের ভিত্তিমূলে আছে বীভৎস কন্কাল বর্তমান,আর তাঁর প্রেমের মধ্যে আত্মগোপন করে আছে জৈবপ্রবৃত্তির প্রেত,তবুও কবি নারীর সৌন্দর্যে অভিভূত হোন, তবুও কবি প্রেম কামনা করেন। তিনি যে চিরকালের রোমান্টিক কবি। আমরা কয়েকটি কবিতা লক্ষ্য করি :
১.
সৌন্দর্য শুধু প্রত্যক্ষই নয়
সৌন্দর্য লুকিয়েও থাকে
খুঁজে নিতে হয় বলে
দু’চোখ তৎপর
এটা কোনো অশ্লীলতা নয়
সৌন্দর্য পূজারী যারা
প্রত্যক্ষের বিপরীতে
চোখের নন্দন দ্রুত
খুঁজে নেয়
লুকানো সৌন্দর্যকেই
( সৌন্দর্য : গোপনেরও সৌন্দর্য আছে, পৃষ্ঠা -২৩)
২.
তৃষ্ণার আগুনে তিনি একাই ছিলেন…?
এই প্রশ্ন কখনো করিনি তাঁকে
তৃষ্ণা কি কখনো মেটে?
তৃষ্ণা মেটেনা ঠোঁটে ;
যার নাম অধরোষ্ঠ
সে কখনো চাতকের মতো
নির্নিমেষ রোদ্দুরে তাকায়।
কবির তৃষ্ণা কি এতই সহজে মিটে?
(তৃষ্ণার আগুনে তিনি : গোপনেরও সৌন্দর্য আছে, পৃষ্ঠা -৫৯)
০৩.
তোকে অবহেলা করি বলে তোকে ভালোবাসি
আগুনে ঝলসে খাই
দূরে ঠেলে দিয়ে কাছে টেনে আনি
তোকে নিয়ে ডুবে যাই গভীর নদীতে
ফের ভেসে উঠি তোর পাটাতনে
সেখানে আশ্রয় খুঁজি নির্ভাবনার
জীবনের নির্ভরতা ওই ওমের শরীরে
তবু তোকে অবহেলা করি
তবু তোকে তবু তোকে…
খুব ভালোবাসি…
(অবহেলা করি : গোপনেরও সৌন্দর্য আছে, পৃষ্ঠা -৫১)
০৪.
হায়! কুমারী যদি বিবাহিত হয়ে যায়
এ খবরে আমি ভীষণ দুঃখ পাই
ঐ মেয়েটা এখন নীরব নদী কেনো
(অই মেয়েটা : বালক বয়সে,২০০৪)
০৫.
তুমি এলে দু’বছর পর
তোমাকে দেখেই মন খারাপ হয়ে গেল
তুমি বেশ সুন্দর হয়েছ
বুকের ওড়না যদি চঞ্চল হতো
তুমি সাবলীল ঠিক করে নিতে
এ মুহূর্তে অসতর্ক বসে আছ আমার সমুখে
ওড়নার ফাঁকে উঁকি দেয়া দ্বিতীয় জীবন
আমাকে বিব্রত করে
দুবছর পর তুমি এসে
চমৎকার বিকেলটাকে অসুন্দর করে দিয়ে গেলে
( মন খারাপ করে দিলে : দ্বিতীয় জীবন,২০০১)
প্রেমের অপরিসীম শক্তি ও মহিমায় কবি মাহমুদ কামাল গভীরভাবে আস্থাশীল। ভালোবাসার অধিকার
কবিকে অনেক বড়ো ক্যানভাস আঁকতে শক্তি জোগায়। আবেগ আলোড়িত হৃদয়ে যে মেয়ের মুখে প্রেমের আলপনা দেখেন, সেই রূপকথা অথবা কল্পনা অথবা বাস্তবের মেয়েটিই কবির অন্তরের রহস্যময় আলো ছায়ার জগতে বাস করে। ভালোবাসার মূলে সৌন্দর্য ভাবনাজাত যে বিশুদ্ধ আবেগ কাজ করে যায় তা উপরের কবিতাগুলো পাঠ করলে অনুধাবন করা যায়। কবির এই নারী কবির কল্পলোকে বাস। কবি সর্বদা সৌন্দর্য ও প্রেমের আদর্শ নিজের অন্তরে যে পবিত্র সৌন্দর্যের সৃষ্টি করতে ব্যগ্র তা তিনি প্রকাশ করেছেন অকপটে। আবার প্রিয়তমেষু নারীর বিয়ের পর দেখে যখন মনটা আক্ষরিক অর্থে খারাপ হয়ে যায়, একটা হতাশার কুয়াশা কবিকে ঘিরে ফেলে তখনো তিনি এক অকল্পনীয় অচিন্তনীয় একটা সময় ধারণ করে নিজেকে সঁপে দেন। ” চমৎকার বিকেলটাকে অসুন্দর করে দিয়ে গেলে”… একটা বিকেল কখনো গোলাপি বর্ণ ধারণ করে,কখনো ঝিরিঝিরি হাওয়ার মধ্যে সবুজ হয়ে যায়,কখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে একটা বিকেল এক কাপ চা আর একবাটি মুড়ির বেহেশতি স্বাদ আনে…. সেই রকম একটা বিকেল এলোমেলো অথবা তমসাচ্ছন্ন হয়ে যায় যখন কবির প্রেমিকা অন্যের হয়ে যাওয়ার দু’বছর পর ঝরা বকুল হয়ে সামনে আসে। এমনই রোমান্টিক হৃদয়ের আত্মা কবি মাহমুদ কামাল। কবির প্রেম বিশুদ্ধ অনুভূতি যা অন্তরে যে সংগীত রচনা করেছে তা ঝংকৃত হয়ে উঠেছে। দু’বছর পর প্রেমিকা যখন অন্যের হয়ে তাঁর সামনে দাঁড়ায় তখন হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে একটা ক্ষত সৃষ্টি হয় বৈকি।কিন্তু সেই ক্ষত হৃদয়ে তাঁর চমৎকার একটা সময় কে বর্ণনা করা, এটিই হলো কবির প্রাণশক্তি। আধুনিক বাংলা কবিতার ছন্দ, শব্দ ও উপমা প্রয়োগের সফল আয়োজন সম্পন্ন করেছেন কবি মাহমুদ কামাল। নিরীক্ষায় তাঁর কবিতার অবয়বে স্পষ্ট দৃশ্যমান, আবার কবিতার চরণবিন্যাসে চিত্ররূপের আমেজ এনে তাতে দৃশ্যমানতা দানের এক অনুপম দৃষ্টান্ত চিত্রায়ন করেছেন মাহমুদ কামাল তাঁর কবিতায়।যেখানে স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দ রস সাধনায় ঠিকঠাক গ্রোথিত হয়ে যায়। তাঁর কবি ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষতা আমরা এখানেই খুঁজে পাই।
১.২
এবার অন্য একজন কবির কথা দিয়ে শুরু করছি। তিনি আবুল হোসেন (১৯২২-২০১৪)। নতুন কবিতা লিখবেন এই স্বপ্নকে লালন করে তরুণ আবুল হোসেন কবিতার ট্রেনে চেপে বসেন। আবুল হোসেন বিশ্বাস করতেন, নতুন কবিতা লিখতে পারেন নতুনরা। পুরোনোরা মাঝে মধ্যে ভালো লিখলেও নতুন চিন্তা, ভাবনা ও দেখার দৃষ্টি নিয়ে চিরকালই নবীন কবিরা লেখেন সময়ের ভাষার সৌন্দর্য ও অনুভূতিময় কবিতা।আবুল হোসেন এর একটি কোড উল্লেখ করছি, ” নির্জনে আপন মনে, পৃষ্ঠা ১৭ থেকে”। তিনি বলছেন,” আমার কবিতার যে ভাষা সে ভাষাকে আমাদের প্রতিদিনের কথাবার্তার ভাষার কাছে নিয়ে গেছি।যে ভাষায় আমি কথা বলছি,যে ভাষায় আমরা আমাদের বৈঠকখানায় বসে কথাবার্তা করি সেই ভাষায় কবিতা লেখার চেষ্টা করেছি। কবিতার ভাষাকে গদ্যের কতটা কাছাকাছি নিয়ে আসা যায়,আমি সেই চেষ্টাই করেছি। এর সঙ্গে আমি ভিন্ন যা করেছি সেটা সমর সেন বা অমিয় চক্রবর্তী করেননি, সেটা হলো এই গদ্যের চাল কবিতায় এনেও আমি ছন্দকে বিসর্জন দিইনি, মিলকেও বিসর্জন দিইনি”….. আমি এই মহৎ কবির কোড ধরে কথা বলতে চাইছি। ভয়াবহ রোমান্টিক ঘরানার কবি মাহমুদ কামাল। কবি আবুল হোসেনের জামানার তিন দশক পরে কবি মাহমুদ কামাল বাংলা কবিতার সত্তর দশকের ট্রেনে চেপে বসেছেন। তিনিও গদ্য চালেই কবিতা লিখে চলেছেন কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেছি ছন্দ কে বিসর্জন দিয়ে নয়, ছন্দের ঠাসবুননে তাঁর গদ্য কবিতা অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও সুখপাঠ্য। হাতুড়ি বাটালি দিয়ে পাথর কেটে কেটে একজন ভাস্কর যেমন শিল্পের চরম উৎকর্ষতায় পৌঁছে একটা অমর সৃষ্টি করেন, ঠিক তেমনি একজন প্রকৃত কবি শব্দের মালা গেঁথে নির্মাণ করেন একটি অমর কবিতা। সেখানে ছন্দের চকমকি পাথর বসিয়ে কবিতায় এমন এক প্রাণ সঞ্চার করেন যা পাঠে পাঠক আত্মার আরাম পায়। আমরা মাহমুদ কামাল এর ছান্দসিক কবিতা লক্ষ্য করি :
১.
” গোপন প্রকাশ্য হলে
আলোকের দ্যুতি কমে যায়
গোপনের ঘরে গোপনকেই
রেখে দেয়া ভালো
গোপনেরও সৌন্দর্য আছে
শিল্পের সকল সংজ্ঞা
শুধুমাত্র প্রকাশে মেলে না
অপ্রকাশও জীবনের সৌন্দর্য প্রতীক
(গোপনেরও সৌন্দর্য আছে : গোপনেরও সৌন্দর্য আছে, পৃষ্ঠা -১০)
২.
কঠিন মুখোশ পরে অন্ধকারে
দাঁড়িয়ে রয়েছে ভয়
তুমিই নিশ্চয়।
কখনো হাঙর কখনো-বা
কালকুট বেশে
আসো এই দেশে
তুমি অন্ধকারে বারে বারে
কেন হানা দাও
নৃপতি মুখোশ ফিরে যাও।
(মুখোশ : শব্দেরা কখনো মানতে চায় না ছন্দাছন্দ)
একটা নিজস্ব কবিতার পৃথিবী নির্মাণের জন্য একটা পথ চিত্রিত করে চলেছেন মাহমুদ কামাল। প্রতিটি কবিতার বইয়ে রয়েছে বাক। শুরু থেকেই হতে চেয়েছেন সবার থেকে আলাদা। একটু একটু করে নিজেকে গড়েছেন কবিতায়। খুব জলদি পাঠ করলে তাঁকে সাদামাটা কবি মনে হবে। আর দশজন কবির মতো। কিন্তু গভীর অনুসন্ধিৎসা মন নিয়ে পাঠ করলেই কেবল চোখের সামনে পরিষ্কার হবে তাঁর কবিতার পথ।কবিতায় শব্দ ব্যবহারে সংযমী তিনি। জীবনের ভাষায় শব্দের আদর দিয়ে তিনি নির্মাণ করেছেন তাঁর কবিতার শরীর। ছন্দের চকমকি পাথর তাঁর কবিতার শরীরকে করেছে ঠিকঠাক, পাশাপাশি তিনি অত্যন্ত অল্প কয়েক বাক্যে বিশাল সব ক্যানভাস এঁকেছেন, যা আমাদেরকে তাঁর কবিতা পাঠে কৌতুহলী করে তোলে।নিজেকে বদ্ধ পুকুরের পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেননি, করেছেন খরস্রোতা নদীর মতো, যে নদী সমুদ্রে মিশতে চায়। চির রোমান্টিক কবি হলেও, সময় সচেতনতা ও প্রকৃতিও এই কবির কবিতার ক্যানভাসের বিশাল জায়গা জুড়ে আছে। তাঁর কবিতার সুখময় অধ্যায় হলো, অল্প কথায় তিনি একটা চিত্রে পাঠককে অনায়াসে টেনে নিয়ে যেতে পারেন। পাঁচ লাইনের কথা তিনি এক লাইনেই দারুণভাবে বলতে সক্ষম। জীবনানন্দ দাশ বলে গেছেন, ” সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি। কেননা তাঁদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাঁদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্য- বিকিরণ তাদের সাহায্য করছে।সাহায্য করছে; কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারেনা; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়; নানারকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।” কবিতার কথা শীর্ষক প্রবন্ধে জীবনানন্দ দাশ শুরুটা করেছেন এই বাক্যগুলোর মাধ্যমে।
” নানা রকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায় “…… মাহমুদ কামাল পঞ্চাশ বছর ধরে নানা রকম চরাচরের সম্পর্কে এসে কবিতা সৃষ্টি করে চলেছেন। রোমান্টিক এ ঘরানার কবির হাতে আরো ফসলের ক্ষেতে বুননের জন্য অসংখ্য চারা( কবিতা) মজুদ আছে এখনো।কবিতার জমিনে মাহমুদ কামালের চারাগুলো বিশাল বৃক্ষে পরিণত হবে ছায়া ও বাতাস দেয়ার নিমিত্তে। আমরা তাকিয়ে আছি মাহমুদ কামালের নির্মাণ ও সৃষ্টির মাঝে সেই প্রাচুর্যের আঙিনায় গভীর বিশ্বাসে।
( লেখক : কবি ও সম্পাদক, উদ্যান)