১.
আমি কী আর জন্মেছিলাম
আমি কী আর জন্মেছিলাম
মানুষ হিশেবে?
জন্মেছিল আবু তাহের
এই লোকটা কে?
মুখ চিনি না তবু মুখের
আদল ধরে হাঁটি
শরীর খুলে বাইরে এসে
ছায়ায় পরিপাটি।
আমি হয়তো ছায়ার মানুষ
শরীর আরেকজন
তার শরীরেই আড়াল হয়ে
বাঁচার আয়োজন।
কার সে জীবন আমার কাঁধে
আমি-ই যে হায় কার
একই সাথে খাচ্ছি-দাচ্ছি
ঘুমোচ্ছি আবার।
আমার যে, সে কোথায় থাকে?
কোথায় বাড়িঘর?
তার সাথে কী বদলেছে এই
আমার টিনের ঘর?
২.
আবু তাহের সরফরাজ
আমার নাম আবু তাহের সরফরাজ
আমি একটি প্রাণ
মহাপ্রাণের একটি অংশ আমি
যদি আমি এই বাক্য লিখি, আমার নিরাপত্তা কোথায়
এরপর কী চিহ্ন দেব
তা নিয়ে ভাবনা এলো, এলোমেলো
আমার নিরাপত্তা কোথায়?
আমার নিরাপত্তা কোথায়!
একই বাক্য দুরকমের মানে প্রকাশ করছে কেবলমাত্র যতিচিহ্নের কারণে
আমাকে দোলাচ্ছে দুটো বাক্য
প্রশ্নবোধক চিহ্ন তীরের ফলার মতো ছুটে এলো আমার দিকে
বুঝলাম, প্রশ্নবোধক মানে কাউকে দোষারোপ করা
মহাপ্রাণ প্রবাহের এই অনন্ত মহাবিশ্বে
দোষ আর অদোষের কোনও ভাষাই
খুঁজে পেলাম না
অতএব, ফিরে এলাম বিস্ময়কর চিহ্নের কাছে
অনন্ত মহাবিস্ময়ের মধ্যেই যার হারিয়ে যাওয়া…
৩.
দুই পথিক
দুই পথিক চলেছেন রাস্তা দিয়ে, খা খা দুপুর
ঝলমলে রোদ আর ছায়ার মধ্যে দিয়ে চলে গেছে রাস্তা, যেন
তারা হাঁটছেন আর তাদের পায়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসছে রাস্তা
আর দুই পথিক হারিয়ে ফেলছেন পেছনের পথ
যেন তারা পর্যটক
তাদের ঝুলি ভরে ওঠে জগতের টুকিটাকি দিয়ে
যেতে যেতে তারা ক্লান্ত হয়, বসে
গোধূলি-নদীর তীরে
তারপর তাদের ঘুম পায়, তবে তারা উঠে পড়ে নদী পেরোবে বলে
দুই পথিক সাঁতরে নদী পেরোতে থাকে
তবে একজন ডুবতে থাকে
তার ঝুলিতে জগতের এত ভার যে, সে ডুবতে থাকে
আরেক পথিক দিব্যি সাঁতরে যেতে থাকে, কেননা
পৃথিবীর কিছুই সে জমা করেনি, তার
অস্তিত্বের অনুভূতি ছাড়া।
৪.
পৃথিবীর পথে পথে
আমি মারা যাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি মৃত্যুদূত
বিশাল দুই ডানায় ভর দিয়ে ছুটে আসছেন আমার দিকে
তারমানে আমি মরে যাব, আর কিছু সময়
এরপর আমি আর বেঁচে থাকব না, এতদিন
কত কত মৃত্যু চোখের সামনে দেখেছি
দেখেছি কীভাবে কতভাবে মানুষ মরে যায়
এইসব দেখতে দেখতে এইসব ডালভাত মনে হতো এতদিন
এখন আমি দেখছি, ওই তো
আমার মৃত্যু ছুটে আসছেন আমার দিকে
আমি ভয়টয় পেলাম না, হাহাকার টের পেলাম
চোখের সামনে দেখতে পেলাম ছায়াবীথির মুখ
রিপা খাতুনের মুখ, এক চিলতে ছায়ার মতো আমার বসতভিটে
আমি মারা যাব। যেতে তো হবেই, তবে
কীভাবে হে চলবে আমার ফেলে যাওয়া সংসার?
কে তাকে ঠেলে নেবে নাভিশ্বাস তুলে?
আল্লাহ?
আমি কি সারা জীবনে তার প্রতি একাত্ম হতে পেরেছি?
পারিনি তো হে, তবে কেন আমি তার কাঁধে তুলে দেব আমার বোঝা?
অথচ এই বোঝা বইতেই আমি আমার আশা-আকাক্সক্ষা ছেড়ে
বন্দি থাকলাম এই মহাবিশ্বের ছোট্ট এক বিন্দুর ভেতর
চোখ তুলে দেখলাম না পর্যন্ত জগৎ-সংসার, আর এখন
বুঝতেছি, এক জীবন দিয়েও আমি নিরাপত্তা তৈরি করতে পারিনি
ওই তো ছুটে আসছেন মৃত্যুদূত
আমি বুঝতেছি যে. পৃথিবীর পথে ঘুরে আশা-আকাক্সক্ষার রেণু
পথে পথে ছড়ানোই আসলে মানুষের কাজ, এছাড়া
মানুষের আর তো বিশেষ কোনো কাজটাজ নেই
পৃথিবীর পথে পথে…
৫.
প্রতিটি জ্ঞানই এক একটি বিভ্রান্তি
প্রতিটি জ্ঞানই এক একটি বিভ্রান্তি
কেননা তা জগৎ ও মানুষের নিজের বিষয়ে
অনেক মত আর চোরাগোপ্তা নানা পথ তৈরি করে
তারমানে, যত জ্ঞান তত গোলোকধাঁধা
আজ পর্যন্ত বিশেষ কোনো মতে একপথে পৃথিবীর সব মানুষ হাঁটেনি
হাঁটলে পৃথিবীর আরেকদিক হেলে পড়ত
আর তাই
জগতে চূড়ান্ত কথা কিছু নেই
জ্ঞান মানুষকে গোলোকধাঁধায় ঘুরিয়ে শেষপর্যন্ত
এই একই সত্য প্রকাশ করে, যেন সাইনবোর্ড
‘প্রতিটি জ্ঞানই এক একটি বিভ্রান্তি’
জীবন ও জগতের দিকে সহজ চোখে তাকাও
যা দেখছ, তা এমনই
যা দেখছ না, তা তুমি
তোমার ভেতরই অদৃশ্য সেই দৃশ্যের জগৎ
অদৃশ্য এ জগৎ জগতের সব মানুষের ভেতরই আছে
তবে আলাদা আলাদা, কেননা
জগতে যত মানুষ তত চিন্তা
সুতরাং জীবন সহজ
জীবনের দিকে সহজ চোখে তাকাও।
৬.
নারীর হৃদয় আজ ঘাস
মানুষ আসলে তার ছায়া
ভেতরে আর বাইরে
দিনে আর রাতে মানুষ তার ছায়ার সাথে ঘুরে বেড়ায়
মানুষ জানে না, জীবন এক ছায়াবাজি খেলা
ছায়ার ভেলকি দেখিয়ে মানুষ ফিরে আসে তার ছায়া ছায়া বাড়িঘরে
বেচেবর্তে থাকে, আর তারা
হৃদয়ের খুব কাছাকাছি থাকে নারীদের
সংসারের কড়িকাঠে ঝুলে পড়ে তারা সর্বংসহা ধরিত্রীর মতো
ঝুলে থাকতে থাকতে
ব্যাকা-ত্যাড়া নানাভাবে ঘাড় নেড়েচেড়ে হঠাৎ তারা দ্যাখে
জীবনানন্দ দাশ দাঁড়িয়ে আছেন আসমানের নিচে
এই ভবসায়রের মাঝখানে
আবার এসেছেন তিনি এই বাংলার নদীমাঠক্ষেত ভালোবেসে
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাই
ঝুলে ঝুলে দোল খাই
আর শুনি, জীবনানন্দ দাশ
বলতেছেন নিচু স্বরে
বাংলার ঘরে ঘরে
নারীর হৃদয় আজ ঘাস।
আর তা শুনে আমাদের মনে হলো, এতদিন তবে আমরা
ঘাস চিবিয়ে এসেছি
নারীর খুঁটিতে বাঁধা পড়ে তার দেহের চারদিক ঘুরতে ঘুরতে
আমরা ঘাস চিবিয়েছি
চর্বচোষ্যলেহ্যপেয় আমাদের সংসার, আমরা তবু
ঘাস চিবোতে চিবোতে বেমালুম ভুলে যাই
নারীর হৃদয় আজ ঘাস!
৭.
চলো, মানুষের মতো খেলাধুলা করি
পাথর ভেঙে গড়িয়ে দিচ্ছ
ওপর থেকে নিচে গড়িয়ে পড়ছে পাথর
তুমিই আবার নিচের থেকে গড়িয়ে দিচ্ছ
নিচের থেকে গড়িয়ে পড়ছে পাথর
তুলে নিচ্ছি আমি। তুমি হাসছ আর গড়িয়ে দিচ্ছ পাথর…
এই খেলা জনে জনে রটে গেল ভবে
ফলে মানুষ শিখে গেল আমাদের কৃৎকৌশল
তারা এখন পাথর গড়িয়ে দিচ্ছে
তারা এখন পাথর কুড়িয়ে নিচ্ছে
তারা শুধু জানলো না হাসির রহস্য, চলো
আমরা এবার পাথরভাঙার কাজ করি
দু’চারটে পাহাড় ভাঙি, এরপর
সিসিফাসের সাথে এসো লেগে যাই অর্থহীন কাজে
এদিকের পাথর ঠেলতে ঠেলতে ওদিকে নেই
ওদিকের পাথর ঠেলতে ঠেলতে এদিকে নেই
এই খেলাও বেশ প্রাচীন
হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ খেলে আসছে
ব্যক্তিজীবন খেলছে সমাজজীবনে
সমাজজীবন খেলছে রাষ্ট্রীয় জীবনে
চলো, মানুষের মতো তাই আমরাও খেলাধুলা করি।
৮.
পৃথিবীর বয়েস
পৃথিবীর বয়েস বেড়ে গেছে হে
একদা তারও যৌবন ছিল এই মহাবিশ্বে…
একটা বয়েস ছিল এই পৃথিবীরও
যখন মানুষ ধ্যানী ছিল
কথাটথা খুব একটা বলত না
নিজের যা কাজ, মনটন দিয়ে তা-ই করে যেত
মানুষ এখন ননস্টপ কথা বলে যায়
কাজ করে, যা না করলেই নয়, ততটুকু
মানুষ এখন অহংকারী
মানুষের তৈরি সভ্যতার জৌলুশে
জ্বলজ্বল জ্বলছে মানুষেরই অহংকার
মানুষ অহংকারী
তাই মানুষ এখন আত্মতৃপ্ত
তাই মানুষের সামনে আর কোনো পথ নেই
তাই
বয়েস বেড়ে গেছে ঢের
পৃথিবীর নর-নারীদের।
৯.
বোধিলতা
এক.
বোধের ভেতর বোধিলতা যেন
বেড় দিয়ে সে ধরে আছে কেন
অস্থিমাংসসহ মম বায়বীয় প্রাণ
ফুৎকারে যে বায়ু গাহিয়া ওঠে রে গান।
বায়ুপ্রাণ নিয়া ভবে এক ভবা পাগলা
ঘুম ভেঙে নিজেরেই, বলে, ‘ক্যান জাগলা?’
ঘুম ঘুম স্বপ্নে আবছায়া মুখ
আয়নার সামনে হয় সম্মুখ।
ভেতরে কেন তবে? বাইরে আয়
তোকে দেখি, চেখে দেখি দুজনার জিহŸায়
বোধের ভেতর সে বোধিলতা যেন
বেড় দিয়ে আমাকেই ধরে আছে কেন?
১০.
বোধিলতা
দুই.
বোধের ভেতর বোধিলতা সে
ফুটে ছিল ঊষারাঙা পাপড়ি খুলে, যেন লাবণ্যগোলাপ
যেন সে সৌন্দর্য-গর্ভের রেণু
তুলে দিতে চায় তোমার মুখে
তুমি নত হও
যদি চিনে থাকো তবে নত হও হে মহাত্মন
তবে ধীর, তোমার খুব তাড়া থাকতে পারে
বোধের অপেক্ষাকাল অনন্ত
বোধের ভেতর অপেক্ষায় থাকে সুন্দর
আরেক সুন্দর এসে তাকে ডাক দেবে বলে
কোনও কোনও সুন্দর এসে কোনও কোনও দিন তাকে ডেকে বলে,
এসো স্নানে যাই।
স্নানে যেতে যেতে সুন্দর দ্যাখে
আরেক সুন্দর যেতে যেতে তার মুখোশগুলো খুলে ফেলছে
আর সে হাসছে
আর সে কাঁদছে
তারপর
সুন্দর ফিরে আসে তার বোধের ভেতর
কেউ এসে তাকে ডেকে নেবে বলে…
…..
পরিচিতি ও কবিতা ভাবনা আমি অহেতুক মনে করি। আমার যা যা অনুভূতি, তা তা তো আমি লিখেই রাখি। এর বাইরে আর কি বলার থাকতে পারে স্রষ্টার? তার পরিচয় তার সৃষ্টি। সৃষ্টির ভেতরই লুকিয়ে রয়েছে তার ভাবনা। আগ্রহী যারা, তারা সৃষ্টির ভেতর থেকেই তা খুঁজে নেন। যারা আগ্রহী নন, তবে জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব, তারা শর্টকাটে লেখক বিষয়ে একটা মোটামুটি ধারণা পেতে ওইসব পরিচিতি আর ভাবনার আশ্রয় নেয়।
লেখার বাইরে আমার কোনো জীবন নেই। চরিত্রও নেই।