spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যআমিনুল ইসলাম এর কবিতা : পাঁচ কবি'র আলোচনা

লিখেছেন : কাজী জহিরুল ইসলাম, রেজাউদ্দিন স্টালিন, শাহীন রেজা, ফরিদ আহমদ দুলাল, ফেরদৌস সালাম

আমিনুল ইসলাম এর কবিতা : পাঁচ কবি’র আলোচনা

কবিতা

১. কুয়াশার বর্ণমালা
…….

প্রথম শীতের হাত; সেই হাতে রচিত আস্তানা।
তথাপি সংহার নয়, ফসলের পক্ষে ছিল গান।
উন্মুক্ত চলনবিল, বাতাসে ডানার ধ্বনি-
আর জলজুড়ে মুগ্ধতার ছবি: খুশি ফলে
ঈর্ষাতুর আলোরাও। আর ছায়ার পাশে
জমেছিল অকৃত কর্তব্য। প্রকৃতির জবাবদিহিতা?
কিন্তু কে নেবে ? বসন্ত করেনি ভুল।
অথচ এখন কোথায় পাখি! শূন্যবিলে
যতসব বিভ্রান্তির ছায়া; রৌদ্রের গায়ে রঙ।
নিঃসঙ্গ দুহাতে পালক কুড়িযে রাখি।
ধূসর শিল্পীর হাতে গড়ে ওঠে যাদুঘর।
পুনঃপুন বিজ্ঞাপন কিউরেটের পদে;
তবু একমাত্র অ্যাপ্লিক্যান্ট-আমাদেরই দুখু বাঙাল ।

২. বনভোজন
…….

কী লাভ বলো বৃত্তের ভূগোল পুষে রেখে উটপাখিপ্রাণ?
তার চেয়ে সেই ভলো—
নিয়ে আসো ফ্লাশব্যাক যাযাবর দিন।
পুঁজির বেদীতে হাসে স্ফুয়ার্ট মিল;
আর অভুক্ত শিশুর মতো একপাশে পড়ে আছে
প্রাচ্য হৃদয়।
প্রতিদিন দেখা,
অথচ হইনি আমরা দিগন্তের ছবি।
ফিতাবাঁধা সিদ্ধান্তের মতো আর কতো ঝুলে রবে
আমাদের একদফা দাবি?
আমার বক্ষভরা জবাফুল জেনেও
সন্ধ্যাবতীর শরীর নিয়ে
তুমিই বা আর কতোদিন থাকবে বসে আঘাটায়?

দ্যাখো আজ সোমপুর বিহারে
সবুজসঙ্কেত হয়ে জমে ওঠে বনভোজনের দিন!
এসো আমরা দু’জনে রচি এ-শতকের
গন্ধেশ্বরীর ঘাট।
সবুজ আঁচলের সুতোয় এ হাতে বেঁধে দিলে
বনভোজনের রাখি,
লজ্জাভাঙা গৌরবের ছাপ এঁকে দেবো আমিও।
ক্ষতি কি বিজয় হলে কৈবর্তশাসন
যদি দিব্বক স্তম্ভ দেখে ভাবী মগজ মানে এদিনের প্রেম!

৩. পর্ণমোচী
…….

বৃষ্টি তো গেছে বেশ কিছুদিন হয়
উধাও অলখে জলের হাওয়াই কণা
গভীর নিবিড়ে ফুরিয়েছে সঞ্চয়
গোড়ায় জড়িয়ে দাঁতাল শীতল ফণা।

সবুজ ডগায় উঠেছে নাভিশ্বাস
হলদে বরণ রাঙিয়েছে আয়োজন
শীর্ণশাখায় টানাটানি ফিসফাস
ঝুরমর্মরে ফোরায় দিনযাপন।

মুগ্ধ পায়েরা দলে যায় ঝরাপাতা
ঝাঁকের পাখিরা আনে বেগানার বীজ
মালিদের চোখে কুয়াশা রচেছে ধাঁধা
বৈশাখ এলেই আজগুবি উদ্ভিদ।

আমাদের ঝরা অদ্ভুত এক শীতে
শত বসন্তে রয়েছি অপুষ্পিত
পোকায় ধরেছে বোধিবৃক্ষের ভিতে
বনসাই-মন কুহুতান-বিরহিত।

বলাকা তথাপি ছড়ায় আমন্ত্রণ
বন্ধ্যা সাঁঝেও ধরিত্রী ঋতুমতী
নষ্ট আঁধার বাড়ায় আলিঙ্গন
উৎসব-আড়ালে ঝরছে পর্ণমোচী।

সমালোচনা:

১. কাজী জহিরুল ইসলাম

প্রথম দুটি কবিতা অক্ষরবৃত্তে, শেষেরটি ৬ মাত্রার মাত্রাবৃত্তে লেখা। ‘বৈশাখ এলেই’ এখানে বৈশাখ নিজেই ৪ মাত্রা কাজেই এলে লিখলেই হবে। ই লাগবে না। ভুল এবং দুর্বল অন্তমিল আছে বেশ কিছু। উদ্ভিদ /বীজ, মতী/মোচী, এগুলো চলবে না। অন্তমিল দিলে ঠিক মতোই দিতে হবে। প্রথম কবিতায় “সেই হাতে রচিত আস্তানা” এই চিত্রকল্পটি ভালো লেগেছে। উটপাখিপ্রাণ কেন তিনি ব্যবহার করলেন এ নিয়ে বেশ ভাবলাম। উড়তে না পারার কষ্ট, নাকি বন্ধ্যা মরুতে বাস। দুটোই হতে পারে। আমি মনে করি একটি রূপক যদি পাঠককে ভাবায় সেটিই কবিতার সার্থকতা। খুব ব্যস্ততার মধ্যে এইটুকু লিখলাম।

২. রেজাউদ্দিন স্টালিন

আমিনুল ইসলামের প্রথম কবিতাটি দারুণ। শুধু শেষের লাইনে দুখু বাঙাল- কেমন নেতিয়ে পড়লো। তবে আমিনুল ইসলামের কাব্যভাষা তিরিশ আক্রান্ত। আর শেষের কবিতায় অন্ত্যমিলের দুর্বলতা, এবং ছন্দের খামতি আছে, “উৎসব আড়ালে ঝরছে পর্ণমোচী” এই লাইনটি। তবে আমিনুল ইসলাম প্রাজ্ঞজন। তার সংগ্রহশালায় অসংখ্য শব্দভান্ডার আমাদের আনন্দিত করে।

৩. শাহীন রেজা

দূর্বোধ্যতা যদি একটি ধ্বনি সৃষ্টি করে এবং তা যদি নান্দনিকতা দিয়ে ঢেকে দেয়া যায় তবে তা উৎরে যেতে পারে তবে জোর করে দূর্বোধ্যতা তৈরি কবির দুর্বলতাকে চিহ্নিত করে। কবি যখন কবিতা লিখতেই হবে এরকম একটি পণ করে কলম নিয়ে বসেন তখন কবিতা ভ্রমর তাকে পাশ কাটিয়ে উড়ে চলে যায়। আল মাহমুদ বলতেন, সব আছে কিন্তু কাঠামো নেই তাহলে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে কোথায়? আমিনুলের পড়ার মত অনেক ভালো কবিতা আছে কিন্তু এখানে সেই আমিনুলকে খুঁজে পাইনি। আমাদেরই দুখু বাঙাল কেবল অকারণ শীত নামিয়েছে।

৪. ফরিদ আহমদ দুলাল

আমিনুল ইসলামের কবিতাত্রয় পড়েছি, পড়েছি বিভিন্নজনের মন্তব্যও। প্রধানত আলস্যের ব্যস্ততায় কিছু লিখতে পারিনি। আমিনুল আমার প্রিয়জন, যেমন অনেকেরই। প্রতিটি মন্তব্যই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। যদি তিন থেকে শুরু করি, বলবো— ৬+৬+২ মাত্রাবৃত্তের কবিতাটিতে অন্তমিলে বেশকিছু অসঙ্গতি যেমন আছে তেমনি শেষ পঙক্তিতে মাত্রা পতনও আছে @কাজী জহিরুল ইসলাম যেভাবে বিন্যাস দেখিয়েছেন তাতে মীমাংসার একটা দিশা আছে। পঙক্তিটি—
উৎসবাড়ালে ঝরছে পর্ণমোচী
এভাবে লিখলে মাত্রার সংকট দূর হয়ে যায়। স্টালিন খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন— ‘মাত্রাবৃত্তে সাউন্ডটা দেখা উচিত।’ অর্থাৎ ছন্দ বুঝতে কানটাকে প্রস্তুত করা চাই; কেবল মাত্রাবৃত্তে নয়, কান প্রস্তুত করা সব ছন্দের জন্যই প্রয়োজন, বিশেষভাবে স্বরবৃত্তে। প্রাথমিক কথা হলো মাত্রা গণনা শুদ্ধ হওয়া; অতঃপর বলবো, মাত্রা গণনার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কবিতার গতি আর প্রবহমানতা নিশ্চিত করা; দুই-ই একে অপরের হবে, তখনই হবে ‘সোনায় সোহাগা’।
দ্বিতীয় কবিতা ‘বনভোজন’। এটিকে আমি অক্ষরবৃত্ত না বলে বলতে চাই ‘অক্ষরবৃত্ত প্রবণ’ একটি কবিতা। প্রথম পঙক্তিসহ বেশ কটি পঙক্তিতে ছন্দ পতন আছে; তবে প্রবহমানতা বিচারে এটিকে একটি ভালো কবিতা বলেই মান্যতা দিতে পারি। কিছুটা বিমূর্ততার আড়াল, কিছুটা ইঙ্গিতধর্মিতা কবিতাটির বাড়তি শক্তি বলে মনে হয়েছে। “ক্ষতি কি বিজয় হলে কৈবর্তশাসন” পঙক্তির সাথে শেষ পঙক্তিটি যোগ হলে কিছুটা কি সংশয় যোগ হয় না মনে?
এবারে প্রথম কবিতাটি, বেশ সচ্ছন্দেই চলছিলো অক্ষরবৃত্ত, “ঈর্ষাতুর আলোরাও। আর ছায়ার পাশে……..” এখানে এসে যেন ট্র্যাক বদলে গেল। শেষে ‘দুখু বাঙাল’ যোগে হোঁচট খেলো কবিতাটি।
আমিনুল ইসলামের কবিতা আমার নিয়মিত পাঠে থাকে; আমিনুলকে আমি যথেষ্ট যত্নশীল এবং আন্তরিক কবি বলেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। তাঁর অগণন উত্তীর্ণ কবিতা আমার পাঠ-সীমায় আছে; প্রতিদিন আমি ওঁর ভালো কবিতা পড়তে আগ্রহী। ভালোবাসা আমিনুলকে। যাঁরা মন্তব্য লিখেছেন তাঁদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা।

৫. ফেরদৌস সালাম

পর্ণমোচী কবিতার প্রথম চার লাইন- যে অন্তমিল নিয়ে এগিয়ে,পরবর্তীতে তা থাকেনি। যেমন আয়োজন এর সাথে দিনযাপন ,ঝরাপাতা বাধা- বীজ উদ্ভিদ—
এছাড়া আধুনিক কালের কবিতায় সাধারণত ধরিত্রী ,তথাপি এসব শব্দ কম ব্যবহার হয়।তবে কবিতার তাল লয় মোটামুটি ভাল। কবিতার বিষয়ও বেশ সুন্দর।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ